ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়- ১১২ পদ উপাচার্য সহ-উপাচার্য মন্ত্রী নেতাদের ভাগ-বাঁটোয়ারা by তৌহিদী হাসান
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সেপ্টেম্বরে ১১২ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের সুপারিশকারীদের তালিকায় এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই তালিকায় উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষর রয়েছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রায় ৭০ দিন ধরে ক্যাম্পাসের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ আছে। স্থগিত হয়েছে চলতি সেশনের ভর্তি পরীক্ষা। ক্যাম্পাসে একের পর এক ভাঙচুর, বোমা মেরে গাড়ি পোড়ানোসহ সড়কে চোরাগোপ্তা হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।সরকার-সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বিএনপি-সমর্থিত জিয়া পরিষদ, জামায়াত-সমর্থিত গ্রিন ফোরাম, শিক্ষক সমিতির সদস্যসহ কর্মকর্তারা এসব নিয়োগ-বাণিজ্যের প্রতিবাদে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর ২১৭তম সিন্ডিকেটের সভায় ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগে উপাচার্যের মেয়ে এবং পরিসংখ্যান বিভাগে চারজন শিক্ষকসহ ১১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে এত নিয়োগের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। ওই নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সুপারিশকারীদের কারও ছেলে, ভাই, শ্যালক-শ্যালিকা, ভাগনে, এমনকি বাসার কাজের বুয়াও। কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আবার অনেকে রয়েছেন ত্যাগী ছাত্রলীগের কর্মী বা আওয়ামী পরিবারের সদস্য।
১১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া-সংক্রান্ত যে প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে, তাতে দেখা যায় উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ছাড়াও মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় এবং ছাত্রলীগের নেতাসহ অনেকের সুপারিশে নিয়োগগুলো হয়েছে। এসব সুপারিশের বিপরীতে রয়েছে কোটি টাকার বাণিজ্য।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আলাউদ্দিনের সুপারিশে ১৭ জন, সহ-উপাচার্য কামাল উদ্দিনের ১৩, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান তুহিনের ১৪, ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ১২, কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আলী মর্তুজা খসরুর নয়, ছাত্রলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের চার, প্রক্টর মেহের আলীর চার, কোষাধ্যক্ষ শাহজাহান আলীর তিন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের তিন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর দুই, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর এক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাইয়ের চার, কুষ্টিয়া-১ আসনের সাংসদ আফাজ উদ্দিনের এক, ঝিনাইদহের মেয়রের এক, শৈলকুপা উপজেলা চেয়ারম্যানের এক, কুষ্টিয়ার মেয়র আনোয়ার আলীর এক, কুষ্টিয়া সদরের সাংসদের তিন, ছাত্রলীগের নেতা মাহবুবের দুই, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনের দুই, উপাচার্যের পিএস সাইফুল ইসলামের তিন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই এবং সহকারী রেজিস্ট্রার জিলুর সুপারিশে দুজনের চাকরি হয়েছে। এ ছাড়া একজন করে আরও বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতার সুপারিশে চাকরি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবুল আহসান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার লজ্জা ও শরম হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন তিনজন (উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধাক্ষ) প্রশাসককে পেয়েছি, যাঁরা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তাঁরা নির্লজ্জ ও কৌশলী। সহ-উপাচার্যের বাসায় যে মহিলা রাঁধুনির দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁকেও চাকরি দেওয়া হয়েছে এবং সেই সুপারিশের কথা প্রধানমন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে।’
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, ‘শুনেছি, উপাচার্য এম আলাউদ্দিন নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন। এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে ক্যাম্পাসে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ ফেরানোর দাবি জানাই। নিয়োগ-বাণিজ্যের দায়ভার মহাজোট সরকার নেবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এম ইয়াকুব আলী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করা হয়েছে। মেধার মূল্যায়নের চেয়ে টাকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই দুর্নীতির কারণে আমরা তিন কর্মকর্তার অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাই।’
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের এম আলাউদ্দিন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটা তালিকা পাঠানো হয়েছিল। সেটা সহ-উপাচার্য তৈরি করেছিলেন। তাতে আমি স্বাক্ষর করেছিলাম। তবে এতে কী লেখা ছিল, সেটা সহ-উপাচার্য ভালো বলতে পারবেন। আমাকে বাদ দিয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপকার হয়, আর সরকার যদি চায় তবে তাতে আমি রাজি।’ তালিকার ব্যাপারে সহ-উপাচার্য কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নিতান্তই গোপনীয় ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমার জানা নেই।’ স্বাক্ষর করার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে কত কিছুই সম্ভব।’
No comments