আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন
(পূর্ব প্রকাশের পর) এখনও পর্যন্ত ভয়ভীতি রহস্যঘেরা। তিতিক্ষার ভয়ঙ্কর পরিবেশ। চমকানো পানি, ভয়ানক সব আওয়াজ। রাত প্রায় ২টার দিকে চোখে তন্দ্রার মতো আসতেই কে একজন টোকা দিয়ে জাগিয়ে দিল। উর্দু ও বর্মী ভাষায় কিছু একটা বলল। আমি বুঝতে পারলাম না।
অবশ্য তার ইশারা-ইঙ্গিতে এটুকু বুঝলাম যে, সে পয়সা চাচ্ছে। আমি বললাম, কিছুই নেই। সে আমার ব্যাগ তল্লাশি করল। তাতে কিছুই পাওয়া গেল না। আমি আমার টাকাকড়ি আমার জাইঙ্গার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। সে নিরাশ হয়ে আমাকে লঞ্চের কিনারায় নিয়ে গেল। তাদের কথাবার্তায় আমার আন্দাজ হলো যে, তারা বলাবলি করছে যে, কি একটা মুছিবত তুলে বসিয়েছে। অপরজন বলল, একে এখানে নামিয়ে দিচ্ছি। প্রথমজন বলল, মরে যাবে। আরেকজন বলল, অন্তত আমাদের প্রাণটা তো এই মুছিবত থেকে রেহাই পাবে। এ কথা বলে সে ইচ্ছা প্রকাশ করল যে, আমাকে সাগরে ফেলে দেবে। কিন্তু যেই না সে একটু আগে বাড়ল, অপরজন বলল, খামখা একটা প্রাণ নষ্ট করছ।
এ কথা শুনে সে থেমে গেল। একটু পরেই সেহরি (শেষরাত) হয়ে গেল। এখান থেকে শহরটা জোনাকির মতো দেখা যাচ্ছিল। আমি খুশি হলাম যে, শহরে পৌঁছে গেছি। কিন্তু লঞ্চ যেই না তীরের দিকে এগিয়ে গেল কেউ টর্চের আলো তাক করল এবং তা সোজা আমার মুখের ওপর পড়ল। মাল্লারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাহাজের নিচের অংশে ঢুকিয়ে দিল। বিপদ কেটে গেল। পরে জানা গেল যে, তারা ছিল ইমিগ্রেশনের লোক।
ফজরের আজানের পরই আমি শহরে পা রাখলাম। নদীর তীরে ছিল কাদা আর কাদা। কাপড় লুটোপুটো হয়ে গিয়েছিল। মসজিদের দিকে চললাম। এ দুই জনের মধ্যে একজন আমার সঙ্গে ছিল। মসজিদে যাওয়ার পর আমি লোকটিকে ২০টি বার্মিজ টাকা দিলাম। সে তখন চলে গেল। এখন নিশ্চিন্তে কাপড়ের কাদা ছাড়িয়ে ফজরের নামাজ পড়লাম। তারপর মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গেলাম। তার নাম ছিল মাওলানা মর্তুজা আহমদ। তিনি কিছু উর্দু বুঝতেন। তিনি আমার করুণ কাহিনী শোনার পর ব্যথিত হলেন এবং তৎক্ষণাৎ আমাকে তার বাড়িতে লুকিয়ে ফেললেন। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। মংডুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুসলমান। আমরা উপযুক্ত সময়ে তার সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম। তিনি আমাদের খানা খাওয়ালেন। তারপর খুব মনোযোগ দিয়ে সমস্ত কাহিনী শুনলেন। তিনি বললেন, খুব শীঘ্র যেন ইমিগ্রেশনওয়ালাদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করি। আর যেন বলি যে, আমি এখনই লুটোপুটো অবস্থায় দেশত্যাগ করে এখানে পৌঁছেছি। তার পরামর্শ মোতাবেক ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছলাম। রিপোর্ট লেখালাম। অফিসার নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে পুনরায় আসার জন্য বললেন।
তিন টাকা সাথে ছিল। ওই টাকা নিয়ে করাচীর জমিয়ত দফতরে মরহুম তাসনীম আলম মানজারকে টেলিগ্রাম করলাম। লোকেরা বললেন যে, এরা তোমাকে গ্রেফতার করবে। পরশুদিন ওই দফতরে যাবে না।। আমরা, স্থানীয় মসুলমানারা তোমার জামিনের ব্যবস্থা করছি। এ সবই গায়েবি সাহায্য ছিল যে, ইমিগ্রেশন অফিসার আমার জামানতের ব্যবস্থা করে দিলেন। আর জামানতনামায় বর্মী ভাষায় কিছু একটা লিখলেন। আমার দ্বারাও দস্তখত করালেন। তারপর বললেন, ‘বেটা! তোমার জামিনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ প্রতিদিন এখানে এসে এই অফিসে হাজিরা দিবে। আমি একমাত্র ব্যক্তি যাকে গ্রেফতার করা হয়নি। অন্যথায় ওদিক থেকে আগত সব লোককে বন্দী করে জেলে পোরা হয়। যেভাবে বলা হলো, এখানে যে তিনটি শ্রেণী স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তন্মধ্যে সবচে সক্রিয় হচ্ছে মুসলমানরা। তারা মুসলিম মুক্তি ফৌজের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর মধ্যে রাতে কমান্ডার বললেন যে, ‘তুমি আমাদের মুক্তি ফৌজের সঙ্গে শামিল হয়ে যাও। ভরণপোষণের জন্য আমরা আমাদের পক্ষ হতে তোমাকে জমি দেব।’
