ষোড়শ সংশোধনী : নয়া বাকশালের পদধ্বনি by মো: আসাদ উদ্দিন

গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতিদের অভিশংসন বিল পাসের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা নেয়া হলো সংসদের হাতে। সংবিধানের ৯৬(৩) দফায় বর্ণিত ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’-এর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণপ্রক্রিয়া ছেঁটে ফেলে দিয়ে চালু করা হলো সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণপ্রক্রিয়া। এখন দেশের সবচেয়ে সম্মানিত, জ্ঞানী, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মানুষদের ‘অযোগ্য’ ঘোষণার অধিকার পেল জাতীয় সংসদের সেসব সদস্য, যাদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এদের মধ্যে খুনের আসামি, কালোবাজারি বা দুর্নীতিবাজ হিসেবে অনেকে পরিচিতি পেয়েছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হক উল্লেখ করেছেন, ‘ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয়, যেকোনো রাষ্ট্রে যখনই সুপ্রিম কোর্ট তথা বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভাকে সংবিধান ও আইনের আওতায় রাখতে ব্যর্থ হয় এবং নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ হয়ে দাঁড়ায় তখনই রাষ্ট্রে ও নাগরিকদের জীবনে চরম বিপত্তি দেখা দেয়।’ যদিও তিনি নিজেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরবর্তী সময়ে স্ববিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না। বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষমতা তো ছিলই, শেষমেশ তাদের অপসারণের ক্ষমতাও বাগিয়ে নিলো সরকার। অতএব সরকার যা বলবে, যেভাবে চাইবে সেটাই গুরুত্ব পেতে বাধ্য।
অতি প্রাচীন ইংল্যান্ডের বিচারব্যবস্থায় রাজার ইচ্ছা ও শর্তানুসারে বিচারক নিয়োগ হতো এবং বিচারকেরা রাজার নামে ও তার পক্ষে বিচার কাজ পরিচালনা করতেন। রাজার অসন্তুষ্টির কারণ হলে বিচারকেরা তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হতেন। এ কারণে বিচারকেরা অন্য রাজ কর্মচারীদের মতো রাজার একান্ত বশংবদ সেবক থাকতেই নিজেদেরকে সন্তুষ্ট ও গর্বিত মনে করতেন। বাংলাদেশের বিচারপতিদেরও সেই প্রাচীনকালে ফিরিয়ে নেয়ার পথ তৈরি করা হলো সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। তৎকালীন ইংল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও মূলত শাসন চলে একজনেরই। প্রধানমন্ত্রী যা ইচ্ছা করেন, তা-ই হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিধান কোনো রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ওই দলের সংসদ সদস্যদের ভোট দেয়া বা মতামত দেয়ার পথ রহিত করে দিয়েছে। দলীয় প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সে সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেয়াই অবশ্য কর্তব্য দলীয় সংসদ সদস্যদের। অনির্বাচিত হলেও যেহেতু সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংসদ সদস্যই এখন সরকারি দলের, সেহেতু প্রধানমন্ত্রী নিজে অথবা কারো ইচ্ছায় বা প্ররোচনায় কোনো বিচারপতির প্রতি কোনোভাবে অসন্তুষ্ট হলে তার আর রক্ষে নেই।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে ‘পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারালয়ে ন্যায্য ও প্রকাশ্য শুনানি লাভের অধিকার’। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদেও এ অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। একইভাবে সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করতে বলা হয়েছে। এরই আলোকে ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিচার বিভাগকে স্বাধীন বলে ঘোষণাও করা হয়েছে। এ রকম সুনির্দিষ্ট আইন সৃষ্টির অনেক আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তার ‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ গ্রন্থে ‘ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি’র ব্যাখ্যা দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচারবিভাগীয় ক্ষমতাকে যদি পৃথক করা না হয়, তা হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকতে পারে না; যদি একে আইন বিভাগের সাথে একত্রীকরণ করা হয় তা হলে একই ব্যক্তি আইন প্রণেতা ও বিচারকর্তা হয়ে দাঁড়াবে এবং ব্যক্তির জীবন ও স্বাধীনতা স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। যেখানে একই ব্যক্তির হাতে নির্বাহী, আইন ও বিচারÑ এই তিন ধরনের ক্ষমতা একীভূত করা হয় সেখানে কিছুই বাকি থাকবে না।’ সুতরাং সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতার্পণের অর্থ হলো বিচার বিভাগ চলে গেল এক প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীনে। তার হাতে বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বেতনভাতা ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ আগে থেকেই ছিল এবার অপসারণের ক্ষমতাও বগলদাবা হয়ে গেল।  ষোড়শ সংশোধনী বিলটি পাসের আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি এই সংসদে বিলটি পাসের পক্ষে ১০১টি কারণ বলতে পারব। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, এই সংসদ সংবিধান অনুযায়ী জনগণের নির্বাচিত সংসদ। সুতরাং আমরা এই সংসদে বিলটি পাস করতে পারি।’ আসলে কি তাই? যে সংসদের ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ১৫৩ জনই বিনা নির্বাচনে, বিনা ভোটে সদস্য হয়েছেন এবং বাকিরাও নির্বাচিত হয়েছেন অনুল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটে সে সংসদকে জনগণের নির্বাচিত বলা শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু হতে পারে কি?
