সাক্ষাৎকার-জলবায়ু যুদ্ধে মানুষই জয়ী হবে by ড. এ আতিক রহমান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :শেখ রোকন বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের (বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক ড. এ আতিক রহমান জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা আইপিসিসির চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের অন্যতম লিড অথর। পরিবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থা (ইউএনইপি) তাকে ২০০৮ সালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের 'চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ' পুরস্কারে ভূষিত করে।
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদফতর তাকে 'এনভায়রনমেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০০৮' প্রদান করে। ড. আতিক রহমান বোস্টনের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর। এর আগে প্রায় দেড় দশক তিনি অক্সফোর্ড ও এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ড. আতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকসমকাল :আগামী সপ্তাহে কাতারের রাজধানী দোহায় শুরু হচ্ছে কোপ-এইটিন বা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ১৮তম বৈশ্বিক সম্মেলন। গোটা দুনিয়ার প্রতিনিধিরা সেখানে আসবেন। আমরা জানি, আপনি নিজেও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তাতে যোগ দিচ্ছেন। এই সম্মেলনের প্রত্যাশিত ফলাফল কী?
আতিক রহমান :দোহা সম্মেলনে দেশগুলো মূলত যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে, তা হচ্ছে কিয়োটো প্রটোকলের পর 'সেকেন্ড কমিটমেন্ট' কী হবে। কারণ ২০১২ সালের মধ্যে কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার কোপেনহেগেন হয়ে কানকুনে যে অঙ্গীকার বিশ্ব সম্প্র্রদায় করেছে, তার মেয়াদ শুরু হবে ২০১৫ সাল থেকে। এখন ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার কাজটি কীভাবে চলবে? এছাড়া সেখানে যথারীতি তহবিল ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি স্থানান্তর প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা, সংলাপ হবে। কিন্তু এটা আশা করা বোধহয় ঠিক হবে না যে, দোহায় কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু হবে।
সমকাল :সম্মেলনের ফল নিয়ে এমন হতাশা কি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে?
আতিক রহমান :সেটা এক অর্থে সত্য। কারণ আমরা পছন্দ করি বা না করি, যে কোনো বৈশ্বিক সমঝোতা প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখন অনস্বীকার্য। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রতিটি দেশের একটি 'রাজনৈতিক মূল্য' থাকে। একই কথা নেপাল বললে এক রকম, যুক্তরাষ্ট্র বললে আবার আরেক রকম প্রভাব তৈরি হয়। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে আমরা দেখলাম ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকলে যুক্তরাষ্ট্র অনুস্বাক্ষর করেনি। পরে মার্কিন সিনেটে বার্ড হ্যাগেল বিল পাসের মধ্য দিয়ে তারা কিয়োটো প্রটোকল থেকে বেরিয়ে আসে। এখন তারা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যদি বৈশ্বিক কাঠামো কার্যকর করতে হয়, তা নতুন হতে হবে। সেখানে কিয়োটো প্রটোকলের কোনো রেফারেন্স থাকতে পারবে না। কারণ বার্ড হ্যাগেল বিলের কারণে 'কিয়োটো প্রটোকল' শব্দটি সমর্থন করতে পারে না। বারাক ওবামা দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হ্যাঁ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সত্য। ক্লাইমেট চেঞ্জ ইজ দেয়ার। কিন্তু সেটা মোকাবেলায় প্রবৃদ্ধি ঝুঁকিতে ফেলা কোনো কর্মসূচি তার সরকার নিতে পারবে না। তাহলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে।
সমকাল :কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ফলে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় তো ঘটছেই। যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা স্যান্ডির মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় কিছু দিন পরপর আঘাত হানতে দেখছি। এর ক্ষয়ক্ষতি তো অর্থমূল্যেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
আতিক রহমান :যুক্তরাষ্ট্র এখন যা করতে চাচ্ছে, তার নাম 'ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড'। তারা আগেই একটা ক্যাপ বা ঊর্ধ্বর্সীমা তৈরি করবে। মানে এত মাত্রার বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ করা যাবে না। তারপর সেই মাত্রায় গ্যাস উদ্গিরণ কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রেরই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। যেমন জেনারেল মোটর একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় তাদের উদ্গিরণ কমিয়ে আনবে।
সমকাল :বিষয়টি কি 'কার্বন ট্রেডে'র মতো?
আতিক রহমান : অনেকটা। তবে এটা ইন্টারনাল। কার্বন ট্রেডের ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী; আর এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে। ধরুন, তারা দেখাবে যে, সেখানে কতখানি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে; তাতে কী পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ কমছে। গাড়ি কোম্পানিগুলোর হয়তো একটা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেওয়া থাকবে। এত কিলোমিটারের বেশি চলার পর একটি গাড়ি আর রাস্তায় নামতে পারবে না।
সমকাল :বৈশ্বিক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র কী করতে চায়? দোহায় তারা কী অবস্থান নিতে যাচ্ছে?
আতিক রহমান :যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রটোকলের সম্প্র্রসারণ বা আইনগত বাধ্যতামূলক অন্য একটি চুক্তির ব্যাপারে এখনও আগ্রহী নয়। কিন্তু তারা আলোচনাও বন্ধ করতে চায় না। তারা মনে করে, সব পক্ষের পছন্দসই ফর্মুলা না পাওয়া পর্যন্ত আলোচনা চলতে থাকুক। অবশ্য স্যান্ডির আঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান খানিকটা নরম হয়েছে। দোহা সম্মেলনের সমঝোতা প্রক্রিয়ায় এর প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়।
সমকাল :দোহায় অন্যান্য পক্ষের অবস্থান কেমন হবে?
আতিক রহমান :দেখুন, কিয়োটো প্রটোকল প্রসঙ্গে যদি দেশগুলোর অবস্থানের কথা বলেন, আমি কোনো আশা দেখি না। কারণ এ বছর থেকে এর মেয়াদ শেষ। এখন এটা দুর্বল হয়ে গেছে। সবাই জানে_ এর কার্যকারিতা আর নেই। তবে ভাঙার দায় কেউ নিতে চায় না। সেকেন্ড কমিটমেন্টের ব্যাপারে ইউরোপ অনেক বেশি কমিটেড। যদিও তারা কানকুন ও ডারবানে বলেছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার দরকার। কিন্তু বাস্তবে কয়েক বিলিয়নের বেশি তারা জোগাড় করতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দোহায় চাইবে যে, কিয়োটো প্রটোকলের এক্সটেনশনের ব্যাপারে একটা সমঝোতা হোক। কিন্তু খোদ জাপান, যে দেশ কিয়োটো প্রটোকল হোস্ট করেছিল, তারা এখন এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কারণ তাদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। তারা মনে হয় না, সেকেন্ড কমিটমেন্টে থাকবে। রাশিয়াও থাকতে চায় না। তাদের কনসার্ন অবশ্য যতখানি না প্রবৃদ্ধি, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে 'আমেরিকা ফ্যাক্টর'। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু মানছে না, তারা মানবে কেন? অস্ট্রেলিয়া প্রথমদিকে বলেছিল, তারা বেরিয়ে যাবে। এখন অবশ্য ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। সব মিলিয়ে কিয়োটো প্রটোকলের এক্সটেনশন বা সেকেন্ড কমিটমেন্ট নিয়ে দোহায় কিছু চূড়ান্ত হওয়া কঠিন।
সমকাল :বাংলাদেশের মতো দেশগুলো দোহা সমঝোতায় কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
আতিক রহমান :জলবায়ু সমঝোতা প্রক্রিয়ায় কোনো দেশের আসলে আলাদাভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। সেখানে আসলে গ্রুপভিত্তিক আলোচনা চলে। যেমন উন্নত দেশগুলোর বাইরে প্রায় সবাই 'জি-৭৭ প্লাস চায়না' গ্রুপের সদস্য। এ ছাড়া বাংলাদেশ আরও কিছু গ্রুপের সদস্য, যেমন এলডিসি, এমভিসি বা মোস্ট ভালনারেবল কান্ট্রিজ গ্রুপ। এর বাইরে রয়েছে স্মল আইল্যান্ড কান্ট্রিজ, আফ্রিকান পুওর কান্ট্রিজ। এভাবে গ্রুপভিত্তিক আলোচনা হয়। কোনো একটি দেশের একার পক্ষে আলোচনায় কিছু উপস্থাপন বা এজেন্ডা ঠিক করা সম্ভব নয়।
সমকাল :জি-৭৭ গ্রুপে তো আবার 'বিগ ব্রাদারস' রয়েছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর এজেন্ডা কি ভিন্ন হওয়ার কথা নয়?
