জন্মদিন-বন্ধু, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে... by আফজাল হোসেন
ভালো লাগে, এখনও প্রায় সবাই বেঁচে আছি, এখনও পরস্পরের বন্ধু হয়ে আছি। মৃত বন্ধুর জন্য মনে হলেই শোক করি। যে কোনো বন্ধুর সাফল্যে গর্ববোধ হয়। এক ঢাকা শহরে সবারই বসবাস, কেউ দূরে, কেউ কাছে। ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। যখন হয়, আমাদের সময় আমাদের কাছেই ফিরে আসে
হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না।
দুটি কান বা দুই চোখ দেখতে একই রকম হলেও তফাত থাকে। যে দুই পা দিয়ে রোজ আমরা সরল বা দুর্গম, ন্যায্য ও অন্যায্য পথ পাড়ি দিয়ে চলেছি সে দুই পায়ের ধরন-গড়ন খালি চোখে এক রকম দেখায় কিন্তু পার্থক্য রয়েছে। কেন এই পার্থক্য, ভেবে কূল-কিনারা মিলবে না।হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না।
যিনি সর্বময় সৃষ্টিকর্তা কোন খেয়ালে এমন তফাত রচনা করছেন? বেখেয়ালে যে নয় তা স্পষ্ট। নিজ সৃষ্টির সঙ্গে এ এক রসিকতা, ভাবা যায় না। তার মানে এই ছোট-বড়র কোনো মানে আছে। জগৎ এবং জীবনকে রহস্যে ভরপুর রেখেছেন তিনি। রহস্য রয়েছে বলেই ওই দুয়ের প্রতি মানব সম্প্রদায়ের আকর্ষণ অতি তীব্র। মনুষ্য মনে রহস্য আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষা প্রবল। সেই নেশায় দৌড়ে, ঝাঁপিয়ে মানুষ এক সময় টের পায় পেঁৗছে গেছে জীবনের শেষ প্রান্তে। গভীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তখন ছোট্ট প্রশ্ন জাগে, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে জীবন এত ছোট কেন? সকল মনে এ প্রশ্ন জাগে না। সকল মন জগৎ ও জীবনের রহস্য খুঁজে হয়রানও হয় না।
চারদিকে অজস্র অসঙ্গতি, ছোট-বড়, সমান-অসমানের প্রসঙ্গ এলো সে কারণে নয়। এক সময় না জেনে, না বুঝে বড় বিষয়কে ছোট ভেবেছি। আমাদের তখন যৌবনকাল। প্রায় এক ডজন বন্ধু, সবাই হৈচৈপ্রিয়, অস্থির, স্বপ্নবাজ। মধ্যে একজন একটু ভিন্ন। বন্ধু হিসেবে সে সমান প্রিয় কিন্তু তার ভাবনার ভিন্নতায় মন দেইনি, কান দেইনি কেউ। তার ভাবনার বিষয় শুধু তারই থেকে গেছে। আমরা আগ্রহ প্রকাশ করিনি, উৎসাহ দেখাইনি, হেলা করেছি।
সেটা সত্তর দশক। তখন কেউ ছোট ছিলাম বলা যাবে না, সবাই তখন পূর্ণদৈর্ঘ্য। আকার-আকৃতি, রঙে-ঢঙে, আচার-ব্যবহারে কেউ কারও মতো ছিলাম না, তবু আমরা সবাই হয়ে উঠি সবার অতি নিকটের মানুষ। মনের মিল, বয়সে মিল ছিল ষোলোআনা। বন্ধুত্বে অমিলও থাকে। সে পূর্ণ যৌবনকালে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় সবার আগ্রহ ও আনন্দ ছিল, সেটাকেই ধরে নেওয়া যায় মনের মিল। সহসা অমিলের আবির্ভাব কখনও বন্ধুত্বকে মলিন করেনি।
যে কোনো বন্ধুদলে একজন কেন্দ্র থাকে, ফরিদুর রেজা সাগর ছিল আমাদের কেন্দ্রবন্ধু। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতাম ঢাকার এদিক-ওদিক। কিন্তু বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণে, স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকের প্রায় উল্টো দিকে 'খাবারদাবার' ছিল আমাদের প্রাণের জায়গা। সেখানে সাগরকে পাওয়া যেত। শাইখ সিরাজকে পাওয়া যেত। বন্ধুদলে সিরাজ সবচেয়ে নিরীহ গোছের মানুষ, সবচেয়ে ধীরস্থির। সাহিত্য, সংস্কৃতি, থিয়েটার, সিনেমা, খেলাধুলা নিয়ে তার উৎসাহ ছিল, তবে বেশি মাতামাতি ছিল না। তার আগ্রহের বিষয় ছিল কৃষি। বিষয়টাকে আমরা হেলা করতাম। তা আমাদের মাথা ঘামানোর বিষয় ছিল না। এখন ভাবতে অবাক লাগে, সবাই সবার টানে এক জায়গায় ছুটে যেতাম। একত্রে আট ফুট ও দশ ফুট একটা ঘরে কাটিয়ে দিতাম অবসরের প্রায় পুরোটা সময়। বন্ধুত্ব তখন সবার উপরে, অনেক মূল্যবান প্রত্যেকের কাছে। কারও সঙ্গে কারও সম্পর্কে অবহেলা ছিল না, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভাবনা ভাগাভাগির বন্ধু ছিলাম অথচ সেই ঝড়ের মতো দিনগুলোয় কেবল একজন বন্ধুর ভাবনাসঙ্গী হওয়া হয়নি।
খাবারদাবারে আমরা খাই, আড্ডা মারি, আলোচনায় বসি, নিজেদের ভালো-মন্দ, ক্ষমতা-অক্ষমতা নিয়ে তর্ক হয়। আমরা স্বপ্ন, দুঃখ, আনন্দের কথা বলি। কোনো কিছুর মধ্যে কৃষি সামান্য উঁকিও দেয় না। কৃষি একলা থেকে যায় বন্ধু শাইখ সিরাজের জন্য। আমাদের আগ্রহের বিষয়ে সিরাজের সদাহাস্য উপস্থিতি সর্বদা ছিল। এত দিন পর মনে হয় সকলের মাঝখানে বসেও অনেক দিন মানুষটা নিঃসঙ্গ থেকেছে। আমরা ঠাট্টা-মশকরা করেও মজা পাই। এক সঙ্গেই রয়েছি, হয়তো কবিতা নিয়ে কথা হচ্ছে, কিংবা নাটক, সে সময় সিরাজের কিছু একটা মনে হলো, তার পছন্দের বিষয়ে সে কথা উচ্চারণ করতেই আমাদের মধ্যে থেকে কেউ হেঁকে উঠত, কৃষি তুমি চুপ থাকো।
মানুষটা নিরীহ হলেও এমন আচরণে যে কারও ক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। সকল বন্ধুদলে একজন থাকে, যাকে ক্ষেপিয়ে আনন্দ মেলে। শাইখ সিরাজ ছিল আমাদের সেই বন্ধু। ঠাণ্ডা মানুষ, ক্ষেপে গেলে গরম হয়ে যেত চট করে। বেরিয়ে আসত ছেলেমানুষি, সেটা ছিল আমাদের বিনোদনের বিষয়।
আমাদের সকলেরই কমবেশি লেখার ঝোঁক ছিল, তা নিয়ে সবার মাতামাতিও ছিল। লেখার অভ্যাস সিরাজেরও ছিল, তবে সেটাও কৃষি নিয়ে। অস্বীকার করব না, কখনও কখনও সেটাকে পাগলামো মনে হয়েছে। সে বয়সে এটা কখনও ভাবা হয়নি, আমরা যা যা নিয়ে ভাবি বা মেতে থাকি, সেসবও তো কারও না কারও চোখে পাগলামো ছিল।
দিন গড়াতে গড়াতে অনেক দূর গেছে। এখন মনে হয় পাগলামো ছাড়া জীবন হয় না, জীবনে নানা রকম পাগলামো খুবই দরকারি। বিশেষ করে শাইখ সিরাজকে দেখে এখন মনে হয়, অমন পাগলামো না থাকলে বাংলাদেশের কৃষি অনুৎসাহী মানুষের এত আগ্রহের বিষয়ে কি পরিণত হতো? অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সিরাজ। হেলায় ঠেলে রাখা বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছে।
এসব হঠাৎ হয়নি। বন্ধুরা জানি, এর পেছনে কতটা আগ্রহ, ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল। ডজনখানেক বন্ধুর ঠাট্টা-মশকরায় সে পিছিয়ে পড়তে পারত। তার ভালো লাগার বিষয় নিয়ে বরাবর সে ছিল একেবারেই একা। এই একাকিত্ব তাকে ছোট করেনি। সিরাজ নুয়ে পড়েনি। সাহস ও আশা নিয়ে একাই হেঁটেছিল। সবার সঙ্গে থেকেও সে ছিল একলা মানুষ।
আমরা বন্ধুরা সবাই সবাইকে নিয়ে গর্ব করি। মনে মনে আমার একটু উসখুস লাগে এখন। আমরা বন্ধু ছিলাম তবে একজন বন্ধুর আগ্রহ, স্বপ্ন, ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। সে বন্ধুটি কখনও অন্য বন্ধুদের চিন্তা-ভাবনার তীরে নিজের সাধের তরী ভেড়াতে পারেনি।
মনে সান্ত্বনা পেয়ে যাই। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না, কান-চোখ দুটি করে, তবে দুটির আকৃতি এক নয়। একই রকম দেখতে হলেও দুই পা আসলে দু'রকম। এই কমবেশি, ছোট-বড়, ভালো ও মন্দের তফাত নিয়ে জগৎ চলছে। মানুষ ঠকে জিতে এগিয়ে চলেছে। রহস্য উন্মোচন, বেঁচে থাকার সৌন্দর্য চর্চা করে চলেছে অবিরাম।
৭ সেপ্টেম্বর শাইখ সিরাজের জন্মদিন। বন্ধুর জন্মদিনে বন্ধু উচ্চারণ করবে 'দীর্ঘায়ু হও'। গুণীর গুণ চিরজীবী হোক, শুভাকাঙ্ক্ষীরা চাইবে। যে কোনো মানুষের কাছে প্রিয় মানুষের জন্মদিন বিশেষ। বিশেষ বলেই বিশেষ করে মনে পড়ে গেল সেই বেলার কথা, যে বেলাটায় ভালো-মন্দ, দোষ-ত্রুটি, সমান-অসমান ছিল, তবে সেটাই ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সবচেয়ে সুন্দর, মধুর শ্বেত-শুভ্রকাল। কোনো স্বার্থ নয় কেবল সম্পর্কের টান সে সময়টা আমাদের একত্র করত।
ভালো লাগে, এখনও প্রায় সবাই বেঁচে আছি, এখনও পরস্পরের বন্ধু হয়ে আছি। মৃত বন্ধুর জন্য মনে হলেই শোক করি। যে কোনো বন্ধুর সাফল্যে গর্ববোধ হয়। এক ঢাকা শহরে সবারই বসবাস, কেউ দূরে, কেউ কাছে। ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। যখন হয়, আমাদের সময় আমাদের কাছেই ফিরে আসে। সবাই বদলেছি, বয়সে। ধরন বদলায়নি। একজনের সঙ্গে অন্যজনের দেখা হলে টের পাওয়া যায়, মন বদলায়নি। কারও জন্মদিন মনে থাকে, কারোটা থাকে না। তাতে সম্পর্ক উঁচু-নিচু হয় না, সবাই এতটা ভালো রয়েছি ভেবে ভালো লাগে।
আমাদের সবার পায়ের পাতা ছোট-বড় হতে পারে কিন্তু কেউ আমরা ছোট পথে হাঁটি না। শাইখ সিরাজ এখনও আমাদের চেনা পথ ছেড়ে আপন মনে নিজের পথে হেঁটে চলেছে। তফাত এই, জোর করে তার কথা, ভাবনা আমাদের শোনানোর চেষ্টা করতে হয় না। আমরা অতি আগ্রহে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখি, শুনি। বিস্মিত হই।
আজ তোমার জন্মদিন বন্ধু। ফুল, শুভেচ্ছার আনুষ্ঠানিকতা থাক। বলি হৃদয়ের কথা। জন্মদিনে আরও হাজার হাজার মাইল আইল পথ মাড়িয়ে সাধারণের মুখে হাসি ছড়িয়ে চল। দেশের সকল কৃষিক্ষেত, ঘরবাড়ি, উঠোন আলোকিত হয়ে উঠুক তোমার অভিযাত্রায়। বন্ধু, তুমি যখন জমির আইল পথ ধরে হেঁটে যাও, দেখে মনে হয় কবিগুরু ওই গানটা তোমার জন্যই রচনা করেছিলেন_ 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একটা চলো রে'...।
আফজাল হোসেন : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments