কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-রবি যখন কল্পশিক্ষক।। রবি যখন ভাবশিক্ষক by রণজিৎ বিশ্বাস
: আপনাকে আমি আজ আমার এক ভাবশিক্ষকের কথা শোনাব। আপনার ভালো লাগতে পারে। : আগে তো শুনি। : শুনবেন তো অবশ্যই। বেশির ভাগই আমার সবচেয়ে বড় ভাবশিক্ষক ও কল্পশিক্ষক রবীন্দ্রনাথের কথা। যেমন- 'হাউই কহিল, আসি- কী সাহস ভাই!/তারকার মুখে আমি দিয়ে আসি ছাই।/কবি কহে- তার গায়ে লাগে নাকো কিছু/সেই চাই ফিরে আসে তোরই পিছু পিছু।'
যেমন, 'প্রাচীরের গাত্রে এক নামগোত্রহীন/ফুটিয়াছে ছোট ফুল অতিশয় দীন।/ধিকধিক করে তারে কাননে সবাই।/সূর্য উঠি বলে তারে ভালো আছ ভাই?'। যেমন, 'কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবি।/শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।/মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল- স্বামী/আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।' যেমন, 'বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।/দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাইবা দিলে সান্ত্বনা/দুঃখকে যেন করিতে পারি জয়।/সহায় মোর না যদি জুটে/নিজের বল না যেন টুটে,/নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।/সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি/লভিলে শুধু বঞ্চনা/তরিতে পারি শকতি যেন রয়।' যেমন, 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে/সকল অহংকার হে আমার ডোবাও চোখের জলে।/নিজেরে করিতে গৌরব দান/নিজেরে কেবলি করি অপমান/তিলে তিলে পলে পলে।' যেমন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/তবে একলা চলো রে/... রক্তমাখা চরণতলে একলা দলোরে/... আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলোরে।' রবীন্দ্রনাথের কথা আমি আর বলব না। আমার বিপদ বাড়বে। রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গেলে বিপদ আবার বাড়ে কী করে। বাড়ে। বিপদ আমার বড় বাড়ে। কারণ, কথার পরে কথা আসে লতার মতো। কিছুতেই শেষ হতে চায় না মনের আমার ভাবনা যত।তাছাড়া ভয় আছে। এক ধরনের লোকভয়।
: সে আবার কেমন ভয়?!
: মানুষ আমাকে উন্মাদের ব্র্যাকেটে ঢুকিয়ে দিতে পারে। ধামার মতো আমার- ধমাধমা শরীরের পরে টাইপ করা কোন লেবেল সেঁটে দিতে পারে যার পরে লেখা থাকবে- 'পাগল'।
: তা থাকে যদি থাকুক না! যা সত্য, তা ফেইস করার সাহস ও দমতো আপনার আছে বলেই জানি।
: আছে যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যতবার আমি মানুষের কাটাছেঁড়ার মধ্যে পড়েছি, তার আধাআধির মোকাবিলাও যদি আপনার করতে হতো, এত দিনে আপনাকে অন্য লোকের ঠিকানায় বসবাস করতে হতো।
: আপনাকে আমার ব্যাপার না ভাবলেও চলবে। আপনাকে যে লোকজন উন্মাদের ব্র্যাকেটে ঢোকাবে, সেটি নিয়েও আপনার ভাববার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথই কী বলে যাননি- যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিসনে কিছু/... কাল সে প্রাতে মালা হাতে আসবে রে তোর পিছু পিছু।'
: তাহলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার কথা আরো দু-চারটি বলি?
: অতগুলো বলবেন?
: বলি না দেখি! বেশি বলব 'কণিকা' থেকেই।
: বলুন যেখান থেকে মর্জি আপনার। পাগলে কী না বলে!
: কী বললেন আপনি?!
: না, আপনি যেমন ভাবছেন, মোটেই তেমন কিছু নয়; বললাম, আপনার যেমন খুশি ও যেখান থেকে খুশি বলতে পারেন।
: শুনুন। 'কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে/ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে।/হেন কালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা।/কেরোসিন শিখা বলে এসো মোর দাদা।' সে মতোই আরেকটা- কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে/আমরা কুটুম্ব দোহে ভুলে গেলি কীরে!/থাকার থলি বলে- কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে/আমার যা আছে, গেলে তোমার ঝুলিতে।' কণিকার আরেক কণা শুনুন- 'উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে/তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।'
: শেষ?
: না। আর মাত্র একটা। 'প্রশ্ন' থেকে। 'তাইতো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে/যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু/নিবাইছে তব আলো/তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ/তুমি কি বেসেছো ভালো?'
: এই প্রশ্নটি আপনার কেন ভালো লাগে?
: ভালো লাগে, কারণ বিধাতাকে এমন প্রশ্ন আমি নিজেও করি। বারবার করি। বিধাতাকে এমন প্রশ্ন করতে হয়। কারণ, তিনি প্রায়শই দুর্গতজনের কথা শোনার জন্য জায়গামতো থাকেন না। কখনো কখনো দুর্গত ও অকারণে দমিত মানুষ বড় হতাশায় ভুগে ভুগে দেখে- তিনি তাদেরই সহায় হন যারা তাঁর আলো নিভিয়ে দেয়, যারা তাঁর বায়ু বিষিয়ে দেয়, যারা যুদ্ধাপরাধ করে, যারা তাদের সমর্থন করে, যারা সাম্প্রদায়িক, যারা ছদ্ম-সাম্প্রদায়িক, যারা মানুষকে মানুষ ভাবার আগে তার জন্ম-পরিচয় দেখে, যারা অদৃশ্য ভবনে মানুষের রেকর্ড রাখে এবং যারা নিজের সন্তানকে ব্যবস্থাপত্রের ইতিহাস পড়ায়।
লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক
No comments