ওবামার মিয়ানমার সফর-গণতন্ত্রের যাত্রাপথে নতুন সম্ভাবনা
মিয়ানমারে যখন গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ সে দেশ সফর করছেন। সর্বশেষ ১৯ নভেম্বর এলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সেনাশাসিত ও বাদবাকি বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন মিয়ানমারের সঙ্গে অর্ধ শতাব্দী ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
সে কারণেই ওবামা ছয় ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ইয়াংগুন এলেও তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াকে তার স্ট্র্যাটেজিক তালিকার প্রথম সারিতে রাখার ঘোষণা দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে মিয়ানমারকেই ওবামার বিদেশ সফর তালিকার পয়লা নম্বরে রাখার ঘটনাটি এই অঞ্চলে মার্কিন ঘনিষ্ঠ সংযোগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। মিয়ানমারের প্রতিবেশী বাংলাদেশের গুরুত্বও আমেরিকার কাছে যথেষ্ট। বিশেষত, বিশ্বে চীন ও ভারতের প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পর্যায়ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ওবামা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করছেন। তাই দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধ বিপুল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের অধিকারী মিয়ানমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা তার কাছে মার্কিন স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া, মিয়ানমারে নব পর্যায়ে গণতন্ত্রের রূপকার প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের হাতকে শক্তিশালী করারও প্রয়োজন রয়েছে, যাতে গণতান্ত্রিক সংস্কার টিকে থাকে এবং কট্টরপন্থি সামরিক কর্মকর্তারা পুনরায় দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে না পারেন। তবে গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করতে হলে সাধারণ মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা, বিশেষত রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও মানবাধিকার সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে মিয়ানমার যুগ যুগ ধরে চলা জাতিগত সহিংসতা ও লড়াইয়ের অবসান ঘটাতে পারে। ওবামা সেই প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ মসৃণ করতেই যে তার এ ধরনের গঠনমূলক ভূমিকা গ্রহণ_ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরাও চাই মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কার পুরোপুরি সফল হোক। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ যে কুসুমাস্তীর্ণ নয়_ সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এমনকি নবলব্ধ গণতন্ত্র রক্ষার জন্যও আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাই মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে না। আমরাও আমাদের সম্পদশালী এই প্রতিবেশীর সঙ্গে অর্থবহ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। জ্বালানি সহযোগিতা, খাদ্য নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত সহযোগিতা ইত্যাদি উভয় দেশের স্বার্থে ও আঞ্চলিক পরিসরেও গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে দু'দেশের সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ সাধারণের পর্যায়ে সহযোগিতার পক্ষেও নতুন আবেদন সৃষ্টি করবে। ওবামার মিয়ানমার সফর শুরুর আগেই মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ মানবাধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে জাতিসংঘকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। বলা যায়, এই প্রথম কোনো মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে খোলা মনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থাকে তাদের পারমাণবিক সাইটগুলো পরিদর্শন ও রক্ষাকবচের ব্যাপারেও মিয়ানমার সরকার অঙ্গীকার করেছে। আমরা মিয়ানমার সরকারের এই নতুন অবস্থানকে স্বাগত জানাই। মিয়ানমারে হাঁটি হঁটি পা পা করে গণতন্ত্রের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তা সব প্রতিকূলতাকে জয় করে সামনের দিকে এগিয়েযাক। বিশ্ব থেকে এক সময় প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকা দেশটির পরিবর্তন ইতিবাচক
ধারায় প্রবাহিত হোক।
No comments