ইসরায়েল- ফিলিস্তিনি শিশুর অঙ্গার বনাম সভ্যতার করাল হাসি by ফারুক ওয়াসিফ
‘আমি একজন ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনিদের কি চোখ নেই? নেই হাত, অঙ্গ, ভাব, অনুভূতি, বোধ ও ভালোবাসা? তুমি-আমি একই খাবার খাই, আহত হই একই অস্ত্রে। একই অসুখে আমরা ভুগি এবং সেরে উঠি একই ওষুধে। ইহুদিদের মতো একই গ্রীষ্ম ও শীত আমাদেরও ওম দেয় আর ঠান্ডায় কাঁপায়।
তুমি যদি আঘাত করো, আমার কি রক্ত ঝরে না? তুমি যদি কৌতুক বলো, আমি কি হাসি না? এবং তুমি যদি অন্যায় করো, আমি কি তার প্রতিশোধ নেব না? সবকিছুতেই যদি আমরা তোমাদের মতোই হই, তাহলে তুমি যা আমার প্রতি করছ; আমিও তা-ই করব। হয়তো তা হবে তোমার থেকেও কঠিন, আমি তো তোমার কাছ থেকেই শিখছি।’পাঠক, ওপরের কথাগুলোর ফিলিস্তিনি শব্দের জায়গায় ইহুদি শব্দ বসালেই আপনি পেয়ে যাবেন শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকের বিখ্যাত ইহুদি চরিত্র শাইলকের সংলাপ। শাইলকের জাতি সুপ্রাচীন ইউরোপীয় ঘৃণার চূড়ান্ত দেখেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। তারই ধারাবাহিকতায় নাৎসিদের থেকেও নির্দয় ঘাতক হয়ে উঠেছে আজকের জায়নবাদী ইসরায়েল। নাৎসিরা তাদের প্রতি যা করেছিল, তার থেকেও কঠিন শোধ তুলছে তারা। পরিহাস, সেই ইউরোপ আজ বন্ধু, আর সহস্র বছরের বন্ধু আরবদের তারা করছে দেশহীন, চালাচ্ছে গণহত্যা। ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলি ঈশাই হুংকার দিয়েছেন, ‘গাজাকে মাটিতে মিশিয়ে দেব। মধ্যযুগে ফেরত পাঠাব। তাদের মরাই দরকার।’ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা কোনো জাতি নয়, তারা নিছক জনসংখ্যা। এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই ১৯৭৪ সালেই জাতিসংঘের ৩৩৭৯ নম্বর সিদ্ধান্তে জায়নবাদকে বর্ণবাদের সমার্থক বলা হয়েছিল। আজকে ফ্যাসিবাদের অপর নামই জায়নবাদ।— নাৎসিবাদের মতো এটাও মানবতার শত্রু।
দিনকে দিন ইসরায়েল হয়ে উঠছে হাতলহীন তলোয়ারের মতো। যেদিকেই ধরা হোক না কেন, তা কাটবেই। শত্রু বা বন্ধু উভয়ের জন্যই তা বিপজ্জনক। তার পরও ওবামা-বুশের মতো ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ আগ্রাসনের সমর্থক বনেছেন। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বলেছেন, ‘ইসরায়েল যা চায়, আমেরিকাও তা-ই চায়।’ কীভয়ংকর! ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীন বাদে জাতিসংঘের পরাশক্তি ক্লাবও ইসরায়েলপন্থী। পক্ষাঘাতগ্রস্ত আরব লিগের অসার বৈঠক থেকে বেরিয়ে কাতারের মার্কিনপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত বলে ফেলেছেন, ‘বৈঠকের নামে টাকা ও সময় দুটোই নষ্ট!’ কেবল মিসর ও তিউনিসিয়া নড়েচড়ে উঠছে।
গাধা যখন মোট বয়, তখনো যেমন গাধা; যখন বোঝা নামিয়ে রাখে, তখনো সে গাধা। কথাটা আমেরিকা-ইসরায়েলের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি সৌদি আরব, কাতার প্রভৃতি আরব দেশের জন্যও সত্য। আনোয়ার সাদাতের দালালি আর হোসনি মোবারকের সহায়তা ছাড়া গাজাকে জায়নবাদী অশউইৎজ বানানো বা ফিলিস্তিনকে এমন ছিবড়ে করা ইসরায়েলের পক্ষে সম্ভব হতো না। আরব শাসকদের শঠতা এমনই, তারা গাজায় যুদ্ধবিরতির কথা তুলছে। যদিও সেখানে যুদ্ধ নয়, চলছে আগ্রাসন ও গণহত্যা। অথচ সিরিয়ার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মেলানো যুদ্ধংদেহী!
