অনুশোচনা by আলী ইদরিস
চুক্তি
ছিল বিশ লাখ টাকার। জামসেদ সদাগরের কাছে বিশ লাখ টাকা নস্যি। কারণ তার
গুদামে পাইকারি ব্যবসায়ের যে মালামাল পড়ে থাকে তার মূল্য বিশ কোটি টাকার কম
নয়। বছরে ১০ বার এ ঘূর্ণায়মান স্টক বিক্রি করে তার ৫০ কোটি টাকা মুনাফা
হয়। শুধু ঘুমানোর সময়টা বাদ দিয়ে রাত-দিন আঠার ঘণ্টাই সদাগর গদি কামরায় বসে
থাকেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস, টেবিলের তিন পাশে সোফা পাতা, একসঙ্গে
বিশ-পঁচিশ জন খদ্দের বসতে পারে। জাহাজ থেকে পুরো কন্টেইনার নিজের ট্রাকে
বহন করে গুদামে আনলোড করা হয়। আবার কখনও পুরো কন্টেইনার মাল খরিদ্দারের
গুদামে চলে যায়। খাতুনগঞ্জ এলাকায় জামসেদ সদাগরের ব্যবসা। একনামে সবাই
চিনে। মানুষ হিসেবেও তিনি সদালাপী, হাসি খুশী, সরল মনের অধিকারী। শুধু
একটাই দোষ, ভোজন-রসিক। খাওয়া-দাওয়ায় খান্দানি চাল বজায় রেখেছেন, সবচেয়ে
দামি হোটেল থেকে দুপুরের খাওয়া আসে, খাসির রোস্ট, পোলাও অথবা বিরানি, গরু
ভুনা, বোরহানি, শেষে দই-মিষ্টি। অফিসে সবার জন্য একই মেনু, উপস্থিত
খরিদ্দাররাও আপ্যায়িত হন। মন মতো আয়েশ করে দুটো ভাতই যদি না খেলাম, তাহলে এ
টাকা-পয়সার কি মূল্য, প্রায়ই সদাগর কথাটা বলে থাকেন।
হঠাৎ একদিন অফিস থেকে গাড়িতে উঠার সময় সদাগর বেসামাল হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। ডাক্তার ডাকা হল। ডাক্তার তাকে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখা গেল সদাগরের একটি কিডনি পুরোপুরি অকেজো, দ্বিতীয়টি ২০ শতাংশ কাজ করে। এখনই ডায়ালাইসিস শুরু করতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিস্থাপন করতে হবে। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র শুনে সদাগর ঘাবড়ে গেলেন। তার এক বন্ধু মাত্র ছ’মাস ডায়ালাইসিস করেই পরাজয়বরণ করে নিয়েছিলেন। মানুষের শরীরে কিডনির কর্মকাণ্ড খুবই জরুরি। তবে একটি কিডনি দিয়েও মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে। সদাগর ভাবলেন তার আংশিক সুস্থ দ্বিতীয় কিডনিকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় কিনা। ডাক্তারের সঙ্গে কয়েকবার লম্বা সময় নিয়ে বসলেন, আরও দু’জন ডাক্তার নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করা হল। বোর্ড বলল, ওষুধ দিয়ে কিডনির কর্মক্ষমতা বাড়ানোর আর সুযোগ নেই, অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস দ্বারা শরীরের কর্মক্ষমতা কয়েক বছর পর্যন্ত ধরে রাখা যেতে পারে, কিন্তু গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে উত্তম পন্থা হবে কমপক্ষে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা। সেজন্য কিডনিদাতা খুঁজে বের করতে হবে। দাতার কিডনি রোগীর কিডনির সঙ্গে ম্যাচিং হলে অস্ত্রোপচার করার ব্যবস্থা করা হবে।
সদাগর ভাবতেও পারেননি তার ভাগ্যে এমনটি হবে। আজ হিসাবের খাতা উল্টিয়ে বুঝলেন সীমাহীন অর্থ-বিত্তের মাঝখানে নিজের ও পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু শরীরের দিকে ফিরে তাকাননি। একটি টেলিফোন করলেই ডাক্তার হাজির হয় কিন্তু সেটুকুও করার সময় করে উঠতে পারেননি। কয়েক বছর আগে ডাক্তার ডায়াবেটিস ও প্রেসারের ওষুধ খেতে বলেছিল এবং পথ্যের একটি তালিকা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ওষুধ কেনা হয়েছে, নিয়মিত খাওয়া হয়নি। খাবার তালিকা দেয়ালে ঝুলানো আছে, অনুসরণ করা হয়নি। স্ত্রী বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সদাগরের একই কথা- মনমতো আয়েশ করে দুটো ভাত যদি খেতে না পারলাম তাহলে এ টাকা-পয়সার মূল্য কি। সদাগরের এক ডাক্তার বন্ধু একদিকে ইনসুলিন নিতেন, অন্যদিকে রাতে স্ত্রীর অজান্তে ফ্রিজে রাখা মিষ্টিগুলো সাবাড় করতেন। একদিন দেখা গেল তার কয়েকটি দাঁত নড়বড়ে হয়ে গেছে, চোখের দৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক ঝাপসা হয়ে গেছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন ডায়বেটিসের মাত্রা মোটেও নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কিছু দিনের মধ্যে তার শরীরে পানি নেমে পায়ের পাতা ফুলে গেল। ডাক্তার বন্ধুর এ অবস্থায় ইনসুলিনও কাজ করল না। ইতিমধ্যে কিডনি দুটো নব্বই শতাংশ অকেজো হয়ে গিয়েছে। শুরু হল ডায়ালাইসিস, ওই ডাক্তার বছর খানেক বেঁঁচেছিলেন। কিডনি প্রতিস্থাপন তখন বাংলাদেশে শুরু হয়নি, ভারতে বা সিঙ্গাপুর যাওয়ার সামর্থ্য তার ছিল না।
সদাগরের অর্থের প্রাচুর্য আছে, তাই ভারতে কেন, সিঙ্গাপুরও যেতে পারেন। কিন্তু পরিবারের ভেতর থেকে বা আত্মীয়ের মধ্যে কেউ কিডনি দান করতে এগিয়ে এলো না। নিরুপায় সদাগর সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলেন এবং কিডনিদাতাকে ত্রিশ লাখ টাকা দিতে ঘোষণা দিলেন। সর্বশেষ তারিখ চলে গেল, কোনো দাতা এগিয়ে এলো না। এক সপ্তাহ পর সদাগর একটি টেলিফোন পেলেন- স্যার কিডনি জোগাড় করে দেয়া যাবে। কিন্তু পঞ্চাশ লাখের কম টাকা দিলে চলবে না। সদাগর ভাবলেন ভারতে চলে যাবেন এবং ওখানকার কোনো স্থানীয় দাতার কাছ থেকে কিডনি কিনে নেবেন। কিন্তু নিজের দেশের ভেতরেই তো কৃতকার্য হলেন না, ভারতে যদি কোনো ঠক-বদমাসের হাতে পড়েন, তাহলে অর্থ তো যাবেই নিজের প্রাণ নিয়েও টানাটানি হতে পারে। হাসপাতালের ডাক্তাররা নিজেরাই অপারেশন করতে এক পায়ে খাড়া। তারা সদাগরকে বোঝালেন দেশে অপারেশন করলে দাতা হাতের নাগালে থাকবে, সবকিছু সময় মতো মিললেই তবে অপারেশন করা হবে। সদাগর ভাবলেন ডাক্তারদের হাতেই তো রোগীর জীবন। বিদেশে গিয়ে ব্যর্থ হলে দেশীয় ডাক্তারদেরই শরণাপন্ন হতে হবে।
অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত সওদাগর সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশনটা দেশেই করিয়ে নেবেন। কিডনি দান করার জন্য তিনি পঞ্চাশ লাখ টাকা মূল্য প্রদান করতেও রাজি হলেন। শুরু হল অপারেশনের জন্য ডাক্তারদের প্রস্তুতি। কিডনিদাতার রক্তের গ্র“প রোগীর রক্তের গ্র“পের সঙ্গে ম্যাচিং হয়েছে বলে সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ডা. শাজাহান সদাগরকে আশ্বস্ত করলেন, কিন্তু দাতার পরিচয়, নাম ঠিকানা গোপন রাখলেন। সদাগর জানার জন্য পীড়াপীড়ি করলেও ডাক্তার রাজি হলেন না। তিনি বললেন- নাম, পরিচয়, ঠিকানা প্রকাশ করতে কিডনিদাতার নিষেধ আছে এবং এ শর্তেই সে কিডনি বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। টাকায় নাকি বাঘের দুধও মিলে, আরও অনেক অসাধ্য সাধন হয়। কিন্তু পঞ্চাশ লাখ টাকা পরিশোধ করেও সদাগর নিজের কিডনিদাতার নাম, পরিচয় জানতে পারলেন না, তার বড় আফসোস হল। অনন্যোপায় সদাগর দাতার শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন।
নির্দিষ্ট দিনে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হল। কিডনি প্রতিস্থাপনে মেডিকেল টিম দারুণভাবে সফল হলেন। কিডনিটি নাকি ছিল খুবই সতেজ এবং সদাগরের রক্তের সঙ্গে চমৎকার মিল। এবার অপেক্ষার পালা। প্রতিস্থাপন করার পর আরও কয়েক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তখন পর্যন্ত হাসপাতালেই থাকতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল নতুন কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে। রোগীকে হাসপাতাল ত্যাগ করতে অনুমতি দেয়া হল। সদাগর মহাখুশি। রুগ্ন, অকেজো কিডনি ফেলে নতুন, তাজা কিডনি শরীরে জুড়ে দেয়া হয়েছে, সেটা কি কাজ না করে পারে? সদাগরের আত্মবিশ্বাস বহু গুণ বেড়ে দেহে মনে শক্তি সঞ্চার করল।
