পোড়া কপাল! by সুভাষ সাহা
খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির জোয়ালটা শেষ পর্যন্ত কলুর বলদের মতো গরিবের ঘাড়েই চাপে। তখন বেচারা গরিবের কাছে একফালি চাঁদ সুকান্তের কবিতার মতো ঝলসানো রুটির মহিমা নিয়ে হাজির হয়। খাদ্যের বাড়তি অর্থ জোগাতে গিয়ে গরিব তার আদরের শিশুসন্তানকে স্কুলে না পাঠিয়ে ফুটফরমাশের কাজে লাগায়।
এভাবে আমাদের মতো দেশগুলোতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলে। আর এমনি বিদেশি সাহায্য সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু শ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে সেমিনারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শিশুশ্রমের মহাপাপ থেকে আমাদের দেশ ও সমাজকে উদ্ধার করার জন্য সারগর্ভ রচনামৃত উপহার দিতে থাকে। আর আমরা বাণী চিরন্তনী জ্ঞানে সেই রচনামৃত মগজে সেঁটে যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে বাহবা দিতে থাকি। কিন্তু ক্ষুধায় যে শিশুটি রোগা-পাতলা হয়ে বেড়ে উঠছে, যাকে বলা হয় আন্ডারওয়েট, তাদের জন্য স্থায়ী কোনো সমাধানসূত্র মেলে কি! আর মিলবেই-বা কী করে! সারা দুনিয়ায় তাদেরই পরিচালিত কোনো করপোরেট হাউস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যে স্পেক্যুলেশনের মাধ্যমে খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাড়তি অর্থ ট্যাঁকে গুঁজতে ব্যস্ত। আল জাজিরা খাদ্যের আন্তর্জাতিক বাজারকে কীভাবে স্পেক্যুলেশনের মাধ্যমে প্রভাবিত করে বার্কলে ব্যাংক দু'বছর ধরে বাড়তি আয় করে নিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, কোনো খাদ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়, একটি প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যাংক এই অনৈতিক কাজটি করেছে। আসলে এখন ব্যাংক অর্থাৎ ফিন্যান্স পুঁজি নয়া ইম্পেরিয়াল জমানায় স্বয়ম্ভূ সত্তায় পরিণত হয়েছে। নগদ টাকার কারবারিদের ওপর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব খ্যাত সিরাজদ্দৌলার (চক্রান্তকারী জেনেও অর্থ লগি্নকারক জগৎশেঠের অর্থের জন্য নবাবকেও তার ওপর নির্ভর করতে হতো) মতো বিশ্বের তাবৎ সরকারকে নির্ভর করতে হয়। এই অতিকায় ফিন্যান্স পুঁজির নজর থেকে গরিবের মোটা ভাতও বাদ নেই। আমাদের দেশেই দেখুন না। মাত্র কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কীভাবে সিন্ডিকেট করে ভোজ্যতেলসহ খাদ্যসামগ্রীর দাম ওঠানামা করায়। মনে রাখতে হবে যে, তারা অনেকেই আবার বেসরকারি ব্যাংকেরও মালিক। তাই আমদানি-রফতানিতে টাকার জোগানেও বাধা পড়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাজারের ওপরও তাদের নিয়ন্ত্রণকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই আমরা মিডিয়াকর্মীরা এবং জনগণ এ নিয়ে যতই সোচ্চার হই না কেন তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারি না কেউ। সরকার বরং তাদের নিয়েই বৈঠক করে আবেদন-নিবেদন জানিয়ে নিজেদের কর্তব্য সারার চেষ্টা করে। যদি টিসিবি সচল থাকত বা জরুরি আমদানি-রফতানি ও বাজারজাত করার মতো কর্মী মজুদ থাকত, তাহলে সরকার তাদের কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারত। কিন্তু মোক্ষম অস্ত্রটি যে লিবারেল অর্থনীতির প্রবক্তা আন্তর্জাতিক মুরবি্বরা বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করার কুযুক্তির আড়ালে অনেক আগেই আমাদের হাত থেকে নিয়ে নিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে একটা মূল্য নির্ধারণ করে এসব ব্যবসাদার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নিতে পারছে। দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কশাঘাত যে শেষ পর্যন্ত গরিবকেই বেশি কাবু করে তা কি বার্কলে ব্যাংক বা আমাদের নিত্যপণ্য ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা জানেন না? তারা অবশ্যই জানেন। আর জানেন বলেই তো তারা ক্ষুধাকে পুঁজি করে ব্যবসা ফাঁদতে পারেন। অবশ্য আমাদের উৎসবের সময় যেমন দান-খয়রাত করে অনেক কোটিপতি খোদার নেক নজর এবং দানশীল ব্যক্তির সম্মান পেতে চান, তেমনি এসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও গরিবদের কীভাবে কষ্ট লাঘব করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে হয়রান হন। আমরা জ্ঞানধারী-মগজওয়ালার তখন তাদেরই পায়রোবি করে আত্মপ্রসাদ লাভ করি। পোড়া কপাল!
No comments