আইনমন্ত্রীসহ এ বিলের পক্ষপাতিত্বকারী অনেক রথী মহারথীই যুক্তি হিসেবে ব্রিটেন, আমেরিকা, ভারত, জার্মানি, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে এ বিধান রয়েছে মর্মে বলার চেষ্টা করে থাকেন; কিন্তু তারা এ কথা চিন্তা করেন না সেসব রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের কাঠামো এবং ভিত্তি কত মজবুত। বাংলাদেশের মতো অনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দিয়ে তাদের পার্লামেন্ট গঠিত নয়। তাদের পার্লামেন্ট বিরোধী দলহীন নয় এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন নয়। বিভিন্ন দল ও মতের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা আর আস্থাহীনতা দিয়ে ভরা নয়। তাদের গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত ও পূর্ণরূপে বিকশিত। তাদের নির্বাচনে পক্ষপাতদুষ্ট সূক্ষ্ম আর স্থূল কারচুপির সয়লাব বয়ে যায় না। সর্বোপরি এসব দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, উল্লেখ করার মতো এমন কোনো নজির নেই বললেই চলে। সুতরাং অবাস্তব ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ উদাহরণ টেনে ‘লিয়াকত আলী আর জুতার কালী’কে এক করে দেখার এবং বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের হাতে নেয়াকে যুক্তিপূর্ণ ও যথোচিত বলার কোনো সুযোগ নেই। প্রসঙ্গত একটি কথা না বললেই নয়, এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর, জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক নীতির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কারো সাথে কোনো পরামর্শ করারও প্রয়োজন মনে করেনি সরকার। অথচ যেকোনো আইন প্রণয়ন বিশেষ করে সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীদের সাথে আলোচনা করা এবং দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর কি না সে বিষয়ে গভীরভাবে হিসাব-নিকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। সংবিধানের এ ষোড়শ সংশোধনীর আদৌ কি কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল? কারণ বিদ্যমান ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’-এর বিধান সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনো সমালোচনা বা অভিযোগ শোনা যায়নি। কেউ কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। তাহলে কেন সেটিকে ছেঁটে ফেলতে হবে?
বাস্তবতা হলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হাঁটছেন তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পথ ধরে। ‘সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি : বাংলাদেশ প্রসঙ্গ’ বইয়ের লেখক মোহাম্মদ আবদুল হালিম উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশে মুজিবের সময়কাল সংসদীয় প্রকৃতির ছিল না, ছিল প্রধানমন্ত্রী শাসিত একনায়কতান্ত্রিক’। একইভাবে আবারো একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ষোড়শ সংশোধনী। যেভাবে কিছু দিন আগে প্রণীত হয়েছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা। এ ছাড়া সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম দেখে সচেতন নাগরিক মাত্রেরই বোঝার বাকি থাকে না যে, এ দেশের ভাগ্যাকাশে মহাপ্রলয়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় নয়া বাকশালের পদধ্বনি। ধেয়ে আসছে কালবৈশাখী। ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা সব কিছুকে তছনছ করে দেবে সে ঝড়। সুতরাং অবধারিত সত্য এটাই যে, জনগণকে আবার জাগতে হবে। জনগণের আন্দোলনই হবে একমাত্র সমাধান। ইতিহাস সাক্ষী, সংগ্রামের পথ বেয়েই আসে সত্যিকার মুক্তি।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
asadiuk@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.