সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-দয়া করে চুপ থাকবেন না by হাসান শাহরিয়ার
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে আপনি আর চুপ থাকবেন না। একজন র্যাব সদস্যকে বাঁচাতে গিয়ে একটি পরিবার ধ্বংস হবে তা নিশ্চয়ই আপনি চান না। র্যাব অনেক ভালো কাজ করেছে। তবে এই সংস্থার কিছুসংখ্যক অসৎ সদস্যের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে যথেষ্ট বদনাম হয়েছে।
অবশ্য যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাদের শাস্তি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন এর ব্যতিক্রম হচ্ছে তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে নাবাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, আবার অনেকে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। যাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আমলা, ব্যবসায়ী এবং পেশাজীবী। যারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি তারা বঞ্চিতদের দলে। সরকার বদল হলে ভাগ্যবানদের তালিকাও বদলে যায়। গোড়া থেকেই আমলারা শক্তিশালী। নীরবে বিত্তবান হয়ে উঠলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সরকার তথা পুলিশ, র্যাব, দুর্নীতি দমন কমিশন ও আয়কর বিভাগের নাকের ডগায় কীভাবে তারা সম্পদশালী হলেন তা আমার আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। ঠিক তেমনি আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি-না, কিংবা পদ্মা সেতু নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত মাথাব্যথা, সুশাসন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ডেসটিনি বা হলমার্ক, সংসদ বনাম বিচার বিভাগ, জনগণের দুর্দশা অথবা মন্ত্রী, উপদেষ্টা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও আমলাদের দুর্নীতি নিয়েও আজ কথা বলব না। আমি আজ এক অসহায় পরিবারের কথা বলব, বলব কীভাবে বিনাদোষে এই পরিবারটি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং সরকারে অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তিরা ঝেড়ে ঘুমাচ্ছেন। তারা দেখেও না দেখার ভান করে অন্যায় ও স্বেচ্ছাচারিতার পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
আমি বলছি ঝালকাঠির পঙ্গু লিমনের কথা, তার পরিবারের কথা। গত বছর ২৩ মার্চ সাতুরিয়া গ্রামে নিজের গরুর পিছু করতে গিয়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়ে ১৬ বছর বয়স্ক কলেজছাত্র লিমন হোসেন। র্যাবের সদস্যরা বললেন : 'তুমি সন্ত্রাসী।' সে বলল : 'আমি সন্ত্রাসী নই। আমি এইচএএসসি প্রথম বর্ষের পরীক্ষার্থী, এপ্রিলের ৫ তারিখ থেকে আমার পরীক্ষা।' সে তার মোবাইল ফোন দিয়ে বলল, 'গ্রামের যে কোনো লোককে ফোন করলেই আমার সম্পর্কে জানতে পারবেন।' তাদের হাত-পা ধরে সে কাকুতি-মিনতি করল; কিন্তু তাদের মন গলাতে পারল না। তারা তাকে ব্রিজের কাছে নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করল। খানিক পরেই গ্রামের একজন মুরবি্ব সেখানে উপস্থিত হলে গোমর ফাঁক হয়ে যায়। তিনি বললেন, 'লিমন ভালো ছেলে, সে সন্ত্রাসী নয়।' তখন জানা গেল, র্যাব মুর্শেদ জমাদ্দার নামের এক সন্ত্রাসীর খোঁজে সাতুরিয়ায় গিয়েছিল। জমাদ্দারের গায়ে লাল জামা ছিল বলে তাদের সোর্স জানিয়েছিল। লিমনের কপাল খারাপ, তারও গায়ে লাল জামা ছিল। লিমনের বক্তব্য : মুর্শেদ জমাদ্দারকে সে চেনে না এবং জমাদ্দারও তাকে চেনে না। যা হোক, গুলিবিদ্ধ লিমনকে তারা বরিশালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। দু'দিন পর এক্স-রে করে ডাক্তার জানালেন, তার পা কেটে ফেলতে হবে। স্বাধীনতা দিবসের এক দিন পর ২৭ মার্চ ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তার অপারেশন হয়। এক পা হারানো ছিল তার স্বাধীনতা দিবসের পুরস্কার!
