খেয়াল বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে আনা মুক্তাকণা by শামসুদ্দোহা চৌধুরী ও আল আমিন তুষার
সময়
দ্বিপ্রহর। শত বছরের প্রাচীন পানামের বিদ্যাপীঠ ‘সোনারগাঁও জি আর
ইন্সটিটিউশন’। অনিবার্য কারণে বিদ্যালয়ের দাফতরিক রুমে কয়েকটি প্রাচীন
আলমিরায় পুরনো কাগজের জঞ্জাল সাফ করার বিরক্তিকর প্রচেষ্টা চলছিল। কিছু
পোকায় খাওয়া কাগজের জঞ্জালের মাঝে তেলাপোকার বিশ্রামহীন দৌড়াদৌড়ি আমাদের
মাঝে বিরক্তি সৃষ্টি করলেও সবার চোখ এক স্থানে এসে স্থির হয়ে যায়। কিছু সময়
পরেই কাগজে মোড়ানো হাতে লেখা একটি পরিপূর্ণ পাণ্ডুলিপি দেখে সবার চোখ
ছানাবড়া হয়ে যায়। সুন্দর হস্তাক্ষরে খাগের কলমে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাঁশের
কঞ্চির কলমে লেখা নবম শ্রেণীর বিদ্যার্থীদের সাহিত্য স্মরণিকা ‘খেয়াল’
অতীতের স্মৃতি নিয়ে আমাদের সামনে দীপ্যমান হয়ে ওঠে। প্রকাশনাটির
প্রকাশকাল-১৩৪৬ সন ২ আশ্বিন। কাল এবং সময় অনুসারে সোনারগাঁও জিআর
ইন্সটিটিউশনের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চা প্রচেষ্টা- ৭৫ বছর
আগের সেই ইতিহাস আমাদের কতটা আলোড়িত করেছে, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এ
ব্যতিক্রমী প্রাপ্তি আমাদের কতটা কর্তব্য-সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
পানামের মতো একটি সমৃদ্ধশালী নগরীতে সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চা যে ছিল তা তো
বলার অবকাশ রাখে না। ব্রিটিশ পিরিয়ডের শেষের দিকে পানামে ছিল ‘ললিত মোহন
স্মৃতিগ্রন্থ পাঠাগারের’ মতো একটি বিশাল পাঠাগার। সরূপ চন্দ্র রায়ের
‘সুবর্ণ গ্রামের ইতিহাসের’ প্রকাশক ছিলেন ললিত মোহন বাবু। ব্রিটিশ ভারতের
রাজধানী কলকাতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পানামে যে শিক্ষিত এলিট ধনাঢ্য শ্রেণীর
সৃষ্টি হয়েছিল এবং তারা যে শিক্ষার এবং সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তা তো
বলার অপেক্ষা রাখে না। পানামের সুরম্য অট্টালিকার বৈঠকী ঘরে নাটক,
সাহিত্যের যে সমৃদ্ধ চর্চা ছিল পানামের সুরম্য ইমারত দর্শনে এখনও তা বোঝা
যায়। পঁচাত্তর বছর আগের বাঁশের কঞ্চিতে লিখিত খেয়াল পত্রিকাটি সম্ভবত
ধারাবাহিকভাবেই হাতে লিখে প্রকাশ হতো। ১৩৪৬ সনের ২ আশ্বিন প্রকাশিত
স্মরণিকাটি ‘খেয়ালের’ ২য় সংখ্যা। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে লেখাপড়ার মান যে অনেক
উন্নত ছিল এবং তা স্পষ্ট হয় সে সময়ের সাহিত্যপ্রেমিকদের লিখন এবং জ্ঞানের
পরিধি দেখলে। স্মরণিকার প্রথম ছয় পৃষ্ঠাতেই ছাত্রদের উল্লিখিত কবিতার চারটি
পঙ্ক্তিমালা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন ‘শিল্পকলা শিখবো কেউ,
গ্রন্থমালা লিখবো কেউ, কেউবা হবো ব্যবসাজীবী কেউবা টাটা কার্নানি। সবার আগে
চলবো মোরা আরকি কভু হার মানি’ ইংরেজির পদ্যের চারটি স্তবক হল- ‘We are the
literature makers, We are the dreamers of dreams.
