অতীত প্রসঙ্গ-বাঙালি-মুসলিম যুবকের সঙ্গে গান্ধী পৌত্রীর প্রেম এবং অতঃপর... by আবু সাঈদ খান
গান্ধীবাদী না হলেও মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবন ও সংগ্রামের প্রতি বরাবরই আমার কৌতূহল। কী করে ক্ষীণকায়, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ধুতি পরা সাদামাটা মানুষটি অহিংসার বাণীকে ধারণ করে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, কোন সম্মোহনী ক্ষমতায় দল-মত-নির্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছেন_ তা আজও বিস্ময় জাগায়।
সেই মহীরুহসম ব্যক্তির স্নেহধন্য ছিলেন বাংলাদেশের মাদারীপুরের মেয়ে ডা. জোহরা বেগম কাজী। ভারতের নাগপুরে মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাগ্রাম আশ্রমে তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। দুই পরিবারের মধ্যেও যোগাযোগ আর ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ নিয়ে ডা. জোহরা কাজীর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখা পড়েছি। কাজী পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের কাছেও গল্প শুনেছি। জোহরার অগ্রজ কাজী আশরাফ মাহমুদের 'লেটার বক্স অব অ্যান আননোন ম্যান' বইয়েও নানা তথ্য সনি্নবেশিত হয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর সমকালে প্রকাশিত 'গান্ধী পরিবার ও ডা. জোহরা বেগম কাজী' শিরোনামে শ্রদ্ধাভাজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর লেখাটি নতুন এক অধ্যায় সংযোজন করল। এতে মহাত্মা গান্ধীর পুত্র রামদাসের সঙ্গে জোহরার হৃদয় ঘটিত অজানা কাহিনী জানা গেল। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী লিখেছেন, 'একি! খালি গায়ে খালি পায়ে মহাত্মা গান্ধী দাঁড়িয়ে কেন? সামনে কে? ছবি পরিষ্কার হলো। সামনে উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গিনী, তীক্ষষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত অকুতোভয় ডা. জোহরা কাজী।' 'বাপুজি, আপনি এ কি করছেন?' 'জোহরা, তুমি আমাকে ভিক্ষা দাও। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও রামদাসকে, আমি কারও কাছে কখনও দয়া ভিক্ষা করিনি। আজ তোমার কাছে দয়া চাচ্ছি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। জোহরা, তুমি আমাকে ভিক্ষা দাও। রামদাস তোমাকে বিয়ে করলে ভারতে আগুন জ্বলবে। আমার মুখ থাকবে না। মা জোহরা, তুমি আমাকে ভিক্ষাদাও।' পাশে কাঁপছেন কস্তুরী বাঈ।
জোহরার চোখের আলো আরও দীপ্ত হলো। তিনি এ কী দেখছেন। এ কী শুনছেন! ধীরে ধীরে তার ঠোঁট নড়ছে কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। মনে পড়ছে, এমবিবিএস পাস করে পদধূলি নেওয়ার সময় বাপুজি তাকে বলেছিলেন, 'জোহরা, কখনও ভয় পাবে না। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। শত্রুরা তোমার কী করবে? বড়জোর জীবনটা নেবে। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হলো আদর্শ।'
লেখাটি পড়ে চমৎকৃত হই। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। তাকে বলি, 'লেটার বক্স অব অ্যান আননোন ম্যান' পুস্তিকাটি আমার কাছে আছে। সে বইয়ের তথ্য অনুযায়ী রামদাসের মেয়ে সুমিত্রার সঙ্গে ডা. জোহরার বড় ভাই আশরাফ মাহমুদের প্রেমঘটিত ব্যাপার ছিল। তার কথার সূত্র ধরে লেখার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তিনি অনুমতি দেন।
১৯৯২ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিষয়ক এক সেমিনারে গিয়েছিলাম। তখন ঘরোয়া আড্ডায় এক প্রবীণ সাংবাদিক বলেছিলেন, ঢাকার এক ছেলের সঙ্গে গান্ধীর পৌত্রীর প্রেম ছিল। বিয়েতে বাদ সেধেছিলেন স্বয়ং গান্ধী। গান্ধীর জীবনীকার ও গবেষকরা কেন বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন?
ঢাকায় ফিরে খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখলাম, বিষয়টি নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। অনেকদিন পর জেনেছি, জোহরা কাজীর বড় ভাই আশরাফ মাহমুদের সঙ্গে গান্ধী-পৌত্রীর প্রেমকাহিনী। তখন অগ্রজপ্রতিম বন্ধু মাহমুদের ভ্রাতুষ্পুত্র আলমগীর সাত্তার (লেখক ও বৈমানিক) আমার আগ্রহ দেখে আশরাফ মাহমুদ সম্পাদিত 'লেটার বক্স অব অ্যান আননোন ম্যান' এবং তার 'বিরহী' কাব্যগ্রন্থটি আমাকে দেন। এ নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল। তা আর হয়ে ওঠেনি। এবার জাফরুল্লাহ চৌধুরী আলোচনাটি এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিলেন।
পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো কাজী আশরাফ মাহমুদও গান্ধীজির স্নেহধন্য ছিলেন। তবে ভাবাদর্শে মাহমুদ ছিলেন বিপরীত অবস্থানে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কমিউনিজমের আদর্শে অনুপ্রাণিত মাহমুদ কলকাতা মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে মাস্টার্স ও পিএইচডি করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেন। হিন্দি/মৈথিলি ভাষার শক্তিমান এ কবির কাব্যগ্রন্থ হলো_ বিহগী, বিহঙ্গিনী, কুতাজ, কুতাজমালা, প্রসাদ, নিমন্ত্রণ, নিবেদন,
বিরহী ইত্যাদি।
'লেটার বক্স...' পুস্তিকায় কাজী আশরাফ মাহমুদ এবং জোহরা কাজীকে লেখা বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির ৩১টি চিঠি রয়েছে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সালের জুনের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, তার প্রাইভেট সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই, গান্ধী-তনয় রামদাস, গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও জোহরার সহপাঠী সুশীলা নায়ার (যিনি পরবর্তীকালে নেহরু ক্যাবিনেটের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন), পেয়ারেলাল নায়ার, দিলীপ কুমার এবং শংকরণ নায়ার এসব চিঠি লিখেছেন।
কংগ্রেস বা গান্ধীর আদর্শের অনুসারী না হয়েও মাহমুদ বিভিন্নভাবে তাদের যে সহযোগিতা করেছেন, চিঠিগুলো পড়লে তা বোঝা যায়। দেশাই তাকে একাধিকবার গান্ধীর জন্য ট্রেন রিজার্ভ, তা ধুয়েমুছে সাফ করা, স্টেশনে থাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছেন, যা মাহমুদ যথাসাধ্য পালনও করেছেন। নাগপুরে তাদের বাড়িতে বিভিন্ন কংগ্রেস নেতার থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ১৯৪২ সালে মাহমুদের পিতার মৃত্যুতেও দেশাই,
সুশীলা শোক জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। সর্বাধিক চিঠি লিখেছেন রামদাস গান্ধী। বলা আবশ্যক, মাহমুদের পাঠানো
কোনো চিঠি এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবে প্রতিটি চিঠির সঙ্গে পাদটীকা থাকায় এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
এবার মাহমুদের সঙ্গে রামদাস কন্যার হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে চোখ ফেরানো যাক। ১৯৪৩ সালের ২০ নভেম্বর মাহমুদ নাগপুরের রামটেকে গিয়ে ওঠেন পাহাড়ের চূড়ার ওপর বন্ধু রামদাসের বাড়িতেই। এ মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশেই ৩৬ বছরের পরিণত যুবকের সঙ্গে চঞ্চলা কিশোরী সুমিত্রার হৃদ্যতা এবং মন দেওয়া-নেওয়া। কবি মাহমুদ তাকে লক্ষ্য করে লিখলেন, 'চপল হরিণী হরি আয়ে,/হো হো চপল চরণ হরি আয়ে/মেরে প্রাণ ভুলায়ান আয়ে/মেরে নয়ন লোভায়ন আয়ে/...।' বিষয়টি রামদাসের কাছে গোপন থাকল না। তাই ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে মাহমুদ রামদাসের কাছে তাদের সম্পর্কের কথা জানালেন। প্রতিউত্তরে রামদাস বললেন, 'বন্ধু, আমি অনেক ভেবেছি। বুঝেছি, সুমিত্রা তোমাকে ছাড়া সুখী হবে না। তাই তোমাদের বিয়ের বিষয়ে আমি মনস্থির করেছি।'
আনন্দে উদ্বেলিত সবাই। কারাবাস আর অনশনের ধকল কাটিয়ে ১৯৪৪ সালের আগস্টে গান্ধী ফিরলেন সেবাগ্রামে। মাহমুদের আনন্দে মিলেছে ভিন্ন এক মাত্রা। রামদাস কথা দিয়েছেন। নির্মলারও সম্মতি রয়েছে। শুধু বাপুজির কাছ থেকে অনুমতির অপেক্ষা। মাহমুদের কাছে মনে হয়েছে, এ কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু সুমিত্রার মধ্যে গভীর আতঙ্ক। তিনি মাহমুদের কানে কানে বললেন, 'বাপু আমাদের বিয়েতে রাজি হবেন না।' ত্রুক্রদ্ধ হয়ে মাহমুদ বললেন, 'তোমার মা-বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন শুধু বাপুর সম্মতির ব্যাপার।' কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুমিত্রার কথাই সঠিক প্রমাণিত হলো। ১৯৪৪ সালের ১৩ আগস্ট ব্যর্থ মনোরথ হয়ে চিরতরে মাহমুদকে সেবাগ্রামের আশ্রম ছাড়তে হলো।
৮ আগস্ট মাহমুদকে লেখা এক পত্রে গান্ধী তাকে ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে লিখলেন যে, অভি ভি মৈ তো তুম কো পুত্রবৎ হি সমঝুগা (তবুও তোমার প্রতি আমার পুত্রবৎ স্নেহই অটুট থাকবে)। গান্ধীজি রামদাসকে পত্রে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। সেখানে উল্লেখ ছিল যে, তিনি প্রেমের বিয়ে সমর্থন করেন না। এ নিয়ে রামদাসের সঙ্গে জোহরা কাজীরও পত্রবিনিময় হয়েছিল। রামদাস জোহরাকে লেখেন, বাপুর সিদ্ধান্তই তাদের জন্য শিরোধার্য। তবে তিনি বয়সের পার্থক্যের কথাও বলেন। মাহমুদের মা বিষয়টি নিয়ে গান্ধীজিকে লিখলে তার পক্ষে একান্ত সচিব পেয়ারেলাল চিঠির জবাব দেন। এতে সুমিত্রাকে 'জাস্ট এ চাইল্ড' বলে উল্লেখ করে বলা হয়, এ মুহূর্তে তার বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না।
মাহমুদ প্রেমের বিয়ে এবং কম বয়সের ব্যাপারটা একমাত্র যুক্তি কি-না সে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ক্ষেত্রে মাহমুদের যুক্তিতে আসা যাক_ ফিরোজ গান্ধী ও ইন্দিরার প্রেমের বিয়ে গান্ধীজি সমর্থন করেছিলেন এবং নেহরুকে রাজি করিয়েছিলেন। রামদাসের সঙ্গে ১৪ বছরের নির্মলার প্রেমের বিয়েরও অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। মাহমুদের বিবেচনায় 'প্রেম' ও বয়সের অজুহাত কোনো বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে তিনি দু'চার বছর দেরি করার কথা বলতে পারতেন। তবে রাজি না হওয়ার কী সে কারণ, যা গান্ধীর মনের গভীরে ছিল? এ ব্যাপারে মাহমুদ নির্বাক। একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন তিনি। '৪৪ সালের ১৩ আগস্ট তিনি যখন গান্ধীর অমতের জন্য ভারাক্রান্ত হয়ে একই গাড়িতে সি. রাজা গোপালাচারি এবং সুব্রামনিয়ামের সঙ্গে ওয়ার্দা স্টেশনে যাচ্ছিলেন, তখন রাজাজি তাকে বলেছিলেন, 'মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, জিন্নাহ হ্যাজ গট পাকিস্তান রাইট ইন হিজ পকেট নাউ।' এরপর সুমিত্রাকে গান্ধীজি বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ দু'বছর রাজপুতনার পিলানিতে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। এ ব্যাপারে রামদাস ছিলেন অসহায়। গান্ধীর সিদ্ধান্ত তার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তিনি সর্বদাই বন্ধু মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে গেছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে মাহমুদ, জোহরা বেগম কাজী, শিরিন কাজীসহ গোটা কাজী পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেই সময় তার সঙ্গে ড. কাজী মোতাহার হোসেনেরও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তখন অকৃতদার এই রোমান্টিক কবি মাহমুদের মধ্যে কেবল বিরহের সুর। ১৯৬৮ সালে এসব বিরহের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় সুমিত্রার ছবিসহ 'বিরহী' কাব্যগ্রন্থ। হিন্দি থেকে কবিতাগুলো অনুবাদ করেন কাজী মোতাহার হোসেন। মূল কবিতা ও বাংলা অনুবাদসহ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল শুধু বন্ধুদের মধ্যে বিলি করার জন্য। এতে সুমিত্রাকে উৎসর্গকৃত কবিতা থেকে কয়েকটি চরণ উল্লেখ করা হলো_
জীবনের এই অন্তিম ক্ষণে পেঁৗছিয়া আজ/বিরহ-মূর্ছিত আমি, হায়,/ তাই চির-সাথী বেদনার কাছে/প্রাণ মোর কাঁদিয়া কাঁদিয়া বিদায় চায়!
প্রাণের পাখি উড়িয়া চলিল সে কোন বনে/গাহিতে গাহিতে, প্রিয়ে, এইগান/ 'এ রজনী কি পোহাবে না আর? ইহার পরে কি/আসিবে না ফের নব ঊষার ফরমান?'
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments