মাদক : একজন শিক্ষার্থীর আর্তনাদ by ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ
সম্প্রতি একজন অভিভাবক তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে আমার অফিসকক্ষে এসেছিলেন। সমস্যার কথা জানতে চাওয়ার পর ভদ্রলোক বললেন, তাঁর সন্তান কয়েক মাস ধরে ভীষণ অসুস্থ। ছাত্রটির দিকে তাকিয়ে আমারও মনে হলো, সে সত্যিই অসুস্থ।
আমি জানতে চাইলাম, কিভাবে আমি তাঁদের সাহায্য করতে পারি। ভদ্রলোক বললেন, অসুস্থতার কারণে তাঁর সন্তানের খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না বলে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই। বহু দিন ধরে ক্লাসও করছে না। সুতরাং সেমিস্টার ড্রপ করা ছাড়া এখন আর কোনো গত্যন্তর নেই। কী ধরনের অসুস্থতায় সে ভুগছে, আমি তার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করলাম। ছেলেটি নিশ্চুপ। বহুবার জিজ্ঞেস করার পরও সে কোনো উত্তর দিল না। পেশাগত দিক থেকে আমি একজন ফার্মাসিস্ট বলে তাকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করলাম যে সমস্যার কথা জানলে আমি হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারব। ছেলেটি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, সে মাদকাসক্ত। বহু দিন ধরে সঙ্গদোষে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্ত হওয়ার পর থেকে তার জীবন অস্বাভাবিক ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণ তার মনে হয়, সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। তার চেহারা দেখে প্রথমেই আমি এ ধরনের একটি সমস্যার কথা অনুমান করেছিলাম। তার কাছ থেকে বিস্তারিত শোনার পর জানতে পারলাম, সে নারায়ণগঞ্জে থাকে। দুই বছর ধরে সে ইয়াবা নিচ্ছে। প্রতিটি গোলাপি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম ২৫০ টাকা। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের শহর ও মফস্বল এলাকায় ব্যাপকভাবে ইয়াবা বিক্রি হয়। শত শত যুবক-যুবতী, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্করাও ইয়াবা গ্রহণ করে। এ মাদক গ্রহণ করার কারণে অসংখ্য যুবক-যুবতীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাবা তাঁর সন্তানের এসব অপকর্মের কথা কিছুই জানতেন না। তাঁর সন্তান মাদকাসক্ত শুনে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। তিনি আমাকে বললেন, তাঁর এ সন্তান অত্যন্ত মেধাবী এবং পরীক্ষায় সব সময় সে ভালো ফল করে আসছে। কিছুদিন আগে থেকে তার মধ্যে তিনি শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন দেখতে পান। পরীক্ষায় ভীষণ খারাপ করছে_এটাও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানতে পারেন। তিনি আরো বলেন, তিনি একজন আল্লাহওয়ালা মানুষ, সমাজে তাঁর মানসম্মান রয়েছে। তাঁর সন্তান মাদকাসক্ত_এটা প্রচার হয়ে গেলে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে? তিনি আমার হাত ধরে অনুরোধ করলেন তাঁর ছেলেকে সাহায্য করার জন্য। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম_সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমি তাকে মাদকের করালগ্রাস থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। আমার দীর্ঘ শিক্ষকতাজীবনে আমি বহু মাদকাসক্ত ছাত্রছাত্রীকে মাদকের গ্রাস থেকে ফিরিয়ে এনে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সাহায্য করেছি। এরপর অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে তাঁরা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় ওই ছেলেটি বলল, 'স্যার আমাকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করুন। না হলে আমি মরে যাব।'যুবসমাজের ওপর সব দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। কোনো দেশের যুবসমাজ বিপথগামী হলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। মাদকের করালগ্রাস যুবসমাজের জন্য এক ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকাসক্তি মহামারি সৃষ্টিকারী ভয়াবহ সংক্রামক রোগের চেয়েও ভয়ংকর। এই ভয়ংকর মহামারির গ্রাস থেকে আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সবাইকে সচেষ্ট ও ঐকান্তিক আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সবার ছেলেমেয়েই, ভালনারেবল বা সংক্রমণের আশঙ্কামুক্ত।
কোন সে এমন বস্তু, যা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পরিচিত একজন মানুষকে এত নিচে নামিয়ে আনতে পারে। এই প্রচণ্ড শক্তিশালী বস্তুটির সাধারণ নাম মাদক। এই প্রচণ্ড শক্তিশালী মাদকের প্রভাবে মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে, শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর এর বিধ্বংসী ও প্রলয়ঙ্করী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির কারণে যুবসমাজ ধ্বংস ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই শক্তিধর ও প্রলয়ঙ্করী বস্তুটির নাম হেরোইন, তার নাম কোকেন, মরফিন, কোডেইন অথবা প্যাথিডিন, নতুবা গাঁজা, হাশিশ, ফেনসিডিল, অ্যামফিটামিন, মেথামফিটামিন বা ইয়াবা।
কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের অনেকের কাছে মাদক বিনোদনমূলক বস্তু। মাদক গ্রহণ করে আনন্দঘন সুখকর ইউফোবিয়াতে ভোগা মাদকসেবীদের কাছে এক আকর্ষণীয় অনুভূতি। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে অনেকেই অ্যাডভেঞ্চারিজমে ভোগে। দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ বা কর্মকাণ্ডে বৈচিত্র্যের পাশাপাশি হরেক রকম পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীন চিন্তাশক্তি অর্জন, স্বতন্ত্র ও স্বাবলম্বী জীবনযাপন, ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে তারা মুখ্য ভূমিকা পালনে তৎপর ও আগ্রহী হয়। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ের বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের পরিধি বৃদ্ধি পায়। অ্যাডভেঞ্চারিজমের অংশ হিসেবে জীবনের কোনো না কোনো সময়ে তারা ধূমপান, অ্যালকোহল পানসহ মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। উঠতি বয়সের এসব ছেলেমেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঙ্গদোষে এসব বদ-অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে।
স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই নানাবিধ সমস্যায় ভোগে, জর্জরিত হয় এবং এসব সমস্যা সমাধানে মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের কাছ থেকে কার্যকর ও সময়োপযোগী সাহায্য-সহযোগিতা এবং সমর্থন না পেয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সমস্যার সমাধান না পেয়ে দিনের পর দিন তাদের হতাশা বাড়তে থাকে এবং স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম থেকে তারা আস্তে আস্তে দূরে সরে পড়ে। অবজ্ঞা, অবহেলা, ব্যর্থতা, হতাশা তাদের কর্মবিমুখ করে তোলে এবং জীবনের প্রতি তাদের ভালোবাসা বা আগ্রহ দিন দিন লোপ পেতে থাকে। উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি, কর্মক্ষমতা, কর্মদক্ষতা, একাগ্রতা থাকা সত্ত্বেও যথাযোগ্য সাফল্য না পেলে বা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে উল্লিখিত এই গুণাবলির মূল্যায়ন না হলে জীবনের প্রতি তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। মানুষে মানুষে, শ্রেণীতে শ্রেণীতে বা জাতিতে জাতিতে বৈষম্যও হতাশার অন্যতম কারণ। পেশা বা চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য, পারিবারিক জীবনে অশান্তি, রোগ-ব্যাধিতে ভোগা, অভাব-অনটনসহ আরো অসংখ্য কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিঘ্নিত হতে পারে। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, হতাশা, দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণার পরিমাণ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেলে অবমুক্তির পন্থা হিসেবে মানুষ বিভিন্ন অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমধর্মী পথ অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে আত্মহত্যা একটি। অনেক মানুষ এই চরম সিদ্ধান্তে না গিয়ে হতাশা-দুঃখ-কষ্ট ভোলার মাধ্যম হিসেবে মাদকদ্রব্যকে সঙ্গী করে নেয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে মাদকদ্রব্য মানুষের কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা নষ্ট করে দেয়। যুবক-যুবতীদের মাদকাসক্তির কারণে পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে সে পরিবার সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়। কারণ মাদকসেবীরা পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি ছাড়াও সমাজে সন্ত্রাস, রাহাজানি, খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ে। মাদকদ্রব্য কেনার পয়সা সংগ্রহের জন্য চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, খুন-জখমে তারা প্রায়ই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। মাদক গ্রহণে দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহারের ফলে এইডস রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। মাদকসেবীদের জানা আবশ্যক, মাদক গ্রহণে বিন্দুমাত্রও উপকারিতা নেই, বরং মাদক যেন মানুষের জন্য মৃত্যু পরোয়ানার এক সাক্ষাৎ যমদূত। মাদক মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে তোলে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে, মূল্যবোধ ধ্বংস করে, আত্মবিশ্বাস, মর্যাদাবোধ নষ্ট করে, মানুষের মনুষ্যত্বকে কেড়ে নেয়। অভিসম্পাত সেই মাদকের প্রতি।
দুই. ১৯৮৯ সালে পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। শোনা যায়, বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বহুগুণ বেড়েছে, যদিও মাদকসেবীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে কারো কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। ওই পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, মাদকসেবীদের ১৫ শতাংশের বয়স ২০-এর নিচে, ৬৬ শতাংশ ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ১৬ শতাংশ ৩০ থেকে ৪০ বছর এবং চার শতাংশ ৪০ থেকে তদূর্ধ্ব বয়সের। বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য উৎপাদিত হয় না। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সব ধরনের স্মাগলিং এবং মাদকদ্রব্য পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এবার একটি সংক্ষিপ্ত মাদক পরিচিতি উপস্থাপন করছি। অপিয়াম পপি থেকে প্রাপ্ত অপরিশোধিত ক্ষয়িত পদার্থকে অপিয়াম বলা হয়। অপিয়ামকে পৃথক ও পরিশুদ্ধ করলে ২০টি ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়। উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বস্তুটির নাম মরফিন। কোডেইন অপিয়াম থেকে প্রাপ্ত অন্য একটি প্রাকৃতিক উপাদান। হেরোইন প্রাকৃতিক উপাদান নয়। মরফিনের রাসায়নিক রূপান্তর ঘটিয়ে হেরোইন প্রস্তুত করা হয়। প্যাথিডিন বহুল পরিচিত একটি সিনথেটিক ওষুধ। ঘুম আনয়নে এবং মাংসপেশির খিঁচুনি উপশমকারী হিসেবে প্যাথিডিন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কোকেনের সামাজিক ব্যবহার এবং অপব্যবহার সর্বজনবিদিত।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের ফলে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মাদকাসক্তিতে ভুগছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অপিয়াম এবং মরফিনের ব্যবহার ব্যাপক ছিল। ১৮৫৯ সালে হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে মাদক ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ হয়। মাদকদ্রব্য পুড়িয়ে ধোঁয়া সেবন করার পরিবর্তে সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক সরাসরি রক্তে পৌঁছানোর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে মাদকাসক্তি বহু গুণ বেড়ে যায়।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই কমবেশি মাদক সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশেও মাদক ও মাদকাসক্তি এক জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ মাদকসেবী কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতী। যে যুবসমাজের ওপর দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি, অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল, তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যদি মাদকাসক্তিতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে, তবে সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ ভয়ংকর অভিশাপ থেকে আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে দু-একটি পরামর্শ।
এক. অধিকাংশ স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাদকের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা না ভেবেই বা না জেনেই মাদক গ্রহণ শুরু করে। তারা জানে না, আসক্তি ও নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়ে গেলে মাদক প্রত্যাহার সহজ নয় এবং মাদক প্রত্যাহারের মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ধারণা দেওয়া আবশ্যক।
দুই. মাদক গ্রহণ সমস্যা যত না সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়, তার চেয়ে বেশি মনস্তাত্তি্বক। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী বা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের সব সমস্যা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন বা শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে সন্তানসন্ততির সঙ্গে মা-বাবা বা শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর দূরত্ব বেশি। দূরত্বের কারণে প্রায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক মূল্যবোধ ও শ্রদ্ধাবোধের অবনতি ঘটে। মাদকাসক্তির পেছনে এসব ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যা মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
তিন. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে মাদক গ্রহণের কারণ ও পরিণতি সম্পর্কে নিয়মিত সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করা বাঞ্ছনীয়। মাদক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় প্রচারমাধ্যমে এবং সংবাদপত্রগুলোর কার্যকর ভূমিকা পালন আবশ্যক।
চার. বাংলাদেশে মাদক ও মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব আরো ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছার আগেই জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। মাদকবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি এবং বৃদ্ধির জন্য সরকার এনজিওর সাহায্য নিতে পারে। সার্কভুক্ত সব দেশেই বিশেষ করে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালে মাদক সমস্যা গুরুতর বলে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মাদক নিয়ন্ত্রণে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। চোরাচালান বন্ধের জন্য সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা দরকার।
পাঁচ. মাদকসেবীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন একটি জটিল, ব্যয়সাপেক্ষ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কার্যকরভাবে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে আশা করা যায়, এ অন্ধকার অপরাধ জগৎ থেকে অনেকেই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা পাবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে এই শতাব্দীর কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বের সব দেশের, সব সম্প্রদায়ের ও সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। তা না হলে মানবসভ্যতাকে মাদকের প্রলয়ঙ্করী ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা যাবে বলে মনে হয় না।
লেখক : প্রফেসর, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ও প্রোভিসি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
drmuniruddin@yahoo.com
No comments