সদাগর বাসায় ফেরার পর খরিদ্দার, স্টাফ, আত্মীয়স্বজনরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তাকে দেখার জন্য। হাসপাতালে যারা দেখতে যেতে পারেননি, তারা তো এলেই, যারা হাসপাতালে গিয়েছিল তারাও আরোগ্য লাভ করার জন্য ফুল হাতে অভিনন্দন জানাতে এলেন। একটি উৎসবের আমেজ সদাগরের বাড়িতে সপ্তাহ খানেক চলল। আত্মীয়-পরিজন যারা সদাগরের আহ্বানে কিডনি দান করতে আগ্রহ দেখাননি তারাও সফল অস্ত্রোপচার ও আরোগ্য লাভের জন্য অভিনন্দন জানাতে এলেন। বাস্তব যে কল্পনার চেয়েও কঠিন এ যাত্রা সদাগর হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। নিজের ছেলেমেয়ে, ভাই-বোন ও রক্তের সম্পর্কের আপনজন যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, কেউ কেউ উত্তর দিয়েছিল- সদাগর টাকার পাহাড় রাখবে কোথায়, তারাই আজ হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার চার পাশে ঘুর ঘুর করছে। শেষ পর্যন্ত সদাগর অর্ধকোটি ব্যয় করেই কিডনি পেয়েছিলেন, সেজন্য তার আত্মতুষ্টির সীমা নেই।
সদাগরের অস্ত্রোপচারের পরই সংবাদপত্রে অবৈধ কিডনি কেনা বেচার কিছু ঘটনা প্রকাশ পায়। তন্মধ্যে একটি ঘটনা ছিল লোমহর্ষক আর মর্মান্তিক। এক ডাক্তার ৮ বছরের এক পথশিশুকে হত্যা করে দেহ থেকে তার কিডনি বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যায়। থানায় মামলা হয় এবং পুলিশ সেই ডাক্তারকে খুঁজে গ্রেফতার করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি সদাগর কয়েকবার পড়লেন, ডাক্তারের নামটা তার চেনাচেনা লাগছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি হাসপাতালে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন যে মেডিকেল টিম তার কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিল ডাক্তার শাহজাহান কি এদের একজন। হাসপাতাল থেকে হ্যাঁ সুচক জবাব এলো। সদাগর বুঝলেন ওই পিশাচ ডাক্তার বা ডাক্তাররা ছেলেটিকে মেরে কিডনি চুরি করে নিয়েছে। সেই চুরি করা কিডনিই হয়তো তার দেহে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পঞ্চাশ লাখ টাকা থেকে এক পয়সাও হয়তো কিডনিদাতাকে দেয়া হয়নি। সদাগর পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি আবার মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। তাতে বোঝা গেল, যেদিন ডাক্তার শাজাহান ছেলেটিকে হত্যা করেছেন সেই দিনই তার অপারেশন হয়েছে। তাহলে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল মৃত ছেলেটির কিডনিই খুব সম্ভবত তার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সদাগর আবার হাসপাতালে টেলিফোন করে বাকি দু’জন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। হাসপাতাল থেকে জানাল ওই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে একটি ৮ বছরের শিশুকে হত্যা ও তার কিডনি চুরির অপরাধে মামলা হয়েছে এবং হুলিয়া জারি করা হয়েছে। তারা এখন আর হাসপাতালে আসেন না, গ্রেফতার এড়াতে হয়তো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সদাগর এবার নিশ্চিত হলেন তার কিডনিদাতা আর কেউ নয়, সেই ৮ বছর বয়সের নিষ্পাপ শিশুটি যাকে কসাই ডাক্তার শাজাহান হত্যা করেছে। সদাগরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। অকেজো কিডনির স্থানে তাজা কিডনি প্রতিস্থাপনের আনন্দটা বিষাদে পরিণত হল। ফেরেশতার মতো একটি নিষ্পাপ, নিরপরাধ শিশুকে নির্দয় কসাই ডাক্তার কি করে হত্যা করতে পারল। সে কি পঞ্চাশ লাখ টাকা পুরোটাই হজম করার জন্য।
এরকম অমানবিক, নৃশংস ঘটনা নিজকে ঘিরে বাস্তবে ঘটতে তা কল্পনাও করেননি সদাগর তাই আক্ষেপে ম্রিয়মান হয়ে গেলেন। ভুলটা তারই হয়েছে, কিডনিদাতার নাম, পরিচয় জেনে এবং স্বচক্ষে তাকে দেখে তার সঙ্গে কথা বলেই পঞ্চাশ লাখ টাকার চুক্তি করা উচিত ছিল। এত কিডনি নয়, একটি নিষ্পাপ শিশুর তাজা প্রাণ সংহার করে তার শরীরে রোপণ করা হয়েছে। তিনি তো কারুর প্রাণ কেড়ে নিতে চাননি, কাউকে হত্যা করতে চাননি। স্রেফ দাতার একটি কিডনি চেয়েছিলেন অন্যটি দিয়ে যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে। বিনিময়ে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন, যাতে