শামসুর রাহমান- তার কবিতায় দেশপ্রেম by নিখিলেশ ঘোষ
কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) বাংলা
কবিতার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার কাব্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,
অসুন্দরের বিরুদ্ধে দ্রোহ, স্বদেশপ্রীতি, স্বাধীনতার আকাক্সা ও তাৎপর্য
চিত্রিত হয়েছে। তার প্রায় সত্তরটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে
স্বদেশপ্রীতিমূলক কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে নিজ বাসভূমে (১৯৭০), বাংলাদেশ স্বপ্ন
দেখে (১৯৭৭), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (১৯৮২), দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে
করে (১৯৮৬), অবিরল জলভূমি (১৯৮৬), বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮)
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শামসুর রাহমানের স্বদেশপ্রীতি ও ব্যক্তিপ্রেমসঞ্জাত কবিতার পাশাপাশি গণচেতনা ও প্রকৃতিপ্রেম জায়গা করে নিয়েছে। তিনি রাজপথের দাবিমুখর আন্দোলনের প্রতিও ঐক্যের সুর প্রকাশ করেছেন কাব্যে। ‘ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯’ কবিতায় কয়েকটি কাব্য পঙ্ক্তিতে তা স্পষ্ট : দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই/জনসাধারণ/দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো/ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা/আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে এখনও বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে/ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে। বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য বাঙালি রাজপথে রক্ত দিয়েছে। ভাষাপ্রেমে তথা স্বদেশপ্রেমের এ দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীর নিকট প্রশংসিত। এ আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শহীদের প্রতি কবির শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়েছে কাব্য পঙ্ক্তিগুলোতে।
কবি কেবল স্বদেশপ্রীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। স্বদেশের শান্তিকামী, সহজ-সরল সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘব করার জন্য তিনি সত্যিকার ভাবনাব ভাবুক ছিলেন। আমরা যখন মানবতাবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীল সমাজে এবং রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারব তখনি শান্তি পাবো। স্বদেশকে তিনি ভেবেছেন নিজের প্রিয়া হিসেবে। স্বদেশভূমির সর্বত্রই তার ভালোবাসার ছোঁয়া। কবির ভাষায় ‘স্বদেশকে প্রিয়ার একান্ত নাম ধরে ডেকে/অগ্নিবলয়ের মধ্যে গড়েছিল প্রেমের প্রতিমা/নিজে পুড়ে পুড়ে। তোমার প্রেমার্ত পঞ্চান্ন হাজার/ একশো ছাব্বিশ বর্গমাইলে আনাচে-কানাচে/পৌঁছে গেছে। বাউলের গেরুয়া বস্ত্রের /মতো মাটি, মাছ আর আকাশের কাছে।’
কবি শামসুর রাহমান স্বদেশপ্রীতির চেতনা ‘বন্দীশিবির থেকে’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষভাবে স্বাধীনতার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ও আকর্ষণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে সর্বত্র : ‘স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার/কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক /স্বাধীনতা, বাংলাদেশ এই মতো শব্দ থেকে ওরা/আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা। অথচ জানে না ওরা কেউ গাছের পাতায়, ফুটপাতে/ পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে /পথের ধুলায়/বস্তির দুরন্ত ছেলেটার/হাতের মুঠোয়/সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।’
শামসুর রাহমানের স্বদেশপ্রীতি ও ব্যক্তিপ্রেমসঞ্জাত কবিতার পাশাপাশি গণচেতনা ও প্রকৃতিপ্রেম জায়গা করে নিয়েছে। তিনি রাজপথের দাবিমুখর আন্দোলনের প্রতিও ঐক্যের সুর প্রকাশ করেছেন কাব্যে। ‘ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯’ কবিতায় কয়েকটি কাব্য পঙ্ক্তিতে তা স্পষ্ট : দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই/জনসাধারণ/দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো/ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা/আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে এখনও বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে/ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে। বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য বাঙালি রাজপথে রক্ত দিয়েছে। ভাষাপ্রেমে তথা স্বদেশপ্রেমের এ দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীর নিকট প্রশংসিত। এ আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শহীদের প্রতি কবির শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়েছে কাব্য পঙ্ক্তিগুলোতে।
কবি কেবল স্বদেশপ্রীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। স্বদেশের শান্তিকামী, সহজ-সরল সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘব করার জন্য তিনি সত্যিকার ভাবনাব ভাবুক ছিলেন। আমরা যখন মানবতাবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীল সমাজে এবং রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারব তখনি শান্তি পাবো। স্বদেশকে তিনি ভেবেছেন নিজের প্রিয়া হিসেবে। স্বদেশভূমির সর্বত্রই তার ভালোবাসার ছোঁয়া। কবির ভাষায় ‘স্বদেশকে প্রিয়ার একান্ত নাম ধরে ডেকে/অগ্নিবলয়ের মধ্যে গড়েছিল প্রেমের প্রতিমা/নিজে পুড়ে পুড়ে। তোমার প্রেমার্ত পঞ্চান্ন হাজার/ একশো ছাব্বিশ বর্গমাইলে আনাচে-কানাচে/পৌঁছে গেছে। বাউলের গেরুয়া বস্ত্রের /মতো মাটি, মাছ আর আকাশের কাছে।’
কবি শামসুর রাহমান স্বদেশপ্রীতির চেতনা ‘বন্দীশিবির থেকে’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষভাবে স্বাধীনতার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ও আকর্ষণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে সর্বত্র : ‘স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার/কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক /স্বাধীনতা, বাংলাদেশ এই মতো শব্দ থেকে ওরা/আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা। অথচ জানে না ওরা কেউ গাছের পাতায়, ফুটপাতে/ পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে /পথের ধুলায়/বস্তির দুরন্ত ছেলেটার/হাতের মুঠোয়/সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।’
শামসুর রাহমান রাজনীতিসচেতন কবি। তার কবিতায় স্বদেশী জনগণের আকাক্সা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতি থেকে গণমুক্তির আকাক্সা প্রকাশ করেছেন কবিতায়। রাজনৈতিক অপশক্তি, দেশদ্রোহী ও দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্যের প্রতি তার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিন্দা অব্যাহত ছিল। দেশাত্মবোধক কাব্যে ও রাজনৈতিক কাব্যে তার বলিষ্ঠ চেতনা লক্ষণীয়। অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও অনিরাপত্তাজনিত সমস্যা জনগণকে উদ্বিগ্ন করে। পরাশক্তির ইশারায় দেশে দেশে সামরিক শাসকদের ক্ষমতায়ন, জাতীয়তাবাদী নেতাদের হত্যা, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য তৎপরতা চলে। উত্তর ঔপনিবেশিকতার কুপ্রভাব আমাদের দেশেও চেপে বসেছিল। সেনা শাসনের দুঃসহ পরিস্থিতি, ‘অবরুদ্ধ স্বাধীনতার আদর্শ আর মহৎ আদর্শের স্খলিত চেতনায় স্বদেশের যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা কবির কাছে মনে হয়েছে : ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ/হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।/ এর চেয়ে মর্মন্তুদ বৃত্তায়ন কাহিনী আর কী হতে পারে।’
কবি ছিলেন একান্তে অন্তর্মুখী। বিষণ্নতার কথা, সংশয়ের কথা, প্রেমের কথা আমরা পাই তার প্রথম দিককার কবিতায়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে বাঙালির মনকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল। তার বিখ্যাত কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে অন্যরকম ভালোবাসাÑ ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার? / উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। সে ফুলের একটি পাপড়ি ও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/ কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।’
‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটিতে প্রতিফলিত হয়েছে স্বদেশের প্রতিচ্ছবি। রক্তমাখা বস্ত্রখণ্ডটি স্বদেশ রক্তাক্ত পরিস্থিতির ঘোষক। ‘আসাদের শার্ট’ প্রতীক হয়ে উঠেছিলো এভাবেÑ ‘আসাদের শার্ট’ আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। স্বদেশ-সমাজ ও গণমানুষের প্রতি কবির ভালোবাসা সিক্ত হয়েছে কাব্যের অভ্যন্তরে। কবিতার ভেতরে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমখচিত আলোকধারা প্রকাশ করে গণচেতনা ও গণ-আন্দোলনকে তিনি শানিত করেছেন। স্বাধীনতার প্রতি প্রেরণাবহুল কাব্য পঙ্ক্তি উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের জন্য। সংগ্রামী জনতার অনবদ্য প্রেরণা হিসেবে তার কাব্য যুদ্ধাস্ত্র হয়ে উঠেছিল। স্বদেশের গণ-আকাক্সাই ভাষা পেয়েছিল তার কাব্যে।
No comments