মুসাফির, মোছ রে আঁখিজল by সৌনক গুপ্ত
আ মের ডালে বাঁধা থাকতো দোলনা- পাশেই
হিজল গাছ, ধানক্ষেত। দোল খেতো ছোট্ট মেয়েটি- ঝরে পড়তো হিজলের ফুল। সারা গা
ভরে যেতো ফুলের পরাগে। এভাবেই কেটেছে শৈশব। বাড়িতে ছিল গ্রামোফোন। সেই
গ্রামোফোনের চোঙা মুখে ধরে সারাদিন গেয়ে বেড়ানোই ছিল তার অভ্যাস- কেউ শুনলো
কিনা, সেদিকে থাকতো না দৃষ্টি। সেদিন কেউ শুনেছিলেন কিনা জানি না- তবে আজ
যে সারা দেশ শুনছে, সে কথা বলতে পারি। তিনি যে ফিরোজা বেগম! বয়স তখন ৯। এক
গ্রীষ্মে ফরিদপুর থেকে কলকাতা এসেছেন ছোট্ট ফিরোজা, একদিন মামার হাত ধরে
গেলেন গ্রামোফোন কোম্পানিতে। সেদিনই প্রথম সাক্ষাৎ কাজী নজরুলের সঙ্গে। গান
গাইতে বললেন কাজী সাহেব। হারমোনিয়াম এগিয়ে দেয়া হলো। অবাক ফিরোজা! এই ‘পা’
টেপেন, তো নিচে অন্য ‘পা’ বেজে ওঠে- ‘ধা’ টেপেন তো সঙ্গে সঙ্গে অন্য ‘ধা’
বেজে ওঠে। সেই প্রথম স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম দেখা, কাপলিং দেখতে অভ্যস্ত
নন। বলেই ফেললেন, ‘এটা তো ভাঙা হারমোনিয়াম!’ হাসিতে ফেটে পড়লো ঘর! ফিরোজার
গান শুনে মুগ্ধ হলেন কাজী নজরুল। বললেন, ‘তুমি তো পুরো রেকর্ডের মতো
গাও!’ ‘আমি তো রেকর্ড থেকেই গান তুলি,’ বললেন ফিরোজা। সেদিনই সাক্ষাৎ হলো
কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে, কাজী সাহেবই পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘দেখো কমল, এ মেয়েটি
একদম রেকর্ডের মতো গায়!’ কাজী নজরুলের আশীর্বাদেই শিল্পীজীবন শুরু হলো
ফিরোজা বেগমের। প্রথম রেকর্ড করলেন চিত্ত রায়ের পরিচালনায়। ১৯৪২ সালে, ‘হিজ
মাস্টার্স ভয়েস’ লেবেলে প্রকাশ পেলো সেই রেকর্ড। শিল্পী তখন ১২।
ফিরোজার মায়ের পরিবার, আরব থেকে এসেছিলেন বাংলায়। মায়ের সূত্রেই আরবি, ফারসি শিখেছিলেন শিল্পী। শিখেছিলেন উর্দুও। এর ফলে, গীত, গজল প্রভৃতি রেকর্ডেও অক্লেশে গাইতে পেরেছিলেন তিনি।
১৯৪৩ সালে কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রথম রেকর্ড করেন ফিরোজা, যার কাছে সংগীতশিক্ষার স্মৃতি কখন ভোলেন নি শিল্পী। পরবর্তীকালে বহুবার স্মরণ করেছেন, তার শিক্ষার্থীজীবনে কমলবাবুর অবদানের কথা, যার ফলে ১৯৪৪-৪৫ সালের মধ্যেই অশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ফিরোজা।
শিল্পীর সংগীত জীবনের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। সামাজিক নানা কারণে একা চলাফেরা করার প্রশ্নই ছিল না। সব সময় অন্য কেউ পাহারা দিতেন, পাশে পাশে থেকে। প্রথম দিকে জনসমক্ষে সংগীত পরিবেশনের বিষয়ে পারিবারিক আপত্তি না থাকলেও, চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে যখন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন ফিরোজা, উঠলো আপত্তি। গান বন্ধ করার আদেশ এলো পরিবার থেকেই। থামতেই হলো। রেকর্ডিং বন্ধ হলো। শিল্পীকে ফিরিয়ে নেয়া হলো ফরিদপুর। দিনরাত চলতে থাকলো মান-অভিমানের পালা। তখনই বোধ হয় ফিরোজা প্রথম বুঝেছিলেন, তিনি বড় একা। অনেক পরে বলেও ছিলেন, একাকিত্ব আমার চিরকালের সঙ্গী! পাখির কলকাকলি যে থামার নয়! ফিরোজার নীলাভ দ্যুতিও, আপনিই বিচ্ছুরিত হয়! ১৯৪৯ সালে ঢাকা বেতারে শর্টওয়েভ উদ্বোধন উপলক্ষে আমন্ত্রিত হন ফিরোজা বেগম ও তপনকুমার তালাত মাহমুদ) বহুদিন পর প্রকাশ্যে গাইলেন ফিরোজা। গানের জগতে ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু ইতিমধ্যে দুই বাংলা আলাদা হয়ে যাওয়ায় কলকাতার সঙ্গে আগের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে আমন্ত্রণ এলো, গেস্ট আর্টিস্ট হয়ে রেকর্ড করার- আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারলেন না শিল্পী- কলকাতায় থাকবেন কোথায়? সঙ্গে কে থাকবে? শিল্পীর সংগীতশিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশের তীর্থ কলকাতা, তখন ভিন দেশ।
ফিরোজা এলেন ঢাকায়, নতুন করে সংগীতজীবন শুরু করার স্বপ্নে। এসে দেখলেন, ঢাকার সংগীতজগতের সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব অপরিসীম। ঢাকার সামাজিক অবস্থাও তখন অনুকূল নয়। আপাদমস্তক আবৃত অবস্থায় চলাফেরা করা, তার ওপর চারপাশের মানুষের গঞ্জনা, অসদাচরণ। একরকম বীতশ্রদ্ধ হয়েই শিল্পী ফিরে গেলেন ফরিদপুর।
কিছুকাল বাদে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফরিদপুর থেকে ঢাকা। আবার শুরু হলো সংগীত পরিবেশন। এ সময়, কালাম-ই-ইকবাল ছাড়া অন্য কোন ধরনের গজল পরিবেশিত হতো না ঢাকা বেতার কেন্দ্রে। ফিরোজাই প্রথম শিল্পী, যিনি কালাম-ই-ইকবাল ছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের গজল পরিবেশন করলেন। কিছুকালের মধ্যেই শ্রোতাদের মন জয় করলেন শিল্পী। গজলে তাঁর নিখুঁত উর্দু উচ্চারণ শুনে আশ্চর্য হলেন সকলেই। ‘ঢাকায় এসে রেডিও স্টেশনের ভোলই পাল্টে দিলাম’, বলেছিলেন ফিরোজা।
শিল্পী আবার পেলেন স্বীকৃতি। কলকাতার সংগীতজগতের সঙ্গেও তার যোগাযোগ হলো, নতুন করে। সাক্ষাৎ হলো গুরু কমল দাশগুপ্তের সঙ্গেও। মাতৃভক্ত কমলবাবু সে সময়ে হারিয়েছেন মাকে। তারপরই, ১৯৫২ সালে হারালেন আপন ভ্রাতা তথা সংগীত জীবনের অন্যতম সঙ্গী, সুরস্রষ্টা সুবল দাশগুপ্তকেও। তখন ভেঙে পড়া কমল দাশগুপ্তকে ভালবাসার আশ্রয় দিতে এগিয়ে এলেন ফিরোজা বেগম। ১৯৫৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন কমল-ফিরোজা। কমল দাশগুপ্তের পেশাগত সাফল্যের দিন ততদিনে শেষ হয়েছে। সংগীতজগতে কমল-ফিরোজা জুটি আর নতুন করে তৈরি হওয়ার নয়। এতদিন ফিরোজার জীবন তো সুখের খাতে বইতে পারেনি। শিল্পীর সংগীতজীবনের প্রথম অনুপ্রেরণাদাতা কাজী নজরুল ইসলাম বহু পূর্বেই বাকশক্তি হারিয়েছেন- সে সময় শিল্পী নিজের জীবনের দুর্দশা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংগীত জগতে ফিরে এসে, ফিরোজা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন, প্রথমেই কাজী সাহেবের গান রেকর্ড করবেন। ততদিনে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে নজরুলগীতির রেকর্ড প্রকাশ প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, সুপ্রভা সরকার, ইলা ঘোষ প্রমুখ নজরুলগীতির জনপ্রিয় শিল্পীরা ততদিনে