দাতা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা তাকে যথেষ্ট অর্থ দিয়েছেন বলেই তিনি প্রতিদান দিতে কার্পণ্য করেননি। এখন শুধু অর্থলোভী পিশাচ ডাক্তার নয়, নিজেকেও সদাগরের খুনি বলে মনে হচ্ছে, শিশুটির কেড়ে নেয়া প্রাণ যেন বলছে- সদাগর তোমার জন্যই আমাকে হত্যা করে হয়েছে, তোমাকে আরোগ্য করার জন্যই আমাকে প্রাণে মারা হয়েছে, তোমার দেয়া অর্থ একা ভোগ করার লোভ সামলাতে না পেরে আমার বুকে ছুরি মারা হয়েছে। সদাগর এক অস্থির, অনিশ্চিত সময় পার করতে লাগলেন। শরীরে রোপণ করা কিডনিটি ফেরত দিলে যদি শিশুটি প্রাণ ফিরে পেত, তাহলে সদাগর তাই করতেন।
ডাক্তার শাজাহানকে রিমান্ডে নেয়ার পর সে স্বীকার করল যে শিশুটিকে অপারেশনের দিন সে একাই হত্যা করেছে এবং পুরো পঞ্চাশ লাখ টাকার মালিক হওয়ার জন্য সে কুকর্মটি করেছে। অন্য ডাক্তাররা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। সে সম্পূর্ণ নিজেই কিডনি সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল এবং শর্ত ছিল, দাতার পরিচয় গোপন রেখে অন্য হাসপাতালে অপারেশন করে কিডনিটি তার শরীর থেকে বের করা হবে। ডাক্তাররাও সেটা মেনে নিয়েছিলেন। টার্গেট করা এতিম শিশুটি ফুটপাতে বাস করত। ডাক্তার শাজাহান তাকে চকোলেট, খাবার, নতুন জামা-কাপড় দিয়ে বশ করেছিল। ভিটামিন ইনজেকশন দেয়ার নাম করে এক সুযোগে তার শরীরে সুই ঢুকিয়ে রক্ত নিয়েছিল। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল সদাগরের রক্তের সঙ্গে ম্যাচিং হচ্ছে তাই শিশুটিকে টার্গেট করা। অপারেশনের দিন শিশুটিকে চিড়িয়াখানা দেখানোর নাম করে একটি পরিত্যক্ত নির্জন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শিশুটিকে হত্যা করে দেহ থেকে কিডনি বের করে বরফে রেখে অস্ত্রোপচার থিয়েটারে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার শাজাহান পুলিশের কাছে স্বীকার করেন টিমের অন্য দু’জন ডাক্তার নির্দোষ।
সদাগরকে জড়িয়ে সব ঘটনার অবতারণা হওয়ায় পুলিশের তদন্তকারী দল সদাগরকে থানায় তলব করল। সদাগরকে প্রশ্নজালে জর্জরিত করে পুলিশ জানতে চাইল কিডনিদাতার নাম-পরিচয় না জেনে ও সাক্ষাৎকার না নিয়ে তিনি কিডনি কিনতে চাইলেন কেন। সদাগর সত্য ঘটনা বর্ণনা করে পুলিশকে বোঝালেন যে, ডাক্তার শাজাহানের মিথ্যাচারে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন কিন্তু তিনি ডাক্তারের জঘন্য অর্থলিপ্সার ব্যাপারটা কল্পনাও করতে পারেননি।
পুলিশের তলব এবং তাকে জেরা করার বিষয়টি সদাগর অপমানজনক মনে করলেন। ডাক্তার হয়ে একটি শিশুকে হত্যা করার পাপ-কর্মও তার মনে অহরহ রক্তক্ষরণ ঘটাতে লাগল। পরদিন তিনি তার গদি কামরায় বসলেন কিন্তু এক ফোটা কাজ করতে পারলেন না। খরিদ্দার ও অংশীদাররা যারা সদাগরকে ঘিরে বসেছিল সব শুনে তারা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে, তিনি নির্দোষ। তারা বলল, সরল বিশ্বাসে আপনি ডা. শাজাহানের মিথ্যাচারকে সত্যি বলে মেনে নিয়েছেন, আপনি তো জানতেন না যে ওই ডাক্তার একটি ফুটফুটে শিশুকে হত্যা করে তার কিডনি আপনার শরীরে জুড়ে দেবে। এ ব্যাপারে আপনার কোনো পাপ নেই। আপনি অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলে দিন। ব্যবসায়ী বন্ধুদের বক্তব্য শুনে সদাগর আশ্বস্ত হলেও কিন্তু পরক্ষণেই আবার পাপবোধ তাকে পেয়ে বসলো। অহরহ তার মনে একই অনুশোচনা তোলপাড় করতে লাগল। আমার জন্যই তো শিশুটি প্রাণ হারাল। আমি তো কিডনির জন্য ফুলের মতো নিষ্পাপ নিরপরাধ শিশুর প্রাণহানি চাইনি। অপরাধ বোধ, পাপবোধ তাকে প্রতি মুহূর্তে কুরে কুরে খেতে লাগল। যে দুই ডাক্তার তার অপারেশন করেছিলেন তাদের তিনি টেলিফোন করে বললেন- ডাক্তার বন্ধুরা আমি আর পারছি না, আমার শরীরে জুড়ে দেয়া কিডনিটি বের করে ফেলুন। ডাক্তার বন্ধুরা হাসল। পাগল নাকি!
হঠাৎ একদিন অফিস থেকে গাড়িতে উঠার সময় সদাগর বেসামাল হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। ডাক্তার ডাকা হল। ডাক্তার তাকে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখা গেল সদাগরের একটি কিডনি পুরোপুরি অকেজো, দ্বিতীয়টি ২০ শতাংশ কাজ করে। এখনই ডায়ালাইসিস শুরু করতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিস্থাপন করতে হবে। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র শুনে সদাগর ঘাবড়ে গেলেন। তার এক বন্ধু মাত্র ছ’মাস ডায়ালাইসিস করেই পরাজয়বরণ করে নিয়েছিলেন। মানুষের শরীরে কিডনির কর্মকাণ্ড খুবই জরুরি। তবে একটি কিডনি দিয়েও মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে। সদাগর ভাবলেন তার আংশিক সুস্থ দ্বিতীয় কিডনিকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় কিনা। ডাক্তারের সঙ্গে কয়েকবার লম্বা সময় নিয়ে বসলেন, আরও দু’জন ডাক্তার নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করা হল। বোর্ড বলল, ওষুধ দিয়ে কিডনির কর্মক্ষমতা বাড়ানোর আর সুযোগ নেই, অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস দ্বারা শরীরের কর্মক্ষমতা কয়েক বছর পর্যন্ত ধরে রাখা যেতে পারে, কিন্তু গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে উত্তম পন্থা হবে কমপক্ষে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা। সেজন্য কিডনিদাতা খুঁজে বের করতে হবে। দাতার কিডনি রোগীর কিডনির সঙ্গে ম্যাচিং হলে অস্ত্রোপচার করার ব্যবস্থা করা হবে।
সদাগর ভাবতেও পারেননি তার ভাগ্যে এমনটি হবে। আজ হিসাবের খাতা উল্টিয়ে বুঝলেন সীমাহীন অর্থ-বিত্তের মাঝখানে নিজের ও পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু শরীরের দিকে ফিরে তাকাননি। একটি টেলিফোন করলেই ডাক্তার হাজির হয় কিন্তু সেটুকুও করার সময় করে উঠতে পারেননি। কয়েক বছর আগে ডাক্তার ডায়াবেটিস ও প্রেসারের ওষুধ খেতে বলেছিল এবং পথ্যের একটি তালিকা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ওষুধ কেনা হয়েছে, নিয়মিত খাওয়া হয়নি। খাবার তালিকা দেয়ালে ঝুলানো আছে, অনুসরণ করা হয়নি। স্ত্রী বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সদাগরের একই কথা- মনমতো আয়েশ করে দুটো ভাত যদি খেতে না পারলাম তাহলে এ টাকা-পয়সার মূল্য কি। সদাগরের এক ডাক্তার বন্ধু একদিকে ইনসুলিন নিতেন, অন্যদিকে রাতে স্ত্রীর অজান্তে ফ্রিজে রাখা মিষ্টিগুলো সাবাড় করতেন। একদিন দেখা গেল তার কয়েকটি দাঁত নড়বড়ে হয়ে গেছে, চোখের দৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক ঝাপসা হয়ে গেছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন ডায়বেটিসের মাত্রা মোটেও নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কিছু দিনের মধ্যে তার শরীরে পানি নেমে পায়ের পাতা ফুলে গেল। ডাক্তার বন্ধুর এ অবস্থায় ইনসুলিনও কাজ করল না। ইতিমধ্যে কিডনি দুটো নব্বই শতাংশ অকেজো হয়ে গিয়েছে। শুরু হল ডায়ালাইসিস, ওই ডাক্তার বছর খানেক বেঁঁচেছিলেন। কিডনি প্রতিস্থাপন তখন বাংলাদেশে শুরু হয়নি, ভারতে বা সিঙ্গাপুর যাওয়ার সামর্থ্য তার ছিল না।