এরপর সে জানতে পারল, তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে : একটি অস্ত্র আইনে এবং অন্যটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে। মাসে দু'বার কোর্টে হাজিরা দিতে হয় তাকে। পরবর্তীকালে লিমন, তার ভাই ও মায়ের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। র্যাব সদস্য লিমনকে গুলি করেনি বলে পুলিশ ইতিমধ্যে গোপনে কোর্টে রিপোর্টও দাখিল করেছে।
লিমনের পরিবারটি হতদরিদ্র। তার বাবা কলা বিক্রি করেন। ভাই ঢাকায় থাকেন, ডিগ্রি পরীক্ষা দেবেন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের সংসার কোনো রকমে চলে। জনগণের দেওয়া অর্থেই তার চিকিৎসা হচ্ছে। এ ঘটনার পর প্রাণের ভয়ে তারা পিরোজপুরের কাউখালীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ঘটনাটি প্রথম পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৬ এপ্রিল। এরপর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সারাদেশে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান নিজে তাকে দেখতে যান। আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ অনেক বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজ সহায়-সম্বলহীন লিমনের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ৩৭ জন বিশিষ্ট নাগরিকও লিমন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি উঠলেও রহস্যজনক কারণে সরকার জগদ্দল পাথরের ভূমিকা পালন করছে। তবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।
এক পা চলে যাওয়ার পরও লিমনের মনোবল ভাঙেনি। সে লেখাপড়া শিখতে চায়, চায় দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে। 'একজন সুনাগরিক হিসেবে মানুষের মতো বাঁচতে চাই', কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে আমাকে বলল। 'আমাদের পক্ষে গ্রামে থাকা সম্ভব নয়। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।' তার ওপর যে অকথ্য নির্যাতন হয়েছে সে জন্য এখন আর সে কাউকে দোষারোপ করে না। বিচারের ভার সে ছেড়ে দিয়েছে আল্লাহর ওপর। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার আবেদন : 'আমার যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তা আর কোনোদিন পূরণ হবে না। দয়া করে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলগুলো তুলে নিন এবং লেখাপড়া করে আমাকে মানুষ হওয়ার সুযোগ দিন।'
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ দেশের দরিদ্র জনগণের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আশীর্বাদ আপনার চলার পথের পাথেয়। বঙ্গবন্ধুর মতো আপনিও গরিবের বন্ধু। তার মতো আপনিও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান, সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াতে চান। বিনা দোষে তারুণ্যে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছে লিমন। হয়তো তাকে জেলের ঘানি টানতে হবে। পঙ্গু ছেলের কারাবাস হবে মৃত্যু সমতুল্য। তার মায়ের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আকুতি আপনিই বুঝবেন। কারণ স্বজন হারানোর বেদনা যে কী প্রকট তা আপনার চেয়ে আর কেউ এতটা গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হজরত ওমরের (রা.) একটি ঘটনা মনে পড়ল। একদিন রাতের বেলায় ছদ্মবেশে বেরিয়েছেন তিনি জনগণের অবস্থা নিজ চোখে দেখার জন্য। হঠাৎ একটি তাঁবু থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, এক মহিলা কী যেন রান্না করছেন। তিনি বাচ্চাদের কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে মহিলা বললেন : 'আমরা মদিনার বাসিন্দা নই। খলিফা ওমরের সঙ্গে দেখা করে সাহায্য নিতে এসেছি। চার দিন ধরে চেষ্টা করে তার দেখা পাচ্ছি না। বাচ্চারা খাওয়ার জন্য কাঁদছে; কিন্তু আমার কাছে কিছুই নেই। আমি হাঁড়িতে পানির মধ্যে কয়েকটি পাথর রেখে নাড়াচাড়া করছি। ওরা ভাবছে, আমি মাংস রান্না করছি।' এ দৃশ্য দেখার পর হজরত ওমর (রা.) আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন। বায়তুল মাল থেকে বস্তাভর্তি আটা, সবজি ও অন্যান্য খাবার নিজ কাঁধে বহন করে তাঁবুতে এলেন। বললেন, 'মা, তুমি তাড়াতাড়ি এগুলো রান্না করো।' তিনি তাঁর পরিচয় গোপন রাখলেন। বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি বিদায় নেওয়ার সময় মহিলা লক্ষ্য করলেন তাঁর চোখে অশ্রু। বললেন : 'ওমরের বদলে আপনার মতো গরিব-দরদি লোক খলিফা হলে খুব ভালো হতো।' এবারও হজরত ওমর (রা.) নিজের পরিচয় গোপন করলেন। শুধু বললেন, 'কাল খলিফার দরবারে এসো। আমিও সেখানে থাকব।' পরদিন বহু কষ্টে দরবারে হাজির হয়ে খলিফার আসনে রাতের আগন্তুককে দেখে তার চক্ষুস্থির। 'আমিরুল মুমেনিন, আমাকে ক্ষমা করুন, গত রাতে আমি ভুল করে ফেলেছি', এই উক্তি করে তিনি বললেন, 'আপনাকে আমি চিনতে পারিনি।' জবাবে হজরত ওমর (রা.) বললেন, 'গত রাতে যদি তোমরা অভুক্ত থাকতে তাহলে হাশরের দিন আমাকে আসামি করে আল্লাহর কাছে বিচার চাইতে পারতে।'
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হজরত ওমরের (রা.) ঘটনাটি বলার কারণ হলো আপনিও ১৫-১৬ কোটি লোকের অভিভাবক। তারা রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আপনি প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করবেন, তেমনি নিশ্চিত করবেন তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি। আপনি একজন বিচারকও বটে। আমরা চাই না আপনার শাসনামলে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা হোক। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। বিচার তো মহল্লা বা গ্রাম থেকে শুরু করে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত হয়। কিন্তু সবসময় কি বাদী ন্যায়বিচার পায়? কখনও পায়, কখনও পায় না। সব ধর্ম ও রাষ্ট্র ন্যায়বিচার প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা আইনের মারপ্যাঁচে যদি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি অত্যাচারিত বা সাজাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তো ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলো না। সাধারণ মানুষ চায় ন্যায়বিচার এবং সরকারকে তার গ্যারান্টি দিতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে আপনি আর চুপ থাকবেন না। একজন র্যাব সদস্যকে বাঁচাতে গিয়ে একটি পরিবার ধ্বংস হবে তা নিশ্চয়ই আপনি চান না। র্যাব অনেক ভালো কাজ করেছে। তবে এই সংস্থার কিছুসংখ্যক অসৎ সদস্যের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে যথেষ্ট বদনাম হয়েছে। অবশ্য যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাদের শাস্তি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন এর ব্যতিক্রম হচ্ছে তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। অন্যায় যে করে এবং অন্যায় যে সহে উভয়েই সমান অপরাধী। আপনি দয়া করে লিমন ও তার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলুন। তাদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন তারা সন্ত্রাসী কি-না। আপনার বিচারে যদি তারা সন্ত্রাসী প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের ভাগ্যে যা আছে তা-ই ঘটবে। আর যদি তার উল্টোটি হয়, তবে কী করতে হবে তা আপনিই ভালো জানেন। মৃতপ্রায় এই পরিবারের শেষ ভরসা আপনি। দেশের আপামর জনগণের বিশ্বাস, আপনিই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবেন। আপনি লিমনের পা ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, কিন্তু আপনিই তাকে দিতে পারেন এক নতুন জীবন। কে জানে, এই ছেলেই একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। দেশবাসী আপনার পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকবে।
হাসান শাহরিয়ার : ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন
No comments