অভিমানী সম্রাজ্ঞী by মুহম্মদ নূরুল হুদা
আমার
দেখা নজরুল সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞীর নাম অবশ্যই ফিরোজা বেগম। আমি নজরুল
সঙ্গীতের কিংবদন্তির শিল্পী আঙুরবালা, ইন্দুবালা, যুথিকা রায়, কে মল্লিক,
ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রসহ আরও অনেককে চাক্ষুষ দেখিনি, কিন্তু যাদের দেখেছি
তাদের মধ্যে চলনে-বলনে-অর্জনে তাকেই সম্রাজ্ঞী বলে মেনে নিয়েছি। আর তার
সঙ্গে সাক্ষাতের প্রথম দিন থেকেই বুঝেছি অন্য কারও মতো তিনি নন, তিনি কেবল
নিজের মতো, আপন মুদ্রাগুণে আপনি মহীয়সী এক শিল্পী তিনি : আপসহীনা,
তুলনাহীনা। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, অভিমানী।
প্রথম সাক্ষাৎটি হয়েছিল যতদূর মনে পড়ে তার বাসাতেই। তারই আমন্ত্রণে আমি কালিন্দী অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। প্রস্তুতি ছিল গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার। কারণ লোকমুখে শুনেছি, তিনি দর্শনার্থীদের সঙ্গে একটু বিলম্বেই দেখা করতে আসেন। কারণ হয়তো তিনি বাসায় যে অবস্থায় থাকেন বা থাকতে পছন্দ করেন, সর্বজনসমক্ষে বা অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময়ের মুহূর্তে তিনি সে-রকম ইনফরমাল থাকতে পছন্দ করতেন না। এটি আমার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ-কারণে যে সচেতন শিল্পী বা স্রষ্টারা যা করেন, তার পেছনে বা অলক্ষে জীবনযাপনের একটি অন্যরকম দর্শন রেখায়িত থাকে। কেননা একই ব্যক্তির ভেতরে আটপৌরে মানুষ ও শিল্পী মানুষ দু’জন অবস্থান করলেও সবসময়ে অভিন্ন হয়ে থাকতে পারেন না। ব্যতিক্রম যে নেই এমন নয়, কিন্তু ব্যক্তিত্ববান ও সচেতন শিল্পীদের মধ্যে এ দুই সত্তার সযত্নে লালন একটি সহজাত প্রক্রিয়া। শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীতের এ-যাবৎকালে শ্রেষ্ঠ সাধক ফিরোজা বেগমের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। এর ফলে বাংলা ভাষাভাষী সঙ্গীতবোদ্ধাদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় ও মনপ্রিয় শিল্পী হওয়া তার প্রকাশ্য বিচরণ বরাবরই সীমিত ছিল। আমি যতবার তার সঙ্গে কথা বলেছি, ততবার তার মধ্যে এক ধরনের অভিমান প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি মনে করতেন, নজরুলকে যেভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন, আমরা তার পুরোটা পারছি না। কিংবা লক্ষার্জনে সরকারি বা বেসরকারি মহলের উদ্যোগও পর্যাপ্ত নয়। ঠিক একই কথা ভাবতেন নিজের সম্পর্কে। এই উক্তি ও উপলব্ধিতে অবশ্যই সত্যতা আছে। কেননা যে কারণেই নজরুলের জীবন ও সৃষ্টিসাধনার এ প্রত্যক্ষ সাক্ষীর কাছ থেকে যে-পরিমাণ সম্পদ আহরণ ও সংরক্ষণ করার কথা ছিল, আমরা তা পারিনি। এ দায় আমাদের প্রায় সবার, আমরা যারা নজরুলকে বাঙালির স্বাতন্ত্র্যসূচক স্বাধীন সত্তার প্রবক্তা বলে মনে করি।
কৈশোরেই তিনি শিল্পের তালিম নেন, আর তারপর পরই নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন। তারপর সেই তিরিশের দশক থেকে এ পর্যন্ত মূলত নজরুল সঙ্গীতের চর্চা, সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও বিশুদ্ধায়নে সমার্পিত ছিলেন। জানা যায়, প্রায় ১ হাজার ৬০০ নজরুল সঙ্গীত গেয়েছেন তিনি আর এর প্রায় সবগুলোই রেকর্ড আকারে সংরক্ষিত। অর্থাৎ নজরুল রচিত, সুরারোপিত ও গীত প্রায় সব গানই তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন এবং প্রামাণ্য রূপ দিয়েছেন। এদিক থেকে বিবেচনা করে আমরা তাকে নজরুল সঙ্গীতের জীবন্ত রেকর্ড বলে মনে করতাম। দেখা গেছে, গানের সুর বা বাণীর কোনো মতভেদ দেখা দিলে তিনিই ছিলেন গ্রাহ্য সমাধান। আর এ-কারণে নজরুল ইন্সটিটিউটে শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীত চর্চা ও প্রমিতকরণের জন্য সরকার নিযুক্ত যে কমিটি আছে, সুস্থ ও কর্মক্ষম অবস্থায় তিনিই ছিলেন তার সভানেত্রী। তার তিরোধানের ফলে এ-ক্ষেত্রে যে অপূর্ণতা সৃষ্টি হল, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। নজরুল গান কেবল কাব্যগীতি নয়, রাগশাসিতও বটে। তার গান গাইতে হলে গানের বাণী, মর্মার্থ ও সুরের মধ্যে একটি ভারসাম্যময় যোগাযোগ প্রয়োজন। প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি। জানা যায়, কমল দাশগুপ্ত ও নজরুলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোনো কোনো গান পূর্ণাঙ্গভাবে রপ্ত করে পরিবেশন করতে তিনি মাসাধিককাল সময়ও ব্যয় করেছেন। এই নিষ্ঠা ও সাধনা এ-কালে দুর্লক্ষ্য। তাই ফিরোজা বেগমকে নজরুলের অনুকরণীয় শিল্পী হিসেবে নমস্য মানবেন উত্তর প্রজন্মের শিল্পীরা। বলা যেতে পারে, নজরুল সঙ্গীত শিল্পীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা পথিকৃতের।
তার শিল্পীসত্তার আরেক উপাদান তার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করা তার স্বভাবজাত ছিল না। তাই নানা সময়ে তিনি ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছেন। কিন্তু ইতিবাচক দিকটি এই যে, সবকিছু সত্ত্বেও তিনি সর্বমহলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন। বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে তার ক্ষেত্রেই সর্বাগ্রে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিধাটি প্রযোজ্য বলে মনে করি। তাকে সম্মান জানিয়ে তার স্মৃতিতে এমন একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা যায়, যা হবে নজরুল সঙ্গীত চর্চার জন্য শ্রেষ্ঠ সম্মান ও স্বীকৃতি। একটি বিশদ ও সুসম্পাদিত স্মারকগ্রন্থে তার জীবন ও সাধনা দলিলায়িত করে রাখাও আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। প্রয়াত ফিরোজা বেগমকে ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব তো আমাদেরই। ‘আমায় নহে গো, ভালোবাসো মোর গান’। না, আমরা অভিমানী সম্রাজ্ঞীর এ অভিমানকে মান্য করব না। আমরা ভালোবাসব তাকেও, তার গানকেও। আমরা বলব, তোমার শ্রেষ্ঠ কীর্তি তোমার গান; আর তুমি যথার্থই তোমার কীর্তির সমান। উত্তর প্রজন্মের নজরুল-সাধকদের পক্ষ থেকে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
প্রথম সাক্ষাৎটি হয়েছিল যতদূর মনে পড়ে তার বাসাতেই। তারই আমন্ত্রণে আমি কালিন্দী অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। প্রস্তুতি ছিল গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার। কারণ লোকমুখে শুনেছি, তিনি দর্শনার্থীদের সঙ্গে একটু বিলম্বেই দেখা করতে আসেন। কারণ হয়তো তিনি বাসায় যে অবস্থায় থাকেন বা থাকতে পছন্দ করেন, সর্বজনসমক্ষে বা অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময়ের মুহূর্তে তিনি সে-রকম ইনফরমাল থাকতে পছন্দ করতেন না। এটি আমার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ-কারণে যে সচেতন শিল্পী বা স্রষ্টারা যা করেন, তার পেছনে বা অলক্ষে জীবনযাপনের একটি অন্যরকম দর্শন রেখায়িত থাকে। কেননা একই ব্যক্তির ভেতরে আটপৌরে মানুষ ও শিল্পী মানুষ দু’জন অবস্থান করলেও সবসময়ে অভিন্ন হয়ে থাকতে পারেন না। ব্যতিক্রম যে নেই এমন নয়, কিন্তু ব্যক্তিত্ববান ও সচেতন শিল্পীদের মধ্যে এ দুই সত্তার সযত্নে লালন একটি সহজাত প্রক্রিয়া। শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীতের এ-যাবৎকালে শ্রেষ্ঠ সাধক ফিরোজা বেগমের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। এর ফলে বাংলা ভাষাভাষী সঙ্গীতবোদ্ধাদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় ও মনপ্রিয় শিল্পী হওয়া তার প্রকাশ্য বিচরণ বরাবরই সীমিত ছিল। আমি যতবার তার সঙ্গে কথা বলেছি, ততবার তার মধ্যে এক ধরনের অভিমান প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি মনে করতেন, নজরুলকে যেভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন, আমরা তার পুরোটা পারছি না। কিংবা লক্ষার্জনে সরকারি বা বেসরকারি মহলের উদ্যোগও পর্যাপ্ত নয়। ঠিক একই কথা ভাবতেন নিজের সম্পর্কে। এই উক্তি ও উপলব্ধিতে অবশ্যই সত্যতা আছে। কেননা যে কারণেই নজরুলের জীবন ও সৃষ্টিসাধনার এ প্রত্যক্ষ সাক্ষীর কাছ থেকে যে-পরিমাণ সম্পদ আহরণ ও সংরক্ষণ করার কথা ছিল, আমরা তা পারিনি। এ দায় আমাদের প্রায় সবার, আমরা যারা নজরুলকে বাঙালির স্বাতন্ত্র্যসূচক স্বাধীন সত্তার প্রবক্তা বলে মনে করি।
কৈশোরেই তিনি শিল্পের তালিম নেন, আর তারপর পরই নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন। তারপর সেই তিরিশের দশক থেকে এ পর্যন্ত মূলত নজরুল সঙ্গীতের চর্চা, সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও বিশুদ্ধায়নে সমার্পিত ছিলেন। জানা যায়, প্রায় ১ হাজার ৬০০ নজরুল সঙ্গীত গেয়েছেন তিনি আর এর প্রায় সবগুলোই রেকর্ড আকারে সংরক্ষিত। অর্থাৎ নজরুল রচিত, সুরারোপিত ও গীত প্রায় সব গানই তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন এবং প্রামাণ্য রূপ দিয়েছেন। এদিক থেকে বিবেচনা করে আমরা তাকে নজরুল সঙ্গীতের জীবন্ত রেকর্ড বলে মনে করতাম। দেখা গেছে, গানের সুর বা বাণীর কোনো মতভেদ দেখা দিলে তিনিই ছিলেন গ্রাহ্য সমাধান। আর এ-কারণে নজরুল ইন্সটিটিউটে শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সঙ্গীত চর্চা ও প্রমিতকরণের জন্য সরকার নিযুক্ত যে কমিটি আছে, সুস্থ ও কর্মক্ষম অবস্থায় তিনিই ছিলেন তার সভানেত্রী। তার তিরোধানের ফলে এ-ক্ষেত্রে যে অপূর্ণতা সৃষ্টি হল, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। নজরুল গান কেবল কাব্যগীতি নয়, রাগশাসিতও বটে। তার গান গাইতে হলে গানের বাণী, মর্মার্থ ও সুরের মধ্যে একটি ভারসাম্যময় যোগাযোগ প্রয়োজন। প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি। জানা যায়, কমল দাশগুপ্ত ও নজরুলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কোনো কোনো গান পূর্ণাঙ্গভাবে রপ্ত করে পরিবেশন করতে তিনি মাসাধিককাল সময়ও ব্যয় করেছেন। এই নিষ্ঠা ও সাধনা এ-কালে দুর্লক্ষ্য। তাই ফিরোজা বেগমকে নজরুলের অনুকরণীয় শিল্পী হিসেবে নমস্য মানবেন উত্তর প্রজন্মের শিল্পীরা। বলা যেতে পারে, নজরুল সঙ্গীত শিল্পীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা পথিকৃতের।
তার শিল্পীসত্তার আরেক উপাদান তার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করা তার স্বভাবজাত ছিল না। তাই নানা সময়ে তিনি ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছেন। কিন্তু ইতিবাচক দিকটি এই যে, সবকিছু সত্ত্বেও তিনি সর্বমহলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন। বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে তার ক্ষেত্রেই সর্বাগ্রে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিধাটি প্রযোজ্য বলে মনে করি। তাকে সম্মান জানিয়ে তার স্মৃতিতে এমন একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা যায়, যা হবে নজরুল সঙ্গীত চর্চার জন্য শ্রেষ্ঠ সম্মান ও স্বীকৃতি। একটি বিশদ ও সুসম্পাদিত স্মারকগ্রন্থে তার জীবন ও সাধনা দলিলায়িত করে রাখাও আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। প্রয়াত ফিরোজা বেগমকে ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব তো আমাদেরই। ‘আমায় নহে গো, ভালোবাসো মোর গান’। না, আমরা অভিমানী সম্রাজ্ঞীর এ অভিমানকে মান্য করব না। আমরা ভালোবাসব তাকেও, তার গানকেও। আমরা বলব, তোমার শ্রেষ্ঠ কীর্তি তোমার গান; আর তুমি যথার্থই তোমার কীর্তির সমান। উত্তর প্রজন্মের নজরুল-সাধকদের পক্ষ থেকে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
No comments