ফুসফুস ক্যানসার প্রতিরোধ by পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফুসফুস ক্যানসার পুরুষদের এক নম্বর ক্যানসার হলেও নারীদের মধ্যে এ রোগীর সংখ্যা কম নয়। ক্যানসারজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণও ফুসফুস ক্যানসার।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত হয়ে থাকে। তখন বিভিন্ন প্রকার উপসর্গ থাকে। ক্যানসার নিরাময় করার মতো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। চিকিৎসার বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেও ফুসফুসজনিত মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই দেশে দেশে ফুসফুস ক্যানসার প্রতিরোধে জোর প্রচারণা চলছে। এ রোগের প্রতিরোধ অনেক সহজ, কার্যকর, সাশ্রয়ী এবং দীর্ঘমেয়াদি। সাধারণত ৪৫ বছরের পর থেকে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে এ রোগের হারও বাড়তে থাকে।ফুসফুস ক্যানসারের কারণ
ধূমপান ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান কারণ। ১৯৫০ সাল থেকে অসংখ্য গবেষণায় প্রাপ্ত, এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।
ফুসফুস ক্যানসারের ৯০ শতাংশ কারণ প্রত্যক্ষ ধূমপান।
যিনি দিনে এক প্যাকেট সিগারেটের ধূম পান করেন, তাঁর ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি অধূমপায়ীর চেয়ে ২৫-৩০ গুণ বেশি। ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর ৯০ শতাংশ ধূমপায়ী। তবে সব ধূমপায়ীই ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হন না। প্রতি ১০ জন ধূমপায়ীর মধ্যে চারজনের ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকির পরিমাণ ততই বেশি হয়; যত অল্প বয়সে ধূমপান শুরু করা হয়, যত বেশি পরিমাণে ধূমপান হয়, যত দীর্ঘদিন ধূমপানে অভ্যস্ত থাকা হয়।
সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায় ৪০০ রকমের রাসায়নিক পদার্থ আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান (কার্সিনোজেন)।
ধূমপানে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে যায় যদি অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কারণ থাকে।
অন্যান্য কারণ
পরোক্ষ ধূমপান। ব্যক্তি নিজে ধূমপান করেন না। তবে দীর্ঘদিন পাশে থেকে অন্যের ধূমপানের ধোঁয়া গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারজনিত মৃত্যুর হার কম নয়। তাই পরোক্ষ ধূমপায়ীও এ রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
বায়ুদূষণ, গাড়ি, কলকারখানা, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত কাঠ, কয়লা ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ পোড়ানো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুকে দূষিত করে। দীর্ঘদিন এ ধরনের দূষিত বায়ুতে বসবাস করলে ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুতে বাস করা আর দীর্ঘদিন পরোক্ষ ধূমপান করা ফুসফুস ক্যানসারের জন্য অনেকটা সমান ঝুঁকিপূর্ণ।
কলকারখানায় ব্যবহূত হয়অ্যাসবেস্টোস। অ্যাসবেস্টোস এক প্রকার আঁশ-জাতীয় পদার্থ, যা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অ্যাসবেস্টোস ফুসফুসের ক্ষত সৃষ্টি করে এবং ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি নয় গুণ বাড়িয়ে দেয়। ধূমপায়ীরা এ পরিবেশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করলে এ রোগের ঝুঁকি ৫০ থেকে ৯০ গুণ বেড়ে যায়। অ্যাসবেস্টোস থেকে সৃষ্ট হয় মেজোথেলিওমা নামক অন্য আরেক ধরনের ক্যানসার।
ফুসফুসের অন্যান্য রোগ
দীর্ঘদিন ফুসফুসের প্রদাহ স্থায়ী হলে ফুসফুসের বিভিন্ন নালি-প্রণালিতে পরিবর্তন হয়। ফুসফুসের বাতাস সহসা বের হয়ে আসতে পারে না এবং বিভিন্ন রোগ বা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস (সিওপিডি), এমফাইজেমা ইত্যাদি। যক্ষ্মা রোগ। এসব রোগী ধূমপায়ী হলে ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
ফুসফুস ক্যানসারে আরও একটি ঝুঁকি র্যাডোন গ্যাস। তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ভেঙে এর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে র্যাডন গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে যায়। ঘরে ও বাইরের বায়ুদূষণ ঘটায়। র্যাডন গ্যাস তেজস্ক্রিয়, ফুসফুসের ক্ষতি করে এবং ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, নিকেল, অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনস, ইথার ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ থাকা পরিবেশের মধ্যে দীর্ঘদিন অবস্থান করলে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পারিবারিক ফুসফুস ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে।
একবার এক ফুসফুসে ক্যানসার হলে অপরটিতে আবার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ফুসফুস ক্যানসার প্রতিরোধের উপায়
কিছু কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে, জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করলে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক কমে আসে।
কখনো ধূমপান না করা। পরিবারের অন্যরাও যাতে ধূমপান করতে না পারে, সে রকম পরিবেশ গড়ে তোলা।
ধূমপায়ী হলে, এখনই তা বন্ধ করে দেওয়া। ধূমপান বন্ধ করতে নিজে সক্ষম না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
পরোক্ষ ধূমপানের শিকার না হওয়া। ধূমপায়ীদের সঙ্গে বসবাস বা কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করলে তাদের খোলা জায়গায় ধূমপান না করার জন্য অনুরোধ করা। যেসব জায়গায় সব সময় ধূমপান চলে, সেসব জায়গায় অবস্থান না করা।
কর্মক্ষেত্রের কার্সিনোজেন এড়িয়ে চলা। কর্মক্ষেত্রে যদি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, তাহলে চাকরির বিধিতে শারীরিক সুরক্ষার জন্য যেসব সতর্ক নিয়মকানুন আছে তা ঠিক ঠিকভাবে মেনে চলা। সুরক্ষার জন্য মুখে মাস্ক দেওয়া হলে, কাজের সময় তা ব্যবহার করাই উচিত।
বাড়ির পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া। ফুসফুস ক্যানসার প্রতিরোধে বাড়ির পরিবেশ ভালো রাখাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কর্মক্ষেত্রে যেমন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, বাড়িতেও বিভিন্ন কিছুতে এসব পদার্থ অগোচরে থাকতে পারে। বিশেষ করে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত কাঠ, পাতা, কয়লা, পাটখড়ি, ময়লা কাগজ ইত্যাদি পোড়ানোর ধোঁয়া ঘরের ভেতরে গিয়ে ঘরের পরিবেশ দূষণ ঘটায়। ঘরের ভেতরের বাতাস যাতে বাইরে চলাচল করতে পারে, সে ধরনের ব্যবস্থা রাখা।
নিয়মিত ব্যায়াম করা। এমনকি সপ্তাহে দুই দিন হালকা ধরনের ব্যায়ামও ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাকসবজি খাওয়া। বিভিন্ন প্রকার ফল ও শাকসবজিতে যে পরিমাণ ভিটামিন থাকে তা প্রক্রিয়াজাত ওষুধে পাওয়া যায় না। খুব সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে বিভিন্ন প্রকার ফল ও শাকসবজি খেলে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায়। পরিমাণের চেয়েও বিভিন্ন প্রকার ফল ও শাকসবজির গুরুত্ব অনেক বেশি।
অন্যদিকে ইনরগানিক ফসফেটযুক্ত খাবার ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। ইনরগানিক ফসফেটযুক্ত খাবারের মধ্যে আছে প্রক্রিয়াজাত খাবার, যেমন: মাংস, ফাস্টফুড, বেকারি খাবার, পনির এবং বিভিন্ন কার্বোনেটেট কোলা ড্রিংক ইত্যাদি। অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবারও ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ধরনের খাবার কম খাওয়ার অভ্যাস করা।
গ্রিন-টি পান করার অভ্যাস করা। নিয়মিত গ্রিন-টি পান করলে ধূমপানে সৃষ্ট কোষের ক্ষতি কিছুটা কম হয়। এর ফলে ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকি কম থাকে।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও এর উপায়
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে প্রায় সব ধরনের ক্যানসারই নিরাময় করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করতে হলে এ রোগ সম্পর্কে জানতে হবে এবং প্রতিরোধেও সচেতন হতে হবে। ফুসফুস ক্যানসারের জন্য নিজে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানা জরুরি। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগের তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলোকে ফুসফুস ক্যানসারের সংকেত হিসেবে গণ্য করা হয়।
দীর্ঘস্থায়ী কাশি। কাশির জন্য চিকিৎসা করা হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কাশি আর সারছে না। কাশির মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ফুসফুস ক্যানসার রোগীর কাশি উপসর্গ থাকে।
কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া।
বুকে, পিঠে বা হাতে ব্যথা অনুভব করা বা অস্বস্তি বোধ হওয়া। কাশি বা শ্বাসকষ্ট হওয়ার আগেও এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বুকে-পিঠে কোনো ধরনের আঘাত পাওয়ার ঘটনাও ঘটেনি।
প্রায়ই জ্বরে আক্রান্ত হওয়া। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পর জ্বর সেরে গেল, কিছুদিন পর আবার জ্বরে আক্রান্ত হওয়া।
এমনিতে তেমন কোনো শ্বাসকষ্ট নেই। তবে কাজকর্ম করতে গেলে বা সামান্য পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট বোধ হওয়া।
খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া
প্রায়ই ফুসফুসে প্রদাহ (ব্রংকাইটিস) হওয়া।
ওজন কমে যাওয়া
দুর্বলতা
আথ্রাইটিস বা হাড়ের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা।
ক্লাবিং অর্থাৎ আঙুলের মাথার বিশেষ পরিবর্তন (ফুলে যাওয়া) ক্যানসার শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে গেলে আরও অনেক উপসর্গ ও চিহ্ন দেখা দিতে পারে।
ফুসফুসের অন্যান্য রোগ, বিশেষ করে যক্ষ্মা হলে উল্লিখিত উপসর্গগুলো হয়ে থাকে। ‘যক্ষ্মা হয়েছে’ নিশ্চিত না হয়ে শুধু লক্ষণ দেখে অনেকের যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। অনেক ক্যানসার রোগীই তাই পাঁচ-সাত মাস দেরি করে আসেন। রোগ দেরিতে শনাক্ত হয়।
ফুসফুস ক্যানসার স্ক্রিনিং
ফুসফুস ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু কোনো ধরনের রোগের উপসর্গ এখনো দেখা দেয়নি তাদের ফুসফুস ক্যানসার হয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখা। এ জন্য চিকিৎসক বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা করার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে রোগ নিরাময় করা সহজ হয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্যানসার সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ক্যানসার স্ক্রিনিং বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা: যেমন বুকের এক্স-রে, কফের প্যাথলজি পরীক্ষা (সাইটোলজি) ও বুকের লো ডোজ সিটি স্ক্যান তুলনামূলক গবেষণা করে দেখা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, ফুসফুস ক্যানসারজনিত মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা।
No comments