আতিক রহমান :হ্যাঁ, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও চীন এই গ্রুপে রয়েছে। তারা আবার গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এখনই কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি নয়। কারণ, তারাও তাদের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে চায় না। এই চারটি প্রভাবশালী দেশের প্রতিযোগিতা হচ্ছে জাপান, ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে। যেমন গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে গাড়ির বাজার হারিয়ে ফেলতে পারে ভারত ও চীন। সেটা তারা চায় না। ভারত ও চীনের মধ্যে আমরা যে আঞ্চলিক বিরোধ দেখি; জলবায়ু সমঝোতার টেবিলে সেটা উধাও হয়ে যায়। তারা একসঙ্গে কাজ করে। বাংলাদেশের তো এই সমস্যা নেই। আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ করি না বললেই চলে। আমাদের মাত্রা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তুলনায়ও কম। কারণ ওই অংশ গত দেড়শ' বছর ধরে শিল্পায়নে রয়েছে। তারা কয়লা তুলছে অনেক আগে থেকে। আপনি শরৎচন্দ্রের লেখায়ও দেখবেন কয়লা শ্রমিকের কথা আছে।
সমকাল : তার মানে, জলবায়ু সমঝোতা প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী দেশগুলোরই আধিপত্য। জি-৭৭ অ্যান্ড চায়নার মতামত ও এজেন্ডা যদি চারটি দেশ নিয়ন্ত্রণ করে, বাংলাদেশের মতো দেশের বক্তব্য কীভাবে প্রতিফলিত হবে?
আতিক রহমান :এর বাইরে এলডিসির সদস্য হিসেবে, এমভিসির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ভয়েস রেইজ করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রভাবশালী পক্ষ এই গ্রুপগুলোর প্রতি সমর্থন দেয়। ফলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
সমকাল : আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং এই দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি_ দুই দিক থেকেই বাংলাদেশ স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। দোহা সম্মেলনের মতো বৈশ্বিক আয়োজনগুলোতে এই ধরনের অবস্থান কোনো গুরুত্ব পায় কি-না?
আতিক রহমান :নিশ্চয়ই। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বাংলাদেশ একটি নজির। এখন তো এটা প্রমাণিত যে, বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশ। যে কারণে এমভিসি (মোস্ট ভালনারেবল কান্ট্রিজ) গ্রুপে আমাদের একটা আলাদা অবস্থান আছে। সব গ্রুপের যৌথ সভায় যখন এমভিসি সম্পর্কে কোনো কথা ওঠে, বাংলাদেশের কাছেই সবাই জানতে চায়। এলডিসি গ্রুপেও আমরা নেতৃস্থানীয় দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় প্রস্তুতি, পদক্ষেপ, সচেতনতা_ সবদিক থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। আমরা প্রায় সবার আগে নীতিগত প্রস্তুতি নিয়েছি। নাপা হয়েছে, কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান হয়েছে। আমরা নিজেদের অর্থে একটি তহবিল গঠন করেছি। এটা উন্নয়নশীল অনেক দেশ এখন পর্যন্ত ভাবতেই পারে না। তারপর আমাদের দেশে যেভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছে, যেভাবে একটি গবেষক দল তৈরি হয়েছে; তার নজির আপনি খুব বেশি দেশে পাবেন না। বিশেষ করে অ্যাডাপ্টেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত কিংবা চীনের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ। আমাদের জেলে, কৃষক নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। আপনি দেখবেন, আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সব বিষয়ে মতভেদ হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমরা একাট্টা। এসব বিষয় যেমন দেশের জন্য মঙ্গলকর হচ্ছে, তেমনই দেশের ভাবমূর্তির জন্যও মঙ্গলময় হচ্ছে। দোহাতে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব নিঃসন্দেহে পড়বে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেখানকার নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়া নেহাতই বহুপক্ষীয়। কেন একটি দেশের পক্ষে এককভাবে এজেন্ডা তৈরি করা যায় না। তবে হ্যাঁ, রাজনৈতিক মূল্য, অভিজ্ঞ প্রতিনিধি দল, আলোচনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, যুক্তির ধার, অন্যদের সহমর্মিতা_ বহুপক্ষীয় আলোচনার ক্ষেত্রে একটি দেশের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। বাংলাদেশের সেই গ্রহণযোগ্যতা আছে।
সমকাল :জলবায়ু বিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলনে বাংলাদেশ কি কোনো প্রস্তাব বা কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে?
