বহে কাল নিরবধি-২০১৪ সালের নির্বাচনের জন্যই এখন শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা by এম আবদুল হাফিজ
দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য সমস্যা ও সার্বক্ষণিক উত্তেজনা-অস্থিরতার মধ্যেও জীবন থেমে থাকে না। তবু প্রশ্ন থেকেই যায় যে এটাই কি জীবন, এটাই কি বেঁচে থাকা? ব্যক্তি, সমাজ বা জাতীয় জীবনে কি এর চেয়ে ভালো পাওয়ার কিছু নেই? প্রত্যেহ সকালবেলা সংবাদপত্র নিয়ে বসলেই কি আমাদের শুধু জানতে হবে দুঃসংবাদ, দুর্ঘটনা, অনিয়ম-অশান্তির কথা? আমাদের এই দেশে, এই জীবনে কি মহৎ কিছু ঘটতে পারে না।
অনেকে বলেন, না, পারে না। যতক্ষণ এ দেশে বর্তমান রাজনীতির ধারা প্রবহমান আছে, বিশেষ করে তা বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে- আমাদের সার্বিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই এবং তা সম্ভবও নয়। কালেভদ্রে টেলিভিশন দেখি- সেখানেও নেতা-নেত্রীদের খিস্তিখেউর। শীর্ষ নেত্রীদের নিক্ষিপ্ত কটাক্ষ-বাণী যখন উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ওড়াউড়ি করে, তা কোনো উপভোগ্য দৃশ্য নয়। বরং এভাবে স্নায়ুচাপ বাড়ে। তাহলে? তাহলে কোথায় যাব আমরা এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে?
মানুষের কল্যাণে নয়, দারিদ্র্যপীড়িত দুস্থের দুঃখ লাঘবেও নয়, দুর্ভোগে বিপর্যস্ত নগরজীবনের উৎকর্ষেও নয়- আজকালের বিতর্ক ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের ক্ষমতারোহণের পথ নিশ্চিত করতে নির্বাচন পদ্ধতিকে ঘিরে আবর্তিত। নির্বাচন কি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে, না নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে? যেন তাবত পৃথিবীতে এর চেয়ে জরুরি আর কোনো বিষয়ই নেই, যা দেশের মঙ্গলকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এ পর্যন্ত এই বিতর্কের ধারা দেখে মনে হয়েছে, প্রলয় সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত এই বিতর্কের শেষ হবে না, কোনো সমাধানও বেরিয়ে আসবে না।
তাই মাঝেমধ্যে ভাবি, এর একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার। তা না হলে দেশে বা সমাজে কোনো স্বস্তি ফিরবে না। অনেক সময় যখন কোনো কঠিন রোগীর চিকিৎসায় চিকিৎসকরা তার আরোগ্যের সম্ভাবনা সম্বন্ধে না-সূচক জবাব দেয়- রোগীর স্বজনরা তার আশু মৃত্যু কামনা করে। তাদের হিসাবে, এত কষ্ট পাওয়ার পরিবর্তে রোগীর মৃত্যুতেই তারা প্রশান্তি দেখে। আমরা অবশ্যই আমাদের সব দুর্ভোগের উৎস রাজনীতিকদের সম্পর্কে এমন ভাবতে পারি না। তবে তাদের কলহের মূল কারণের অর্থাৎ সত্বর নির্বাচনে কোনো এক পক্ষের ক্ষমতারোহণের পর্ব সমাপ্ত হোক, দেশ ও সমাজে শান্তি আসুক এবং রাজনৈতিক খিস্তিখেউরের অবসান হোক- এমন কামনা তো করতেই পারি।
আমরা জনসাধারণ তাই শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষায় আছি ২০১৪ সালের দিকে তাকিয়ে। তবে এই সরকারের মেয়াদের অবশিষ্ট এক বছরও দীর্ঘ সময়, কেননা এই সরকারের যে পারঙ্গমতা আমরা দেখেছি, তাতে এদের আর কিছু দেওয়ার নেই। বর্তমান সরকার যত শিগগির বিদায় হয়, তা তাদের এবং জনগণের স্বার্থেই কাম্য। ভবিষ্যতে যে বা যারাই ক্ষমতারোহণ করুক, তাদের সম্বন্ধেও কেউ খুব একটা আশাবাদী নয়। কেননা নব্বই-উত্তর 'গণতান্ত্রিক সরকারগুলো' যেভাবে গণতন্ত্রকে দুমড়ে পঙ্গু করে ছেড়েছে, তাকে কাঙ্ক্ষিত অবয়বে ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে। তবে এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে নৈরাজ্যের কোনো কারণ আমি দেখি না।
গণতন্ত্রের যে অঙ্গহানি বিগত দুই যুগে ঘটেছে, তাতে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। তারা তাদের কাজ সুচারুরূপেই করেছে। অতঃপর এর ধ্বংসযজ্ঞে জনগণের কোনো ভূমিকা ছিল না। একটি জাতির জীবনে দুই দশক অতিসামান্য সময়। আমি দৃঢ় বিশ্বাসী যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের সেই ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে। যদিও সামরিক স্বৈরশাসনের ছোবল এ দেশকে অতীতে স্পর্শ করেছে এবং গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের দুষ্কার্যের বদৌলতে আবারও তা ঘটতে পারে। কিন্তু দেশের জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে তা অতীতে হার মেনেছে, ভবিষ্যতেও তাদের একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।
আমার দৃষ্টিতে সামরিক স্বৈরশাসনের বিপরীতে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা আরো কঠিন এবং তার বিতাড়ন দুঃসাধ্য। কেননা তখন জনগণ দলীয় নিয়ন্ত্রণে বিভক্ত হয়ে যায় এবং একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসামরিক জনগণের শক্তি নির্বাচিত স্বৈরশাসকের পক্ষে থেকে যায়। তাই খুব ভালো হয়, যদি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছে লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ডে অন্তত দশম সংসদের নির্বাচনটি করতে পারে। এ পর্যন্ত উঁকিঝুঁকি দেওয়া দেশের তৃতীয় রাজনৈতিক ধারাও বর্তমান অচলাবস্থায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তার জন্য রাজনীতির চিরাচরিত রীতিনীতি ও নিয়ম-কানুনের অনুসরণ তাদের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য। তারা অবশ্যই এ দেশের রাজনীতির ঐতিহ্যে কোনো আরামকেদারার রাজনীতি করতে সক্ষম হলেও সফল হবে না। চুয়ান্নর নির্বাচনে আমি নিজ চক্ষে একজন 'অ্যারিস্টোক্র্যাটিক' শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে বগুড়ার ধূলিধূসর পথে একটি সেকেলে জিপে দৈনিক সাত-আটটি জনসভা করতে দেখেছি। এসব কথা তৃতীয় ধারার প্রবক্তার অবশ্যই অজানা নয়। তবে কেন তারা সে পথে হাঁটছেন না!
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক বিআইএসএস
মানুষের কল্যাণে নয়, দারিদ্র্যপীড়িত দুস্থের দুঃখ লাঘবেও নয়, দুর্ভোগে বিপর্যস্ত নগরজীবনের উৎকর্ষেও নয়- আজকালের বিতর্ক ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের ক্ষমতারোহণের পথ নিশ্চিত করতে নির্বাচন পদ্ধতিকে ঘিরে আবর্তিত। নির্বাচন কি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে, না নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে? যেন তাবত পৃথিবীতে এর চেয়ে জরুরি আর কোনো বিষয়ই নেই, যা দেশের মঙ্গলকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এ পর্যন্ত এই বিতর্কের ধারা দেখে মনে হয়েছে, প্রলয় সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত এই বিতর্কের শেষ হবে না, কোনো সমাধানও বেরিয়ে আসবে না।
তাই মাঝেমধ্যে ভাবি, এর একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার। তা না হলে দেশে বা সমাজে কোনো স্বস্তি ফিরবে না। অনেক সময় যখন কোনো কঠিন রোগীর চিকিৎসায় চিকিৎসকরা তার আরোগ্যের সম্ভাবনা সম্বন্ধে না-সূচক জবাব দেয়- রোগীর স্বজনরা তার আশু মৃত্যু কামনা করে। তাদের হিসাবে, এত কষ্ট পাওয়ার পরিবর্তে রোগীর মৃত্যুতেই তারা প্রশান্তি দেখে। আমরা অবশ্যই আমাদের সব দুর্ভোগের উৎস রাজনীতিকদের সম্পর্কে এমন ভাবতে পারি না। তবে তাদের কলহের মূল কারণের অর্থাৎ সত্বর নির্বাচনে কোনো এক পক্ষের ক্ষমতারোহণের পর্ব সমাপ্ত হোক, দেশ ও সমাজে শান্তি আসুক এবং রাজনৈতিক খিস্তিখেউরের অবসান হোক- এমন কামনা তো করতেই পারি।
আমরা জনসাধারণ তাই শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষায় আছি ২০১৪ সালের দিকে তাকিয়ে। তবে এই সরকারের মেয়াদের অবশিষ্ট এক বছরও দীর্ঘ সময়, কেননা এই সরকারের যে পারঙ্গমতা আমরা দেখেছি, তাতে এদের আর কিছু দেওয়ার নেই। বর্তমান সরকার যত শিগগির বিদায় হয়, তা তাদের এবং জনগণের স্বার্থেই কাম্য। ভবিষ্যতে যে বা যারাই ক্ষমতারোহণ করুক, তাদের সম্বন্ধেও কেউ খুব একটা আশাবাদী নয়। কেননা নব্বই-উত্তর 'গণতান্ত্রিক সরকারগুলো' যেভাবে গণতন্ত্রকে দুমড়ে পঙ্গু করে ছেড়েছে, তাকে কাঙ্ক্ষিত অবয়বে ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে। তবে এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে নৈরাজ্যের কোনো কারণ আমি দেখি না।
গণতন্ত্রের যে অঙ্গহানি বিগত দুই যুগে ঘটেছে, তাতে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। তারা তাদের কাজ সুচারুরূপেই করেছে। অতঃপর এর ধ্বংসযজ্ঞে জনগণের কোনো ভূমিকা ছিল না। একটি জাতির জীবনে দুই দশক অতিসামান্য সময়। আমি দৃঢ় বিশ্বাসী যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের সেই ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে। যদিও সামরিক স্বৈরশাসনের ছোবল এ দেশকে অতীতে স্পর্শ করেছে এবং গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের দুষ্কার্যের বদৌলতে আবারও তা ঘটতে পারে। কিন্তু দেশের জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে তা অতীতে হার মেনেছে, ভবিষ্যতেও তাদের একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।
আমার দৃষ্টিতে সামরিক স্বৈরশাসনের বিপরীতে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা আরো কঠিন এবং তার বিতাড়ন দুঃসাধ্য। কেননা তখন জনগণ দলীয় নিয়ন্ত্রণে বিভক্ত হয়ে যায় এবং একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসামরিক জনগণের শক্তি নির্বাচিত স্বৈরশাসকের পক্ষে থেকে যায়। তাই খুব ভালো হয়, যদি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছে লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ডে অন্তত দশম সংসদের নির্বাচনটি করতে পারে। এ পর্যন্ত উঁকিঝুঁকি দেওয়া দেশের তৃতীয় রাজনৈতিক ধারাও বর্তমান অচলাবস্থায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তার জন্য রাজনীতির চিরাচরিত রীতিনীতি ও নিয়ম-কানুনের অনুসরণ তাদের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য। তারা অবশ্যই এ দেশের রাজনীতির ঐতিহ্যে কোনো আরামকেদারার রাজনীতি করতে সক্ষম হলেও সফল হবে না। চুয়ান্নর নির্বাচনে আমি নিজ চক্ষে একজন 'অ্যারিস্টোক্র্যাটিক' শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে বগুড়ার ধূলিধূসর পথে একটি সেকেলে জিপে দৈনিক সাত-আটটি জনসভা করতে দেখেছি। এসব কথা তৃতীয় ধারার প্রবক্তার অবশ্যই অজানা নয়। তবে কেন তারা সে পথে হাঁটছেন না!
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক বিআইএসএস
No comments