জামালের আন্দোলনের বেগ চেপেছে by নেয়ামতউল্যাহ
বাংলা
স্কুল মাঠ। শত শত মানুষ। মিছিল আসছে... আর আসছে। সকলের একই দাবি, ‘মেঘনার
পাড়ে ব্লক ফেলে ভাঙন প্রতিরোধ করতে হবে!’ ভোলার বাঘা বাঘা রাজনৈতিক বক্তারা
জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী এসে এক্ষুনি মেঘনার
পাড়ে ব্লক ফেলে দেবেন। মেঘনা পাড়ের মানুষের আর কোনো সমস্যা থাকবে না। আর
কোনো মানুষ তাদের সাত পুরুষের শত স্মৃতিময় ভিটেঘর হারাবে না, হারাবে না
প্রিয় মানুষের ভালোবাসা, হারাবে না একান্নবর্তী পরিবার, মানুষ আর উদ্বাস্তু
হবে না। কেউ এ আন্দোলনকে সাধু-সাধু বলছে। কেউ করছে তিরস্কার! সত্তরোর্ধ্ব
এক বৃদ্ধ বলছেন, ‘গুড়া কালেত্তোন দেহি মাইনষে ভাঙনে ব্যাক ক্ষুয়াইতেছে,
সরকার সত্তুর বছরে কিছুই করতে পারে, নো, আর এইতেরা এ্যান করি কতা কো, মনে
অয় নদী আর ভাইংতোনো, ভাঙগোন পোরতিরোদ চায়, আমার বাল হালাইন্যা হুরুষ হোলা
হগল!’ বলতে বলতে গড-গড করে হাঁটছে। আলতাজের রহমান রোডের বাসিন্দা জামাল এসে
উটের মতো গলা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলা স্কুলের মাঠের পাশে সৃষ্টিতলায়।
এখানে ভোলার বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-সংস্কৃতিক কর্মীরা আড্ডা দেয়। জামালের
শরীর মন কিছু ভালো নেই। সকাল থেকে কুকুরের মতো দৌড়োচ্ছে। দৌড়তে দৌড়তে পেট
চো-চো করছে। গত দুদিন আগে ঘুম থেকে উঠেই দেখে, তার রিকশাটি নেই। খোঁজখবর
নিয়ে যা বোঝা গেল, তার অর্থ ‘রিকশাটি আসলে চুরি হয়েছে’। শহরে চুরি-চামারি
বেড়ে গেছে, দিনে-দুপুরে চুরি হচ্ছে, সাংবাদিকের, রাজনীতিবিদদের মোটরসাইকেল
চুরি হচ্ছে, ঘরের বারান্দা থেকে চুরি হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারীরা ইদানীং
সালিশ-বিচারে নেমেছে- তারা চোর ডাকাত ধরা ছেড়ে দিয়েছে সাধারণের ধারণা।
‘এইসব চুরির লগে পুলিশরাই জড়িত’, আয়েশ করে চা খেতে খেতে বলল, চায়ের জটলা;
যারা আসলে জনগণ-তারা প্রধানমন্ত্রীকেও গাল দেয়, ডিসিকেও গাল দেয়; ওদের
দারুণ সুবিধা। পুলিশও তেমনি পাঠামো সব উত্তর দিচ্ছে। বলছে, ‘চুরি গেলে কি
আর মাল ফেরত পাওয়া যায়, মামলা কইর্যা কি অইবো!’ এ কথা পুলিশ জামালকে
বলেনি; সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদকে বলেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা জামালকে বলেছে
একটু অন্য ভাষায়। রিকশাটি খুঁজে দিতে জামাল যখন পুলিশের নিকট একটু শক্ত
দাবি করছিল, তখন পুলিশ বলেছে, ‘হমুন্দির পোলা, আগে দ্যাশ না খুইজ্যা আইছো
মোগো দারে, চোরে চুরি হইর্যা মোগো ধারে জামানত থুইয়্যা যায়, অ্যা, এমুন
পিডান পিডামু বাপের নাম মোনে থাকবে না, বোজ্জো।’ জামালকে দু-চার ঘা লাগাতেও
ছাড়েনি। সেই থেকে জামালের দৌড় শুরু হয়েছে।
বিকাল ৪টা। দুপুরে খাওয়া হয়নি জামালের। বাসায় যেতে ভয় করছে। বৌ ঘরে ঢুকতে দেবে না। মারধরও করতে পারে। গত ১০ বছর আগে বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে রিকশাটি পেয়েছিল জামাল। তাই চালিয়ে কোন রকম চলছে; সংসারও চালাচ্ছে। চলছে বললে ভুল হবে, জামালকে চালানো হচ্ছে। জামালের বৌ সুন্দরী পুরুষ ধরনের মহিলা। জামালকে সে চালায়। সন্তানাদি কিছু হয়নি।
