‘টাকা দিয়ে দল চালাই, চোখ তুলে নেবো’
দ্বন্দ্বে টালমাটাল সংসদের বিরোধী দলজাতীয় পার্টি। পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়ার পর এবার হাতাহাতিতে
জড়ালেন দলটির সিনিয়র নেতারা। দলের প্রেসিডিয়াম থেকে প্রভাবশালী দুই নেতাকে
অব্যাহতি দেয়াকে কেন্দ্র করে গতকাল জাতীয় সংসদের লবিতে এমন ঘটনা ঘটে। এ সময়
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন
আহমেদ বাবলু চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দেন। এ ঘটনার পর রাতে সংসদ ভবনে সিনিয়র
কয়েকজন নেতাকে নিয়ে বৈঠক করেন এরশাদ। দলীয় সূত্র জানায় জাতীয় সংসদের বিরোধী
দলের চিফ হুইপের পদ থেকে তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে অব্যাহতি দেয়া ও মশিউর
রহমান রাঙ্গার বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এ
বৈঠকে। গতকাল সংসদে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর এক নম্বর লবিতে জাতীয়
পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গে সদ্য প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ
থেকে অব্যাহতি পাওয়া বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও এলজিআরডি
প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, কথাকাটাকাটি, অকথ্য
গালিগালাজের এক পর্যায়ে হাতাহাতি ঘটে। পরে অন্য নেতাদের মধ্যস্থতায়
পরিস্থিতি শান্ত হয়। এর আগে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন জাতীয় পার্টির
চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম
মাহমুদের সঙ্গে মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু এর কিছুক্ষণ পর প্রেসিডিয়াম সদস্য
থেকে অব্যাহতি পাওয়া তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মশিউর রহমান রাঙ্গাও তাদের
পেছনের সারিতে নিজেদের আসনে বসেন। তবে রাঙ্গা ও তাজুলের সঙ্গে এরশাদের কোন
কথা হয়নি, কেউ কারও দিকে তাকানওনি। মাগরিবের নামাজের বিরতির সময় বিরোধী
দলের লবিতে (১ নম্বর) জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে রাঙ্গা-তাজুলের মধ্যে ওই
অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সেখানে উপস্থিত থাকা জাপার একাধিক নেতা জানান, বিরতির
সময় এইচ এম এরশাদ ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ লবিতে ছিলেন না। এ সময়
মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গা বলেন, ‘আপনি
তো এখন অনেক বড় নেতা হয়ে গেছেন, উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। যখন তখন যে কাউকে দল
থেকে বের করে দিচ্ছেন, অব্যাহতি দিচ্ছেন। আপনি আমার এলাকার কমিটি ভেঙে
দিলেন, এগুলো করছেন কেন?’ জবাবে বাবলু বলেন ‘আমি কিছু জানি না।’ রাঙ্গা
বলেন ‘আপনিই তো সব কিছুু করছেন।’ এ সময় উত্তেজিত কণ্ঠে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে
মশিউর রহমান রাঙ্গা গালিগালাজ করেন। বলেন- রংপুরে আমি দল চালাই, আমার টাকায়
দল চলে, আর সেখানে নাকি আমার ছবি পোড়ানো হচ্ছে। আমিও এরশাদের এক শ’ ছবি
পোড়াবো। আমার ওপর খবরদারি, চোখ তুলে ফেলবো!
এ সময় রাঙ্গার সমর্থনে উচ্চস্বরে কথা বলেন বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীও। তিনি জিয়াউদ্দিন বাবলুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি আজ প্রেস কনফারেন্সে আমাকে যুদ্ধাপরাধী বলেছেন। আমি সাতবার এমপি, কেউ কখনও এ অভিযোগ করতে পারেনি। আপনি এসব মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছেন কেন? বিরোধী দলের উপনেতা হতে না পেরে আপনি এসব করছেন, উপনেতা হতে চাইলে আপনি আমাদেরকে বলতেন, আপনি তো বলেননি। উপস্থিত নিরাপত্তাকর্মী ও জাপার একাধিক এমপি জানান, তীব্র উত্তেজনার মধ্যে জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে রাঙ্গা-তাজুলের হাতাহাতি হলে দলের কয়েকজন সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে এ নিয়ে এরশাদ তার সংসদ ভবন অফিসে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠক করেন। একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বৈঠকে তাজুল-রাঙ্গাকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি স্পিকার ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর ফলে প্রতিমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় হুইপের পদ হারতে পারেন মশিউর রহমান রাঙ্গা ও তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
এরশাদকে হুমকি: পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দলের প্রেসিডিয়াম থেকে অব্যাহতি পাওয়া তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। একই সঙ্গে সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের পদ থেকে তাকে সরানোর ক্ষমতা এরশাদের নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল বিকালে রওশন এরশাদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ হুঁশিয়ারি দেন তাজুল। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল বলেন, আমি সংসদীয় দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত চিফ হুইপ। এরশাদের কোন ক্ষমতা নেই আমাকে এ পদ থেকে সরানোর।