এখানকার মুসলমানরা জুডো কারাতে খেলায় বেশ অভিজ্ঞ। মেয়েদেরকেও সেই ট্রেনিং দেয়া হয়। একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এখানে ছেলে কম এবং মেয়ে বেশি জন্মায়।
জুলাইয়ের শেষে আমি আকিয়াব চলে গেলাম। পৌঁছেই পাকিস্তানের কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করলাম। তারা সহযোগিতা করলেন। তার কিছুদিন পর আমি পাকিস্তান পৌঁছে গেলাম।
এখানেও কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়Ñ মসজিদের ইমাম বাঙালীদের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও ফারুকির মতো আলবদরকে সাহয্যে করেন। তবলিগকে আমরা জামাতবিরোধী মনে করলেও দেখা যায়, অন্তিমে যখন যে কোন এক পক্ষ সমর্থনের কথা বলা হয় তখন তারা আলবদরদেরই সমর্থন করে। আলবদররা পালাবার সময় মসজিদে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে।
আরাকানের রোহিঙ্গারা অধিকাংশ দেখা যাচ্ছে শুরু থেকেই আলবদরদের সমর্থক। বার্মা হয়ে যেসব আলবদর পাকিস্তান গিয়েছিলেন তাদের সবাইকে সমর্থন করেছে রোহিঙ্গারা। সেই ধারা এখনও অব্যাহত। এ কারণে দেখা যায় এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি। কারণ কালক্রমে তারা ভোটার হলে বিএনপির ভোটার হবে।
ময়মনসিংহের পরিচিত আলবদর ছিলেন নাজমুস সাকিব। ময়মনসিংহের আলবদররা পাকিস্তান বাহিনী ঠেকানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। কিন্তু তাদের কমান্ডার কর্নেল মুহাম্মদ খান তাদের ক্যাম্পে এসে বললেন পিছু হটতে হবে, তারপর বললেন তোমরা এখন ইচ্ছে হলে যেখানে খুশি যেতে পারো। অথবা ‘আমার সঙ্গে ঢাকায় যেতে পার।’
সাকিব ও তার কিছু সঙ্গী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঢাকার দিকে মার্চ শুরু করল। তারা এতই ক্ষুব্ধ ছিল যে, রাতের খাবারও কেউ খায়নি। কেউ কারও সঙ্গে কথাও বলছিন না। এরপর সাকিবের ভাষায়Ñ
“পরের দিনও আমরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। রাতের বেলা টাঙ্গাইল পৌঁছলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম যে, অপরদিক থেকেও পাক আর্মির ইউনিটসমূহ ঢাকা যাচ্ছে। এখানে এটাও জানা গেল যে, ভারতীয় বাহিনী কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়া ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঐ সময় আমাদের থেকে মাত্র পঁচিশ মাইল ব্যবধানে ছিল। এতদসত্ত্বেও সারারাত পায়ে হেঁটে সফর চলল। পরের দিন আমরা ঢাকার পার্শ্ববর্তী শহর মির্জাপুর পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে যানবাহন পাওয়া গেল এবং আমরা ঢাকা ছাউনির আলবদর ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। ১৬ ডিসেম্বর জানা গেল যে, অস্ত্র সমর্পণ করা হচ্ছে। আমাদের সকল সাথী দুঃখ-দুশ্চিন্তায় ডুকরে কাঁদতে লাগল। এই ফাঁকে আর্মি অফিসার বললেন যে, ‘আপনারাও আমাদের সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণ করুন।’ কিন্তু আমরা অস্বীকার করলাম। ইসলামী জমিয়তে তালাবার পূর্ব পাকিস্তানের নাজেম উর্ধতন অফিসারদের বললেন, ‘আমরা ইসলামী আদর্শের জীবন-ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য অর্জিত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। এখন আমাদের ক্ষতাসীনদের গাদ্দারির কারণে এ ভুখ- দুশমনের হাতে চলে যাচ্ছে। আমরা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করব, যাতে এই ট্র্যাজেডি দেখতে না হয়। আপনারা গেরিলাযুদ্ধের জন্য আত্মগোপন করুন।’ আর্মির পক্ষ হতে জবাব এলো, ‘আমরা ডিসিপ্লিনের অনুগত।’ এরপর আমাদের ক্যাম্প থেকে সকল আলবদর একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে অজানা পথে রওনা হয়ে গেল। আমি ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ছিলাম। তারপর মোটর লঞ্চযোগে ফরিদপুর এসে গেলাম। ওখান থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে দিনাজপুর চলে গেলাম। আবার ১০ ফেব্রুয়ারি পায়ে হেঁটে ভারত সীমান্ত পার হলাম। চার মাস ভারতে কাটালাম। সেখান থেকে নেপাল চলে গেলাম। কাঠমন্ডুতে আমাদের আরও সাথী হিজরত করে চলে এসেছিল।
আমি নয় মাস পর্যন্ত টুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য বিনিময় নিতাম। আমরা আমদের বেতনগুলো যৌথভাবে ব্যয় করতাম। এরপর ভারত হয়ে রাজস্থান বর্ডার দিয়ে পাকিস্তান প্রবেশ করলাম।
