জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের হিসাব- ব্যাংকের মুনাফা কমেছে, লোকসানও হচ্ছে by মনজুর আহমেদ
বছরের তৃতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এসে হঠাৎ করেই ব্যাংকগুলোর মুনাফা থমকে গেছে। এ সময় লোকসানও গুনেছে অনেক ব্যাংক। আগের দুই প্রান্তিকে যে মুনাফা হয়েছিল, তা দিয়েই কোনো রকমে নয় মাসের মুনাফার হিসাব করেছে ব্যাংকগুলো।
আগের বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে মাত্র সাতটি ব্যাংক আগের বছরের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। সাতটি ব্যাংক বড় অঙ্কের নিট লোকসান দিয়েছে। এ চিত্র সাম্প্রতিক বছরগুলোর সঙ্গে বেমানান। কেননা, কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকগুলো বড় ধরনের মুনাফা করছিল।সময়মতো ঋণ আদায় করতে না পারায় তার বিপরীতে বড় অঙ্কের নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) সংরক্ষণ, শেয়ারবাজারে মূল্যপতনের কারণে নতুন করে প্রভিশনিং, নিত্যপণ্য আমদানি অর্থায়নে টাকা আটকে পড়া, কিছু শিল্প ও ব্যবসা খাতের মন্দা, আমানত সংগ্রহে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং নতুন বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে বলে ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির প্রভাব।
দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তালিকা-ভুক্ত। শর্ত মেনে ব্যাংকগুলোকে অনিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়েছে। মূল্য সংবেদনশীল এসব তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশের পর ব্যাংকগুলোর শেয়ারের এক দফা মূল্যপতনও ঘটেছে।
নিট মুনাফার হিসাব থেকে গত তিন মাসে ব্যাংকগুলোর ব্যবসায় মন্দার কথাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন। আর এ নিয়ে নানা ধরনের আভাস দিয়েছেন ব্যাংকাররা, শঙ্কাও আছে তাঁদের মধ্যেও।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, জুলাই-সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি নিট লোকসান দিয়েছে ব্যাংক এশিয়া। লোকসানের পরিমাণ ৪৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। তারপর রয়েছে রূপালী ব্যাংক, ২৮ কোটি এক লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংক ২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা, দি সিটি ব্যাংক ২৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক ১৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক আট কোটি ৪৩ লাখ টাকা এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৬২ লাখ টাকা।
ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন বিধান কার্যকর হবে। ফলে নতুনভাবে ঋণ শ্রেণীকরণ ও ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এতে ব্যাংক খাতের নিট মুনাফা আরও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও নতুন বিধানের কারণে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি বা শক্তি বাড়বে। তবে এখন যে নিট মুনাফা কমেছে, ইতিপূর্বে বিতরণ করা ঋণ আদায় আটকে পড়াই এর কারণ।
ব্যাংক এশিয়ার প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুসারে হিসাব করা শুরু করেছিলেন। পরে আগের নিয়মে করতে গিয়ে প্রায় ৩০ ভাগ নতুন নির্দেশনা অনুসারে রয়ে গেছে। এতে তাঁদের লোকসান বেশি হয়েছে। তাঁদের ব্যাংকের আর্থিক ভিত শক্ত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রিয়েল এস্টেট খাত: অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি খাত নিয়ে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান ব্যাংকাররা। এর মধ্যে রিয়েল এস্টেট বা আবাসন খাতের বেচাবিক্রি কমে গেছে। বেশ কিছু ঋণগ্রহীতা ভিন্ন খাতের জন্য ঋণ নিয়ে বড় মুনাফার আশায় এ খাতে বিনিয়োগ করেছে। এখন বেচাবিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের টাকা ফেরত আসছে না।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখারও মনে করেন, আবাসন খাতে কিছু ঋণ আটকে আছে। যে কারণে প্রভিশনিং করতে নিট মুনাফা কমে গেছে কারও কারও।
জাহাজভাঙা শিল্প: কয়েকটি ব্যাংক জাহাজভাঙা শিল্পেও বিনিয়োগ করেছিল। এখন এ খাতে বড় অঙ্কের ঋণ আটকা পড়েছে। দি সিটি ব্যাংকের এমডি কে মাহমুদ সাত্তার বলেন, তাঁদের কিছু নতুন ঋণ জাহাজভাঙা শিল্পে মূল্যপতনের কারণে আটকে পড়েছে। ফলে তাঁদের বড় অঙ্কের প্রভিশন করতে হয়েছে। তিনি আরও জানান, ‘আমাদের পুরোনো কিছু ঋণ অনেক দিন ধরে আমরা টেনে যাচ্ছিলাম। একটু একটু পরিশোধ করছিল গ্রাহকেরা। এখন আমরা শক্ত অবস্থান নিয়েছি। ফলে সব মিলে ব্যাংকের তৃতীয় প্রান্তিকে লোকসান হয়েছে। তবে তিন প্রান্তিক মিলে লাভ থাকছে।’
নিত্যপণ্য আমদানি অর্থায়ন: একদল ব্যবসায়ী আমদানি করা নিত্যপণ্য বাজারজাত করতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ তিন মাসের জন্য বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গ করায় হাজার হাজার কোটি টাকা এখন মেয়াদি ঋণ হয়ে আটকে গেছে। আর ব্যাংকগুলোও যাচাই-বাছাই বা ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ ছাড়াই এই বিপুল অর্থায়ন করে এখন ফেঁসে গেছে। এসব অর্থায়নই সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর নগদ সংকটের অন্যতম কারণ।
সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা তাঁদের এই অর্থায়নগুলো ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মেয়াদের জন্য পুনঃ তফসিল করে নিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে এখনো এর কাজ চলছে। ফলে স্বল্প মেয়াদে ৯০ দিন কিংবা ১২০ দিনে যে অর্থ ব্যাংকের কাছে ফিরে আসার কথা ছিল, তা এখন মেয়াদের ভিন্নতায় পাঁচ বছর অথবা তারও বেশি সময় ধরে ব্যাংকে আসবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এর সুদ মওকুফসহ নানা ধরনের মুনাফা ছাড় ও কিছু ক্ষেত্রে খেলাপি হয়ে পড়ায় নতুন প্রভিশনিংয়েরও প্রয়োজন হয়েছে। যাতে নিট মুনাফা কমে গেছে।
শেয়ারের মূল্যপতন: শেয়ারবাজারে নানাভাবে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো ব্যাংক। তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ আছে, তেমনি গ্রাহককেও ঋণ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক ঋণ (মার্জিন লোন) সীমা অনুসরণও হয়নি। আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বহুবার এই সীমা পরিবর্তন করেছে। এখন শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় মার্ক টু মার্কেট (বাজারদরে সমন্বয়) রাখতে গিয়ে নতুন করে প্রভিশন করায় নিট মুনাফায় প্রভাব পড়েছে।
ভালো মুনাফা কীভাবে: মাত্র সাতটি ব্যাংক জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আগের বছরের তুলনায় বেশি নিট মুনাফা করেছে। সাফল্য পাওয়া আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আগে যে শাখার খেলাপি ঋণ, তারাই এটা আদায়ের উদ্যোগী হতো। আমি প্রধান কার্যালয়ে আইন বিভাগ খুলে সব খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগ এদের হাতে দিয়েছি। এতে নগদ আদায় বেড়েছে।’
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের এমডি এ এ এম জাকারিয়া বলেন, ‘এলসি জাতীয় এবং শিল্প-বাণিজ্যে ঋণ বিতরণ করে ভালোভাবে তা আদায় করার মধ্য দিয়েই আমরা নিট মুনাফা করেছি।’ ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি এম শাহ আলম সারওয়ার বলেন, ‘আমরা অস্থিরতার দিকে যাইনি। নিরাপদ বিনিয়োগ করেছি। আমানত সংগ্রহেও কখনো অতিরিক্ত সুদ দিইনি।’
No comments