জনপ্রিয়তার নিরিখে খানিকটা পিছিয়েও পড়েছেন। আধুনিক গানের তখন স্বর্ণযুগ। গ্রামোফোন কোম্পানি ফিরোজার কণ্ঠে নজরুলগীতি রেকর্ড করতে রাজি হলেন না। জীবনের অভিজ্ঞতা হয়তো শিল্পীকে অনেক বলিষ্ঠ করে দিয়েছিল- রেকর্ডের জগতে একচেটিয়া গ্রামোফোন কোম্পানিকে ফিরোজা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন- নজরুলগীতি রেকর্ড করতে না দিলে তিনি গান রেকর্ডই করবেন না। অবশেষে ১৯৬০ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হলো নজরুলগীতির রেকর্ড- ‘দূরদ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি, দারুচিনির দেশের তুমি বিদেশিনী গো, সুমন্দভাষিণী। রেকর্ড প্রকাশ পেতেই রসিকমহলে সাড়া পড়ে গেল। আগেকার সেই জনপ্রিয় কিশোরী শিল্পী ফিরোজা, ফিরে এলেন সাবালিকা ফিরোজা বেগম হয়ে, সংগীত জগৎকে নবদীপ্তিতে আলোকিত করতে! জনপ্রিয়তার কারণে, এ গান পরেও একাধিকবার রেকর্ড করতে হয়েছে শিল্পীকে। এরপর বেশ কিছু রেকর্ডে নজরুলগীতি পরিবেশন করেছেন শিল্পী। বেশ কিছু গান জনপ্রিয়ও হয়েছে। ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ (১৯৬৬), ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’ (১৯৭০), ‘মনে পড়ে আজ’ (১৯৭৩), ‘গানগুলি মোর আহত পাখির সম’ (১৯৭৮) প্রভৃতি গান আজও আবেদন হারায় নি। ১৯৬৭ সালে, বহুকাল পরে কমল দাশগুপ্ত সংগীত পরিচালক হয়ে ফিরে এলেন। দিলীপ নাগ পরিচালিত, প্রদীপকুমার ও গীতা দত্ত (গায়িকা) অভিনীত ছবি ‘বধূবরণ’-এ, শ্যামল গুপ্ত রচিত কিছু গান সুরারোপিত করলেন কমল দাশগুপ্ত। সে ছবির একটি গানে আরতি মুখোপাধ্যায় ও অরুণ দত্তের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন ফিরোজা বেগম। তবে কমলবাবুর এই শেষ প্রচেষ্টাও বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে পারলো না। দুঃখ-দৈন্য ও মর্যাদার অভাব অসহনীয় হয়ে ওঠায়, কমলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ফিরোজা চলে গেলেন ঢাকায়। ১৯৬৭ সাল তখন।
১৯৭৪ সালের ২০শে জুলাই, কমল দাশগুপ্ত গমন করেন অমৃতলোকে। তার স্মরণসভায় ফিরোজা বেগম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ, উৎপলা সেন, কল্যাণী মজুমদার, সন্তোষ সেনগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পী। সে সভায় গীতিকার প্রণব রায়, বহুকালের বন্ধু কমলবাবুর স্মৃতিচারণা করে, বন্ধুপত্নী ফিরোজার প্রতি গভীরভাবে সমবেদনা জানান। ফিরোজা আরও একবার একাকিত্বকে বরণ করেন। ততদিনে অবশ্য তিনি তিন সন্তানের জননী। জীবনে নানাভাবে বঞ্চিতা ফিরোজা, কাজী নজরুলের গানকে আঁকড়ে বাঁচতে ভালবেসেছিলেন। নজরুল প্রয়াণের পর, কবির স্মরণে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে যে দীর্ঘবাদন রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়, তাতে একক কণ্ঠে গান ছিল মাত্র চারজন শিল্পীর। তাদের একজন ফিরোজা বেগম। এ স্বীকৃতি, শিল্পীর জীবনে নিঃসন্দেহে এক পরম পাওয়া। ‘বিদ্রোহী কবি স্মরণে’ শীর্ষক সেই রেকর্ডে ফিরোজা গীত ‘মুসাফির, মোছ রে আঁখিজল’ কি ভোলা যায় ? গুরু তথা স্বামী কমল দাশগুপ্তের সুরকেও হারিয়ে যেতে দেননি ফিরোজা। অতীতের শিল্পীদের গাওয়া, কমলবাবু সুরারোপিত বেশ কিছু গান নতুন করে রেকর্ড করে, নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন। স্মরণীয় এই সুরস্রষ্টার সংগীত সংরক্ষণে ফিরোজা বেগমের অবদান, রসিক শ্রোতা কোনদিন ভুলবেন না।
কোন বাধাই জীবনে চরম নিরাশা আনতে পারে না, যদি জীবনের প্রতি বিশ্বাস থাকে গভীর। এই পরম বিশ্বাসে ফিরোজা উপনীত হয়েছিলেন সংগীতেরই হাত ধরে। এ বিশ্বাসের কাছে হার মানে মৃত্যুও। তাই সুরের ফিরোজার উজ্জ্বল আভা হয় চিরন্তন। ভালবাসার ঝর্ণাবারি সে ফিরোজাকে বারে বারে করে তোলে প্রাণময়। আর ফিরোজার সেই উজ্জ্বল দ্যুতি বিকিরণ করতে করতে, সুরের ঝর্ণাতলায়, ধরা দিয়ে যান ফিরোজা বেগম- গানে গানে, নিত্য নতুন!
ফিরোজার মায়ের পরিবার, আরব থেকে এসেছিলেন বাংলায়। মায়ের সূত্রেই আরবি, ফারসি শিখেছিলেন শিল্পী। শিখেছিলেন উর্দুও। এর ফলে, গীত, গজল প্রভৃতি রেকর্ডেও অক্লেশে গাইতে পেরেছিলেন তিনি।
১৯৪৩ সালে কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রথম রেকর্ড করেন ফিরোজা, যার কাছে সংগীতশিক্ষার স্মৃতি কখন ভোলেন নি শিল্পী। পরবর্তীকালে বহুবার স্মরণ করেছেন, তার শিক্ষার্থীজীবনে কমলবাবুর অবদানের কথা, যার ফলে ১৯৪৪-৪৫ সালের মধ্যেই অশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ফিরোজা।
শিল্পীর সংগীত জীবনের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। সামাজিক নানা কারণে একা চলাফেরা করার প্রশ্নই ছিল না। সব সময় অন্য কেউ পাহারা দিতেন, পাশে পাশে থেকে। প্রথম দিকে জনসমক্ষে সংগীত পরিবেশনের বিষয়ে পারিবারিক আপত্তি না থাকলেও, চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে যখন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন ফিরোজা, উঠলো আপত্তি। গান বন্ধ করার আদেশ এলো পরিবার থেকেই। থামতেই হলো। রেকর্ডিং বন্ধ হলো। শিল্পীকে ফিরিয়ে নেয়া হলো ফরিদপুর। দিনরাত চলতে থাকলো মান-অভিমানের পালা। তখনই বোধ হয় ফিরোজা প্রথম বুঝেছিলেন, তিনি বড় একা। অনেক পরে বলেও ছিলেন, একাকিত্ব আমার চিরকালের সঙ্গী! পাখির কলকাকলি যে থামার নয়! ফিরোজার নীলাভ দ্যুতিও, আপনিই বিচ্ছুরিত হয়! ১৯৪৯ সালে ঢাকা বেতারে শর্টওয়েভ উদ্বোধন উপলক্ষে আমন্ত্রিত হন ফিরোজা বেগম ও তপনকুমার তালাত মাহমুদ) বহুদিন পর প্রকাশ্যে গাইলেন ফিরোজা। গানের জগতে ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু ইতিমধ্যে দুই বাংলা আলাদা হয়ে যাওয়ায় কলকাতার সঙ্গে আগের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে আমন্ত্রণ এলো, গেস্ট আর্টিস্ট হয়ে রেকর্ড করার- আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারলেন না শিল্পী- কলকাতায় থাকবেন কোথায়? সঙ্গে কে থাকবে? শিল্পীর সংগীতশিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশের তীর্থ কলকাতা, তখন ভিন দেশ।
ফিরোজা এলেন ঢাকায়, নতুন করে সংগীতজীবন শুরু করার স্বপ্নে। এসে দেখলেন, ঢাকার সংগীতজগতের সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব অপরিসীম। ঢাকার সামাজিক অবস্থাও তখন অনুকূল নয়। আপাদমস্তক আবৃত অবস্থায় চলাফেরা করা, তার ওপর চারপাশের মানুষের গঞ্জনা, অসদাচরণ। একরকম বীতশ্রদ্ধ হয়েই শিল্পী ফিরে গেলেন ফরিদপুর।
কিছুকাল বাদে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফরিদপুর থেকে ঢাকা। আবার শুরু হলো সংগীত পরিবেশন। এ সময়, কালাম-ই-ইকবাল ছাড়া অন্য কোন ধরনের গজল পরিবেশিত হতো না ঢাকা বেতার কেন্দ্রে। ফিরোজাই প্রথম শিল্পী, যিনি কালাম-ই-ইকবাল ছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের গজল পরিবেশন করলেন। কিছুকালের মধ্যেই শ্রোতাদের মন জয় করলেন শিল্পী। গজলে তাঁর নিখুঁত উর্দু উচ্চারণ শুনে আশ্চর্য হলেন সকলেই। ‘ঢাকায় এসে রেডিও স্টেশনের ভোলই পাল্টে দিলাম’, বলেছিলেন ফিরোজা।
শিল্পী আবার পেলেন স্বীকৃতি। কলকাতার সংগীতজগতের সঙ্গেও তার যোগাযোগ হলো, নতুন করে। সাক্ষাৎ হলো গুরু কমল দাশগুপ্তের সঙ্গেও। মাতৃভক্ত কমলবাবু সে সময়ে হারিয়েছেন মাকে। তারপরই, ১৯৫২ সালে হারালেন আপন ভ্রাতা তথা সংগীত জীবনের অন্যতম সঙ্গী, সুরস্রষ্টা সুবল দাশগুপ্তকেও। তখন ভেঙে পড়া কমল দাশগুপ্তকে ভালবাসার আশ্রয় দিতে এগিয়ে এলেন ফিরোজা বেগম। ১৯৫৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন কমল-ফিরোজা। কমল দাশগুপ্তের পেশাগত সাফল্যের দিন ততদিনে শেষ হয়েছে। সংগীতজগতে কমল-ফিরোজা জুটি আর নতুন করে তৈরি হওয়ার নয়। এতদিন ফিরোজার জীবন তো সুখের খাতে বইতে পারেনি। শিল্পীর সংগীতজীবনের প্রথম অনুপ্রেরণাদাতা কাজী নজরুল ইসলাম বহু পূর্বেই বাকশক্তি হারিয়েছেন- সে সময় শিল্পী নিজের জীবনের দুর্দশা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংগীত জগতে ফিরে এসে, ফিরোজা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন, প্রথমেই কাজী সাহেবের গান রেকর্ড করবেন। ততদিনে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে নজরুলগীতির রেকর্ড প্রকাশ প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, সুপ্রভা সরকার, ইলা ঘোষ প্রমুখ নজরুলগীতির জনপ্রিয় শিল্পীরা ততদিনে জনপ্রিয়তার নিরিখে খানিকটা পিছিয়েও পড়েছেন। আধুনিক গানের তখন স্বর্ণযুগ। গ্রামোফোন কোম্পানি ফিরোজার কণ্ঠে নজরুলগীতি রেকর্ড করতে রাজি হলেন না। জীবনের অভিজ্ঞতা হয়তো শিল্পীকে অনেক বলিষ্ঠ করে দিয়েছিল- রেকর্ডের জগতে একচেটিয়া গ্রামোফোন কোম্পানিকে ফিরোজা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন- নজরুলগীতি রেকর্ড করতে না দিলে তিনি গান রেকর্ডই করবেন না। অবশেষে ১৯৬০ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হলো নজরুলগীতির রেকর্ড- ‘দূরদ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি, দারুচিনির দেশের তুমি বিদেশিনী গো, সুমন্দভাষিণী। রেকর্ড প্রকাশ পেতেই রসিকমহলে সাড়া পড়ে গেল। আগেকার সেই জনপ্রিয় কিশোরী শিল্পী ফিরোজা, ফিরে এলেন সাবালিকা ফিরোজা বেগম হয়ে, সংগীত জগৎকে নবদীপ্তিতে আলোকিত করতে! জনপ্রিয়তার কারণে, এ গান পরেও একাধিকবার রেকর্ড করতে হয়েছে শিল্পীকে। এরপর বেশ কিছু রেকর্ডে নজরুলগীতি পরিবেশন করেছেন শিল্পী। বেশ কিছু গান জনপ্রিয়ও হয়েছে। ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ (১৯৬৬), ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’ (১৯৭০), ‘মনে পড়ে আজ’ (১৯৭৩), ‘গানগুলি মোর আহত পাখির সম’ (১৯৭৮) প্রভৃতি গান আজও আবেদন হারায় নি। ১৯৬৭ সালে, বহুকাল পরে কমল দাশগুপ্ত সংগীত পরিচালক হয়ে ফিরে এলেন। দিলীপ নাগ পরিচালিত, প্রদীপকুমার ও গীতা দত্ত (গায়িকা) অভিনীত ছবি ‘বধূবরণ’-এ, শ্যামল গুপ্ত রচিত কিছু গান সুরারোপিত করলেন কমল দাশগুপ্ত। সে ছবির একটি গানে আরতি মুখোপাধ্যায় ও অরুণ দত্তের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন ফিরোজা বেগম। তবে কমলবাবুর এই শেষ প্রচেষ্টাও বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে পারলো না। দুঃখ-দৈন্য ও মর্যাদার অভাব অসহনীয় হয়ে ওঠায়, কমলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ফিরোজা চলে গেলেন ঢাকায়। ১৯৬৭ সাল তখন।
১৯৭৪ সালের ২০শে জুলাই, কমল দাশগুপ্ত গমন করেন অমৃতলোকে। তার স্মরণসভায় ফিরোজা বেগম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ, উৎপলা সেন, কল্যাণী মজুমদার, সন্তোষ সেনগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পী। সে সভায় গীতিকার প্রণব রায়, বহুকালের বন্ধু কমলবাবুর স্মৃতিচারণা করে, বন্ধুপত্নী ফিরোজার প্রতি গভীরভাবে সমবেদনা জানান। ফিরোজা আরও একবার একাকিত্বকে বরণ করেন। ততদিনে অবশ্য তিনি তিন সন্তানের জননী। জীবনে নানাভাবে বঞ্চিতা ফিরোজা, কাজী নজরুলের গানকে আঁকড়ে বাঁচতে ভালবেসেছিলেন। নজরুল প্রয়াণের পর, কবির স্মরণে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে যে দীর্ঘবাদন রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়, তাতে একক কণ্ঠে গান ছিল মাত্র চারজন শিল্পীর। তাদের একজন ফিরোজা বেগম। এ স্বীকৃতি, শিল্পীর জীবনে নিঃসন্দেহে এক পরম পাওয়া। ‘বিদ্রোহী কবি স্মরণে’ শীর্ষক সেই রেকর্ডে ফিরোজা গীত ‘মুসাফির, মোছ রে আঁখিজল’ কি ভোলা যায় ? গুরু তথা স্বামী কমল দাশগুপ্তের সুরকেও হারিয়ে যেতে দেননি ফিরোজা। অতীতের শিল্পীদের গাওয়া, কমলবাবু সুরারোপিত বেশ কিছু গান নতুন করে রেকর্ড করে, নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন। স্মরণীয় এই সুরস্রষ্টার সংগীত সংরক্ষণে ফিরোজা বেগমের অবদান, রসিক শ্রোতা কোনদিন ভুলবেন না।
কোন বাধাই জীবনে চরম নিরাশা আনতে পারে না, যদি জীবনের প্রতি বিশ্বাস থাকে গভীর। এই পরম বিশ্বাসে ফিরোজা উপনীত হয়েছিলেন সংগীতেরই হাত ধরে। এ বিশ্বাসের কাছে হার মানে মৃত্যুও। তাই সুরের ফিরোজার উজ্জ্বল আভা হয় চিরন্তন। ভালবাসার ঝর্ণাবারি সে ফিরোজাকে বারে বারে করে তোলে প্রাণময়। আর ফিরোজার সেই উজ্জ্বল দ্যুতি বিকিরণ করতে করতে, সুরের ঝর্ণাতলায়, ধরা দিয়ে যান ফিরোজা বেগম- গানে গানে, নিত্য নতুন!
No comments