ভারত-চীন সম্পর্ক -সীমান্তে চীনের যুদ্ধংদেহী অবস্থান by ব্রহ্ম চেলানি
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) দেশটির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তির বদৌলতে বহু বিতর্কিত হিমালয় সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে দেশটির সীমান্তবাহিনীকে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার উসকানি দিচ্ছে। ফলে তারা ভারতের সঙ্গে একধরনের দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। পিএলএর এরূপ সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আসন্ন ভারত সফরে কালো ছায়া ফেলবে, দেশ দুটির ভবিষ্যৎ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেও এর প্রভাব অনুভূত হবে।
দেখা গেছে, চীনা নেতাদের ভারত সফরের আগে এরূপ উসকানির ঘটনা বরাবরই ঘটেছে। ২০০৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের ভারত সফরের আগে চীন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহৎ রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের ওপর তার দাবি পুনরায় উত্থাপন করে। একইভাবে, ২০১০ সালে চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওয়ের ভারত সফরের আগে কাশ্মীরের চীনা ভিসা প্রত্যাশী লোকজনের পাসপোর্টে একটি আলগা কাগজ স্টেপলার দিয়ে লাগিয়ে তাতে ভিসার সিল লাগিয়ে দেয় চীন। এটা ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জের শামিল ছিল। ভারতের অধিকৃত কাশ্মীর ও চীনের অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যকার এক হাজার ৫৯৭ কিলোমিটার সীমান্তরেখা চীন একসময় মেনে নিলেও তারা হঠাৎ করে তা লঙ্ঘন করে বসে। আর গত মে মাসে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াংয়ের সফরের পর পিএলএ ভারতের লাদাখ প্রদেশের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়ে।
চীন এখন আবারও সেটা শুরু করেছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তে তাদের আনাগোনা বেড়েছে। এই জায়গাতেই পিএলএর সীমা লঙ্ঘনের কারণে গত বছর তিন সপ্তাহের জন্য অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। তার মানে, চীনা নেতাদের সফরের উদ্দেশ্য কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো নয়, বরং চীনের স্বার্থ সংহত করা। আর এটা শুরু হয় ভূমির অধিকার দাবির মধ্য দিয়ে। এমনকি ভারতের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও চীন এই ভূমির দাবি থেকে সরে আসছে না।
ভারতের মনোভাব কিন্তু এর ঠিক বিপরীত। সেই জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে ভারতের সব প্রধানমন্ত্রীই চীন সফরে শুভকামনা নিয়ে গেছেন, কৌশলগত কিছু ছাড় তাঁরা দিয়েছেন, যেগুলো অনেকটা উপহারের পর্যায়েই পড়ে। ফলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে যে ভারত মার খেয়েছে, সেটা কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।
এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ২০০৩ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির তিব্বত-সংক্রান্ত আত্মসমর্পণ দেশ দুটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক কুখ্যাত নজির হয়েই থাকবে। বাজপেয়ি এত দূর গিয়েছিলেন যে প্রথমবারের মতো তিনি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অংশ হিসেবে’ তিব্বত অটোনোমাস রিজিয়নের (টিএআর) ‘স্বীকৃতি’ দেন। এর ফলে চীন ‘দক্ষিণ তিব্বত’ হিসেবে অরুণাচল প্রদেশ দাবি করে বসে (যা তাইওয়ানের তিন গুণ), একই সঙ্গে চীনের ভূমিসংক্রান্ত দাবিও জোরালো হয়। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে যায় যে চীন কোনো ভূমি দখল করলেই সেটা তাদের এবং তারা কোনো ভূমি দাবি করলেই সেটা ‘পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে’ মীমাংসা করতে হবে।
এর আগে নেহরু ১৯৫৪ সালে এক মহা ভুল করেছিলেন, বাজপেয়ি সেটাকে আরও পোক্ত করেছেন। নেহরু সে সময় চীনের তিব্বত অধিগ্রহণ মেনে নেন, যেটাকে বলা হতো পঞ্চশীল চুক্তি। অথচ সে সময় ভারত-তিব্বত সীমান্ত থাকলেও ভারত এর স্বীকৃতির জন্য কিছু করেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকার হিসেবে ভারত তিব্বতে যে রাষ্ট্রবহির্ভূত অধিকার ও সুবিধা ভোগ করত, সেটা হারিয়ে ফেলে।
চুক্তির শর্ত হিসেবে ভারত তিব্বত থেকে ‘সামরিক পাহারা’ উঠিয়ে নেয় আর চীনা সরকারকে ‘যুক্তিসংগত মূল্যে’ ডাক, টেলিগ্রাফ ও গণটেলিফোনসেবা প্রদান করে। এদিকে চীন বারবার আট বছরের চুক্তি ভঙ্গ করেছে, যা শেষমেশ ১৯৬২ সালের যুদ্ধে মোড় নেয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, চীন এই পঞ্চশীল চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে বোকা বানিয়েছে, অবমাননা করেছে। তার পরও এই গ্রীষ্মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভাইস প্রেসিডেন্ট হামিদ আনসারিকে এই চুক্তির ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বেইজিংয়ে পাঠান। সেই সফরে আনসারি একা যাননি, তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সিথারমনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী সেখানে একটি ঐকমত্যে স্বাক্ষর করেছেন, তার শর্ত অনুযায়ী চীন ভারতকে কোনো সুবিধা দেওয়া ছাড়াই ভারতে একটি শিল্পপার্ক স্থাপন করবে। এতে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। চীন বর্তমানে ভারত থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার তিন গুণ দেশটিতে রপ্তানি করে। চীনের রপ্তানি করা এসব পণ্যের মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে কাঁচামাল। ফলে ভারত নানা রকম কৌশলগত চাপে পড়ে যাচ্ছে এবং চীনের সমকক্ষ হিসেবে তার উত্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আসলে তিব্বতের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কারণেই চীন অরুণাচল প্রদেশ নিজেদের দাবি করার সাহস করেছে। এটাই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, তিব্বতের মর্যাদার বিষয়টি নয়। অর্থাৎ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে চীনের মাতব্বরিই মুখ্য। আর তিব্বত থেকে আসা নদীর পানিতে ভারতের হিস্যা থাকায় ভারতকে বড় খেসারত দিতে হবে।
চীন ক্রমাগতই সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু এটাকে লজ্জাকর মনে করেন, এ বছর ২১৬ দিনে ৩৩৪ বার এরূপ লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভারত সম্প্রতি একটি ভুয়া পার্থক্য নিরূপণ করেছে। চীনাদের অনুপ্রবেশের ঘটনাকে তারা দুই ভাগে বিভক্ত করেছে: তারা একটাকে বলছে ‘ভুল করে প্রবেশ’, আরেকটিকে বলছে ‘অনাহূত প্রবেশ’। ফলে চীনাদের সব লঙ্ঘনের ঘটনাই তারা ‘ভুল করে প্রবেশের’ কাতারে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু এই কথার খেলা থেকে ভারত কিছুই অর্জন করতে পারবে না।
জুলাই মাসের ব্রিকস সম্মেলনেও এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। সেখানেও দেখা গেল, ব্রিকস ব্যাংক (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) গঠনেও চীন ভারতের চেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ব্রিকস নামক এই নতুন উন্নয়ন ব্যাংকের সদর দপ্তর হবে চীনের সাংহাই শহরে, নয়াদিল্লিতে নয়। একজন ভারতীয় ব্যাংকটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হবেন, এটাই ভারতের সান্ত্বনা পুরস্কার।
নাছোড়বান্দা ও প্রতিশোধপরায়ণ চীনের চাপে ভারতের উচিত হবে সতর্কতার সঙ্গে একটি দূরদর্শী ও পাল্টা কৌশল প্রণয়ন। শুরুতেই ভারত তিব্বতে চীনের সার্বভৌমত্বের যে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেটা ফিরিয়ে নিতে পারে। বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে, চীন ঠিক যেটা করেছিল জাপান ও ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে—এই দেশ দুটিও চীনের কিছু ভূমি নিজেদের দাবি করেছিল। পানি, ভূমি ও রাজনৈতিক বিবাদে চীনকে প্যাঁচে ফেলে ভারত চীনের অগ্রগামী অবস্থানের রাশ টেনে ধরতে পারে।
তার পরও চীনের এই অকস্মাৎ আক্রমণ রুখে দিতে ভারতের উচিত হবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও চীনের অধিকৃত ভূমিতে সেনা পাঠানো। এতে কিছু প্রাণহানি হলেও চীন কিছুটা পিছিয়ে আসবে।
শেষমেশ এই ব্রিকস ও বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে ভারতের যে অংশীদারি গড়ে উঠছে, সেটা আসলে একধরনের ভণ্ডামি, যতক্ষণ একটি ভারসাম্যপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে না উঠছে। কারণ, এর ফলে ফেঁপে ওঠা বাণিজ্য ও ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়া সত্ত্বেও ভারত চীনের এই বলপ্রয়োগ থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের অধ্যাপক।
দেখা গেছে, চীনা নেতাদের ভারত সফরের আগে এরূপ উসকানির ঘটনা বরাবরই ঘটেছে। ২০০৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের ভারত সফরের আগে চীন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহৎ রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের ওপর তার দাবি পুনরায় উত্থাপন করে। একইভাবে, ২০১০ সালে চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওয়ের ভারত সফরের আগে কাশ্মীরের চীনা ভিসা প্রত্যাশী লোকজনের পাসপোর্টে একটি আলগা কাগজ স্টেপলার দিয়ে লাগিয়ে তাতে ভিসার সিল লাগিয়ে দেয় চীন। এটা ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জের শামিল ছিল। ভারতের অধিকৃত কাশ্মীর ও চীনের অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যকার এক হাজার ৫৯৭ কিলোমিটার সীমান্তরেখা চীন একসময় মেনে নিলেও তারা হঠাৎ করে তা লঙ্ঘন করে বসে। আর গত মে মাসে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াংয়ের সফরের পর পিএলএ ভারতের লাদাখ প্রদেশের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়ে।
চীন এখন আবারও সেটা শুরু করেছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তে তাদের আনাগোনা বেড়েছে। এই জায়গাতেই পিএলএর সীমা লঙ্ঘনের কারণে গত বছর তিন সপ্তাহের জন্য অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। তার মানে, চীনা নেতাদের সফরের উদ্দেশ্য কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো নয়, বরং চীনের স্বার্থ সংহত করা। আর এটা শুরু হয় ভূমির অধিকার দাবির মধ্য দিয়ে। এমনকি ভারতের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও চীন এই ভূমির দাবি থেকে সরে আসছে না।
ভারতের মনোভাব কিন্তু এর ঠিক বিপরীত। সেই জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে ভারতের সব প্রধানমন্ত্রীই চীন সফরে শুভকামনা নিয়ে গেছেন, কৌশলগত কিছু ছাড় তাঁরা দিয়েছেন, যেগুলো অনেকটা উপহারের পর্যায়েই পড়ে। ফলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে যে ভারত মার খেয়েছে, সেটা কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।
এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ২০০৩ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির তিব্বত-সংক্রান্ত আত্মসমর্পণ দেশ দুটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক কুখ্যাত নজির হয়েই থাকবে। বাজপেয়ি এত দূর গিয়েছিলেন যে প্রথমবারের মতো তিনি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অংশ হিসেবে’ তিব্বত অটোনোমাস রিজিয়নের (টিএআর) ‘স্বীকৃতি’ দেন। এর ফলে চীন ‘দক্ষিণ তিব্বত’ হিসেবে অরুণাচল প্রদেশ দাবি করে বসে (যা তাইওয়ানের তিন গুণ), একই সঙ্গে চীনের ভূমিসংক্রান্ত দাবিও জোরালো হয়। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে যায় যে চীন কোনো ভূমি দখল করলেই সেটা তাদের এবং তারা কোনো ভূমি দাবি করলেই সেটা ‘পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে’ মীমাংসা করতে হবে।
এর আগে নেহরু ১৯৫৪ সালে এক মহা ভুল করেছিলেন, বাজপেয়ি সেটাকে আরও পোক্ত করেছেন। নেহরু সে সময় চীনের তিব্বত অধিগ্রহণ মেনে নেন, যেটাকে বলা হতো পঞ্চশীল চুক্তি। অথচ সে সময় ভারত-তিব্বত সীমান্ত থাকলেও ভারত এর স্বীকৃতির জন্য কিছু করেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকার হিসেবে ভারত তিব্বতে যে রাষ্ট্রবহির্ভূত অধিকার ও সুবিধা ভোগ করত, সেটা হারিয়ে ফেলে।