সবশেষে চিফ জল্লাদ আশরাফুজ্জামানের বক্তব্য শোনা যাক। তার বর্ণনায় নিজের ওপর তিনি দৈব ছায়ার বর্ণনা করেছেন। খুনীদের ওপরও দৈব ছায়া বিস্তার করে এ ঘটনা খুব বিরল।
আশরাফ ছিলেন ঢাকার সালাউদ্দিন কোম্পানির কমান্ডার। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গ্রেফতার করেছিল। দুর্ভাগ্য, তাদের শৈথিল্যের কারণে আশরাফুজ্জামান পালিয়ে যান। তার ভাষায় গায়েবি নির্দেশ পেয়ে, যা একটা ভাঁওতাবাজি।
আশরাফ খালেদকে জানিয়েছেন, তার ৫০-৬০ আত্মীস্বজন ছিলেন। কিন্তু কারও সঙ্গে জানাশোনা ছিল না। হয়ত এ কারণে যে সবাই তাকে আলবদরের প্রধান জল্লাদ হিসেবে জানত। তার ভাষায়, “ইউনিভার্সির ব্যাপার ছিল কাছাকাছি, প্রত্যেক মানুষ জানত যে, এ হচ্ছে আলবদরের লোক। ঢাকার পতনের পর সাথীরা যাচ্ছিল এবং এমনভাবে দেখা সাক্ষাত করছিল যে, জীবনে তাদের সাথে আর দেখা হবে না। চোখে অশ্রুবন্যা নিয়ে গলায় গলায় জড়িয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। ওই অবস্থায় আনোয়ারুল হক, আব্দুল্লাহ ও আব্দুস সামাদ জানলো তাদের মা-বাবা ইন্তেকাল করেছিলেন। আত্মীয়রা বিরোধী মতাদর্শের কারণে রক্তের পিপাসু ছিল। তারা বলতে লাগল, ‘আশরাফ! আমরা কোথায় যাব, কোন ঠিকানা তো দেখছি না।’
আমি জবাব দিলাম, ‘ভাই, যদি কেউ উপযুক্ত হতো তাহলে অবশ্যই তোমাদের আশ্রয় দিত। কিন্তু আমি তো তোমাদের সাথী। এমন জাহাজের আরোহী, যার মাল্লাদের কাছে পাল নাই।’ এই জবাব শুনে আমার দুঃসাহসী ও প্রাণোৎসর্গী সঙ্গী এ কথা বলে চলে গেল, ‘আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করব অথবা শহীদ হয়ে যাব। খোদা হাফেজ।’ ওই তিন সাথী চলে গেল। এরপর তারা কোথায় সেটা আর জানা যায়নি।
ওই রাতে আমরা ইংশিল রোডে আন্দোলনের সাথীর বাড়িতে ছিলাম। পরের দিন সকালে নাস্তা সারার পর আমাদের সাথী আসাদের সঙ্গে অন্য কোন ঠিকানা তালাশের জন্য বের হলাম। ছয় সাত মাইল দূরে অপর এক বন্ধুর ওখানে থাকার ব্যবস্থা হলো।
আমরা আমাদের মালপত্র ফেরত নেয়ার জন্য অফিসে গেলাম। কিন্তু যে লোকের কাছে স্যুটকেস রেখে এসেছিলাম সে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করল। শুধু তাই নয়, সে মুক্তি বাহিনীর লোকদের ডেকে নিয়ে এলো। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ হলো। আমরা বললাম যে, ‘আমরা ছাত্র।’ তারা প্রশ্ন করল, ‘আলবদর?’
আমরা হ্যাঁ না জবাব দেয়ার পরিবর্তে বললাম, ‘মুসাফির।’ তারা আসাদকে দু’একটি থাপ্পড় মারল। আর তার কাছ থেকে দুইশ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষান্ত হলো।
তারপর মুক্তি বাহিনীর আরেক গ্রুপ এল। তাদের মধ্যে একজন বলল যে, ‘আমি এই দুইজনকে আলবদরের ক্যাম্পের কাছে দেখেছিলাম।’
জেনারেল ফরমান আলীর দেয়া আমার পরিচয়পত্র তাদের তল্লাশিতে পাওয়া গেল। তাতে সন্দেহ আরও বেশি হলো। তারা আমাদের আলবদরের একটি ক্যাম্পে নিয়ে গেল। কিন্তু ওখানে আমাদের বন্ধুরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করল। কিন্তু তারা আমাদের ছাড়ল না। আমাদের গাড়িতে বসিয়ে শহরে চক্কর লাগানো হলো। রাস্তায় রাস্তায় তারা লোকদেরকে গর্বের সাথে বলতে লাগল যে, ‘এরা হচ্ছে আলবদর কমান্ডার। আমরা তাদের পাকড়াও করেছি।’ আসরের সময় আমাকে ফকিরাপুলে নিয়ে গেল। সেখানে আসাদকে মারধর করে অন্যত্র নিয়ে গেল। আমি একা রয়ে গেলাম। তারপর আমাকে টর্চার করা হলো, মারপিট করা হলো।
এর আগে আমাকে কোন টর্চার করা হয়নি। টর্চারের পর রেলওয়ে লাইনের নিকটে একটি ঘিঞ্জি এলাকায় যেখানে তাদের আড্ডা ছিল, সেখানে আমাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে গেল। ওখানে আমাকে একজন জল্লাদের সামনে দাঁড় করানো হলো। আর তথ্য উদ্ধারের জন্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসা শুরু করল।
আমি গোপন কোন তথ্য প্রকাশ করিনি। জল্লাদ রাশিয়ান রাইফেল দিয়ে আমাকে টার্গেট করার জন্য মোশন নিতে থাকে। দৃশ্যত মৃত্যু আর আমার মাঝখানে কয়েকটি মুহূর্তের ব্যবধান ছিল। কিন্তু আল্লাহ্র দয়া বিস্মকরভাবে আমার দিকে হাত বাড়াল। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি, যাকে তারা হক সাহেব বলে ডাকত, আমার কাঁধ ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কী বিয়ে হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। জিজ্ঞেসা করল, ‘বাচ্চা কয়টা?’ আমি জবাব দিলাম, ‘একটি মেয়ে।’ এ কথা বলতেই তিনি জল্লাদকে বললেন, ‘ওকে মেরো না।’
তাদের এক সঙ্গী একা টাকার মালিক হতে চেয়েছিল। তার সঙ্গীরা টাকার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমি তখন বললাম যে, ওই ব্যক্তি টাকা নিয়েছিল এবং অমুক জায়গায় ইটের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। এ কথার ওপর তাদের মধ্যে বেশ ঝগড়া হলো। তারা আমাকে গালি দিতে থাকে যে, সে নিজে মরবে, আমাদেরও মারবে। অস্বীকারকারী ব্যক্তিকে তারা খুব পেটাল। শেষ পর্যন্ত সে স্বীকার করল যে, টাকা সেই নিয়েছিল। এই ফাঁকে আমার ডায়েরি থেকে বাংলা ও ইংরেজী লেখা পড়ে নেয়া হয় যার মধ্যে পাকিস্তানপন্থী ও গাদ্দারখ্যাত লোকদের তালিকা ছিল। স্যুটকেসে স্টেনগানের গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আলোচনাও ছিল।
এসব কথা তাদের জন্য ভূমিকম্পের চাইতেও কম ছিল না। তারা সেøাগান বানাল যে, আমাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। আবার শেষ রাতে ওই স্থানটি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। যে হক সাহেব আমাকে বাঁচিয়েছিলেন, তিনি নিজেই তখন বলছিলেন যে, ‘একে মেরে ফেলা উচিত।’ এই কথাগুলো পাশের কামরায় হচ্ছিল। আর আমি চিন্তা করছিলাম যে, মরতে তো হবেই। দু’চার জনকে খতম করে মরাই উত্তম হবে। আমি কারো কাছ থেকে স্টেনগান ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা মনে মনে তৈরি করলাম, ভয়ভীতি আসলেই ছিল না। তারপর আর একটি কথা মনে এল যে, ঢাকায় আলবদরের তিনজন কোম্পানি কমান্ডারের মধ্যে দু’জন শহীদ হয়ে গেছেন। হয়ত [আমি] তৃতীয় জনের কপালেও শাহাদৎ লেখা হয়ে আছে। এই চিন্তায় মন একেবারে চিন্তামুক্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর জমিয়তের আরেকজন সাথীকে উপর্যুপরি কিল, ঘুষি ও গালিগালাজের তুফানের মধ্যে আমার কামরায় নিয়ে আসা হলো। এটি ১৮ ডিসেম্বরের কথা। ওই সময় না আমার চোখ বন্ধ রাখা হয়েছিল, না আমার হাত। এ কারণে আমি কারও কাছ থেকে স্টেনগান ছিনিয়ে নেয়ার জন্য উঠলাম। তখন পাহারাদার বলল, ‘পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছ! সাথে সাথে অন্যদের ডেকে আমার ও আমার সাথীর হাত ও চোখ বেঁধে দেয়া হয়। আমি ওই অবস্থাতেই এশার নামাজ পড়লাম। আমার হাত পেছন দিকে ছিল এবং তারা আমাকে মেরে ফেলার জন্য উতলা হয়ে রয়েছিল। ওই কথার ওপর তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত হক বলল, ‘ওকে যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তবে এখন কিছু করো না। তার কাছ থেকে মূল্যবান তথ্য উদ্ধার করে নাও। তারপর তাকে শেষ করে দাও।’ হক থাকত ফকিরাপুল। সে আমার চোখের উপর পর্যন্ত বাঁধল। কারে বসাল আর বাড়ির চাকর বাকরের মাঝ দিয়ে আমাকে উপরের বাড়িতে নিয়ে গেল।
এ পর্যন্ত তো মুক্তিবাহিনীর তরুণদের পাল্লায় পড়েছিলাম। এখন হকের ঘরে বয়সের দিক দিয়ে পরিপক্ব লোকদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। যারা জালেম ছিল, অভিজ্ঞতাসম্পন্নও ছিল।
আমাকে শক্ত করে পিছমোড়া বাঁধা হয়েছিল। বলা হলো যে, ‘প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব ঠিক ঠিক বলবে। না হলে তুমি দেখছ যে, পরে কি অবস্থা হয়ে যাবে।’
আমার কাছে অস্ত্র, টাকাকড়ি, অলঙ্কার প্রভৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু আমি সঠিকভাবে তাদের কিছু বলিনি।
তারা বলতে লাগল, ‘সঠিক বল। বাহু কেটে ফেলব। চোখ খুলে ফেলব।’ কিন্তু যখন এই ধমকও কাজে এল না তখন তারা আমাকে চিত করে শুইয়ে দিল। পাঁচ ছয় জন লোক আমার হাত-পা শক্ত করে ধরল আর এক ব্যক্তি চট করে আমার বুকের ওপর বসে পড়ল। আর আমার এক চোখের উপরে সজোরে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিল। আমি যদি জোরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ধাক্কা না দিতাম তাহলে সেই জালেম অবশ্যই আমার চোখ বের করে ফেলত। যখন সে আমার বাধার কারণে দূরে ছিটকে পড়ল তখন এ কথা বলে আমাকে ছেড়ে দিল যে, ‘কমবখতের ভীষণ শক্তি, একে আজকে নয় কালকে মারব।’
