ভারত-পাকিস্তান: ‘ছোড়ো বুলি, মারো গোলি’ by হাসান ফেরদৌস
এক মাস ধরে বিক্ষিপ্তভাবে ভারত-পাকিস্তান
সীমান্তে গোলাগুলি চলছে। ইতিমধ্যে উভয় পক্ষের বেশ কিছু মানুষ হতাহতহয়েছে।
তাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষ ঘটে সপ্তাহ দুয়েক
আগে জম্মু ও কাশ্মীরের বিবদমান সীমান্ত বরাবর, উভয় পক্ষই যখন ঈদুল আজহা
উদ্যাপনে ব্যস্ত ছিল। জন্মের গোড়া থেকেই এই দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে
ঠোকাঠুকিতে লেগে আছে। উভয় পক্ষই শান্তির কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে
ফেলে, কিন্তু গুলি ছোড়ার পর ‘আমরাই বড়ে বাহাদুর’—এ দাবিও ছাড়ে না। এবারের
ঘটনার কথা ধরুন। উভয় পক্ষই দাবি করেছে, তারা আক্রমণ শুরু করেনি, বরং
আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সে কথা মুখ থেকে খসে পড়তে না পড়তে উভয় পক্ষ থেকেই
বলা হচ্ছে, হামলার এমন জবাব দিয়েছি যে বাবাজির আর এমুখো হতে হবে না।
বন্দুকযুদ্ধে ভারত অবশ্য কিঞ্চিৎ এগিয়ে, কারণ তারা বেশি সংখ্যায় পাকিস্তানি হতাহত করতে পেরেছে। সর্বশেষ গোলাগুলিতে মোট ১৯ জন নাগরিক নিহত হয়েছে, যার ১১ জন পাকিস্তানি, আটজন ভারতীয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তাঁর যোদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন বটে, তবে তাঁর গলার স্বরটি কিঞ্চিৎ মিনমিনে। অন্যদিকে ভারত সরকারের ছোট-বড় সব মন্ত্রী সমস্বরে বলছেন, খুব করেছি, বেশ করেছি। পাকিস্তানকে আর এক ইঞ্চিও ছাড় দেওয়া হবে না। এর পরে আর কখনো যদি এক পা এগোয়, তো পুরো ঠ্যাংই ভেঙে দেব। ‘এখন থেকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে পেশিবহুল। পাকিস্তান যদি অ্যাডভেঞ্চারের চেষ্টা করে, তাহলে তার দাঁতভাঙা জবাব পাবে,’ বলেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি। তাঁর নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অত কূটনৈতিক কথাবার্তার দিকে না গিয়ে এক জনসভায় প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন, এখন থেকে আর শুধু বাক্যব্যয় হবে না, সরাসরি গুলি চলবে। তাঁর কথায়, ‘ছোড়ো বুলি, মারো গোলি।’
নরেন্দ্র মোদি ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। নিকট-উপদেষ্টাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং দিল্লিতে তাঁকে আন্তরিক স্বাগতও জানিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে বৈঠক বসবে দিল্লিতে। কিন্তু সে বৈঠক শেষ পর্যন্ত হলো না, কারণ ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও দিল্লিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আবদুল বাসিত কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তার পর থেকেই দুই পক্ষে বাগ্যুদ্ধ ও সীমান্ত বরাবর বন্দুকযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।
যার শুরুটা এমন চমৎকার, দুই মাস যেতে না যেতেই তিনি হঠাৎ এমন খেপে উঠলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় পণ্ডিতেরা সব দোষ চাপিয়েছেন পাকিস্তানের ওপর। তাঁদের যুক্তি, রাজনৈতিক ঝামেলায় পড়লেই পাকিস্তানের নেতারা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের পাঁয়তারা শুরু করেন। এই ‘ইন্ডিয়া কার্ড’ সে দেশের সামরিক-বেসামরিক সব সরকারই ব্যবহার করেছে। একদম অযৌক্তিক নয় এই ব্যাখ্যা। ইমরান খানের ‘নওয়াজ হটাও’ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের সরকার এখন চাপের মুখে রয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো হজমি দাওয়াই পাকিস্তানিদের জন্য দ্বিতীয়টি নেই। অতএব, দেশের মানুষের নজর সে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেশরক্ষার পবিত্র কাজে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে আক্রমণ শাণানো হয়েছে। অবশ্য অন্য মতও শোনা গেছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী ভারতীয় পণ্ডিতেরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, মোদির আমন্ত্রণ পেয়ে নওয়াজ শরিফ যে তড়িঘড়ি ভারতে উড়ে এলেন এবং তাঁর হাতে মিষ্টি খেয়ে ও নিজের মায়ের জন্য শাড়ি পেয়ে অতি ডগমগ হলেন, পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআই তাতে মোটেই খুশি হয়নি। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক নয়, তার সঙ্গে লাঠালাঠি জিইয়ে রাখলেই তাদের অধিক লাভ। চালকের আসনে যে তারাই বসে, নওয়াজ শরিফ নন, সে কথা জানানোর জন্য তাদের হাতে যে ব্রহ্মাস্ত্র আছে, সেটাই তারা ছুড়েছে।
এই তত্ত্বে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল মোশাররফ। গৃহবন্দী অবস্থায় থেকেই এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, মোদি মুসলমানবিরোধী ও পাকিস্তানবিরোধী। অতএব, যেভাবে সম্ভব তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে হবে। তিনি হুমকি দিয়েছেন, ‘সেনাবাহিনী ছাড়াও কাশ্মীরে আমাদের নিজস্ব ক্ষমতার উৎস (সোর্স) রয়েছে। তাদের ব্যবহার করতে হবে।’ বলাই বাহুল্য, তিনি লস্কর-ই-তাইয়েবার মতো সন্ত্রাসীদের কথাই ইঙ্গিত করেছেন। আইএসআইয়ের সম্মতিতেই যে সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যদি ধরে নিই, আরেকটা সামরিক অভ্যুত্থানের লক্ষ্যে আইএসআই সামরিক উত্তেজনা বাড়াতে চায়, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, মোদি ও ভারত সরকার আইএসআইয়ের এই পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছে কেন? সেনাকর্তাদের উসকানির জবাবে যদি পালটা উসকানি দেওয়া হয়, তাতে সে দেশের রাজনৈতিক সরকারের হাত দুর্বল হয়। তাতে ভারতের লাভ কী? পাকিস্তানকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার ক্ষমতা ভারতের আছে, সে কথা ফলাও করে বলারই বা দরকার কী?
ভারতের বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনডিটিভি যাঁরা মাঝেমধ্যে দেখে থাকেন, তাঁদের পক্ষে এই প্রশ্নের একটি উত্তর খোঁজা কঠিন হবে না। গত সপ্তাহে এই চ্যানেলের ‘বিগ ফাইট’ অনুষ্ঠানে বিজেপি, কংগ্রেসসহ দেশটির প্রধান দলগুলোর প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল। আলোচনার বিষয় ছিল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুজন সাংবাদিক-ভাষ্যকারও তাতে যোগ দেন। তঁারা দুজন যে সেনা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য তোতা পাখির মতো আওড়াবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু এই লেখককে যা বিস্মিত করেছে, তা হলো ভারতীয় পক্ষের প্রত্যেক বক্তার ঠিক একই রকম অতি-আক্রমণাত্মক সুরে কথা বলা। তাঁদের দাবি, মোদির ভারত আর আগের ভারত নেই। সে এখন মস্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি, চীনকে ধমক দেওয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত তার আছে। এই আঞ্চলিক ‘পরাশক্তির’ তুলনায় পাকিস্তান কোন নস্যি! ভারতের বৈদেশিক নীতি যে এখন ‘মাস্কুলার’, সে কথা চৌদ্দবার স্মরণ করিয়ে বলা হলো, আক্রমণকারী যে-ই হোক, মুখ বুজে সহ্য করবে না ভারত। শুধু বিজেপি বা তার সহযোগী দল নয়, প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের প্রতিনিধিও একই সুরে কথা বললেন। তা নিয়ে বেশ হাসাহাসিও হলো। (তাহলে বাবা, তোমরা এখন আমাদের নেতৃত্ব মেনে নিচ্ছ?)
বুদ্ধিমান ও পরিণত বয়সের এসব নেতা ও বুদ্ধিজীবীর কথা শুনে আমার ধারণা হয়েছে, তাঁরা কেউ আসলে এখনো বিশ্বাস করেন না যে ভারত একটি বৃহৎ শক্তি। চারদিকে বলা হচ্ছে, এশিয়ায় চীনের পর ভারতই এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি, কিন্তু নিজের দেশের ভেতরে তাকিয়ে ভারতীয়দের সে কথায় আস্থা জাগে না। ‘আমি মস্ত শক্তি’—এ কথা বলে সে নিজেকেই বারবার স্মরণ দেয়। তার পরও স্বস্তি আসে না, বাতাসে তলোয়ার ঘোরাতে হয়।
নরেদ্র মোদি ভারতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে চান, এ কথা নানাভাবে বলেছেন। কিন্তু ভারতের উন্নয়নের একটি পূর্বশর্ত প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। যদি যুদ্ধপ্রস্তুতিতে তঁাকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়, তাহলে উন্নয়নের চাকা মন্থর হতে বাধ্য। বর্তমানে ভারত তার মোট জাতীয় আয়ের প্রায় আড়াই শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে (পাকিস্তান করে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ)। এই ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। দুটি দেশই এখনো ভীষণ রকম গরিব। ভারত মঙ্গল গ্রহে নভোযান পাঠাচ্ছে তা ঠিক, অথচ তার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের শৌচাগার নেই। গ্রামাঞ্চলের ৭২ শতাংশ মানুষ এখনো প্রকৃতির ডাক এলে বাড়ির পেছনে গাছের নিচে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানের কথা না-ই বললাম, সেখানে ৬০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। সেখানেও গাছের নিচে মলত্যাগী মানুষের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি।
ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ, যার কথাই বলি, সমরায়োজনের পেছনে অর্থ ব্যয়ের ঘোড়ারোগ এদের কারও পোষায় না, এ কথা বুঝতে রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না। কিন্তু যদ্দিন প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনীতিবিদেরা বন্দুকের ঘোড়ায় আঙুল রেখে কথা বলা বন্ধ না করছেন, অবস্থা বদলাবে না। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়, এই কাজ সবার আগে ভারতকেই করতে হবে। সে বড় দেশ, এই অঞ্চলে তারই নেতৃত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু ভারত যদি ভেবে থাকে গায়ে-পায়ে সে বড় বলে সবাই তাকে সালাম ঠুকবে, তাহলে মস্ত ভুল করবে। ভারতের বড় ভাইসুলভ আচরণের কারণে দেশটির প্রতি তার প্রতিবেশীদের একদিক ভীতি, অন্যদিকে অবিশ্বাস রয়েছে। সামরিক শক্তির সমীকরণ যা-ই হোক, ঘৃণা-অবিশ্বাস-প্রতিযোগিতার এক নষ্ট চক্রে আমরা আটকে আছি গত ছয় দশক। একমাত্র ভারতই পারে সেই চক্র ভাঙতে। প্রায় দুই দশক আগে তেমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন আই কে গুজরাল। ১৯৯৬ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি যে পাঁচ দফা প্রস্তাব রেখেছিলেন, তার এক নম্বরই ছিল পাল্টা লাভের আশা না করেই ভারত তার প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জনের জন্য এককভাবে উদ্যোগ নেবে।
আই কে গুজরাল নেই। মোদির ভারতে তাঁকে কেউ মনে রাখবে, এ কথা ভাবাও বাতুলতা। ভারতীয় নেতারা এখন নিজেদের হাতের গুলতি দেখাতে ব্যস্ত।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments