সিংহাসন আছে সিংহ নেই by অমিত বসু
লন্ডন থেকে একটু দূরে এসেক্সের রাস্তায় সিংহ দেখে পথচারীরা সংজ্ঞাহীন। পুলিশ এসে কিন্তু সিংহের সন্ধান পায়নি। সার্কাস পার্টিতে খোঁজ নিয়েছে। তারাও বলেছে, তাদের কোনো সিংহ ছুটে পালায়নি। অবশেষে সিদ্ধান্ত, ওটা সিংহ নয়, সিংহের ভূত। ভয়ে রজ্জুকে সাপ বলে ভ্রম হওয়ার মতো কুকুরজাতীয় প্রাণীকে সিংহ মনে হয়েছে।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আগে পুরুষসিংহ মনে হতো। তার গর্জনে শঙ্কা জাগত। ক্রমে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অনেকে বলছেন, তিনি সিংহ ছিলেন। এখন আর নেই। সেটা আবার হয় নাকি! প্রাণীর রূপান্তর সম্ভব কীভাবে। মানুষ যেমন মূষিক হতে পারে না, মূষিকেরও তেমন মানুষ হওয়া অসম্ভব। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া হয় না। আবার ঘোড়াকে চাবকালে আরও জোরে ছুটবে, শত আঘাতেও গাধা হয়ে যাবে না। নরেন্দ্র মোদি এসব নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। নিজেই নিজের প্রশংসা বা নিন্দা করলে লোকে ভালো চোখে দেখে না। অহঙ্কারী মনে করে। তবে এটা ঠিক, বারবার সিংহ বিক্রমে তিনি ক্ষমতায় ফিরেছেন। কংগ্রেস ফাঁস লাগাতে ব্যর্থ। মোদির দল বিজেপি খুশি। দলে এমন একজন আছে যাকে হারানো অসাধ্য। মোদির ইমেজ আকাশচুম্বী। কোনো রাজ্যে নির্বাচন হলেই তাকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেবল ঠেকেছেন বিহারে। যেখানে জনতা ইউনাইটেড দলের নেতা, মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার মোদিকে গ্রহণ করেননি। স্পষ্ট জানিয়েছেন, তারা বিজেপির শরিক হলেও মোদিকে মানতে পারবেন না। বিজেপি বাধ্য হয়েছে তা স্বীকার করতে।মোদি মনঃক্ষুণ্ন হলেও পাল্টা দোষ দেখানোর সাহস করেননি। উন্নয়নের সাফল্যে নীতিশ কুমার স্বরাজ্যে সিংহপ্রতিম। অন্য অরণ্যের সিংহকে তিনি কেন বরদাশত করবেন।
বাকি সব রাজ্যে কি মোদির স্বীকৃতি আছে? না, নেই। যেসব রাজ্যে বিজেপি সরকার, সেখানেও তাকে ভোট ক্যাচার মনে করা হয় না। বরং ভোট কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণটা স্পষ্ট হয়েছে ২৯ আগস্ট আহমেদাবাদ হাইকোর্টের রায়ে। বিচারপতি জ্যোৎস্না খতি্বক ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি মানে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, ৩০২ ধারায় হত্যা, ৩০৭-এ হত্যা চেষ্টার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছেন ৩২ জনকে। তারা সবাই মোদি ঘনিষ্ঠ। দোষীদের মধ্যে দু'জন সাবেক মন্ত্রীও রয়েছেন। ২০০২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরা স্টেশনে সাবরমতি এক্সপ্রেসে আগুন লাগে। মারা যান ৫৮ জন কর সেবক। পরের দিন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বন্ধ ডাকে। একদল লোক জড়ো হয় নারোদা পাটিয়া এলাকায়। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ চালায়। নিহত হন ৯৭ জন। মায়াবেন কোডনানি আর বাবু বজরঙ্গি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ওই এলাকায় তিনবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন মায়াবেন। নিজের কেন্দ্রের সুরক্ষার দায়িত্ব ছিল তার। কিন্তু তিনি বিপরীত দায়িত্ব পালনে ব্রতী হন।
মোদিকে দিয়ে ভোটের বাজার মাত করতে চেয়েছে সংঘ পরিবার। বারবার সফল হয়েছে মোদির শিল্পোন্নয়নের ইমেজের ওপর ভরসা রেখে। কিন্তু তার আস্তিনের তলায় যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ, সেটা জানা যায়নি। ২০০২-এর ঘটনা বিষয়টি স্পষ্ট। প্রশ্ন উঠবে, তারপরও তিনি ভোটে জিতলেন কী করে? আরও ১০ বছর সরকার চালালেন কীভাবে? উত্তর সহজ। সাম্প্রদায়িক শক্তিতেই গুজরাটে কংগ্রেসকে শেষ করেছেন মোদি। বিজেপির মধ্যে উদারপন্থিদের ডানা ছেঁটেছেন।
নভেম্বরে গুজরাটে রাজ্য নির্বাচন। মোদি কি এবারও পার পেয়ে যাবেন? বোধহয় না। ছয় মাস আগেও ছবিটা ছিল অন্যরকম। মোদি ধরেই নিয়েছিলেন গুজরাট তাকে ফের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসানোর জন্য সংকল্প নিয়ে বসে আছে। অভিজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০১৪-এর নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর দাবিদারও হতে পারেন। যেহেতু বিজেপিতে নতুন কোনো মুখ দেখা যাচ্ছে না। পাশে যখন সংঘ পরিবার, তখন তো কেল্লাফতে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তার মুখ্যমন্ত্রী থাকাটাই সংশয়ের।
শিল্পায়নের স্বার্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। এবার যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রটা আলাদা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে। তিনি ক্যাপিটালিজমের পথ ছেড়ে সমাজতন্ত্রের রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন। রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি সেটাকেই মূলধন করে ওবামাকে কোণঠাসা করতে চাইছেন। '২০১৬ ওবামাজ আমেরিকা' নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন দীনেশ ডিসুজা। চিত্রে বলা হয়েছে ওবামা বামপন্থি। তিনি ফের প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনাশ। তথ্যচিত্রটি ৬৫ লাখ ডলারের ব্যবসা করেছে। ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। একই সময় মোদির মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরীক্ষা। ওবামা জিতুন বা হারুন, তিনি যে বার্তাটা দিয়েছেন তাতে মানবতার ঐশ্বর্য অপরিসীম। তিনি বলেছেন, দেশটা দু'চারজনের নয়, সবার। ভালোবাসার বন্ধন ছাড়া কোনো দেশ সুন্দর হয় না। এসব কথা মোদির ভালো লাগতে না পারে; কিন্তু এটাই সত্যি। মানলে বিকাশ, নইলে বিনাশ।
অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক
No comments