হামাসের সামরিক প্রধান আহমেদ আল জাবিরকে হত্যার মাধ্যমে চলমান হামলার শুরু। এর জন্য তারা মাসের পর মাস প্রস্তুতি নিয়ে, তথ্য সংগ্রহ করে, ফাঁদ পেতে মওকা বুঝে মিসাইল মেরেছে জাবিরের গাড়িতে। সুতরাং এটা হঠাৎ ঘটা কোনো অশান্তি নয়। অথচ এই জাবিরই গাজায়আটক ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতের মুক্তির মধ্যস্থতা করেছিলেন, মৃত্যুর ঘণ্টা খানেক আগেও ব্যস্ত ছিলেন ইসরায়েলের পাঠানো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব চূড়ান্ত করার কাজে। শান্তির নামে প্রতারণাই ছিল ইসরায়েলের উদ্দেশ্য। গাজায় হামলার আগে তারা শুরু করেছিল পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের নতুন অভিযান।
প্রথম শান্তিভঙ্গের কথা তুললে চলে আসবে ১৯৪৮ সালের কথা। সে বছরই বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ীরা ইহুদিদের হাতে ফিলিস্তিনকে তুলে দেয়। ফিলিস্তিন যেন ইহুদিদের শূলকাঠে বিদ্ধ নিষ্পাপ যিশু। ইসরায়েল হলো আধুনিক শূলকাঠ, ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি যার পত্তনিদাতা। ইউরোপীয় ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রয়োজন, কিন্তু তা ফিলিস্তিনের কবরের ওপর হবে কেন?
যুক্তি দেওয়া হলো, ৭০ খ্রিষ্টাব্দে যেহেতু রোমানরা ইহুদিদের জেরুজালেম থেকে গণহারে বিতাড়িত করেছিল, সেহেতু সেখানেই তাদের পুনর্বাসিত করা ন্যায়বিচার। এটা ছিল ইতিহাসের দুর্ধর্ষ ধাপ্পা। আদি ইসরায়েলি হিব্রু জাতির বর্তমান বংশধর যদি কেউ হয়ে থাকে, খোদ ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তার দাবিদার। গবেষণাজাত বই লিখে এই দাবি প্রতিষ্ঠা করছেন ইসরায়েলের তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শোলমো স্যান্ড। তাঁর সাড়া জাগানো দি ইনভেনশন অব দ্য জুইয়িশ পিপল বা ইহুদি জাতির আবিষ্কার নামক বইটি বেশ কয়েক মাস ইসরায়েলে বেস্ট সেলার ছিল। শোলমো স্যান্ড তাঁর দাবির পক্ষে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ফরেনসিক প্রমাণ হাজির করেছেন। স্যান্ডের দাবির সারসংক্ষেপ এই: ইহুদিরা কোনো জাতি নয়; জাতি হতে গেলে যে সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বর্ণগত মিল প্রয়োজন, তা তাদের কোনোকালেই ছিলনা। ইসরায়েলি ইহুদিদের বড় অংশ কখনোই আদি হিব্রু জাতির সদস্যও ছিল না। এমনকি মুসার অনুসারীদেরও ‘জিউ’ বলা হতো না। সেটা ছিল জুডায়ি ধর্ম। তালেবানি ইসলাম যেমন আদি ইসলামের বিকৃতি, জায়নিজমও তেমন জুডায়ি বিশ্বাসের বিকৃতি। বহু নিষ্ঠাবান ইহুদি এ কারণেই জায়নবাদের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে।
৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেম থেকে ইহুদিদের বিতাড়নের ঘটনাও বিশুদ্ধ কল্পনা। তারা বংশপরম্পরাগত ইহুদিও নয়। তারা মূলত পূর্ব ইউরোপীয় খাজারীয় সাম্রাজ্যের লোকজন, প্রথম সহস্রাব্দের পরে যারা ইহুদি হয়। খাজারিয়ারা ছিল বহিষ্কৃত কোনো এশীয় গোত্র। মধ্যযুগে রুশ সাম্রাজ্যের উত্থানে খাজারিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে তারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং ইহুদিদের ফিলিস্তিনের ওপর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার দাবি সম্পূর্ণ জোচ্চুরি। যাদের উৎপত্তি, জন্ম ইতিহাস ও রাষ্ট্রীয় সংবিধান সম্পূর্ণ মিথ্যার বুনিয়াদে দাঁড় করানো, জবরদস্তি ছাড়া তারা টিকতে পারে না। ফিলিস্তিনিদের নিছক জনসংখ্যা বলে হেয়করার জবাবে শোলমো স্যান্ডের বরাতে বলা যায়, ইসরায়েলই হলো অভিবাসী পপুলেশন আর ফিলিস্তিনিরাই সেখানকার আদি নেশন।
দুই.