আতিক রহমান :সাইড ইভেন্ট আকারে পারে। যেমন দোহায় 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' ইস্যুতে আমরা একটি ইভেন্ট করব। এ বিষয়টি নিয়ে যে কমিটি গঠিত হয়েছে, বাংলাদেশ সেখানে রয়েছে। এখন আলোচনা চলছে দুর্যোগের ক্ষতির আর্থিক মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, সেই পদ্ধতি নিয়ে।
সমকাল : গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড নিয়ে কোপেনহেগেন থেকে ডারবান পর্যন্ত কেবল আশ্বাসই পাওয়া যাচ্ছে। এটি বাস্তবে হাতে পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা কি দোহায় হবে?
আতিক রহমান :দেখুন, এত বড় একটি তহবিল গঠন, বিতরণ নীতি ও কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সময় লাগা অস্বাভাবিক নয়। কোপেনহেগেনে এ ব্যাপারে প্রস্তাব করা হয়েছিল; কানকুনে সেটা অনুমোদিত হয়েছিল। ডারবানে গিয়ে তহবিলটির ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছে। কথা ছিল, ৩০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই অর্থ পুরোটা টেবিলে আসেনি। দোহায় এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হতে পারে।
সমকাল : সামষ্টিক এই তহবিলের বাইরে কয়েকটি দেশ ও পক্ষের দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ যে ফান্ড পেয়েছে, সেই বিসিসিআরএফ (বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়্যান্স ফান্ড) অর্থ ছাড় হয়েছে, আমরা জানি। এও জানি যে, কিছু প্রশ্ন ওঠা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক শেষ পর্যন্ত এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছে। কিন্তু তাদের 'সার্ভিস চার্জ' নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?
আতিক রহমান :গত ১২ তারিখ ওই ফান্ড লঞ্চিং সেরিমনি ছিল ঢাকায়। সেখানেও সাংবাদিকরা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। কারণ কথা ছিল_ বিশ্বব্যাংক শতকরা এক ভাগ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট চার্জ নেবে। এখন আরও চার শতাংশ সার্ভিস চার্জ কেন? উত্তরে বলা হয়েছে যে, ফান্ড ডেভেলপমেন্ট ছাড়াও বিতরণ, মূল্যায়ন প্রভৃতি কাজের চার্জ হচ্ছে এটা। আর ইউএনডিপি যেখানে ১৪ শতাংশ, এফএও যেখানে ১২ শতাংশ চার্জ নেয়; সেখানে এটা কি খুব বেশি? এই তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য যে কমিটি করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের নাগরিক প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তারাও নিশ্চয়ই মতামত দিতে পারবেন।
সমকাল :এই তহবিলের বড় অংশ 'অনুদান' নয়, 'ঋণ'। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ঋণ নেওয়া কতটা উচিত হবে?
আতিক রহমান : জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সমঝোতার প্রথমদিকে বলাও হয়েছিল যে, 'নিউ এন্ড অ্যাডিশনাল' ফান্ডিং হতে হবে। তখন প্রশ্ন উঠেছে, কতটা অ্যাডিশনাল? উপকূলীয় বাঁধ যখন নির্মাণ করব, তখন কতটুকু জোয়ারের জন্য, আর কতটুকু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে পদ্মা সেতু এক মিটার বেশি উঁচু করা হয়েছে? কোন এক মিটার? নিচের দিকের এক মিটারে খরচ এক রকম, উপরের দিকের খরচ আরেক রকম। এসব বিষয় নিয়েই আসলে আলোচনা চলছে। রিজল্ভ হয়ে যাবে আশা রাখি।
সমকাল :এই যে এত আলোচনা, সমঝোতা প্রক্রিয়া, তহবিল ব্যবস্থাপনা, গবেষণা_ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবেলা করা কতটা সম্ভব হবে?
আতিক রহমান :জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে মূল লড়াই করছে সাধারণ মানুষ। তাদের প্রচেষ্টা বৃথা যাবে না। শেষ পর্যন্ত মানুষেরই জয় হবে।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
আতিক রহমান : ধন্যবাদ।
No comments