We are the movers sand shakers of all the world, it seems’
এ স্মরণিকার এসো, আত্মশাসন, প্রার্থনা, ভারতগাঁথা, শেষচরণ, শ্রাবণমাস, মোহনবেনু, দুর্গাপূজা, সান্ধ্য আইন নামে ৯টি কবিতা আছে। কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ভূপেন দে, শিব প্রসাদ ভট্টাচার্য। প্রবন্ধ, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, রসরচনা মিলে প্রায় বেশকটি লেখা স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে দু’জন মুসলিম লেখক আছেন। তারা হলেন ‘প্রেমের সরূপ’ নিবন্ধের লেখক আবদুল হক মোল্লা এবং ‘হারাধন সুমতির’ গল্পের লেখক জিয়াউদ্দীন আহাম্মদ।
খেয়ালের নবীন লেখকরা যা লিখেছেন
‘খেয়ালের’ লেখকরা বয়সে নবীন। সাহিত্য রসে সিক্ত মন-প্রাণ। খাগের অথবা বাঁশের সুতীক্ষ্ণ কঞ্চির কলমে লিখিত হস্তলিপি সুন্দর। ভাষা প্রাঞ্জল। লেখার গতি আবেগবর্জিত নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুরধার। ৭৫ বছর আগের হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবের বর্ণনায় যেমন এসেছে তেমনি সম্রাট বাবরের ‘আত্মকাহিনী’ নবম শ্রেণীর বিদ্যার্থীদের নাড়া দিয়েছে, বাবরের আত্মশক্তি প্রেরণা জুগিয়েছে। ‘খেয়ালে’ চিত্রশিল্পীর আঁকা জননী সন্তানের ভালোবাসা, পল্লী দৃশ্য ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। পেনসিল স্কেচের সেই শিল্পী। এখনও জীবিত আছে কিনা, কর্মজীবনে সে কি চিত্রশিল্পী হয়েছে কিনা তা জানা সম্ভব হয়নি। স্মরণিকায় আছে কয়েকটি গল্প। পল্লীর সুখ-দুঃখ, বিরহ-ব্যথা কৃষক পরিবারের ব্যঞ্জনাময় স্মৃতির বর্ণনায় অতিরঞ্জন নেই। সমুদ্রে সূর্যাস্তের বর্ণনা আছে। বিস্মিত হতে হয় স্যার ওয়াল্টার স্কটের ‘দ্যা লে অব দ্যা মিনিস্টার’ কবিতার ছায়া অনুসারে লেখা কবিতাও স্থান পেয়েছে। জমিদার নির্মল রায়ের গাঁয়ে ফেরা এবং পল্লীর মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে স্মরণিকার একটি উপন্যাসে। মাস্টার দা সূর্য সেনের ১৯৩১ সালের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল, সে সান্ধ্য আইনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে যে আতংকের সৃষ্টি হয়েছিল তার বর্ণনাও স্মরণিকায় বাদ যায়নি। ১৬৬ পৃষ্ঠার হাতে লেখা স্মরণিকায় ব্রিটিশদের সঙ্গে পানামের জমিদার শ্রেণীর সম্পর্কের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।
পানাম সোনারগাঁওয়ের বাবু কালচার প্রসঙ্গ
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া যখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয় কলকাতা। অবশ্য তার আগে মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময়ে বাংলার জমিদারি হিন্দু রায়তদের কাছে বণ্টন করা হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব মুসলিম জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারি ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দু জমিদারের কাছে পত্তনি দেয়া হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া শাসনামলে মূলত হিন্দুরা পানাম সোনারগাঁওয়ে অর্থ, সম্পদে প্রাচুর্যশীল হয়ে ওঠে, সোনারগাঁওয়ে মুসলমান পতন ত্বরান্বিত হয়। মুসলমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মসলিন বস্ত্র ব্যবসা, হিন্দু এবং ইংরেজ বেনিয়াদের কাছে চলে যায়। সে সময় মসলিন তাঁতীদের অর্থের জোগানদাতা ব্যাংকার রূপে আবির্ভূত হয় পানামের নব্য জমিদাররা। পানামের ব্রিটিশ পিরিয়ডের যে ইমারতরাজী এখনও দৃশ্যমান সেসব ইমারতের মালিক ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেমন- নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল থেকে আগত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শ্রেণী। মূলত ব্যবসাপ্রধান এবং টাকা লগ্নি, সুদের ব্যবসা থেকে মোটা অর্থ আদায় করা এসব হিন্দু নব্যজমিদারদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল। এ ছাড়াও ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করে প্রাচীন বনেদি মুসলিম জমিদার পরিবারগুলো থেকে ছলেবলে কৌশলে জমিদারি ছিনিয়ে নিয়ে বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যাওয়ার পর পানাম সোনারগাঁওয়ে একটি নব্য এলিট শ্রেণী গড়ে ওঠে। কলকাতার সঙ্গে পাট, কাপড়, চালের ব্যবসা করে হিন্দু ধনাঢ্য শ্রেণী কালক্রমে পানাম সোনারগাঁওয়ের বিশাল স্থাবর সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। পানামের বিখ্যাত সর্দার বাড়ি, পোদ্দার বাড়ি, পাল বাড়ি, রায় বাড়ি, হাসি সেনের ব্যবসা ছিল মূলত মহাজনি ব্যবসা। জমিদারি থেকে আয় হওয়ার পরও মহাজনি ব্যবসায় পানাম নগরের হিন্দুদের ধন-সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। রাজধানী কলকাতা এবং ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের কারণে এসব হিন্দু ধনপতিদের মাঝে ব্রিটিশ শাসিত প্রশাসনের সংস্কৃতি, কৃষ্টির একটি গোপন ধারা পানামের হিন্দু নব্যশিক্ষিত তরুণের মাঝে প্রবাহিত হয়। প্রাচীনত্বের ধ্যান-ধারণাকে পেছনে ফেলে দিয়ে সেসময় কলকাতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির বিকাশও দেখা যায় সোনারগাঁও পানামে। নব্য এলিট শ্রেণীর মাঝে শিক্ষিত নারীরাও উপনিবেশিক সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পানামের অদূরে বারদীর শিক্ষিত নাগ জমিদারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পানাম নগরে সাহিত্য সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের বিকাশ ঘটে। গড়ে ওঠে সুরম্য দালানকোঠার মাঝে জমকালো জলসাঘর, নাচ ঘর, বৈঠকি ঘর। পুজোপার্বণের পাশাপাশি হিন্দু জমিদাররা কিছু জনহিতকর কাজেও আত্মনিয়োগ করে। সে সময় সোনারগাঁওয়ের পানামের মুসলমান সমাজের অবস্থা ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। জমিদারি এবং সম্পদ হারিয়ে মুসলমানরা ইংরেজ এবং হিন্দুদের ক্রীড়নক হয়ে পড়ে। এ ধারা চলে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান-ভারত দেশ ভাগ পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে পানামের হাসি সেন জমিদার পরিবারের লোকেরা গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে শরিক হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় কিছু শিক্ষিত তরুণ সে সময় উদ্বুদ্ধ হয়। গান্ধীজীর স্বদেশী চিন্তায় মূর্ত হয়ে এ স্থানের কিছু শিক্ষিত তরুণ ব্রিটিশ কাপড়ের পরিবর্তে এ দেশীয় খদ্দরের কাপড় পরিধান করার কথাও শোনা যায়। কলকাতার, ঢাকার বিখ্যাত সঙ্গীতবিদদের এখানে আনিয়ে পানামের নব্য এলিট শ্রেণীর মধ্যে সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হতো। বিত্তশালীরা পঙ্খিরাজ নৌকায় চড়ে পানামের পঙ্খিরাজ খালে প্রমোদ নৌবিহারের কথাও শোনা যায়। ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিকে ‘ললিত মোহন স্মৃতি গ্রন্থাগারের’ মতো সমৃদ্ধ একটি পাঠাগারও এখানে গড়ে ওঠে। তবে আশরাফ আতরাফ গোষ্ঠীর বিশেষ করে তীব্র ধর্ম ও বর্ণ বিদ্বেষের দুষ্ট চক্রও বিরাজমান ছিল হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে। বিশেষ করে মুসলিম প্রজাদের বাবুদের বাড়িতে ঢোকা এবং জুতা পায়ে হেঁটে যাওয়াও হিন্দু জমিদারদের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো। হিন্দুদের এ প্রবল প্রতাপশালী ঔদ্ধত্যের অবসান ঘটে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত সরকারি আইনের ফলে। এ সময় সরদার বাড়ির রাধিকা মোহন সর্দার, আনন্দ পোদ্দার, সুরেশ পাল, হাসি সেন, অমিয় সেনের এবং আরও ছোটখাটো জমিদারির পতন ঘটে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগেই প্রভাবশালী হিন্দুরা চলে যায় কলকাতায়। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর অবশিষ্ট হিন্দুরাও ভারতগামী হয়। সে সময় গুটিকয়েক মুসলিম পরিবার ছাড়া ধনাঢ্য মুসলিম শিক্ষিত পরিবারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত সোনারগাঁও জিআর ইন্সটিটিউশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে নিগৃহীত দু-চার জন মুসলিম ছাত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। বর্তমানে সে সময়ের অধিকাংশ লোকই ইন্তেকাল করেছেন। শতাব্দীর নিঃসঙ্গ রহস্য নগরী হিসেবে পানাম সাক্ষী হয়ে আছে ইতিহাসের ঝরা পাতায়। বির্পযস্ত ঐতিহ্যের কালের সাক্ষী হিসেবে সোনারগাঁও পানাম ঘুমিয়ে পড়ে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই। ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে সোনারগাঁওয়ের লুপ্ত লোক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
‘খেয়াল’ স্মরণিকায় প্রকাশিত
এক লেখক জীবনবৃত্তান্ত
১৯২৬ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখে আবদুল হক মোল্লা সোনারগাঁওয়ের অর্জুন্দি গ্রামের মোল্লা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের অধীনে সোনারগাঁও জিআর ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিকুলেশন, ১৯৪৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিটি কলেজ কলকাতা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বিকম পাস করেন। কর্মজীবনে ১৯৪৫ সালে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া রেলওয়ে বিভাগে অডিট অফিসার, ১৯৪৭ সালে ইবি রেলওয়েতে অডিট অফিসার, ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কমার্শিয়াল অডিট অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সচিবালয়ে পূর্ত, পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে অডিট কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে অডিট অ্যাকাউন্ট অফিসার থাকা অবস্থায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আবদুল হক মোল্লা ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। তার উত্তরসূরিদের অধিকাংশই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। ‘খেয়ালের’ লেখক নির্মল কুমার রায় পানামের নিকটবর্তী জয়রামপুর গ্রামের অধিবাসী। ১৯৪১ সালে সোনারগাঁও জিআর ইন্সটিটিউশন থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। দলিল লেখক হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতি ছিল। নির্মল কুমার রায় ইহধাম ত্যাগ করেছেন দীর্ঘদিন আগেই। যে পরিবেশে খেয়ালের নবীন কর্মীরা সাহিত্যচর্চার চেষ্টা করেছে এমন পরিবেশে সচরাচর এ ধরনের বড় প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না। খেয়ালের কর্মীরা এ অনুপ্রেরণা কোথায় পেল এবং খেয়ালের কর্মীদের উদ্যম পরবর্তীতে এলাকার তরুণদের কীভাবে প্রভাবিত করেছে- এ বিষয় গবেষণা অব্যাহত রাখা জরুরি।