ফের ভাঙনের আওয়াজ: নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বে ফের ভাঙনের মুখে পড়েছে জাতীয় পার্টি। যে কোন মুহূর্তে আরেক দফা ভাঙনের কবলে পড়তে পারে দলটি। বুধবার বিরোধীদলীয় হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাকে প্রেসিডিয়াম পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর তারা এমনই আওয়াজ দিয়েছেন। তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান দলটি ছোট করে ফেলতে চাইছেন। এরশাদ নিজেই দল ভাঙছেন। দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেছেন, যে পরিস্থিতি তাতে যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে জাতীয় পার্টি। যাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তারা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছেন। জাপার ওই প্রেসিডিয়াম সদস্য আরও বলেন, এ অবস্থার জন্য শুধু চেয়ারম্যানই দায়ী নন। তাকে বা রওশন এরশাদকে প্রভাবিত করে দলের ভেতর থেকে একটি সুবিধাবাদী চক্র এসব করছে। গতকাল জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেছেন, দলে কোন বিভক্তি নেই। যে নদীর গর্জন বেশি, সে নদীর ঢেউ তো উপচে পড়বেই। এমন বক্তব্য দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংসদ লবিতে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সিনিয়র নেতারা। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর গত বছর ১২ই ডিসেম্বর রাতে এরশাদকে সিএমএইচ-এ নেয়ার পর জিএম কাদের ও রহুল আমীন হাওলাদারকে দলের মুখপাত্র করা হয়। ববি হাজ্জাজকে এরশাদ সিএমএইচ থেকে দলের মুখপাত্র করেন। কয়েকদিন এরশাদের পক্ষে বক্তব্য দেয়ার পর তাকে জোরপূর্বক লণ্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরশাদ সিএমএইচ এ থাকাকালে জিএম কাদের ও রুহুল আমীন হাওলাদার তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তবে ভাইয়ের নির্দেশে লালমনিরহাট সদর আসন থেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জিএম কাদের। এরশাদ রংপুর-৩ আসন থেকে এমপি হিসেবে শপথ নিলেও জিএম কাদের এমপি হতে পারেননি। শুধু এমপি নন তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতও হয়েছেন। নির্বাচন বর্জন করলেও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ও পরে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ৪০ জন এমপি হয়েছেন। ছিটকে পড়েছেন মহাসচিব পদ থেকে এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু মহাসচিব হওয়ার পর দলে মূল্যায়ন না পাওয়ায় অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন জিএম কাদের। তাকে বাবলুর কারণে শোকজ নোটিশ দিয়েছিলেন এরশাদ। এছাড়া বিরোধীদলীয় উপনেতা হওয়ার দ্বন্দ্বে ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি পদ হারিয়েছেন কাজী ফিরোজ রশীদ। রওশনপন্থিরা মনে করেন, বাবলু বিরোধীদলীয় উপনেতা হতে চান বলেই ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি পদ হারিয়েছেন ফিরোজ রশীদ। কারণ এরশাদের ওই পদে পছন্দ বাবলুকে। ওদিকে এরশাদের পক্ষে অবস্থান নেয়ারা এখন দলে কোণঠাসা। মহাসচিবকে চ্যালেঞ্জ করায় চট্টগ্রামের সোলায়মান আলম শেঠকে প্রেসিডিয়ামের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জাপা নেতাদের অভিযোগ, গত কয়েক মাসে ৭/৮টি জেলা কমিটি ভেঙে সেখানে যারা দল করেন না তাদেরকে বসানো হয়েছে। এ অবস্থায় তৃণমূলে জাপার অবস্থা নাজুক। এছাড়া জাতীয় পার্টির এরশাদ গ্রুপ ছেড়ে কাজী জাফর গ্রুপে যোগ দিয়েছেন প্রভাবশালী নেতা আহসান হাবিব লিংকন, অতিকুর রহমান অতিক।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি নির্বাচনকালে সরকারে যোগ দিলে দল থেকে বেরিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে টিআইএম ফজলে রাব্বি, মোস্তফা জামাল হায়দার, এসএম আলম, নবাব আলী আব্বাসসহ ৮জন প্রেসিডিয়াম সদস্য। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন এরশাদের প্রেসিডিয়াম থেকে অব্যাহতি পাওয়া গোলাম মসীহ। তারা আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। পরে অবশ্য গোলাম মসীহ জাফর গ্রুপ থেকে বের হয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব হন।
রাঙ্গা-তাজুলের ব্যাপারে এরশাদ ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য নন: এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা এবং তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি দেয়ার ব্যাপারে পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য নন বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। গতকাল বনানী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলেও তার কক্ষে ছিলেন। মহাসচিব বলেন, তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়নি, অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া কারও বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি বলেন, রাঙ্গা ও তাজুলকে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাজুল একজন বিতর্কিত লোক। এটা সবাই জানেন। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আমরা শুনেছি। জাতীয় পার্টি ছেড়ে তিনি পিডিপি করেছেন। ২০০৮ সালে বিএনপির নমিনেশন নিয়ে পার্টি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে হেরেছেন। তারপরও স্যার তাকে মাফ করে দিয়েছিলেন। এছাড়া এটা দল পুনর্গঠনেরই অংশ। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে যে কোন সময় যে কাউকে দল থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন চেয়ারম্যান। জাতীয় পার্টি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল হচ্ছে শ্যাডো গভর্নমেন্ট। আর প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সংসদ নেতা। তিনি বিরোধী দলেরও নেতা। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা তো বলতেই হবে। কিন্তু কেউ নালিশ করতে যাননি। কোন ভাঙন বা বিভক্তি দেখা দেবে কিনা- এমন প্রশ্নে মহাসচিব বলেছেন, দলে কোন বিভক্তি নেই। আপনি বিরোধীদলীয় উপনেতা হতে চান বলে জাপায় নতুন সঙ্কট- এমন, প্রশ্নে বাবলু বলেন, আমার কোন আগ্রহ নেই।
No comments