সামাজিক মর্যাদার জন্যই প্রশাসনে পদোন্নতি! by আশরাফুল হক রাজীব
রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নয়, সামাজিক মর্যাদা রক্ষার খাতিরে কর্মকর্তাদের আবারও পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অথচ এখনই পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। প্রশাসন সূত্রই এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এমনিতেই বিভিন্ন স্তরে অনুমোদিত পদের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি থাকায় প্রশাসনে কাজের গতি ও মান কমে গেছে।
এ পরিস্থিতিতে আবারও পদোন্নতি দেওয়া হলে সরকারের কাজে স্থবিরতা আরো বাড়বে। কারণ পদোন্নতি দেওয়া কর্মকর্তাদের যথার্থ পদায়ন সম্ভব হবে না। পদোন্নতি পেলেও তাঁদের বর্তমান পদেই কাজ করতে হবে।এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয় জনস্বার্থে। পদোন্নতি দেওয়ার বিধিবিধানও করা হয়েছে একই উদ্দেশ্যে। কারো ব্যক্তিস্বার্থ বা সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য পদোন্নতি দেওয়া উচিত নয়; তাহলে প্রশাসন আরো গতিহীন হয়ে পড়বে।'
জানা গেছে, চলতি মাসেই সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভা হবে। সেখানে যোগ্য কর্মকর্তাদের খসড়া তালিকা চূড়ান্ত করে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হবে। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব ও যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে এসব পদোন্নতি হবে। তবে কোন পদে কতজন পদোন্নতি পাবেন, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ জন্য এসএসবিকে একাধিক বৈঠকে বসতে হবে। সব কিছু বিবেচনায় আগামী মাসের শেষে বা জানুয়ারিতে এই পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পদ সীমিত থাকায় এর বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে সমাজে কর্মকর্তাদের একটি অবস্থান আছে। তাঁদের মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনায় এনে পদোন্নতি দেওয়া হবে। এটা মানবিকভাবেই দেখা উচিত। কারণ যে কর্মকর্তার চাকরিজীবনের ১৫ বছরে যুগ্ম সচিব হওয়ার কথা ছিল, তিনি ২৫ বছরেও সেই অবস্থানে যেতে পারছেন না।'
সরকারের শেষ সময়ে দেওয়া এ পদোন্নতিতে ১৯৮৪, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মূলত বিবেচনায় আনা হবে। কয়েকজন কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেলেও ৮৫ ব্যাচের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই উপসচিব পদে কাজ করছেন। কয়েকজন সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবেও কাজ করছেন। এই ব্যাচের কর্মকর্তারা ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চাকরিতে যোগ দেন। তাঁদের চাকরির বয়স প্রায় ২৫ বছর। এর পরও তাঁরা যুগ্ম সচিব হতে পারেননি। যুগ্ম সচিব হচ্ছে যেকোনো মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পদ। চাকরিতে যোগদানকারী সব কর্মকর্তারই স্বপ্ন ন্যূনতম যুগ্ম সচিব হওয়া। যুগ্ম সচিব পদ মোট ৪৩০টি। অথচ ৮৫ ব্যাচেই কর্মকর্তা রয়েছেন প্রায় ৬৫০ জন। বড় ব্যাচ হওয়ায় ৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ১৯৮৫ ফোরামের সভাপতি মো. মোশারফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পদ যে নেই তা আমরা বুঝি। একসময় হয়তো এই সমস্যা থাকবে না। বড় ব্যাচ হওয়ার কারণে সরকার সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু একজন কর্মকর্তার দৃষ্টিতে দেখুন। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছি। কর্মকর্তারা যোগ্য হলে নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতি হবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ যে সময়ে একজন কর্মকর্তার সচিব হওয়ার কথা সেই সময়ে তিনি উপসচিব। পদোন্নতি না পেয়ে আমরা সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি। এটা কারো কাম্য নয়। তা ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া হলে কর্মকর্তারা যে আর্থিকভাবে খুব লাভবান হবেন তাও নয়। এরই মধ্যে তাঁরা সিনিয়র স্কেল পেয়ে গেছেন।'
তিনি আরো জানান, চাকরিজীবনের ২৫ বছরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব হতে পারলেও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কপালে তাও জোটেনি। তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই দীর্ঘ চাকরিজীবনে কোনো পদোন্নতিই পাননি। তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন তথ্য অফিসার হিসেবে। এখন হয়েছেন সিনিয়র তথ্য অফিসার। সিনিয়র হওয়াটা কোনো পদোন্নতি নয়। নির্দিষ্ট সময় পর সবারই বেতনস্কেল বাড়ে। সেই সূত্রে তাঁরা সিনিয়র তথ্য অফিসার।
বিসিএস ইনফরমেশন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এ এম মোতাহের হোসেন বলেন, 'নবম ব্যাচ চাকরিতে যোগ দিয়েছে ১৯৯১ সালে। সেই ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন সিনিয়র তথ্য অফিসার। আবার ২৪তম ব্যাচ চাকরিতে যোগ দিয়েছে ২০০৫ সালে। তাঁরাও এখন সিনিয়র তথ্য অফিসার। সামাজিক মর্যাদা আর রইল কোথায়?'
জানা গেছে, বর্তমানে প্রশাসনে পদ ও পদোন্নতি নিয়ে যে জটিলতা চলছে এর মূলে প্রশাসনের কাঠামো বিবেচনায় না এনে কর্মকর্তা নিয়োগ। ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়েছিল এরশাদ সরকারের উপজেলা প্রশাসন বাস্তবায়ন করার জন্য। এ কারণে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু এসব কর্মকর্তা ভবিষ্যতে কিভাবে পদোন্নতি পাবেন, তা আমলে নেওয়া হয়নি। এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬ ও ১৯৮৯ ব্যাচ নিয়োগ পায়। প্রতিটি ব্যাচই বড় হওয়ায় তাদের ধারণ করার মতো সক্ষমতা প্রশাসনের ছিল না। কেউ এ বিষয়ে মনোযোগীও হয়নি।
পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি হওয়ায় সচিবালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পাঁচ স্তরের প্রশাসনিক ব্যবস্থার কোনো স্তরেই এখন সঠিক সংখ্যায় কর্মকর্তা নেই। বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কোনো কর্মকর্তা নেই। এ স্তরে বর্তমানে উপসচিবরা কাজ করছেন। কোনো aকোনো মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিবরাও এ দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যেও কার্যত কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি বা ক্ষমতা বণ্টন করে নিচের পদগুলোর ক্ষমতায়ন করা হয়নি। কর্মকর্তারা যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করে আত্মমর্যাদা পান, সেই ব্যবস্থাটাই পুরোপুরি ধ্বংসের aমুখে। এ অবস্থায় শুধু কর্মকর্তাদের মর্যাদার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় একটি ব্যবস্থাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে মনে করছেন প্রশাসনসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা।
সমস্যা আরো জটিল হওয়ার নেপথ্যে বর্তমান সরকারেরও ভূমিকা আছে। বিধি অনুযায়ী ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের অবসর শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এতে করে সেই পদগুলো শূন্য হতো এবং তাতে পদোন্নতি পেতে পারতেন ১৯৮৫সহ অন্য ব্যাচের কর্মকর্তারা। কিন্তু সরকার হুট করেই অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেয়। এতে পদোন্নতি জট আরো বেড়ে গেছে।a
No comments