সৃষ্টিতলায় দাঁড়িয়ে নেতাদের লম্বা লম্বা বক্তৃতা শুনে, জামাল বুঝেছে, আন্দোলন করলে সব কিছু পাওয়া যায়। সে মহিউদ্দিনকে বলল, ‘বাইয়্যা আমার রিকশাডা পাইতাছি না, কাইল বেহান রাইতে চুরি অইয়্যা গেছে, পুলিশের দারে গেছিলাম, পাত্তা দেয়নো যে... উল্টা পিডাইছে, ও মহিউদ্দিন বাই! এই বিষয়ে এট্টু আন্দোলন করা যাইবো না যে...? ও মহিদ্দিন বাই! বৌ পিডাইবো, হুনতাছেন? এট্টু আন্দোলন...’ শেষ বাক্য শেষ করতে পারে না। মহিউদ্দিন খিঁচরে ওঠে, ‘এই কুত্তার ছাও এনে পোন দিতে আইছোস! যা, আন্দোলন কর, নাইলে তোর বোউরে খানকি বানা, আমারে জিগাছ ক্যা। যা... ভাগ।’ জামাল চুপ করে আবার বলে, ‘মহিউদ্দিন বাই খালি চেইত্তা যাও, এট্টা ভালা পরামিশ দিবো না, খালি চেইত্তা যায়। আমার বৌ পিডাইব, এট্টু আন্দোল’... এট্টু আন্দোলন! ‘ও মহিদ্দিন ভাই’।
মহিউদ্দিন বাংলা স্কুলের মোড়ে সৃষ্টি তলার চা বিক্রেতা। মিছিল-মিটিং আন্দোলন হলে মহিউদ্দিন ক্ষেপে যায়। কারণ নেতারা চা খেয়ে টাকা দেয় না, পরে! বলে সব সটকে পড়ে। মহিউদ্দিনও এক সময় রাজনীতি করত। রাজনীতি করতে গিয়ে বুঝেছে, গরীবের জন্য রাজনীতি নয়। সে এখন চা বিক্রেতা সঙ্গে কৃষক। জামালের উপর ক্ষেপে গাল-মন্দ করে নিজের মনে বলে, ‘পুরান পাগলে বাত পায় না, নতুন পাগলের আমদানী’। আবার জোরে বলে, ‘এই বাড়ি কুডে? যা! বাড়িত যা’। জামালকে মহিউদ্দিনের পাগলই মনে হয়েছে। রিকশা চুরি হলে কেউ আন্দোলন করে?
আন্দোলন হয় নেতাদের সমস্যা নিয়ে; দেশের বৃহত্তর জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য। কিন্তু রিকশা চুরি হলে তা নিয়ে কেউ আন্দোলন করে? মনকে এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে মহিউদ্দিনের মন থেকে উত্তর এলো, ‘হ, এইডা লইয়্যাও আন্দোলন অইতে পারে, রিকশা না থাকলে ওই ব্যাডা কামাই করবো কেমনে? খাইবো কি? ওই ব্যাডার সংসার চলবো কেমনে? ওই বেডার পোলাইন কি খাইয়্যা স্কুল যাইবো? স্কুল না গেলে জাতি শিক্ষিত অইয়্যা উঠবো ক্যামনে? মহিউদ্দিনের মনে আরও প্রশ্ন জাগান দিয়ে ওঠে। কিন্তু এরই মধ্যে এক নেতা এসে চা চায়। বলে, ‘মহিদ্দিন এট্টা নেবি সিগারেটও দিয়ো’!
মহিউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘টিয়া কিন্তুক নগদ দেওন লাগবো, আইজ বাকি নাই।’ আবার নিজে মনে মনে বলে, ‘খাইয়্যা খালি দোর দেয়, কি ব্যস্ত নেতারে আমার, খালি টিয়া মারোনের মতলব!’
পাঁচ টাকার একটা কয়েন ফিঁকে দিয়ে নেতা বলে, ‘ওই মহিদ্দিন্না! টিয়া দিমনা কইছি, এই ল নগদ পাঁচ টিয়া।’
মহিদ্দিন চা ঘুটতে ঘুটতে বলে, ‘আরও তিন টিয়া লাগবো, চা-ই পাঁচ টিয়া’।
নেতা বলে, ‘কচ কি হালার পুত! দমে দমে চা’র দাম বারাছ, দেশটায় কি লাগলো?’ গাল-মন্দ মহিউদ্দিনের যায় আসে না। গা সওয়া হয়ে গেছে। সে এক হাতে নেতাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে অন্য হাতে পাছা চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘দমে দমে ত্যালের দাম বাড়ান, মালের দাম বারবো না, মালকি নদী দিয়া ভাইস্যা আইয়্যে? ’
জামাল মাথা চুলকাতে চুলকাতে কোন কথা না বলে প্রতিবাদ সমাবেশের দিকে এগিয়ে যায়। এই মাত্র মাঠে আসা ধনিয়ার মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে কুতুব মিয়া ঘেমে গেছেন। শহীদ মিনারের পাশে আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গা মুছছেন। পাশে দাঁড়ানো কর্মীদের বলছেন, ‘ব্যাডা! আন্দোলন ছাড়া কিছু অয়? আর ব্যক্কের কতায় মানুষও আইয়্যেওনা, আমি না আইলে বাইন্যা কান্দিরতোন পাউচগাঁও আইতো না।’
জামাল কাচুমাচু করে কুতুব মিয়ার পাশে দাঁড়ায়; বলে, ‘মিয়া বাই, আমনে ঠিক কতা কইছেন! আন্দোলন ছাড়া কিছু অয় না, আমি এট্টা কতা কইতাম যে, আমার এট্টা রিকশা...।’
কুতুব মিয়া জামালের পুরো কথা না শুনে খেঁকিয়ে উঠে বলে, ‘ওই মিয়া কাম কইর্যা খাইতা পারো না, খরাত করতো আইছো, হালার মাইনষের কোন আক্কোল-জ্ঞান নাই, জোয়ান ব্যাডা খরাত করে, লাজ-শরমের মাতা খাইছে, যাও মিয়া ভাগো, তোমারে খরাত দিলে আল্লায় নারাজ অইবো! যাও!’
জামাল প্রতিবাদ সমাবেশে যার কাছেই গেছে, সেই তাকে ভিক্ষুক ভেবে তাড়িয়ে দিয়েছে। অবজ্ঞা করেছে। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আবার লম্বা লম্বা ভাষণে বলছে, ‘আন্দোলন ছাড়া কিছু হয় না, এ সমস্যা সমাধানে কঠোর আন্দোলনে নামতে হবে।’
সকাল থেকে জামালের পেটে কিছু পড়েনি। লুঙ্গির ট্যাকে কিছু টাকা আছে। কিন্তু সেটি খরচ করতে মায়া লাগছে। শেষ হলে তো শেষ। সমাবেশ শেষে মানুষজন শহরে বিক্ষোভ নিয়ে বের হয়। সামনে থাকেন বড় নেতারা। সাংবাদিকরা ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাংবাদিকের ছবি তোলা শেষ হলে নেতারা কেটে পড়েন। অনেক নেতা শুধু আন্দোলনের অভিনয় করেন, আর সাংবাদিকরা সে ছবি ফলাও করে পত্রিকায় ছাপেন। পরের দিন নেতা নিজের ছবি ৃপত্রিকার পাতায় দ্যাখেন আর হাসেন। পকেটে একটা থাবা দিয়ে মনে-মনে সাংবাদিকের মা-বোন তুলে গালাগাল দিয়ে ঠাট্টা করেন।
এক সময় বাংলা স্কুলের মাঠ আর ভোলা সদর রোডের ব্যস্ততা কমে যায়। জামাল শূন্য শহীদ মিনারের উপর বসে থাকে। শহরে যেমনি বেড়েছে ময়লা-আবর্জনা, তেমনি বেড়েছে মশা। মশার চেহারাও পাল্টে গেছে। বিদ্যুতের আলোয় হোক, ডিজিটাল কয়েলের ছোয়ায় হোক, মশাগুলোর চেহারায় একটা আভিজাত্য বেড়েছে। ঠিক মশা মশা মনে হয় না। শরীরে বসে রক্ত খাচ্ছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না; রক্ত খাচ্ছে, খাচ্ছে; রক্ত খাওয়া হয়ে গেলে বোঝা যাচ্ছে, ‘খেয়ে গেলো! অনেকটা আধুনিক নেতাদের মতো। জোর নাই-জুলুম নাই, শুধু ফোনে ফোনে হেসে হেসে লুটপাট। অথচ জামালের পাতে ভাত নাই। জামাল ঘরে রাতে যে মশারি খাটিয়ে শোয়, তাতে শত তালি। মশারিতে তালি বেশি দিন টেকসই হয় না। সিনথেটিকের মশারি তো! তাই ওই ফাঁক গলে দু’একটা মশা ঢুকে পড়ে। সকালে দেখা যায়, মশারির ভাঁজে-ভাঁজে রক্ত ভরা পেট নিয়ে মশা সব আয়েশ করে ঘুমোচ্ছে।
মশার কামড় খেয়েই শহীদ মিনারে বসে বসে জামালের ক্লান্ত শরীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অবসন্ন জাগ্রত দেহে যখন মশারা রক্ত খাচ্ছিল তখন বুঝতে পারছিল যে, মশা কামড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার পড়ে আর টের পায়নি।
জামাল রাতে স্বপ্ন দেখল। পুলিশ তাকে তাড়া করছে। তাকেই ‘রিকশা চোর’ বলে ভদ্র-শান্ত পুলিশ ধাওয়া করছে। পুলিশের পেছনে তার স্ত্রী। জামাল ঘুমের মধ্যে দৌড়তে পারেনা । তার ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ তার পেটে কামড় দিয়ে ওঠে। পায়খানার বেগ চেপেছে। কিন্তু কোথায় পায়খানা করবে। চারপাশে পাকা বিল্ডিং। পাকা বারান্দা। টয়লেটে তালা। শহীদ মিনারের পেছনে বসতে পারে। যদি কেউ দেখে ফেলে। নাইট গার্ড আছে। জামাল শহীদ মিনারের চারপাশ ঘোরে। এক সময় সেখান থেকে সরে আসে। টয়লেটের সামনে একটা আড়াল পায়, সেখানেই বসে পড়ে। কিন্তু বড্ড গন্ধ। সমাবেশে আসা হাজার হাজার লোক সব এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন খুলে আর লুঙ্গি উঁচিয়ে বসে পড়েছে। পেট চিন চিন করে ওঠে, না বসে আর উপায় থাকে না। সারা দিন ভাত জোটেনি। তবুও খুদা মেটাতে ছাই-পাশ যা পেয়েছে, খেয়েছে। এখন চাপ দিয়েছে। জামাল লুঙ্গি খুলে নাক চেপে বসে পড়ে।
২.
বোর...র...রোৎ করে জামাল বিকট আওয়াজ তুলে বাংলা স্কুলের টয়লেটে যাওয়ার পথটির মাঝে গন্ধযুক্ত পায়খানায় তলিয়ে দেয়। টুস-টাস আওয়াজ করে। উ...হু...উম...আল্লা...! পেট চেপে ধরে। লুঙ্গিটা মাথায় পেঁচানো। পেটের ব্যথায় নাকের হাতটি পেটে চলে আসে। চেপে চেপে হাগু বের করে কুত কুত শব্দে। এক সময় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় জামাল। ব্যথাটা কমে আসে পেটের। তার নাকে আর কোনো দুর্গন্ধ আসছে না। মনে হচ্ছে নিজের গুয়ের টক টক গন্ধ সত্যিই গ্রহণযোগ্য। হাতের কাছে পানি নেই। আশপাশে পাতা খুঁজতে থাকে পাছাটা মোছার জন্য। কিন্তু অন্ধকারে কিছু খুঁজে পায় না। উঠে দাঁড়ানোর পরে একটু গা ঘিন ঘিন লাগে। পা টপকে টপকে বের হয়। আকাশে মেঘের আলো-লুকোচুরি খেলা। সে আবছায়া আলোয় মাঠ পেরিয়ে জামাল চলে আসে পশ্চিমের পুকুর ঘাটে। এর নাম বাংলাস্কুল পুকুর। স্কুল মাঠের পাশে শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে জামালের মনে পড়ে প্রতিদিন ঘাটে বসা স্বপ্নবাজ, আড্ডাবাজ ভোলাইয়া পোলাগো কথা। তারা প্রতিদিন মেলা করে ওই ঘাটে বসে। বিকালে শীতল বাতাস খেতে খেতে তারা গল্পের ঝুড়ি, আর দেশ মাতৃকার সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর পুকুরের জলে ভেসে থাকা শাপলা কিংবা পদ্ম পাতা, নয়তো কাঠের টুকরোর উপরে খেলা করা ব্যাঙ-কচ্ছপের সাঁতার দেখে। জলজ প্রাণী জলে খাবার খায়, বিপদ সংকেতে ডুব সাঁতারে জলের ভেতর ধাঁয়। আড্ডাবাজগুলো বিকালের আকাশের পাখি দেখে। শত শত শাদা বক, পানকৌড়ি, চখাচখি। মাঝে-মাঝে এ পুকুরকে দখলদারের হাত থেকে বাঁচাতে আন্দোলন করে। কখনও মানববন্ধন, কখনও বিক্ষোভ, কখনওবা স্মারকলিপি পেশ। এসব আন্দোলনের সময় জামালের রিকশা সড়কের কিনারে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। জামালের মনে হয়, একটি পুকুরকে বাঁচাতে যদি আন্দোলন করা যায়, তাহলে তার রিকশাটি উদ্ধারে কেন আন্দোলন হবে না? জামাল এক পা, দু’পা করে যখন জলডোবা সিঁড়িতে পা দিয়েছে তখনই তার মনে হয়েছে আজ সারা দিন গোসল হয়নি। শরীর বড্ড পানির সান্নিধ্য চায়। সে আবার উঠে আসে। পরিধানের লুঙ্গি-গামছা আর গেঞ্জি শান বাঁধানো বসার বেঞ্চের উপর রাখে। তারপরে ন্যাংটো নেমে যায় জলের তলায়। আহ! পরম শান্তি। ঘষে ঘষে শরীর মাজে। জলে ভেসে বিদ্যুতের আলোয় জামাল দেখে, পুকুরটি চারপাশ থেকে দখল হয়ে গেছে, সেখানে বড় বড় আকাশছোঁয়া বিল্ডিং উঠেছে। কত বড় পুকুর দিনে দিনে ছোট হচ্ছে। হয়তো এক সময় এ পুকুর থাকবে না। জামালের এসব দেখে মনে প্রশ্ন হয়, যারা পুকুরটি বাঁচাবে তারা কেন পুকুরটি দখলমুক্ত করছে না? তাদের মনে হয় পুকুর-টুকুর পছন্দ না। কিছু ফালতু মানুষ অকারণেই আন্দোলনে নেমেছে। যেমন সে নিজেও ফালতু রিকশা খুঁজে পাওয়া আর পুলিশের আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাইছে।
জামালের লম্বা একটা ঘুম হয়েছে। সূর্যের আলো চোখে ও শরীরে পড়ে তাপ বিকিরণের পরই তার ঘুম ভেঙেছে। রাতে গোসল করে শহীদ মিনারে শুয়ে পড়লে ক্ষুধা আর মশার কামড়ে ঘুম আসছিল না। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য সে কোমর থেকে লুঙ্গির বাঁধন আলগা করে, সমস্ত শরীর হাত-পা একত্র করে গুটি-শুটি মেরে লুঙ্গি দিয়ে ঢেকে দেয়। এতে খিদেও কিছুটা কম অনুভব হয়। পেট থেকে বের হয় রাজ্যের হাওয়া। শরীরটাকে মনে হয় নির্ভার। এলোমেলো চিন্তা আসে; তার স্ত্রী সুরমা, রিকশা, পুলিশ এবং আন্দোলনকে নিয়ে। রিকশা চালাতে গিয়ে মানুষের মন্দ-বকুনি জীবনে কম সহ্য করেনি। অনেকে কারণে-অকারণে শরীরে হাত পর্যন্ত তুলেছে। তার একটা সময় মনে হয়েছে পশুদের প্রকারভেদ আছে, মানুষের মধ্যেও প্রকারভেদ আছে। কেউ কুকুর প্রজাতির, কেউ বাঘ, কেউ ছাগল, কেউ হায়না, কেউ শেয়াল প্রজাতির। আবার কেউ মানুষ প্রজাতিরও আছে। তারা প্রকৃত মানুষ। তবে দুঃখ হচ্ছে পশুদের চেহারা বাইরে থেকে ধরা যায় বলে সাবধানতা অবলম্বন করা যায়। কিন্তু মানুষের এক চেহারা হওয়ায় ধরা যায় না, পড়া যায় না। তাই সে পশুর চেয়ে ভয়ংকর। তাই তো জামাল এক সময় নিজেদের কুকুর বিড়াল প্রজাতি মনে করে বাঘ-শেয়ালের নির্যাতন মেনে নিয়েছে। কিন্তু আজ কেন মানতে পারছে না, আজ কেন মনে হচ্ছে তার একটা প্রতিবাদ করা দরকার, আন্দোলন করা দরকার। আজ একবার মানুষ হতে ইচ্ছে করছে। আর মানুষ হওয়ার বাসনায় জামালের শরীর কেঁপে উঠল। সে থর থর কাঁপতে শুরু করে। তার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। সকালে উঠে দেখে শরীরের লুঙ্গি সরে গেছে, ইজ্জতের সঙ্গে কোমরে টাকা-পয়সাও আরেকটু হলে হারাতে বসেছিল।
বিকাল ৪টা। দুপুরে খাওয়া হয়নি জামালের। বাসায় যেতে ভয় করছে। বৌ ঘরে ঢুকতে দেবে না। মারধরও করতে পারে। গত ১০ বছর আগে বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে রিকশাটি পেয়েছিল জামাল। তাই চালিয়ে কোন রকম চলছে; সংসারও চালাচ্ছে। চলছে বললে ভুল হবে, জামালকে চালানো হচ্ছে। জামালের বৌ সুন্দরী পুরুষ ধরনের মহিলা। জামালকে সে চালায়। সন্তানাদি কিছু হয়নি।
সৃষ্টিতলায় দাঁড়িয়ে নেতাদের লম্বা লম্বা বক্তৃতা শুনে, জামাল বুঝেছে, আন্দোলন করলে সব কিছু পাওয়া যায়। সে মহিউদ্দিনকে বলল, ‘বাইয়্যা আমার রিকশাডা পাইতাছি না, কাইল বেহান রাইতে চুরি অইয়্যা গেছে, পুলিশের দারে গেছিলাম, পাত্তা দেয়নো যে... উল্টা পিডাইছে, ও মহিউদ্দিন বাই! এই বিষয়ে এট্টু আন্দোলন করা যাইবো না যে...? ও মহিদ্দিন বাই! বৌ পিডাইবো, হুনতাছেন? এট্টু আন্দোলন...’ শেষ বাক্য শেষ করতে পারে না। মহিউদ্দিন খিঁচরে ওঠে, ‘এই কুত্তার ছাও এনে পোন দিতে আইছোস! যা, আন্দোলন কর, নাইলে তোর বোউরে খানকি বানা, আমারে জিগাছ ক্যা। যা... ভাগ।’ জামাল চুপ করে আবার বলে, ‘মহিউদ্দিন বাই খালি চেইত্তা যাও, এট্টা ভালা পরামিশ দিবো না, খালি চেইত্তা যায়। আমার বৌ পিডাইব, এট্টু আন্দোল’... এট্টু আন্দোলন! ‘ও মহিদ্দিন ভাই’।
মহিউদ্দিন বাংলা স্কুলের মোড়ে সৃষ্টি তলার চা বিক্রেতা। মিছিল-মিটিং আন্দোলন হলে মহিউদ্দিন ক্ষেপে যায়। কারণ নেতারা চা খেয়ে টাকা দেয় না, পরে! বলে সব সটকে পড়ে। মহিউদ্দিনও এক সময় রাজনীতি করত। রাজনীতি করতে গিয়ে বুঝেছে, গরীবের জন্য রাজনীতি নয়। সে এখন চা বিক্রেতা সঙ্গে কৃষক। জামালের উপর ক্ষেপে গাল-মন্দ করে নিজের মনে বলে, ‘পুরান পাগলে বাত পায় না, নতুন পাগলের আমদানী’। আবার জোরে বলে, ‘এই বাড়ি কুডে? যা! বাড়িত যা’। জামালকে মহিউদ্দিনের পাগলই মনে হয়েছে। রিকশা চুরি হলে কেউ আন্দোলন করে?