We are the movers sand shakers of all the world, it seems’
এ স্মরণিকার এসো, আত্মশাসন, প্রার্থনা, ভারতগাঁথা, শেষচরণ, শ্রাবণমাস, মোহনবেনু, দুর্গাপূজা, সান্ধ্য আইন নামে ৯টি কবিতা আছে। কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ভূপেন দে, শিব প্রসাদ ভট্টাচার্য। প্রবন্ধ, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, রসরচনা মিলে প্রায় বেশকটি লেখা স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে দু’জন মুসলিম লেখক আছেন। তারা হলেন ‘প্রেমের সরূপ’ নিবন্ধের লেখক আবদুল হক মোল্লা এবং ‘হারাধন সুমতির’ গল্পের লেখক জিয়াউদ্দীন আহাম্মদ।
খেয়ালের নবীন লেখকরা যা লিখেছেন
‘খেয়ালের’ লেখকরা বয়সে নবীন। সাহিত্য রসে সিক্ত মন-প্রাণ। খাগের অথবা বাঁশের সুতীক্ষ্ণ কঞ্চির কলমে লিখিত হস্তলিপি সুন্দর। ভাষা প্রাঞ্জল। লেখার গতি আবেগবর্জিত নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুরধার। ৭৫ বছর আগের হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবের বর্ণনায় যেমন এসেছে তেমনি সম্রাট বাবরের ‘আত্মকাহিনী’ নবম শ্রেণীর বিদ্যার্থীদের নাড়া দিয়েছে, বাবরের আত্মশক্তি প্রেরণা জুগিয়েছে। ‘খেয়ালে’ চিত্রশিল্পীর আঁকা জননী সন্তানের ভালোবাসা, পল্লী দৃশ্য ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। পেনসিল স্কেচের সেই শিল্পী। এখনও জীবিত আছে কিনা, কর্মজীবনে সে কি চিত্রশিল্পী হয়েছে কিনা তা জানা সম্ভব হয়নি। স্মরণিকায় আছে কয়েকটি গল্প। পল্লীর সুখ-দুঃখ, বিরহ-ব্যথা কৃষক পরিবারের ব্যঞ্জনাময় স্মৃতির বর্ণনায় অতিরঞ্জন নেই। সমুদ্রে সূর্যাস্তের বর্ণনা আছে। বিস্মিত হতে হয় স্যার ওয়াল্টার স্কটের ‘দ্যা লে অব দ্যা মিনিস্টার’ কবিতার ছায়া অনুসারে লেখা কবিতাও স্থান পেয়েছে। জমিদার নির্মল রায়ের গাঁয়ে ফেরা এবং পল্লীর মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে স্মরণিকার একটি উপন্যাসে। মাস্টার দা সূর্য সেনের ১৯৩১ সালের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল, সে সান্ধ্য আইনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে যে আতংকের সৃষ্টি হয়েছিল তার বর্ণনাও স্মরণিকায় বাদ যায়নি। ১৬৬ পৃষ্ঠার হাতে লেখা স্মরণিকায় ব্রিটিশদের সঙ্গে পানামের জমিদার শ্রেণীর সম্পর্কের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।
পানাম সোনারগাঁওয়ের বাবু কালচার প্রসঙ্গ
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া যখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয় কলকাতা। অবশ্য তার আগে মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময়ে বাংলার জমিদারি হিন্দু রায়তদের কাছে বণ্টন করা হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব মুসলিম জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারি ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দু জমিদারের কাছে পত্তনি দেয়া হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া শাসনামলে মূলত হিন্দুরা পানাম সোনারগাঁওয়ে অর্থ, সম্পদে প্রাচুর্যশীল হয়ে ওঠে, সোনারগাঁওয়ে মুসলমান পতন ত্বরান্বিত হয়। মুসলমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মসলিন বস্ত্র ব্যবসা, হিন্দু এবং ইংরেজ বেনিয়াদের কাছে চলে যায়। সে সময় মসলিন তাঁতীদের অর্থের জোগানদাতা ব্যাংকার রূপে আবির্ভূত হয় পানামের নব্য জমিদাররা। পানামের ব্রিটিশ পিরিয়ডের যে ইমারতরাজী এখনও দৃশ্যমান সেসব ইমারতের মালিক ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেমন- নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল থেকে আগত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শ্রেণী। মূলত ব্যবসাপ্রধান এবং টাকা লগ্নি, সুদের ব্যবসা থেকে মোটা অর্থ আদায় করা এসব হিন্দু নব্যজমিদারদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল। এ ছাড়াও ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করে প্রাচীন বনেদি মুসলিম জমিদার পরিবারগুলো থেকে ছলেবলে কৌশলে জমিদারি ছিনিয়ে নিয়ে বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যাওয়ার পর পানাম সোনারগাঁওয়ে একটি নব্য এলিট শ্রেণী গড়ে ওঠে। কলকাতার সঙ্গে পাট, কাপড়, চালের ব্যবসা করে হিন্দু ধনাঢ্য শ্রেণী কালক্রমে পানাম সোনারগাঁওয়ের বিশাল স্থাবর সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। পানামের বিখ্যাত সর্দার বাড়ি, পোদ্দার বাড়ি, পাল বাড়ি, রায় বাড়ি, হাসি সেনের ব্যবসা ছিল মূলত মহাজনি ব্যবসা। জমিদারি থেকে আয় হওয়ার পরও মহাজনি ব্যবসায় পানাম নগরের হিন্দুদের ধন-সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। রাজধানী কলকাতা এবং ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের কারণে এসব হিন্দু ধনপতিদের মাঝে ব্রিটিশ শাসিত প্রশাসনের সংস্কৃতি, কৃষ্টির একটি গোপন ধারা পানামের হিন্দু নব্যশিক্ষিত তরুণের মাঝে প্রবাহিত হয়। প্রাচীনত্বের ধ্যান-ধারণাকে পেছনে ফেলে দিয়ে সেসময় কলকাতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির বিকাশও দেখা যায় সোনারগাঁও পানামে। নব্য এলিট শ্রেণীর মাঝে শিক্ষিত নারীরাও উপনিবেশিক সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পানামের অদূরে বারদীর শিক্ষিত নাগ জমিদারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পানাম নগরে সাহিত্য সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের বিকাশ ঘটে। গড়ে ওঠে সুরম্য দালানকোঠার মাঝে জমকালো জলসাঘর, নাচ ঘর, বৈঠকি ঘর। পুজোপার্বণের পাশাপাশি হিন্দু জমিদাররা কিছু জনহিতকর কাজেও আত্মনিয়োগ করে। সে সময় সোনারগাঁওয়ের পানামের মুসলমান সমাজের অবস্থা ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। জমিদারি এবং সম্পদ হারিয়ে মুসলমানরা ইংরেজ এবং হিন্দুদের ক্রীড়নক হয়ে পড়ে। এ ধারা চলে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান-ভারত দেশ ভাগ পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে পানামের হাসি সেন জমিদার পরিবারের লোকেরা গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে শরিক হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় কিছু শিক্ষিত তরুণ সে সময় উদ্বুদ্ধ হয়। গান্ধীজীর স্বদেশী চিন্তায় মূর্ত হয়ে এ স্থানের কিছু শিক্ষিত তরুণ ব্রিটিশ কাপড়ের পরিবর্তে এ দেশীয় খদ্দরের কাপড় পরিধান করার কথাও শোনা যায়। কলকাতার, ঢাকার বিখ্যাত সঙ্গীতবিদদের এখানে আনিয়ে পানামের নব্য এলিট শ্রেণীর মধ্যে সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হতো। বিত্তশালীরা পঙ্খিরাজ নৌকায় চড়ে পানামের পঙ্খিরাজ খালে প্রমোদ নৌবিহারের কথাও শোনা যায়। ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিকে ‘ললিত মোহন স্মৃতি গ্রন্থাগারের’ মতো সমৃদ্ধ একটি পাঠাগারও এখানে গড়ে ওঠে। তবে আশরাফ আতরাফ গোষ্ঠীর বিশেষ করে তীব্র ধর্ম ও বর্ণ বিদ্বেষের দুষ্ট চক্রও বিরাজমান ছিল হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে। বিশেষ করে মুসলিম প্রজাদের বাবুদের বাড়িতে ঢোকা এবং জুতা পায়ে হেঁটে যাওয়াও হিন্দু জমিদারদের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো। হিন্দুদের এ প্রবল প্রতাপশালী ঔদ্ধত্যের অবসান ঘটে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত সরকারি আইনের ফলে। এ সময় সরদার বাড়ির রাধিকা মোহন সর্দার, আনন্দ পোদ্দার, সুরেশ পাল, হাসি সেন, অমিয় সেনের এবং আরও ছোটখাটো জমিদারির পতন ঘটে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগেই প্রভাবশালী হিন্দুরা চলে যায় কলকাতায়। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর অবশিষ্ট হিন্দুরাও ভারতগামী হয়। সে সময় গুটিকয়েক মুসলিম পরিবার ছাড়া ধনাঢ্য মুসলিম শিক্ষিত পরিবারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত সোনারগাঁও জিআর ইন্সটিটিউশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে নিগৃহীত দু-চার জন মুসলিম ছাত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। বর্তমানে সে সময়ের অধিকাংশ লোকই ইন্তেকাল করেছেন। শতাব্দীর নিঃসঙ্গ রহস্য নগরী হিসেবে পানাম সাক্ষী হয়ে আছে ইতিহাসের ঝরা পাতায়। বির্পযস্ত ঐতিহ্যের কালের সাক্ষী হিসেবে সোনারগাঁও পানাম ঘুমিয়ে পড়ে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই। ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে সোনারগাঁওয়ের লুপ্ত লোক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
‘খেয়াল’ স্মরণিকায় প্রকাশিত
এক লেখক জীবনবৃত্তান্ত
১৯২৬ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখে আবদুল হক মোল্লা সোনারগাঁওয়ের অর্জুন্দি গ্রামের মোল্লা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের অধীনে সোনারগাঁও জিআর ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিকুলেশন, ১৯৪৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিটি কলেজ কলকাতা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বিকম পাস করেন। কর্মজীবনে ১৯৪৫ সালে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া রেলওয়ে বিভাগে অডিট অফিসার, ১৯৪৭ সালে ইবি রেলওয়েতে অডিট অফিসার, ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের করাচিতে কমার্শিয়াল অডিট অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সচিবালয়ে পূর্ত, পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে অডিট কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে অডিট অ্যাকাউন্ট অফিসার থাকা অবস্থায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আবদুল হক মোল্লা ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। তার উত্তরসূরিদের অধিকাংশই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। ‘খেয়ালের’ লেখক নির্মল কুমার রায় পানামের নিকটবর্তী জয়রামপুর গ্রামের অধিবাসী। ১৯৪১ সালে সোনারগাঁও জিআর ইন্সটিটিউশন থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। দলিল লেখক হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতি ছিল। নির্মল কুমার রায় ইহধাম ত্যাগ করেছেন দীর্ঘদিন আগেই। যে পরিবেশে খেয়ালের নবীন কর্মীরা সাহিত্যচর্চার চেষ্টা করেছে এমন পরিবেশে সচরাচর এ ধরনের বড় প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না। খেয়ালের কর্মীরা এ অনুপ্রেরণা কোথায় পেল এবং খেয়ালের কর্মীদের উদ্যম পরবর্তীতে এলাকার তরুণদের কীভাবে প্রভাবিত করেছে- এ বিষয় গবেষণা অব্যাহত রাখা জরুরি।
No comments