আমিরাত থেকে ফিরতে হচ্ছে লক্ষাধিক কর্মীকে by হায়দার আলী
অবৈধভাবে বসবাসকারী প্রবাসীদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত আগামী ৪ ডিসেম্বর থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমা (অ্যামনেস্টি) ঘোষণা করেছে। অবৈধ অভিবাসীরা এই সময়ের মধ্যে থাকার বৈধতা লাভের চেষ্টা করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত জরিমানা দিয়ে ভিসা নবায়ন করা যাবে।
তা না হলে ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অবশ্যই নিজ নিজ দেশে ফিরে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরিমানা বা শাস্তি ছাড়াই আউটপাস (দেশত্যাগের অনুমতি) সংগ্রহ করা যাবে। আমিরাত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিবাসন ও পোর্টস অ্যাফেয়ার্স বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি মেজর জেনারেল নাসের আল আওয়াদি আল মিনহালি গত ১৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলন এ কথা জানান। নির্ধারিত সময়ের পর কোনো অবৈধ অভিবাসী পাওয়া গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও নাসের হুঁশিয়ার করে দেন।আমিরাতে আড়াই লক্ষাধিক বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় ও প্রবাসীদের সূত্রে জানা গেছে। কাগজপত্রের অভাবে তাঁদের বেশির ভাগেরই আয়-রোজগার নেই, থাকলেও তা নগণ্য। ফলে ফিরতে হলে তাঁদের শূন্য হাতেই আসতে হবে। সৌদি আরবের পর আমিরাতেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন এবং তাঁদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সন্তোষ কুমার অধিকারী (মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট) কালের কণ্ঠকে বলেন, আমিরাত সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসীরা ভিসা নবায়ন কিংবা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করে নিতে পারলে বৈধ হয়ে যাবেন। তা না হলে তাঁদের বাংলাদেশে চলে আসতে হবে। তিনি বলেন, 'আমাদের মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ করছেন এবং আমিরাতে বাংলাদেশের দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও প্রবাসীদের সহযোগিতা করছেন।'
আমিরাতে অবস্থানরত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত ডা. নাজমুল কাউনাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিতে দূতাবাসের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। হয়রানি এবং জরিমানা ছাড়াই অনেক অবৈধ শ্রমিক বাংলাদেশেও ফিরতে পারবেন বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মো. শাহজালাল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অন্যান্য দেশ তাদের শ্রমিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমিরাত সরকারের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করছে। কিন্তু আমাদের সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা তারাই জানে।' তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'আমরা আমাদের অবস্থান থেকে আমিরাতের শ্রম বাজারের বেহাল অবস্থা নিয়ে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছি যে আপনারা আমিরাতের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন। তারা আমাদের শ্রমিকদের যেন বাংলাদেশে না পাঠিয়ে সেখানেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে কাজ করার সুযোগ দেয়। সরকার আমাদের কথা শুনতে চায় না, ডাকেও না।'
মানব পাচার প্রতিরোধ কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক (শিসউক) সাকিউল মিল্লাত মোরশেদ বলেন, 'আমিরাতে অবৈধ শ্রমিকদের কাজে লাগানোর সুযোগ তো আছে। সরকারি পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে অর্ধেক শ্রমিককেও যদি বৈধতা দেওয়া যায়, সেটা হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া।' শেষ পর্যন্ত পাঠিয়ে দেওয়া হলে তা ধাপে ধাপে হওয়া যুক্তিসঙ্গত বলে তিনি মনে করেন।
প্রবাসী ও মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, অবৈধ অভিবাসীদের বেশিরভাগই অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আরব আমিরাতে গিয়েছেন, কেউ বা ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর আর দেশে ফেরেননি। কেউ কেউ বেশি টাকা উপার্জনের আশায় এক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাজ নেওয়ায় অবৈধ হয়ে পড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন দেশের অবৈধ অভিবাসীরা আরব আমিরাতের মুছাপ্পা, দুবাই, সারজা, রাস-আল-খইমাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছেন। তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে খুন, চুরি, ছিনতাই ও যৌনব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণেই দেশটির সরকার এই কঠোর অবস্থান নেয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ নিয়ে আমিরাত চতুর্থবারের মতো ক্ষমা ঘোষণা করল। ২০০৭ সালে এ ধরনের ক্ষমা ঘোষণা করায় প্রায় তিন লাখ ৪২ হাজার অবৈধ অভিবাসী সেই সুযোগ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া তখন ৯৫ হাজার অভিবাসী তাঁদের ভিসার মেয়াদ বৈধ করিয়ে নেন।
অভিবাসীদের কথা : মানিকগঞ্জের সোহরাব হোসেন, মাদারীপুরের আয়নাল মণ্ডল, নরসিংদীর আবদুস সাত্তার ভুঁইয়াসহ আমিরাতের কয়েকজন অবৈধ অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভালো আয়-রোজগারের আশায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করে তাঁরা গিয়েছিলেন আরব আমিরাতে। কিন্তু আয়ের মুখ তো দেখেনইনি, কাজ না পেয়ে পুলিশের ভয়ে কাটছে তাঁদের সময়। গায়ের কাপড় ছাড়া আর কোনো সম্বল সঙ্গে নেই অনেকের।
সম্প্রতি আমিরাত থেকে খালি হাতে দেশে ফিরেছেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার নর কদমপুরের মো. ইউনূস। দেড় বছর আগে তিন লাখ টাকা ব্যয় করে দুবাই গিয়েছিলেন। ইউনূস কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক লাখ লাখ টাকা খরচ করে আমিরাতে গিয়ে কাজ না পেয়ে অবৈধ হয়ে পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে মাঠে-ঘাটে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।' প্রবাসীদের হিসাবে, আমিরাতের কারাগারগুলোতে আটক বিদেশিদের মধ্যে ৮০ ভাগই বাংলাদেশি।
No comments