জেদই তাকে পৌঁছে দিয়েছিল সাফল্যের স্বর্ণশিখরে by মোশাররফ রুমী
শৈশবে একেবারেই এক অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন
ফিরোজা বেগম। নিজের জগতেই ছিল তার বসবাস। পড়ালেখা, খেলাধুলা, গান, অভিনয়,
আঁকাআঁকি, নাচ সবকিছুই করছেন। বাদ ছিল না কিছুই। সব কিছুতেই তিনি ছিলেন
প্রথম। অথচ তাকে যে কেউ কিছু শেখাচ্ছিলেন তাও নয়। নিজেই শিখেছেন। ভুল হলে
নিজেই শুধরে নিতেন। নিজেই যেন নিজের শিক্ষক ছিলেন। খুব জেদি ছিলেন তিনি। যা
করার জেদ তার মনে তৈরি হতো তা তিনি করতেনই। আর এ জেদই তাকে পৌঁছে দিয়েছিল
সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। যে সাফল্য এ উপমহাদেশে নজরুলের গানকে সংগীতপ্রেমী
মানুষদের হৃদয়ে শক্ত এবং প্রিয় আসনে আসীন করার। সিংহ রাশির জাতিকা ছিলেন
ফিরোজা বেগম। ছোটবেলায় সব কিছুর মধ্যেও গান শোনার এক অদ্ভুত নেশা তাকে
তাড়িয়ে বেড়াতো। রক্ষণশীল বাড়ি না হলেও গানের চর্চা ছিল না তাদের বাড়িতে।
সেই সময়ে মেয়েদের পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়ার চলই ছিল না। তেমন পরিবেশে গান
শেখার অবকাশ না থাকলেও বাবা-মায়ের সংগীতপ্রীতি যে ছিল তা বলাই বাহুল্য।
এটাই ছোট্ট মেয়েটির সংগীত আগ্রহে অনুঘটক হয়েছে। তাদের বাড়ির ভাঁড়ারঘরে ছিল
বেশকিছু পুরনো রেকর্ড। ছিল বেশ পুরনো একটি কলের গানও। সেটার পিনটাও ঠিক
ছিল না, অথচ তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতেন সংগীতপাগল মেয়েটি। একাকী
নিবিষ্টচিত্তে তিনি গান শুনতেন। কেউ তাকে বিরক্ত করতেন না। ফলে গানের ভুবনে
হারিয়ে যেতে তার মানাও ছিল না। এমনি একদিন গান শুনতে শুনতে তিনি এতটাই
আনমনা ছিলেন যে, কাজের লোকেরা কখন ভাঁড়ারঘর তালাবন্ধ করে দিয়েছিল সেই
খেয়ালও করেননি। পরে বুঝতে পারলেও তাতে তার কোন চিন্তা হয়নি বরং ভেবেছেন,
মন্দ কি? একা একা গান তো শোনা হবে! এদিকে সন্ধ্যায় সবাই পড়তে বসেছে। কেবল
তিনি নেই। অভ্যাসবশত প্রতিদিনের মতো চোখ বোলাতে গিয়ে ঠিকই মা দেখেছেন একটা
চেয়ার খালি। অন্যদের জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কেউই বলতে পারল না তিনি কোথায়।
অবশেষে তাকে সেই গানের ঘরেই খুঁজে পাওয়া গেল। এভাবেই সব সময় গানের নিশি
তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। ভেতরে ভেতরে ভাল গান শেখার প্রবল ইচ্ছায় অস্থির থাকতেন
তিনি। আর এ অস্থিরতাই তাকে সংগীতে ব্যাপক পারদর্শী করে তোলে। ১৯৪২ সালে
মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ইসলামী গান নিয়ে তার
প্রথম রেকর্ড বের হয়েছিল। এতে চিত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে ছোট্ট ফিরোজা
গেয়েছিলেন ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। সাহেব রেকর্ডিস্ট, তাই দুরু দুরু
বুকে গেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেই বাজিমাৎ। বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে হু হু
করে সব রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায়। সংগীতপ্রেমীদের সঙ্গে সুরের আকাশের এই
তারার সেটাই প্রথম পরিচয়। ছোট্ট মেয়েটির গায়কী সংগীতবোদ্ধা এবং সাধারণ
শ্রোতা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড বের করার জন্য
যেখানে বড় সব শিল্পী হা-পিত্যেশ করে থাকেন, সেখানে এই একরত্তি মেয়ের একের
পর এক রেকর্ড বেরিয়ে যাচ্ছিল। পর পর চারটি রেকর্ড বেরিয়ে যায় অল্পদিনের
মধ্যেই। গুণীজনদের সাহচর্য এবং স্নেহ পেয়েই তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে
করেন। তাছাড়া তার চাই যতসব জটিল সুরের সমাধান। সবার ছিল একই জিজ্ঞাসা, কেন
তুমি এত কঠিন গান শিখতে চাও? সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এজন্য
সবাই আমাকে নিয়ে মজা করতো। আসলে আমি তো আমার সংগীত শিক্ষা নিয়ে খুশি নই। সব
সময় আরও ভাল গান শেখার ইচ্ছেটা আকুলি বিকুলি করতো। তাই নিজেই একদিন চিত্ত
রায়কে বলে বসলাম, গান শিখতে চাই আমি। শুনে তো অবাক চিত্ত রায়। কি বলে এই
মেয়ে? সেই থেকে শুরু হলো শিক্ষা। একদিকে চিত্ত রায় অন্যদিকে কমল দাশগুপ্ত।
এই দু’জনের কাছেই আমি ঋণী। বিশেষত কমল দাশগুপ্তের কাছে। তার কাছে আমি সব
ধরনের গান শিখেছি। আমার জীবনের মূল শিক্ষাটাই পেয়েছি ওর কাছে। তখন রেডিওতে
তিনি সমান্তরালে নানা ধরনের গান গেয়ে যাচ্ছিলেন। ততদিনে তিনি সংগীতে
বিখ্যাত। দু-দুইবার আধুনিক গানের ক্ষেত্রে মাসের সেরা শিল্পী হয়েছিলেন।
একবার তার গলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনে তাকে গান শেখানোর জন্য পঙ্কজ মল্লিকের
মতো শিল্পী ফিরোজা বেগমের কলকাতার বাড়িতে চলে এসেছেন। গুণী শিল্পীরা তার
প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অন্যদিকে তিনি আব্বাসউদ্দিন এবং পল্লীকবি জসীমউদদীনের
কাছে অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য মাঝে মাঝে লোকগীতির তালিম নিতেন। রেডিওর
পাশাপাশি স্টুডিওতে গান গাইতেন তিনি। আর এভাবেই গানের জগতে বিরামহীন ডুবে
থেকে এগিয়ে চলে তার সাফল্যে ভরপুর পথচলা। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭- টানা ১৩ বছর তিনি
ছিলেন কলকাতায়। এ সময়টাকে তিনি নির্বাসন হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন। এই সময়েই
১৯৫৬ সালে বরেণ্য সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এ সিদ্ধান্তকে
মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার। কিন্তু এক্ষেত্রে নিজের জেদকেই তিনি সব সময়
অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কলকাতাতেই জন্মেছে তার তিন সন্তান- তাহসিন, হামিন ও
শাফিন। ওই সময়ে স্বর্ণযুগ স্বর্ণকণ্ঠী ফিরোজার। অথচ টানা পাঁচ বছর
স্বামী-সন্তান-সংসার সামলাতে গিয়ে গান গাইতে পারেননি তিনি। এগিয়ে চলা সময়ের
সঙ্গে তাদের দুর্ভাগ্যও এগিয়ে এসেছিল একসময়। অসুস্থ হয়ে পড়লেন কমল
দাশগুপ্ত। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাদের কথা, স্বামীর চিকিৎসার কথা ভেবে ’৬৭-তে
দেশে ফেরেন। আসতে না আসতেই পড়েছিলেন দুর্বিপাকে। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার
তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে
এসেছিল উপর্যুপরি টেলিগ্রাম। দুঃসহ সেসব স্মৃতি তাকে শেষ বয়সেও কষ্ট দিত।
১৯৭৪ সালের ২০শে জুলাই মারা যান কমল দাশগুপ্ত। যতি পড়ে মাত্র ১৮ বছরের
সুরময় দাম্পত্যের। বিভিন্ন সময়ে নানা সম্মাননা পেয়েছেন ফিরোজা বেগম। এর
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, শিল্পকলা একাডেমি
পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে),
নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক,
সত্যজিৎ রায় স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার,
সিকোয়েন্স পুরস্কার এবং সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড ও চ্যানেল আই
নজরুল মেলায় আজীবন সম্মাননা। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেন বাংলা ১৪০০
সালে কলকাতার সাহিত্যিক-শিল্পীদের দেয়া সংবর্ধনা। সেবার একই বৃন্তে দুটি
কুসুম শিরোনামে দুই অসামান্য কণ্ঠমাধুর্যের অধিকারী নজরুল সংগীতে ফিরোজা
বেগম এবং রবীন্দ্রসংগীতে সুচিত্রা মিত্রকে সম্মান জানানো হয়। সংগীত ভুবনের
এই সম্রাজ্ঞীর জীবন কখনোই কুসুম বিছানো ছিল না। প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে
হয়েছে তাকে। ভারত আর পাকিস্তান মিলিয়ে যেখানে এই কিংবদন্তির রেকর্ডসংখ্যা
১৬০০, সেখানে বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র।
No comments