সদাগরের অর্থের প্রাচুর্য আছে, তাই ভারতে কেন, সিঙ্গাপুরও যেতে পারেন। কিন্তু পরিবারের ভেতর থেকে বা আত্মীয়ের মধ্যে কেউ কিডনি দান করতে এগিয়ে এলো না। নিরুপায় সদাগর সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলেন এবং কিডনিদাতাকে ত্রিশ লাখ টাকা দিতে ঘোষণা দিলেন। সর্বশেষ তারিখ চলে গেল, কোনো দাতা এগিয়ে এলো না। এক সপ্তাহ পর সদাগর একটি টেলিফোন পেলেন- স্যার কিডনি জোগাড় করে দেয়া যাবে। কিন্তু পঞ্চাশ লাখের কম টাকা দিলে চলবে না। সদাগর ভাবলেন ভারতে চলে যাবেন এবং ওখানকার কোনো স্থানীয় দাতার কাছ থেকে কিডনি কিনে নেবেন। কিন্তু নিজের দেশের ভেতরেই তো কৃতকার্য হলেন না, ভারতে যদি কোনো ঠক-বদমাসের হাতে পড়েন, তাহলে অর্থ তো যাবেই নিজের প্রাণ নিয়েও টানাটানি হতে পারে। হাসপাতালের ডাক্তাররা নিজেরাই অপারেশন করতে এক পায়ে খাড়া। তারা সদাগরকে বোঝালেন দেশে অপারেশন করলে দাতা হাতের নাগালে থাকবে, সবকিছু সময় মতো মিললেই তবে অপারেশন করা হবে। সদাগর ভাবলেন ডাক্তারদের হাতেই তো রোগীর জীবন। বিদেশে গিয়ে ব্যর্থ হলে দেশীয় ডাক্তারদেরই শরণাপন্ন হতে হবে।
অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত সওদাগর সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশনটা দেশেই করিয়ে নেবেন। কিডনি দান করার জন্য তিনি পঞ্চাশ লাখ টাকা মূল্য প্রদান করতেও রাজি হলেন। শুরু হল অপারেশনের জন্য ডাক্তারদের প্রস্তুতি। কিডনিদাতার রক্তের গ্র“প রোগীর রক্তের গ্র“পের সঙ্গে ম্যাচিং হয়েছে বলে সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ডা. শাজাহান সদাগরকে আশ্বস্ত করলেন, কিন্তু দাতার পরিচয়, নাম ঠিকানা গোপন রাখলেন। সদাগর জানার জন্য পীড়াপীড়ি করলেও ডাক্তার রাজি হলেন না। তিনি বললেন- নাম, পরিচয়, ঠিকানা প্রকাশ করতে কিডনিদাতার নিষেধ আছে এবং এ শর্তেই সে কিডনি বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। টাকায় নাকি বাঘের দুধও মিলে, আরও অনেক অসাধ্য সাধন হয়। কিন্তু পঞ্চাশ লাখ টাকা পরিশোধ করেও সদাগর নিজের কিডনিদাতার নাম, পরিচয় জানতে পারলেন না, তার বড় আফসোস হল। অনন্যোপায় সদাগর দাতার শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন।
নির্দিষ্ট দিনে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হল। কিডনি প্রতিস্থাপনে মেডিকেল টিম দারুণভাবে সফল হলেন। কিডনিটি নাকি ছিল খুবই সতেজ এবং সদাগরের রক্তের সঙ্গে চমৎকার মিল। এবার অপেক্ষার পালা। প্রতিস্থাপন করার পর আরও কয়েক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তখন পর্যন্ত হাসপাতালেই থাকতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল নতুন কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে। রোগীকে হাসপাতাল ত্যাগ করতে অনুমতি দেয়া হল। সদাগর মহাখুশি। রুগ্ন, অকেজো কিডনি ফেলে নতুন, তাজা কিডনি শরীরে জুড়ে দেয়া হয়েছে, সেটা কি কাজ না করে পারে? সদাগরের আত্মবিশ্বাস বহু গুণ বেড়ে দেহে মনে শক্তি সঞ্চার করল।
সদাগর বাসায় ফেরার পর খরিদ্দার, স্টাফ, আত্মীয়স্বজনরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তাকে দেখার জন্য। হাসপাতালে যারা দেখতে যেতে পারেননি, তারা তো এলেই, যারা হাসপাতালে গিয়েছিল তারাও আরোগ্য লাভ করার জন্য ফুল হাতে অভিনন্দন জানাতে এলেন। একটি উৎসবের আমেজ সদাগরের বাড়িতে সপ্তাহ খানেক চলল। আত্মীয়-পরিজন যারা সদাগরের আহ্বানে কিডনি দান করতে আগ্রহ দেখাননি তারাও সফল অস্ত্রোপচার ও আরোগ্য লাভের জন্য অভিনন্দন জানাতে এলেন। বাস্তব যে কল্পনার চেয়েও কঠিন এ যাত্রা সদাগর হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। নিজের ছেলেমেয়ে, ভাই-বোন ও রক্তের সম্পর্কের আপনজন যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, কেউ কেউ উত্তর দিয়েছিল- সদাগর টাকার পাহাড় রাখবে কোথায়, তারাই আজ হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার চার পাশে ঘুর ঘুর করছে। শেষ পর্যন্ত সদাগর অর্ধকোটি ব্যয় করেই কিডনি পেয়েছিলেন, সেজন্য তার আত্মতুষ্টির সীমা নেই।
সদাগরের অস্ত্রোপচারের পরই সংবাদপত্রে অবৈধ কিডনি কেনা বেচার কিছু ঘটনা প্রকাশ পায়। তন্মধ্যে একটি ঘটনা ছিল লোমহর্ষক আর মর্মান্তিক। এক ডাক্তার ৮ বছরের এক পথশিশুকে হত্যা করে দেহ থেকে তার কিডনি বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যায়। থানায় মামলা হয় এবং পুলিশ সেই ডাক্তারকে খুঁজে গ্রেফতার করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি সদাগর কয়েকবার পড়লেন, ডাক্তারের নামটা তার চেনাচেনা লাগছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি হাসপাতালে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন যে মেডিকেল টিম তার কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিল ডাক্তার শাহজাহান কি এদের একজন। হাসপাতাল থেকে হ্যাঁ সুচক জবাব এলো। সদাগর বুঝলেন ওই পিশাচ ডাক্তার বা ডাক্তাররা ছেলেটিকে মেরে কিডনি চুরি করে নিয়েছে। সেই চুরি করা কিডনিই হয়তো তার দেহে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পঞ্চাশ লাখ টাকা থেকে এক পয়সাও হয়তো কিডনিদাতাকে দেয়া হয়নি। সদাগর পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি আবার মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। তাতে বোঝা গেল, যেদিন ডাক্তার শাজাহান ছেলেটিকে হত্যা করেছেন সেই দিনই তার অপারেশন হয়েছে। তাহলে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল মৃত ছেলেটির কিডনিই খুব সম্ভবত তার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সদাগর আবার হাসপাতালে টেলিফোন করে বাকি দু’জন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। হাসপাতাল থেকে জানাল ওই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে একটি ৮ বছরের শিশুকে হত্যা ও তার কিডনি চুরির অপরাধে মামলা হয়েছে এবং হুলিয়া জারি করা হয়েছে। তারা এখন আর হাসপাতালে আসেন না, গ্রেফতার এড়াতে হয়তো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সদাগর এবার নিশ্চিত হলেন তার কিডনিদাতা আর কেউ নয়, সেই ৮ বছর বয়সের নিষ্পাপ শিশুটি যাকে কসাই ডাক্তার শাজাহান হত্যা করেছে। সদাগরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। অকেজো কিডনির স্থানে তাজা কিডনি প্রতিস্থাপনের আনন্দটা বিষাদে পরিণত হল। ফেরেশতার মতো একটি নিষ্পাপ, নিরপরাধ শিশুকে নির্দয় কসাই ডাক্তার কি করে হত্যা করতে পারল। সে কি পঞ্চাশ লাখ টাকা পুরোটাই হজম করার জন্য।
এরকম অমানবিক, নৃশংস ঘটনা নিজকে ঘিরে বাস্তবে ঘটতে তা কল্পনাও করেননি সদাগর তাই আক্ষেপে ম্রিয়মান হয়ে গেলেন। ভুলটা তারই হয়েছে, কিডনিদাতার নাম, পরিচয় জেনে এবং স্বচক্ষে তাকে দেখে তার সঙ্গে কথা বলেই পঞ্চাশ লাখ টাকার চুক্তি করা উচিত ছিল। এত কিডনি নয়, একটি নিষ্পাপ শিশুর তাজা প্রাণ সংহার করে তার শরীরে রোপণ করা হয়েছে। তিনি তো কারুর প্রাণ কেড়ে নিতে চাননি, কাউকে হত্যা করতে চাননি। স্রেফ দাতার একটি কিডনি চেয়েছিলেন অন্যটি দিয়ে যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে। বিনিময়ে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন, যাতে দাতা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা তাকে যথেষ্ট অর্থ দিয়েছেন বলেই তিনি প্রতিদান দিতে কার্পণ্য করেননি। এখন শুধু অর্থলোভী পিশাচ ডাক্তার নয়, নিজেকেও সদাগরের খুনি বলে মনে হচ্ছে, শিশুটির কেড়ে নেয়া প্রাণ যেন বলছে- সদাগর তোমার জন্যই আমাকে হত্যা করে হয়েছে, তোমাকে আরোগ্য করার জন্যই আমাকে প্রাণে মারা হয়েছে, তোমার দেয়া অর্থ একা ভোগ করার লোভ সামলাতে না পেরে আমার বুকে ছুরি মারা হয়েছে। সদাগর এক অস্থির, অনিশ্চিত সময় পার করতে লাগলেন। শরীরে রোপণ করা কিডনিটি ফেরত দিলে যদি শিশুটি প্রাণ ফিরে পেত, তাহলে সদাগর তাই করতেন।
ডাক্তার শাজাহানকে রিমান্ডে নেয়ার পর সে স্বীকার করল যে শিশুটিকে অপারেশনের দিন সে একাই হত্যা করেছে এবং পুরো পঞ্চাশ লাখ টাকার মালিক হওয়ার জন্য সে কুকর্মটি করেছে। অন্য ডাক্তাররা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। সে সম্পূর্ণ নিজেই কিডনি সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল এবং শর্ত ছিল, দাতার পরিচয় গোপন রেখে অন্য হাসপাতালে অপারেশন করে কিডনিটি তার শরীর থেকে বের করা হবে। ডাক্তাররাও সেটা মেনে নিয়েছিলেন। টার্গেট করা এতিম শিশুটি ফুটপাতে বাস করত। ডাক্তার শাজাহান তাকে চকোলেট, খাবার, নতুন জামা-কাপড় দিয়ে বশ করেছিল। ভিটামিন ইনজেকশন দেয়ার নাম করে এক সুযোগে তার শরীরে সুই ঢুকিয়ে রক্ত নিয়েছিল। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল সদাগরের রক্তের সঙ্গে ম্যাচিং হচ্ছে তাই শিশুটিকে টার্গেট করা। অপারেশনের দিন শিশুটিকে চিড়িয়াখানা দেখানোর নাম করে একটি পরিত্যক্ত নির্জন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শিশুটিকে হত্যা করে দেহ থেকে কিডনি বের করে বরফে রেখে অস্ত্রোপচার থিয়েটারে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার শাজাহান পুলিশের কাছে স্বীকার করেন টিমের অন্য দু’জন ডাক্তার নির্দোষ।
সদাগরকে জড়িয়ে সব ঘটনার অবতারণা হওয়ায় পুলিশের তদন্তকারী দল সদাগরকে থানায় তলব করল। সদাগরকে প্রশ্নজালে জর্জরিত করে পুলিশ জানতে চাইল কিডনিদাতার নাম-পরিচয় না জেনে ও সাক্ষাৎকার না নিয়ে তিনি কিডনি কিনতে চাইলেন কেন। সদাগর সত্য ঘটনা বর্ণনা করে পুলিশকে বোঝালেন যে, ডাক্তার শাজাহানের মিথ্যাচারে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন কিন্তু তিনি ডাক্তারের জঘন্য অর্থলিপ্সার ব্যাপারটা কল্পনাও করতে পারেননি।
পুলিশের তলব এবং তাকে জেরা করার বিষয়টি সদাগর অপমানজনক মনে করলেন। ডাক্তার হয়ে একটি শিশুকে হত্যা করার পাপ-কর্মও তার মনে অহরহ রক্তক্ষরণ ঘটাতে লাগল। পরদিন তিনি তার গদি কামরায় বসলেন কিন্তু এক ফোটা কাজ করতে পারলেন না। খরিদ্দার ও অংশীদাররা যারা সদাগরকে ঘিরে বসেছিল সব শুনে তারা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে, তিনি নির্দোষ। তারা বলল, সরল বিশ্বাসে আপনি ডা. শাজাহানের মিথ্যাচারকে সত্যি বলে মেনে নিয়েছেন, আপনি তো জানতেন না যে ওই ডাক্তার একটি ফুটফুটে শিশুকে হত্যা করে তার কিডনি আপনার শরীরে জুড়ে দেবে। এ ব্যাপারে আপনার কোনো পাপ নেই। আপনি অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলে দিন। ব্যবসায়ী বন্ধুদের বক্তব্য শুনে সদাগর আশ্বস্ত হলেও কিন্তু পরক্ষণেই আবার পাপবোধ তাকে পেয়ে বসলো। অহরহ তার মনে একই অনুশোচনা তোলপাড় করতে লাগল। আমার জন্যই তো শিশুটি প্রাণ হারাল। আমি তো কিডনির জন্য ফুলের মতো নিষ্পাপ নিরপরাধ শিশুর প্রাণহানি চাইনি। অপরাধ বোধ, পাপবোধ তাকে প্রতি মুহূর্তে কুরে কুরে খেতে লাগল। যে দুই ডাক্তার তার অপারেশন করেছিলেন তাদের তিনি টেলিফোন করে বললেন- ডাক্তার বন্ধুরা আমি আর পারছি না, আমার শরীরে জুড়ে দেয়া কিডনিটি বের করে ফেলুন। ডাক্তার বন্ধুরা হাসল। পাগল নাকি!
No comments