আন্দোলন হয় নেতাদের সমস্যা নিয়ে; দেশের বৃহত্তর জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য। কিন্তু রিকশা চুরি হলে তা নিয়ে কেউ আন্দোলন করে? মনকে এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে মহিউদ্দিনের মন থেকে উত্তর এলো, ‘হ, এইডা লইয়্যাও আন্দোলন অইতে পারে, রিকশা না থাকলে ওই ব্যাডা কামাই করবো কেমনে? খাইবো কি? ওই ব্যাডার সংসার চলবো কেমনে? ওই বেডার পোলাইন কি খাইয়্যা স্কুল যাইবো? স্কুল না গেলে জাতি শিক্ষিত অইয়্যা উঠবো ক্যামনে? মহিউদ্দিনের মনে আরও প্রশ্ন জাগান দিয়ে ওঠে। কিন্তু এরই মধ্যে এক নেতা এসে চা চায়। বলে, ‘মহিদ্দিন এট্টা নেবি সিগারেটও দিয়ো’!
মহিউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘টিয়া কিন্তুক নগদ দেওন লাগবো, আইজ বাকি নাই।’ আবার নিজে মনে মনে বলে, ‘খাইয়্যা খালি দোর দেয়, কি ব্যস্ত নেতারে আমার, খালি টিয়া মারোনের মতলব!’
পাঁচ টাকার একটা কয়েন ফিঁকে দিয়ে নেতা বলে, ‘ওই মহিদ্দিন্না! টিয়া দিমনা কইছি, এই ল নগদ পাঁচ টিয়া।’
মহিদ্দিন চা ঘুটতে ঘুটতে বলে, ‘আরও তিন টিয়া লাগবো, চা-ই পাঁচ টিয়া’।
নেতা বলে, ‘কচ কি হালার পুত! দমে দমে চা’র দাম বারাছ, দেশটায় কি লাগলো?’ গাল-মন্দ মহিউদ্দিনের যায় আসে না। গা সওয়া হয়ে গেছে। সে এক হাতে নেতাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে অন্য হাতে পাছা চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘দমে দমে ত্যালের দাম বাড়ান, মালের দাম বারবো না, মালকি নদী দিয়া ভাইস্যা আইয়্যে? ’
জামাল মাথা চুলকাতে চুলকাতে কোন কথা না বলে প্রতিবাদ সমাবেশের দিকে এগিয়ে যায়। এই মাত্র মাঠে আসা ধনিয়ার মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে কুতুব মিয়া ঘেমে গেছেন। শহীদ মিনারের পাশে আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গা মুছছেন। পাশে দাঁড়ানো কর্মীদের বলছেন, ‘ব্যাডা! আন্দোলন ছাড়া কিছু অয়? আর ব্যক্কের কতায় মানুষও আইয়্যেওনা, আমি না আইলে বাইন্যা কান্দিরতোন পাউচগাঁও আইতো না।’
জামাল কাচুমাচু করে কুতুব মিয়ার পাশে দাঁড়ায়; বলে, ‘মিয়া বাই, আমনে ঠিক কতা কইছেন! আন্দোলন ছাড়া কিছু অয় না, আমি এট্টা কতা কইতাম যে, আমার এট্টা রিকশা...।’
কুতুব মিয়া জামালের পুরো কথা না শুনে খেঁকিয়ে উঠে বলে, ‘ওই মিয়া কাম কইর্যা খাইতা পারো না, খরাত করতো আইছো, হালার মাইনষের কোন আক্কোল-জ্ঞান নাই, জোয়ান ব্যাডা খরাত করে, লাজ-শরমের মাতা খাইছে, যাও মিয়া ভাগো, তোমারে খরাত দিলে আল্লায় নারাজ অইবো! যাও!’
জামাল প্রতিবাদ সমাবেশে যার কাছেই গেছে, সেই তাকে ভিক্ষুক ভেবে তাড়িয়ে দিয়েছে। অবজ্ঞা করেছে। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আবার লম্বা লম্বা ভাষণে বলছে, ‘আন্দোলন ছাড়া কিছু হয় না, এ সমস্যা সমাধানে কঠোর আন্দোলনে নামতে হবে।’
সকাল থেকে জামালের পেটে কিছু পড়েনি। লুঙ্গির ট্যাকে কিছু টাকা আছে। কিন্তু সেটি খরচ করতে মায়া লাগছে। শেষ হলে তো শেষ। সমাবেশ শেষে মানুষজন শহরে বিক্ষোভ নিয়ে বের হয়। সামনে থাকেন বড় নেতারা। সাংবাদিকরা ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাংবাদিকের ছবি তোলা শেষ হলে নেতারা কেটে পড়েন। অনেক নেতা শুধু আন্দোলনের অভিনয় করেন, আর সাংবাদিকরা সে ছবি ফলাও করে পত্রিকায় ছাপেন। পরের দিন নেতা নিজের ছবি ৃপত্রিকার পাতায় দ্যাখেন আর হাসেন। পকেটে একটা থাবা দিয়ে মনে-মনে সাংবাদিকের মা-বোন তুলে গালাগাল দিয়ে ঠাট্টা করেন।
এক সময় বাংলা স্কুলের মাঠ আর ভোলা সদর রোডের ব্যস্ততা কমে যায়। জামাল শূন্য শহীদ মিনারের উপর বসে থাকে। শহরে যেমনি বেড়েছে ময়লা-আবর্জনা, তেমনি বেড়েছে মশা। মশার চেহারাও পাল্টে গেছে। বিদ্যুতের আলোয় হোক, ডিজিটাল কয়েলের ছোয়ায় হোক, মশাগুলোর চেহারায় একটা আভিজাত্য বেড়েছে। ঠিক মশা মশা মনে হয় না। শরীরে বসে রক্ত খাচ্ছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না; রক্ত খাচ্ছে, খাচ্ছে; রক্ত খাওয়া হয়ে গেলে বোঝা যাচ্ছে, ‘খেয়ে গেলো! অনেকটা আধুনিক নেতাদের মতো। জোর নাই-জুলুম নাই, শুধু ফোনে ফোনে হেসে হেসে লুটপাট। অথচ জামালের পাতে ভাত নাই। জামাল ঘরে রাতে যে মশারি খাটিয়ে শোয়, তাতে শত তালি। মশারিতে তালি বেশি দিন টেকসই হয় না। সিনথেটিকের মশারি তো! তাই ওই ফাঁক গলে দু’একটা মশা ঢুকে পড়ে। সকালে দেখা যায়, মশারির ভাঁজে-ভাঁজে রক্ত ভরা পেট নিয়ে মশা সব আয়েশ করে ঘুমোচ্ছে।
মশার কামড় খেয়েই শহীদ মিনারে বসে বসে জামালের ক্লান্ত শরীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অবসন্ন জাগ্রত দেহে যখন মশারা রক্ত খাচ্ছিল তখন বুঝতে পারছিল যে, মশা কামড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার পড়ে আর টের পায়নি।
জামাল রাতে স্বপ্ন দেখল। পুলিশ তাকে তাড়া করছে। তাকেই ‘রিকশা চোর’ বলে ভদ্র-শান্ত পুলিশ ধাওয়া করছে। পুলিশের পেছনে তার স্ত্রী। জামাল ঘুমের মধ্যে দৌড়তে পারেনা । তার ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ তার পেটে কামড় দিয়ে ওঠে। পায়খানার বেগ চেপেছে। কিন্তু কোথায় পায়খানা করবে। চারপাশে পাকা বিল্ডিং। পাকা বারান্দা। টয়লেটে তালা। শহীদ মিনারের পেছনে বসতে পারে। যদি কেউ দেখে ফেলে। নাইট গার্ড আছে। জামাল শহীদ মিনারের চারপাশ ঘোরে। এক সময় সেখান থেকে সরে আসে। টয়লেটের সামনে একটা আড়াল পায়, সেখানেই বসে পড়ে। কিন্তু বড্ড গন্ধ। সমাবেশে আসা হাজার হাজার লোক সব এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন খুলে আর লুঙ্গি উঁচিয়ে বসে পড়েছে। পেট চিন চিন করে ওঠে, না বসে আর উপায় থাকে না। সারা দিন ভাত জোটেনি। তবুও খুদা মেটাতে ছাই-পাশ যা পেয়েছে, খেয়েছে। এখন চাপ দিয়েছে। জামাল লুঙ্গি খুলে নাক চেপে বসে পড়ে।
২.
বোর...র...রোৎ করে জামাল বিকট আওয়াজ তুলে বাংলা স্কুলের টয়লেটে যাওয়ার পথটির মাঝে গন্ধযুক্ত পায়খানায় তলিয়ে দেয়। টুস-টাস আওয়াজ করে। উ...হু...উম...আল্লা...! পেট চেপে ধরে। লুঙ্গিটা মাথায় পেঁচানো। পেটের ব্যথায় নাকের হাতটি পেটে চলে আসে। চেপে চেপে হাগু বের করে কুত কুত শব্দে। এক সময় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় জামাল। ব্যথাটা কমে আসে পেটের। তার নাকে আর কোনো দুর্গন্ধ আসছে না। মনে হচ্ছে নিজের গুয়ের টক টক গন্ধ সত্যিই গ্রহণযোগ্য। হাতের কাছে পানি নেই। আশপাশে পাতা খুঁজতে থাকে পাছাটা মোছার জন্য। কিন্তু অন্ধকারে কিছু খুঁজে পায় না। উঠে দাঁড়ানোর পরে একটু গা ঘিন ঘিন লাগে। পা টপকে টপকে বের হয়। আকাশে মেঘের আলো-লুকোচুরি খেলা। সে আবছায়া আলোয় মাঠ পেরিয়ে জামাল চলে আসে পশ্চিমের পুকুর ঘাটে। এর নাম বাংলাস্কুল পুকুর। স্কুল মাঠের পাশে শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে জামালের মনে পড়ে প্রতিদিন ঘাটে বসা স্বপ্নবাজ, আড্ডাবাজ ভোলাইয়া পোলাগো কথা। তারা প্রতিদিন মেলা করে ওই ঘাটে বসে। বিকালে শীতল বাতাস খেতে খেতে তারা গল্পের ঝুড়ি, আর দেশ মাতৃকার সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর পুকুরের জলে ভেসে থাকা শাপলা কিংবা পদ্ম পাতা, নয়তো কাঠের টুকরোর উপরে খেলা করা ব্যাঙ-কচ্ছপের সাঁতার দেখে। জলজ প্রাণী জলে খাবার খায়, বিপদ সংকেতে ডুব সাঁতারে জলের ভেতর ধাঁয়। আড্ডাবাজগুলো বিকালের আকাশের পাখি দেখে। শত শত শাদা বক, পানকৌড়ি, চখাচখি। মাঝে-মাঝে এ পুকুরকে দখলদারের হাত থেকে বাঁচাতে আন্দোলন করে। কখনও মানববন্ধন, কখনও বিক্ষোভ, কখনওবা স্মারকলিপি পেশ। এসব আন্দোলনের সময় জামালের রিকশা সড়কের কিনারে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। জামালের মনে হয়, একটি পুকুরকে বাঁচাতে যদি আন্দোলন করা যায়, তাহলে তার রিকশাটি উদ্ধারে কেন আন্দোলন হবে না? জামাল এক পা, দু’পা করে যখন জলডোবা সিঁড়িতে পা দিয়েছে তখনই তার মনে হয়েছে আজ সারা দিন গোসল হয়নি। শরীর বড্ড পানির সান্নিধ্য চায়। সে আবার উঠে আসে। পরিধানের লুঙ্গি-গামছা আর গেঞ্জি শান বাঁধানো বসার বেঞ্চের উপর রাখে। তারপরে ন্যাংটো নেমে যায় জলের তলায়। আহ! পরম শান্তি। ঘষে ঘষে শরীর মাজে। জলে ভেসে বিদ্যুতের আলোয় জামাল দেখে, পুকুরটি চারপাশ থেকে দখল হয়ে গেছে, সেখানে বড় বড় আকাশছোঁয়া বিল্ডিং উঠেছে। কত বড় পুকুর দিনে দিনে ছোট হচ্ছে। হয়তো এক সময় এ পুকুর থাকবে না। জামালের এসব দেখে মনে প্রশ্ন হয়, যারা পুকুরটি বাঁচাবে তারা কেন পুকুরটি দখলমুক্ত করছে না? তাদের মনে হয় পুকুর-টুকুর পছন্দ না। কিছু ফালতু মানুষ অকারণেই আন্দোলনে নেমেছে। যেমন সে নিজেও ফালতু রিকশা খুঁজে পাওয়া আর পুলিশের আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাইছে।
জামালের লম্বা একটা ঘুম হয়েছে। সূর্যের আলো চোখে ও শরীরে পড়ে তাপ বিকিরণের পরই তার ঘুম ভেঙেছে। রাতে গোসল করে শহীদ মিনারে শুয়ে পড়লে ক্ষুধা আর মশার কামড়ে ঘুম আসছিল না। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য সে কোমর থেকে লুঙ্গির বাঁধন আলগা করে, সমস্ত শরীর হাত-পা একত্র করে গুটি-শুটি মেরে লুঙ্গি দিয়ে ঢেকে দেয়। এতে খিদেও কিছুটা কম অনুভব হয়। পেট থেকে বের হয় রাজ্যের হাওয়া। শরীরটাকে মনে হয় নির্ভার। এলোমেলো চিন্তা আসে; তার স্ত্রী সুরমা, রিকশা, পুলিশ এবং আন্দোলনকে নিয়ে। রিকশা চালাতে গিয়ে মানুষের মন্দ-বকুনি জীবনে কম সহ্য করেনি। অনেকে কারণে-অকারণে শরীরে হাত পর্যন্ত তুলেছে। তার একটা সময় মনে হয়েছে পশুদের প্রকারভেদ আছে, মানুষের মধ্যেও প্রকারভেদ আছে। কেউ কুকুর প্রজাতির, কেউ বাঘ, কেউ ছাগল, কেউ হায়না, কেউ শেয়াল প্রজাতির। আবার কেউ মানুষ প্রজাতিরও আছে। তারা প্রকৃত মানুষ। তবে দুঃখ হচ্ছে পশুদের চেহারা বাইরে থেকে ধরা যায় বলে সাবধানতা অবলম্বন করা যায়। কিন্তু মানুষের এক চেহারা হওয়ায় ধরা যায় না, পড়া যায় না। তাই সে পশুর চেয়ে ভয়ংকর। তাই তো জামাল এক সময় নিজেদের কুকুর বিড়াল প্রজাতি মনে করে বাঘ-শেয়ালের নির্যাতন মেনে নিয়েছে। কিন্তু আজ কেন মানতে পারছে না, আজ কেন মনে হচ্ছে তার একটা প্রতিবাদ করা দরকার, আন্দোলন করা দরকার। আজ একবার মানুষ হতে ইচ্ছে করছে। আর মানুষ হওয়ার বাসনায় জামালের শরীর কেঁপে উঠল। সে থর থর কাঁপতে শুরু করে। তার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। সকালে উঠে দেখে শরীরের লুঙ্গি সরে গেছে, ইজ্জতের সঙ্গে কোমরে টাকা-পয়সাও আরেকটু হলে হারাতে বসেছিল।
No comments