চুক্তির শর্ত হিসেবে ভারত তিব্বত থেকে ‘সামরিক পাহারা’ উঠিয়ে নেয় আর চীনা সরকারকে ‘যুক্তিসংগত মূল্যে’ ডাক, টেলিগ্রাফ ও গণটেলিফোনসেবা প্রদান করে। এদিকে চীন বারবার আট বছরের চুক্তি ভঙ্গ করেছে, যা শেষমেশ ১৯৬২ সালের যুদ্ধে মোড় নেয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, চীন এই পঞ্চশীল চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে বোকা বানিয়েছে, অবমাননা করেছে। তার পরও এই গ্রীষ্মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভাইস প্রেসিডেন্ট হামিদ আনসারিকে এই চুক্তির ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বেইজিংয়ে পাঠান। সেই সফরে আনসারি একা যাননি, তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সিথারমনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী সেখানে একটি ঐকমত্যে স্বাক্ষর করেছেন, তার শর্ত অনুযায়ী চীন ভারতকে কোনো সুবিধা দেওয়া ছাড়াই ভারতে একটি শিল্পপার্ক স্থাপন করবে। এতে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। চীন বর্তমানে ভারত থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার তিন গুণ দেশটিতে রপ্তানি করে। চীনের রপ্তানি করা এসব পণ্যের মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে কাঁচামাল। ফলে ভারত নানা রকম কৌশলগত চাপে পড়ে যাচ্ছে এবং চীনের সমকক্ষ হিসেবে তার উত্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আসলে তিব্বতের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কারণেই চীন অরুণাচল প্রদেশ নিজেদের দাবি করার সাহস করেছে। এটাই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, তিব্বতের মর্যাদার বিষয়টি নয়। অর্থাৎ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে চীনের মাতব্বরিই মুখ্য। আর তিব্বত থেকে আসা নদীর পানিতে ভারতের হিস্যা থাকায় ভারতকে বড় খেসারত দিতে হবে।
চীন ক্রমাগতই সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু এটাকে লজ্জাকর মনে করেন, এ বছর ২১৬ দিনে ৩৩৪ বার এরূপ লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভারত সম্প্রতি একটি ভুয়া পার্থক্য নিরূপণ করেছে। চীনাদের অনুপ্রবেশের ঘটনাকে তারা দুই ভাগে বিভক্ত করেছে: তারা একটাকে বলছে ‘ভুল করে প্রবেশ’, আরেকটিকে বলছে ‘অনাহূত প্রবেশ’। ফলে চীনাদের সব লঙ্ঘনের ঘটনাই তারা ‘ভুল করে প্রবেশের’ কাতারে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু এই কথার খেলা থেকে ভারত কিছুই অর্জন করতে পারবে না।
জুলাই মাসের ব্রিকস সম্মেলনেও এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। সেখানেও দেখা গেল, ব্রিকস ব্যাংক (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) গঠনেও চীন ভারতের চেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ব্রিকস নামক এই নতুন উন্নয়ন ব্যাংকের সদর দপ্তর হবে চীনের সাংহাই শহরে, নয়াদিল্লিতে নয়। একজন ভারতীয় ব্যাংকটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হবেন, এটাই ভারতের সান্ত্বনা পুরস্কার।
নাছোড়বান্দা ও প্রতিশোধপরায়ণ চীনের চাপে ভারতের উচিত হবে সতর্কতার সঙ্গে একটি দূরদর্শী ও পাল্টা কৌশল প্রণয়ন। শুরুতেই ভারত তিব্বতে চীনের সার্বভৌমত্বের যে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেটা ফিরিয়ে নিতে পারে। বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে, চীন ঠিক যেটা করেছিল জাপান ও ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে—এই দেশ দুটিও চীনের কিছু ভূমি নিজেদের দাবি করেছিল। পানি, ভূমি ও রাজনৈতিক বিবাদে চীনকে প্যাঁচে ফেলে ভারত চীনের অগ্রগামী অবস্থানের রাশ টেনে ধরতে পারে।
তার পরও চীনের এই অকস্মাৎ আক্রমণ রুখে দিতে ভারতের উচিত হবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও চীনের অধিকৃত ভূমিতে সেনা পাঠানো। এতে কিছু প্রাণহানি হলেও চীন কিছুটা পিছিয়ে আসবে।
শেষমেশ এই ব্রিকস ও বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে ভারতের যে অংশীদারি গড়ে উঠছে, সেটা আসলে একধরনের ভণ্ডামি, যতক্ষণ একটি ভারসাম্যপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে না উঠছে। কারণ, এর ফলে ফেঁপে ওঠা বাণিজ্য ও ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়া সত্ত্বেও ভারত চীনের এই বলপ্রয়োগ থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের অধ্যাপক।
No comments