এবারের আগ্রাসনটি কেবল গাজার বিরুদ্ধে হয়নি, এটা হয়েছে সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগণ তথা মুক্তিকামী আরব জনতার বিরুদ্ধেও। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য একাধিক। ১. যুদ্ধোন্মাদনায় উত্তেজিত করে ইসরায়েলি ভোটারদের আরও চরমপন্থী করে তোলা, যাতে অজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লিকুদ আর চরমপন্থী প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিবারম্যানের বেইতনু দল আগামী জানুয়ারির নির্বাচনে জিততে পারে। ২. ২৯ নভেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে ফিলিস্তিন যাতে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য ভোটাভুটির দাবি না তুলতে পারে। যুদ্ধ পরিস্থিতি এ ধরনের ভোটাভুটি কঠিন করে তুলতে পারে। ৩. আরবের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সরিয়ে মৌলবাদীদের সামনে আসার উসকানি জোগানো এবং তারপর মৌলবাদ দমনের নামে ইরানের ওপর ঝাঁপিয়েপড়া। ৪. স্বাধীন ফিলিস্তিনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে সমগ্র ফিলিস্তিনকেই ‘বৃহত্তর ইসরায়েলের’ মধ্যে গিলে ফেলা।
১৫ লাখ গাজাবাসীর ওপর ২০০৬ সাল থেকে সর্বাত্মক অবরোধ চলছে। দফায় দফায় মিসাইল নিক্ষেপ আর রাসায়নিক অস্ত্রে খুন হচ্ছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। ২০০৮-০৯ সালে নিহত হয়েছিল দেড় হাজার মানুষ, যার তিন ভাগের এক ভাগই ছিল শিশু। কত নিখুঁত সামর্থ্য ইসরায়েলের ধ্বংস-মেশিনের। গণিতের নিয়মে তারা মানুষ হত্যা করায় ওস্তাদ।
ভূমি দখলের গণিতের পাশাপাশি আরব জনসংখ্যার গণিত বদলাতেও ইসরায়েল অত্যন্ত মনোযোগী। অবরোধ, ক্ষুধা, চিকিৎসার ঘাটতির জন্য অকালমৃত্যু ও অপঘাতে মৃত্যুর হার দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাজায়। ২০০৮ সালের রাসায়নিক হামলার পর থেকে সেখানে শিশুদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পঙ্গু হয়ে জন্মাচ্ছে। এমন ত্রাস যে, গর্ভের শিশুও জন্মাতে ভয় পায়। তবু তারা জন্মায় পাথর, রকেট বা রাইফেল হাতে নেওয়ার জন্য। গাজা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম কারাগার। বন্দিশালায় শৈশব বলে কিছু থাকে না। দাসের শিশুও যে দাস, সেটা সেই শিশু দাসটিও জানে—জাতিসংঘ জানে না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানে না। তবু সেই শিশুরা বলে না, ‘মা, আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।’ বোমা-বারুদ আর মৃত্যুর আবহে নারী-পুরুষের মিলন তবু হয়, সন্তানের আশায়। হায় সন্তান! এত জন্মে, তবু কমে যায় জাতির আকার। জাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আরও আরও জন্ম চাই। আরও শিশু চাই শহীদদের খালি জায়গা ভরাট করার জন্য। কয়েক হাজার বছরের অস্তিত্ব টিকবে না, যদি-না শিশু জন্মায়, যদি-না তারা হাঁটাচলা শিখলেই পাথর হাতে শহীদ হতে না যায়। জন্ম আর মৃত্যুর এ কোন বুক হিম করা অঙ্ক কষে যাচ্ছে ফিলিস্তিন?
এ কোন সহনশীলতা নিয়ে দেখে যাচ্ছি অঙ্গার হওয়া শিশুর দেহ জাপটে ধরা মায়ের মাতম? যুদ্ধ আর অবরোধে ইরাকে শিশুরা মরেছে লাখে লাখে, আফগানিস্তানে হাজারে হাজারে। পাঁচ হাজার বছর বয়সী সভ্যতা যখন দুধের শিশুদের হত্যা ঠেকাতে পারে না, তখন এই সভ্যতার গর্ব করার কী অধিকার থাকতে পারে?
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আন্দোলন আধুনিক যুগের সবচেয়েপুরোনো ওজনপ্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন। ফিলিস্তিনই হলো বৈশ্বিক আধিপত্যবাদের ভরকেন্দ্র। ফিলিস্তিনের মুক্তি মানে তাই মানবতার মুক্তি, বিশ্বেরই মুক্তি। ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার বৈধতা তাই বিশ্বজনীন।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments