ষড়যন্ত্র, হত্যা, নির্যাতনের দায়ে সাজা হয়েছিল তাঁর
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম আযম যে অপরাধ
করেছিলেন, তা ছিল মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু বয়স ও শারীরিক অবস্থা
বিবেচনায় তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক
অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই এ রায় ঘোষণা করা হয়।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ যেভাবে নিষ্পত্তি করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল:
ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ছয়টি ঘটনা এবং পরিকল্পনার অভিযোগে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে গোলাম আযম মানবতা–বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনের ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনা করেন।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, টিক্কা খান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে গোলাম আযম ও তাঁর সহযোগীরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী আধা সামরিক বাহিনী গঠনে যৌথভাবে ভূমিকা রাখেন। তাঁরা শান্তি কমিটিকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেন; রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে আসামি আহ্বান জানিয়েছেন ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ রাজাকারদের অস্ত্র সরবরাহের জন্য, মুক্তিকামী বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করতে রাজাকারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। আসামির কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, তিনি ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যার ফলে আসামির অধীনস্থ আধা সামরিক বাহিনীগুলো দেশজুড়ে ব্যাপক গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে। এ দুটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় গোলাম আযমকে ১০ বছর করে ২০ বছর কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
উসকানি: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে উসকানির ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ ছিল, একাত্তরে গোলাম আযম বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে তাঁর অনুসারীদের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনে উসকানি দেন।
রায়ে বলা হয়, গোলাম আযমের হিংসাত্মক বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে হিন্দুদের প্রতি আসামির বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতি প্রকাশ করে, যাতে একই সঙ্গে রয়েছে এই ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দেশ থেকে বিতাড়ন বা ধ্বংসের গূঢ় ইচ্ছা। অথচ উপমহাদেশের ইতিহাস বলে, গত এক হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান শান্তিপূর্ণভাবে ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে বসবাস করছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করা স্পষ্টভাবে গোলাম আযমের ঊর্ধ্বতন অবস্থান নির্দেশ করে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনে রাজাকারদের উসকানি দেওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। উসকানি কোনো অপরাধের প্রাথমিক পর্ব এবং গোলাম আযম তাঁর অধীনস্থ আধা সামরিক বাহিনীকে অপরাধ সংঘটনে স্পষ্ট উসকানি দিয়েছেন। এ অভিযোগটিও প্রমাণিত হওয়ায় গোলাম আযমকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সহযোগিতা: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতার ২৩টি ঘটনা অভিযোগ আকারে উপস্থাপন করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, পাকিস্তানি সেনা ও অন্য আধা সামরিক বাহিনী যেমন শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি গোটা বাংলাদেশে যে নৃশংসতা চালিয়েছে, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ দাখিল করেছে। এসব আধা সামরিক বাহিনী পূর্ণ ছিল মূলত জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের দিয়ে। জামায়াতের আমির হিসেবে এসব বাহিনীর ওপর গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। নেতা ও সংগঠনের মধ্যে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক থাকলে এবং অধস্তন বাহিনী সরাসরি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলে, অধীনস্থ বাহিনীর অপরাধের দায় ঊর্ধ্বতনের ওপর বর্তায়। গোলাম আযম পূর্ণ জ্ঞানে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা উপায়ে অধস্তন বাহিনীকে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেছেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গোলাম আযমকে আরও ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হত্যা ও নির্যাতন: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগও আনা হয়। এতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম আযমের নির্দেশে কুমিল্লার সিরু মিয়া দারোগা ও তাঁর ছেলে আনোয়ার কামাল, নজরুল ইসলাম ও আবুল কাশেমসহ ৩৮ জনকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, গোলাম আযম চাইলে তাঁর অধীনস্থ পেয়ারা মিয়াকে নির্দেশ দিয়ে সিরু মিয়া ও আনোয়ার কামালের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি, বরং নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়ে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গোলাম আযমকে ৩০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
প্রতিটি শাস্তি ধারাবাহিকভাবে একটির পর একটি বা মৃত্যু পর্যন্ত চলবে বলে আদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
কাঠগড়ায় গোলাম আযম
১ নভেম্বর, ২০১১
মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল। অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সংশ্লিষ্টতা এবং হত্যা ও নির্যাতন
১১ জানুয়ারি, ২০১২
ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা। আবেদন খারিজ করে কারাগারে প্রেরণ
১৩ মে, ২০১২
অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু
১৫ জুলাই, ২০১৩
রায় ঘোষণা। অপরাধ মৃত্যুদণ্ডতুল্য, বয়স বিবেচনায় ৯০ বছরের কারাদণ্ড
৫ আগস্ট, ২০১৩
রায়ের বিরুদ্ধে গোলাম আযমের আপিল
১২ আগস্ট, ২০১৩
রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল। আগামী ২ ডিসেম্বর আপিল শুনানি শুরুর দিন ধার্য
২৩ অক্টোবর, ২০১৪
রাতে হাসপাতালে মৃত্যু
No comments