পরের দিন অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর আমাকে নাস্তা দিল আর বলল যে, ‘খেয়ে দেয়ে মর।’ এরপর আমাকে শহরে ঘোরাল। লোকদেরকে বলল যে, ‘এ হচ্ছে আলবদরের কমান্ডার। আমরা একে গ্রেফতার করেছি।’ চক্কর দেয়ার পর আমাকে পুনরায় ওখানে নিয়ে আসে। আমাকে বলতে লাগল যে, ‘অস্ত্র ভা-ার যদি দেখিয়ে দাও তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিব।’ (চলবে)
এ কথা শুনে সে থেমে গেল। একটু পরেই সেহরি (শেষরাত) হয়ে গেল। এখান থেকে শহরটা জোনাকির মতো দেখা যাচ্ছিল। আমি খুশি হলাম যে, শহরে পৌঁছে গেছি। কিন্তু লঞ্চ যেই না তীরের দিকে এগিয়ে গেল কেউ টর্চের আলো তাক করল এবং তা সোজা আমার মুখের ওপর পড়ল। মাল্লারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাহাজের নিচের অংশে ঢুকিয়ে দিল। বিপদ কেটে গেল। পরে জানা গেল যে, তারা ছিল ইমিগ্রেশনের লোক।
ফজরের আজানের পরই আমি শহরে পা রাখলাম। নদীর তীরে ছিল কাদা আর কাদা। কাপড় লুটোপুটো হয়ে গিয়েছিল। মসজিদের দিকে চললাম। এ দুই জনের মধ্যে একজন আমার সঙ্গে ছিল। মসজিদে যাওয়ার পর আমি লোকটিকে ২০টি বার্মিজ টাকা দিলাম। সে তখন চলে গেল। এখন নিশ্চিন্তে কাপড়ের কাদা ছাড়িয়ে ফজরের নামাজ পড়লাম। তারপর মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গেলাম। তার নাম ছিল মাওলানা মর্তুজা আহমদ। তিনি কিছু উর্দু বুঝতেন। তিনি আমার করুণ কাহিনী শোনার পর ব্যথিত হলেন এবং তৎক্ষণাৎ আমাকে তার বাড়িতে লুকিয়ে ফেললেন। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। মংডুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুসলমান। আমরা উপযুক্ত সময়ে তার সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম। তিনি আমাদের খানা খাওয়ালেন। তারপর খুব মনোযোগ দিয়ে সমস্ত কাহিনী শুনলেন। তিনি বললেন, খুব শীঘ্র যেন ইমিগ্রেশনওয়ালাদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করি। আর যেন বলি যে, আমি এখনই লুটোপুটো অবস্থায় দেশত্যাগ করে এখানে পৌঁছেছি। তার পরামর্শ মোতাবেক ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছলাম। রিপোর্ট লেখালাম। অফিসার নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে পুনরায় আসার জন্য বললেন।
তিন টাকা সাথে ছিল। ওই টাকা নিয়ে করাচীর জমিয়ত দফতরে মরহুম তাসনীম আলম মানজারকে টেলিগ্রাম করলাম। লোকেরা বললেন যে, এরা তোমাকে গ্রেফতার করবে। পরশুদিন ওই দফতরে যাবে না।। আমরা, স্থানীয় মসুলমানারা তোমার জামিনের ব্যবস্থা করছি। এ সবই গায়েবি সাহায্য ছিল যে, ইমিগ্রেশন অফিসার আমার জামানতের ব্যবস্থা করে দিলেন। আর জামানতনামায় বর্মী ভাষায় কিছু একটা লিখলেন। আমার দ্বারাও দস্তখত করালেন। তারপর বললেন, ‘বেটা! তোমার জামিনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ প্রতিদিন এখানে এসে এই অফিসে হাজিরা দিবে। আমি একমাত্র ব্যক্তি যাকে গ্রেফতার করা হয়নি। অন্যথায় ওদিক থেকে আগত সব লোককে বন্দী করে জেলে পোরা হয়। যেভাবে বলা হলো, এখানে যে তিনটি শ্রেণী স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তন্মধ্যে সবচে সক্রিয় হচ্ছে মুসলমানরা। তারা মুসলিম মুক্তি ফৌজের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর মধ্যে রাতে কমান্ডার বললেন যে, ‘তুমি আমাদের মুক্তি ফৌজের সঙ্গে শামিল হয়ে যাও। ভরণপোষণের জন্য আমরা আমাদের পক্ষ হতে তোমাকে জমি দেব।’
এখানকার মুসলমানরা জুডো কারাতে খেলায় বেশ অভিজ্ঞ। মেয়েদেরকেও সেই ট্রেনিং দেয়া হয়। একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এখানে ছেলে কম এবং মেয়ে বেশি জন্মায়।
জুলাইয়ের শেষে আমি আকিয়াব চলে গেলাম। পৌঁছেই পাকিস্তানের কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করলাম। তারা সহযোগিতা করলেন। তার কিছুদিন পর আমি পাকিস্তান পৌঁছে গেলাম।
এখানেও কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়Ñ মসজিদের ইমাম বাঙালীদের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও ফারুকির মতো আলবদরকে সাহয্যে করেন। তবলিগকে আমরা জামাতবিরোধী মনে করলেও দেখা যায়, অন্তিমে যখন যে কোন এক পক্ষ সমর্থনের কথা বলা হয় তখন তারা আলবদরদেরই সমর্থন করে। আলবদররা পালাবার সময় মসজিদে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে।
আরাকানের রোহিঙ্গারা অধিকাংশ দেখা যাচ্ছে শুরু থেকেই আলবদরদের সমর্থক। বার্মা হয়ে যেসব আলবদর পাকিস্তান গিয়েছিলেন তাদের সবাইকে সমর্থন করেছে রোহিঙ্গারা। সেই ধারা এখনও অব্যাহত। এ কারণে দেখা যায় এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি। কারণ কালক্রমে তারা ভোটার হলে বিএনপির ভোটার হবে।
ময়মনসিংহের পরিচিত আলবদর ছিলেন নাজমুস সাকিব। ময়মনসিংহের আলবদররা পাকিস্তান বাহিনী ঠেকানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। কিন্তু তাদের কমান্ডার কর্নেল মুহাম্মদ খান তাদের ক্যাম্পে এসে বললেন পিছু হটতে হবে, তারপর বললেন তোমরা এখন ইচ্ছে হলে যেখানে খুশি যেতে পারো। অথবা ‘আমার সঙ্গে ঢাকায় যেতে পার।’
সাকিব ও তার কিছু সঙ্গী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঢাকার দিকে মার্চ শুরু করল। তারা এতই ক্ষুব্ধ ছিল যে, রাতের খাবারও কেউ খায়নি। কেউ কারও সঙ্গে কথাও বলছিন না। এরপর সাকিবের ভাষায়Ñ
“পরের দিনও আমরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। রাতের বেলা টাঙ্গাইল পৌঁছলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম যে, অপরদিক থেকেও পাক আর্মির ইউনিটসমূহ ঢাকা যাচ্ছে। এখানে এটাও জানা গেল যে, ভারতীয় বাহিনী কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়া ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঐ সময় আমাদের থেকে মাত্র পঁচিশ মাইল ব্যবধানে ছিল। এতদসত্ত্বেও সারারাত পায়ে হেঁটে সফর চলল। পরের দিন আমরা ঢাকার পার্শ্ববর্তী শহর মির্জাপুর পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে যানবাহন পাওয়া গেল এবং আমরা ঢাকা ছাউনির আলবদর ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। ১৬ ডিসেম্বর জানা গেল যে, অস্ত্র সমর্পণ করা হচ্ছে। আমাদের সকল সাথী দুঃখ-দুশ্চিন্তায় ডুকরে কাঁদতে লাগল। এই ফাঁকে আর্মি অফিসার বললেন যে, ‘আপনারাও আমাদের সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণ করুন।’ কিন্তু আমরা অস্বীকার করলাম। ইসলামী জমিয়তে তালাবার পূর্ব পাকিস্তানের নাজেম উর্ধতন অফিসারদের বললেন, ‘আমরা ইসলামী আদর্শের জীবন-ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য অর্জিত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। এখন আমাদের ক্ষতাসীনদের গাদ্দারির কারণে এ ভুখ- দুশমনের হাতে চলে যাচ্ছে। আমরা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করব, যাতে এই ট্র্যাজেডি দেখতে না হয়। আপনারা গেরিলাযুদ্ধের জন্য আত্মগোপন করুন।’ আর্মির পক্ষ হতে জবাব এলো, ‘আমরা ডিসিপ্লিনের অনুগত।’ এরপর আমাদের ক্যাম্প থেকে সকল আলবদর একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে অজানা পথে রওনা হয়ে গেল। আমি ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ছিলাম। তারপর মোটর লঞ্চযোগে ফরিদপুর এসে গেলাম। ওখান থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে দিনাজপুর চলে গেলাম। আবার ১০ ফেব্রুয়ারি পায়ে হেঁটে ভারত সীমান্ত পার হলাম। চার মাস ভারতে কাটালাম। সেখান থেকে নেপাল চলে গেলাম। কাঠমন্ডুতে আমাদের আরও সাথী হিজরত করে চলে এসেছিল।
আমি নয় মাস পর্যন্ত টুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য বিনিময় নিতাম। আমরা আমদের বেতনগুলো যৌথভাবে ব্যয় করতাম। এরপর ভারত হয়ে রাজস্থান বর্ডার দিয়ে পাকিস্তান প্রবেশ করলাম।
সবশেষে চিফ জল্লাদ আশরাফুজ্জামানের বক্তব্য শোনা যাক। তার বর্ণনায় নিজের ওপর তিনি দৈব ছায়ার বর্ণনা করেছেন। খুনীদের ওপরও দৈব ছায়া বিস্তার করে এ ঘটনা খুব বিরল।
আশরাফ ছিলেন ঢাকার সালাউদ্দিন কোম্পানির কমান্ডার। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গ্রেফতার করেছিল। দুর্ভাগ্য, তাদের শৈথিল্যের কারণে আশরাফুজ্জামান পালিয়ে যান। তার ভাষায় গায়েবি নির্দেশ পেয়ে, যা একটা ভাঁওতাবাজি।
আশরাফ খালেদকে জানিয়েছেন, তার ৫০-৬০ আত্মীস্বজন ছিলেন। কিন্তু কারও সঙ্গে জানাশোনা ছিল না। হয়ত এ কারণে যে সবাই তাকে আলবদরের প্রধান জল্লাদ হিসেবে জানত। তার ভাষায়, “ইউনিভার্সির ব্যাপার ছিল কাছাকাছি, প্রত্যেক মানুষ জানত যে, এ হচ্ছে আলবদরের লোক। ঢাকার পতনের পর সাথীরা যাচ্ছিল এবং এমনভাবে দেখা সাক্ষাত করছিল যে, জীবনে তাদের সাথে আর দেখা হবে না। চোখে অশ্রুবন্যা নিয়ে গলায় গলায় জড়িয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। ওই অবস্থায় আনোয়ারুল হক, আব্দুল্লাহ ও আব্দুস সামাদ জানলো তাদের মা-বাবা ইন্তেকাল করেছিলেন। আত্মীয়রা বিরোধী মতাদর্শের কারণে রক্তের পিপাসু ছিল। তারা বলতে লাগল, ‘আশরাফ! আমরা কোথায় যাব, কোন ঠিকানা তো দেখছি না।’
আমি জবাব দিলাম, ‘ভাই, যদি কেউ উপযুক্ত হতো তাহলে অবশ্যই তোমাদের আশ্রয় দিত। কিন্তু আমি তো তোমাদের সাথী। এমন জাহাজের আরোহী, যার মাল্লাদের কাছে পাল নাই।’ এই জবাব শুনে আমার দুঃসাহসী ও প্রাণোৎসর্গী সঙ্গী এ কথা বলে চলে গেল, ‘আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করব অথবা শহীদ হয়ে যাব। খোদা হাফেজ।’ ওই তিন সাথী চলে গেল। এরপর তারা কোথায় সেটা আর জানা যায়নি।
ওই রাতে আমরা ইংশিল রোডে আন্দোলনের সাথীর বাড়িতে ছিলাম। পরের দিন সকালে নাস্তা সারার পর আমাদের সাথী আসাদের সঙ্গে অন্য কোন ঠিকানা তালাশের জন্য বের হলাম। ছয় সাত মাইল দূরে অপর এক বন্ধুর ওখানে থাকার ব্যবস্থা হলো।
আমরা আমাদের মালপত্র ফেরত নেয়ার জন্য অফিসে গেলাম। কিন্তু যে লোকের কাছে স্যুটকেস রেখে এসেছিলাম সে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করল। শুধু তাই নয়, সে মুক্তি বাহিনীর লোকদের ডেকে নিয়ে এলো। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ হলো। আমরা বললাম যে, ‘আমরা ছাত্র।’ তারা প্রশ্ন করল, ‘আলবদর?’
আমরা হ্যাঁ না জবাব দেয়ার পরিবর্তে বললাম, ‘মুসাফির।’ তারা আসাদকে দু’একটি থাপ্পড় মারল। আর তার কাছ থেকে দুইশ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষান্ত হলো।
তারপর মুক্তি বাহিনীর আরেক গ্রুপ এল। তাদের মধ্যে একজন বলল যে, ‘আমি এই দুইজনকে আলবদরের ক্যাম্পের কাছে দেখেছিলাম।’
জেনারেল ফরমান আলীর দেয়া আমার পরিচয়পত্র তাদের তল্লাশিতে পাওয়া গেল। তাতে সন্দেহ আরও বেশি হলো। তারা আমাদের আলবদরের একটি ক্যাম্পে নিয়ে গেল। কিন্তু ওখানে আমাদের বন্ধুরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করল। কিন্তু তারা আমাদের ছাড়ল না। আমাদের গাড়িতে বসিয়ে শহরে চক্কর লাগানো হলো। রাস্তায় রাস্তায় তারা লোকদেরকে গর্বের সাথে বলতে লাগল যে, ‘এরা হচ্ছে আলবদর কমান্ডার। আমরা তাদের পাকড়াও করেছি।’ আসরের সময় আমাকে ফকিরাপুলে নিয়ে গেল। সেখানে আসাদকে মারধর করে অন্যত্র নিয়ে গেল। আমি একা রয়ে গেলাম। তারপর আমাকে টর্চার করা হলো, মারপিট করা হলো।
এর আগে আমাকে কোন টর্চার করা হয়নি। টর্চারের পর রেলওয়ে লাইনের নিকটে একটি ঘিঞ্জি এলাকায় যেখানে তাদের আড্ডা ছিল, সেখানে আমাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে গেল। ওখানে আমাকে একজন জল্লাদের সামনে দাঁড় করানো হলো। আর তথ্য উদ্ধারের জন্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসা শুরু করল।
আমি গোপন কোন তথ্য প্রকাশ করিনি। জল্লাদ রাশিয়ান রাইফেল দিয়ে আমাকে টার্গেট করার জন্য মোশন নিতে থাকে। দৃশ্যত মৃত্যু আর আমার মাঝখানে কয়েকটি মুহূর্তের ব্যবধান ছিল। কিন্তু আল্লাহ্র দয়া বিস্মকরভাবে আমার দিকে হাত বাড়াল। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি, যাকে তারা হক সাহেব বলে ডাকত, আমার কাঁধ ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কী বিয়ে হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। জিজ্ঞেসা করল, ‘বাচ্চা কয়টা?’ আমি জবাব দিলাম, ‘একটি মেয়ে।’ এ কথা বলতেই তিনি জল্লাদকে বললেন, ‘ওকে মেরো না।’
তাদের এক সঙ্গী একা টাকার মালিক হতে চেয়েছিল। তার সঙ্গীরা টাকার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমি তখন বললাম যে, ওই ব্যক্তি টাকা নিয়েছিল এবং অমুক জায়গায় ইটের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। এ কথার ওপর তাদের মধ্যে বেশ ঝগড়া হলো। তারা আমাকে গালি দিতে থাকে যে, সে নিজে মরবে, আমাদেরও মারবে। অস্বীকারকারী ব্যক্তিকে তারা খুব পেটাল। শেষ পর্যন্ত সে স্বীকার করল যে, টাকা সেই নিয়েছিল। এই ফাঁকে আমার ডায়েরি থেকে বাংলা ও ইংরেজী লেখা পড়ে নেয়া হয় যার মধ্যে পাকিস্তানপন্থী ও গাদ্দারখ্যাত লোকদের তালিকা ছিল। স্যুটকেসে স্টেনগানের গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আলোচনাও ছিল।
এসব কথা তাদের জন্য ভূমিকম্পের চাইতেও কম ছিল না। তারা সেøাগান বানাল যে, আমাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। আবার শেষ রাতে ওই স্থানটি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। যে হক সাহেব আমাকে বাঁচিয়েছিলেন, তিনি নিজেই তখন বলছিলেন যে, ‘একে মেরে ফেলা উচিত।’ এই কথাগুলো পাশের কামরায় হচ্ছিল। আর আমি চিন্তা করছিলাম যে, মরতে তো হবেই। দু’চার জনকে খতম করে মরাই উত্তম হবে। আমি কারো কাছ থেকে স্টেনগান ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা মনে মনে তৈরি করলাম, ভয়ভীতি আসলেই ছিল না। তারপর আর একটি কথা মনে এল যে, ঢাকায় আলবদরের তিনজন কোম্পানি কমান্ডারের মধ্যে দু’জন শহীদ হয়ে গেছেন। হয়ত [আমি] তৃতীয় জনের কপালেও শাহাদৎ লেখা হয়ে আছে। এই চিন্তায় মন একেবারে চিন্তামুক্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর জমিয়তের আরেকজন সাথীকে উপর্যুপরি কিল, ঘুষি ও গালিগালাজের তুফানের মধ্যে আমার কামরায় নিয়ে আসা হলো। এটি ১৮ ডিসেম্বরের কথা। ওই সময় না আমার চোখ বন্ধ রাখা হয়েছিল, না আমার হাত। এ কারণে আমি কারও কাছ থেকে স্টেনগান ছিনিয়ে নেয়ার জন্য উঠলাম। তখন পাহারাদার বলল, ‘পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছ! সাথে সাথে অন্যদের ডেকে আমার ও আমার সাথীর হাত ও চোখ বেঁধে দেয়া হয়। আমি ওই অবস্থাতেই এশার নামাজ পড়লাম। আমার হাত পেছন দিকে ছিল এবং তারা আমাকে মেরে ফেলার জন্য উতলা হয়ে রয়েছিল। ওই কথার ওপর তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত হক বলল, ‘ওকে যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তবে এখন কিছু করো না। তার কাছ থেকে মূল্যবান তথ্য উদ্ধার করে নাও। তারপর তাকে শেষ করে দাও।’ হক থাকত ফকিরাপুল। সে আমার চোখের উপর পর্যন্ত বাঁধল। কারে বসাল আর বাড়ির চাকর বাকরের মাঝ দিয়ে আমাকে উপরের বাড়িতে নিয়ে গেল।
এ পর্যন্ত তো মুক্তিবাহিনীর তরুণদের পাল্লায় পড়েছিলাম। এখন হকের ঘরে বয়সের দিক দিয়ে পরিপক্ব লোকদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। যারা জালেম ছিল, অভিজ্ঞতাসম্পন্নও ছিল।
আমাকে শক্ত করে পিছমোড়া বাঁধা হয়েছিল। বলা হলো যে, ‘প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব ঠিক ঠিক বলবে। না হলে তুমি দেখছ যে, পরে কি অবস্থা হয়ে যাবে।’
আমার কাছে অস্ত্র, টাকাকড়ি, অলঙ্কার প্রভৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু আমি সঠিকভাবে তাদের কিছু বলিনি।
তারা বলতে লাগল, ‘সঠিক বল। বাহু কেটে ফেলব। চোখ খুলে ফেলব।’ কিন্তু যখন এই ধমকও কাজে এল না তখন তারা আমাকে চিত করে শুইয়ে দিল। পাঁচ ছয় জন লোক আমার হাত-পা শক্ত করে ধরল আর এক ব্যক্তি চট করে আমার বুকের ওপর বসে পড়ল। আর আমার এক চোখের উপরে সজোরে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিল। আমি যদি জোরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ধাক্কা না দিতাম তাহলে সেই জালেম অবশ্যই আমার চোখ বের করে ফেলত। যখন সে আমার বাধার কারণে দূরে ছিটকে পড়ল তখন এ কথা বলে আমাকে ছেড়ে দিল যে, ‘কমবখতের ভীষণ শক্তি, একে আজকে নয় কালকে মারব।’
পরের দিন অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর আমাকে নাস্তা দিল আর বলল যে, ‘খেয়ে দেয়ে মর।’ এরপর আমাকে শহরে ঘোরাল। লোকদেরকে বলল যে, ‘এ হচ্ছে আলবদরের কমান্ডার। আমরা একে গ্রেফতার করেছি।’ চক্কর দেয়ার পর আমাকে পুনরায় ওখানে নিয়ে আসে। আমাকে বলতে লাগল যে, ‘অস্ত্র ভা-ার যদি দেখিয়ে দাও তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিব।’ (চলবে)
No comments