সমকালীন প্রসঙ্গ-সাম্রাজ্যবাদ ও তালেবানদের বর্বর হামলার মুখে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের জনগণ by বদরুদ্দীন উমর
মালালা ইউসুফজাই মাত্র ১৪ বছরের এক স্কুলছাত্রী সোয়াতে তালেবানদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, মালালা তার স্কুল সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাসের মধ্যে এক তালেবান সন্ত্রাসী দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়।
এত অল্প বয়স্ক একটি মেয়ের বিরুদ্ধে তালেবানদের এই আক্রোশের কারণ সে তাদের নারী শিক্ষাবিরোধী কঠোর নীতির একজন কড়া বিরোধী ছিল এবং তিন বছর আগে থেকে অর্থাৎ মাত্র ১১ বছর বয়স থেকেই সে এই বিরোধিতার বিষয়ে সোচ্চার ছিল! মালালার এই সাহসী বিরোধিতা শুধু পাকিস্তানে নয়, পাকিস্তানের বাইরেও প্রচার লাভ করে তালেবানদের জন্য অসুবিধার কারণ হয়েছিল। কাজেই তালেবানদের চরম পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা নীতি ও নারীবিদ্বেষের বিষয় দুনিয়ার সামনে নতুন করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মালালার প্রতিরোধ তাদের জন্য উপেক্ষার ব্যাপার ছিল না। শুধু তাই নয়, মালালার এই প্রতিরোধ তাদের অসহিষ্ণু করেছিল। এই অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়েই তারা মালালাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পাকিস্তানে তালেবানদের এই সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং উৎপাত আফগানিস্তানে তালেবানদের তৎপরতা ও উৎপাতের তুলনায় এক সাম্প্রতিক ব্যাপার। আফগানিস্তানে বামপন্থি সরকারের পতনের পর তালেবানরা ক্ষমতায় আসে। পশ্চাৎপদ আফগান জনগণের মধ্যে বামপন্থি সরকারকে নাস্তিক বলে প্রচার করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের কিছু ভ্রান্তনীতিও তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছিল। কিন্তু সেখানে বামপন্থি সরকারের পতনের মূল কারণ ছিল আফগানিস্তানের চরম ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তিগুলোকে অর্থ, অস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে মার্কিনসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্য-সহযোগিতা। শুধু অর্থ এবং অস্ত্রই নয়, তাদের সামরিক ট্রেনিং, পরামর্শ ইত্যাদির মাধ্যমেও তারা শক্তিশালী করেছিল। বামপন্থি সরকারের পতনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রীর সম্পর্ক, যে সম্পর্কের কারণে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য পেত। এই সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এ কারণে আফগান জনগণ তাদের এক প্রকার দখলদার হিসেবে গণ্য করে দেশকে এই দখলদারমুক্ত করতে যুদ্ধে নামে। এই যুদ্ধ যারা সংগঠিত ও পরিচালনা করে তারা ছিল চরম ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল। বামপন্থি সরকারের পতনের পর তারাই ক্ষমতাসীন হয়। এই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যেই একটি সংগঠিত দল হিসেবে তালেবানদের উদ্ভব ঘটে এবং পরে তারা মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে। এই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা দেশ থেকে সোভিয়েত দখলদার ও তাদের ওপর নির্ভরশীল বামপন্থি সরকারকে হটিয়ে দিলেও আফগানিস্তানে কায়েম করে এক সামাজিক বর্বরতার শাসন। এই শাসনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল নারীদের ওপর চরম নির্যাতন। তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ, তাদের চলাফেরার ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ, যা ছিল তাদের গৃহবন্দি রাখারই শামিল। তাদের জন্য শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ ছিল চাকরি ও পেশার জীবন। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর ওপর নির্যাতন সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে বড় আকারে হলেও আফগানিস্তানে তালেবানদের নারী নির্যাতন ছিল এদিক দিয়ে উপরোক্ত দেশগুলোর অবস্থার থেকে অনেক বেশি ভয়াবহ।
আফগানিস্তানের জনগণের দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল কারজাই সরকার উৎখাতের জন্য যে আন্দোলন ও যুদ্ধ হচ্ছে তার নেতৃত্ব আবার দিচ্ছে তালেবান প্রতিক্রিয়াশীলরা। কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির উত্থান এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা বিরোধিতার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। কাজেই সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণ আফগানিস্তান থেকে উচ্ছেদের পর সেখানে কোনো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পুরোদস্তুর সম্ভাবনা আছে বর্বর তালেবানদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের। ক্ষমতা দখল করলে তারা যে তাদের নারী নীতি আবার কার্যকর করবে এতে সন্দেহ নেই। এখন নারীরা যেভাবে শিক্ষাদীক্ষা পাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি কাজে নিযুক্ত থাকছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে_ এসবের কিছুই থাকবে না। নারীরা আবার গৃহবন্দি হবে। অন্তত তালেবানরা এ ক্ষেত্রে তাদের নীতি কার্যকর করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তবে তাদের সে চেষ্টা আগের মতো একইভাবে সফল হবে, না প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে সেটা সে সময় দেখা যাবে। কারণ গত দশ বছরে নারীরা শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে নানাক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে এবং সরকারি-বেসরকারি কাজের সঙ্গে জড়িত থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যতখানি এগিয়ে এসেছে এই অবস্থা আগে ছিল না। সে কারণে আগে তালেবানরা তাদের নারী নীতি যত মসৃণভাবে কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছিল ততখানি সাফল্য পরবর্তীকালে তারা অর্জন করতে যে সক্ষম হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
মালালার ওপর তালেবান হামলার সঙ্গে আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কিত থাকার কারণে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের কথা বলা দরকার হলো। আশির দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আমলে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের আফগান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হয়। এভাবে জড়িত হওয়ার পর থেকে একদিকে ক্রমশ ও দ্রুত পাকিস্তানে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়শীলতার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অন্যদিকে পাকিস্তান পরিণত হয় আফগান যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য শরিকে। আফগানিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তথাকথিত ৯/১১-এর ঘটনার পর এই সম্পর্ক অন্যদিকে মোড় নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘটনার জন্য আল কায়দা ও আফগান তালেবানদের দায়ী করে আফগানিস্তান সরাসরি আক্রমণ করে দখল করে। এরপর আফগানিস্তানের তালেবানরা পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে আফগানবিরোধী যুদ্ধ তৎপরতা পরিচালনা করছে_ এই অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের এই অঞ্চলে সামরিক হামলা শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে এই হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই পাকিস্তানে গড়ে ওঠে তালেবানদের শক্তি। আফগান তালেবানদের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি তালেবানরা শুধু ওয়াজিরিস্তান নয়, সোয়াতসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় তাদের সংগঠন গড়ে তোলে। তবে তাদের মূল ঘাঁটি হয় ওয়াজিরিস্তান ও সোয়াতে। যেভাবে পাকিস্তানে তালেবানরা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে তাতে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের বিরোধিতা ও সংঘর্ষ পরিস্থিতি দেখা দেয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সোয়াতে অবস্থিত তালেবানদের সশস্ত্র শক্তি নির্মূল করার জন্য সেখানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে না পারলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ খতম করে। তালেবানরা সোয়াত অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পর নিজেদের নারী ও শিক্ষা নীতি কার্যকর করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা রদ করে। আফগান তালেবানদের মতোই মেয়েদের গৃহবন্দি করে। পাকিস্তান সরকার সেখানে তালেবানদের অবস্থান পূর্ণ করার পর আবার মেয়েদের স্কুল-কলেজ খোলা হয়। কিন্তু তালেবান হুমকি সেখানে অব্যাহত থাকে। এর বিরুদ্ধে মালালার মতো এত অল্প বয়সী মেয়েরাও তালেবানদের নারী শিক্ষাবিরোধী নীতির বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসে। দেখা যাচ্ছে যে, প্রশাসন ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তালেবানরা উচ্ছেদ হলেও সন্ত্রাসী ও বর্বর গ্রুপ হিসেবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। উপরন্তু জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ক্ষমতা তাদের আছে। এই ক্ষমতার সব থেকে বড় ছাউনি হলো সোয়াতে মালালার মতো মাত্র ১৪ বছরের একটি মেয়ের ওপর তাদের সন্ত্রাসী হামলা।
এই হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানে রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব যথেষ্ট থাকলেও মালালার ওপর এই তালেবান আক্রমণের বিরোধিতা সেখানে শুধু সরকার ও সামরিক বাহিনী নয়, সর্বস্তরের জনগণের মধ্যেও ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে আরব আমিরাতের মতো প্রতিক্রিয়াশীল অঞ্চলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো পাকিস্তানের জনগণের তালেবান বিরোধিতা। এই বিরোধিতা যে ব্যাপক সেটা আমরা দেখছি মসজিদে মসজিদে, খ্রিস্টান গির্জায় গির্জায় মালালার জন্য প্রার্থনার মধ্যে। এই প্রতিরোধই সব থেকে বড় শক্তি যা পাকিস্তানে বর্বর তালেবানদের রাজনৈতিক প্রভাব নির্মূল করে সেখানে শুধু ধর্মনিরপেক্ষ নয়, ধর্ম বিযুক্ত (ঝবপঁষধৎ) রাজনীতির সম্প্রসারণ ঘটাতে পারে।
১৫.১০.২০১২
বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
পাকিস্তানে তালেবানদের এই সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং উৎপাত আফগানিস্তানে তালেবানদের তৎপরতা ও উৎপাতের তুলনায় এক সাম্প্রতিক ব্যাপার। আফগানিস্তানে বামপন্থি সরকারের পতনের পর তালেবানরা ক্ষমতায় আসে। পশ্চাৎপদ আফগান জনগণের মধ্যে বামপন্থি সরকারকে নাস্তিক বলে প্রচার করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের কিছু ভ্রান্তনীতিও তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছিল। কিন্তু সেখানে বামপন্থি সরকারের পতনের মূল কারণ ছিল আফগানিস্তানের চরম ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তিগুলোকে অর্থ, অস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে মার্কিনসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্য-সহযোগিতা। শুধু অর্থ এবং অস্ত্রই নয়, তাদের সামরিক ট্রেনিং, পরামর্শ ইত্যাদির মাধ্যমেও তারা শক্তিশালী করেছিল। বামপন্থি সরকারের পতনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রীর সম্পর্ক, যে সম্পর্কের কারণে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য পেত। এই সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এ কারণে আফগান জনগণ তাদের এক প্রকার দখলদার হিসেবে গণ্য করে দেশকে এই দখলদারমুক্ত করতে যুদ্ধে নামে। এই যুদ্ধ যারা সংগঠিত ও পরিচালনা করে তারা ছিল চরম ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল। বামপন্থি সরকারের পতনের পর তারাই ক্ষমতাসীন হয়। এই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যেই একটি সংগঠিত দল হিসেবে তালেবানদের উদ্ভব ঘটে এবং পরে তারা মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে। এই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা দেশ থেকে সোভিয়েত দখলদার ও তাদের ওপর নির্ভরশীল বামপন্থি সরকারকে হটিয়ে দিলেও আফগানিস্তানে কায়েম করে এক সামাজিক বর্বরতার শাসন। এই শাসনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল নারীদের ওপর চরম নির্যাতন। তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ, তাদের চলাফেরার ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ, যা ছিল তাদের গৃহবন্দি রাখারই শামিল। তাদের জন্য শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ ছিল চাকরি ও পেশার জীবন। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর ওপর নির্যাতন সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে বড় আকারে হলেও আফগানিস্তানে তালেবানদের নারী নির্যাতন ছিল এদিক দিয়ে উপরোক্ত দেশগুলোর অবস্থার থেকে অনেক বেশি ভয়াবহ।
আফগানিস্তানের জনগণের দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল কারজাই সরকার উৎখাতের জন্য যে আন্দোলন ও যুদ্ধ হচ্ছে তার নেতৃত্ব আবার দিচ্ছে তালেবান প্রতিক্রিয়াশীলরা। কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির উত্থান এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা বিরোধিতার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। কাজেই সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণ আফগানিস্তান থেকে উচ্ছেদের পর সেখানে কোনো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পুরোদস্তুর সম্ভাবনা আছে বর্বর তালেবানদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের। ক্ষমতা দখল করলে তারা যে তাদের নারী নীতি আবার কার্যকর করবে এতে সন্দেহ নেই। এখন নারীরা যেভাবে শিক্ষাদীক্ষা পাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি কাজে নিযুক্ত থাকছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে_ এসবের কিছুই থাকবে না। নারীরা আবার গৃহবন্দি হবে। অন্তত তালেবানরা এ ক্ষেত্রে তাদের নীতি কার্যকর করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তবে তাদের সে চেষ্টা আগের মতো একইভাবে সফল হবে, না প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে সেটা সে সময় দেখা যাবে। কারণ গত দশ বছরে নারীরা শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে নানাক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে এবং সরকারি-বেসরকারি কাজের সঙ্গে জড়িত থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যতখানি এগিয়ে এসেছে এই অবস্থা আগে ছিল না। সে কারণে আগে তালেবানরা তাদের নারী নীতি যত মসৃণভাবে কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছিল ততখানি সাফল্য পরবর্তীকালে তারা অর্জন করতে যে সক্ষম হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
মালালার ওপর তালেবান হামলার সঙ্গে আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কিত থাকার কারণে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের কথা বলা দরকার হলো। আশির দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আমলে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের আফগান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হয়। এভাবে জড়িত হওয়ার পর থেকে একদিকে ক্রমশ ও দ্রুত পাকিস্তানে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়শীলতার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অন্যদিকে পাকিস্তান পরিণত হয় আফগান যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য শরিকে। আফগানিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তথাকথিত ৯/১১-এর ঘটনার পর এই সম্পর্ক অন্যদিকে মোড় নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘটনার জন্য আল কায়দা ও আফগান তালেবানদের দায়ী করে আফগানিস্তান সরাসরি আক্রমণ করে দখল করে। এরপর আফগানিস্তানের তালেবানরা পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে আফগানবিরোধী যুদ্ধ তৎপরতা পরিচালনা করছে_ এই অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের এই অঞ্চলে সামরিক হামলা শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে এই হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই পাকিস্তানে গড়ে ওঠে তালেবানদের শক্তি। আফগান তালেবানদের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি তালেবানরা শুধু ওয়াজিরিস্তান নয়, সোয়াতসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় তাদের সংগঠন গড়ে তোলে। তবে তাদের মূল ঘাঁটি হয় ওয়াজিরিস্তান ও সোয়াতে। যেভাবে পাকিস্তানে তালেবানরা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে তাতে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের বিরোধিতা ও সংঘর্ষ পরিস্থিতি দেখা দেয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সোয়াতে অবস্থিত তালেবানদের সশস্ত্র শক্তি নির্মূল করার জন্য সেখানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে না পারলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ খতম করে। তালেবানরা সোয়াত অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পর নিজেদের নারী ও শিক্ষা নীতি কার্যকর করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা রদ করে। আফগান তালেবানদের মতোই মেয়েদের গৃহবন্দি করে। পাকিস্তান সরকার সেখানে তালেবানদের অবস্থান পূর্ণ করার পর আবার মেয়েদের স্কুল-কলেজ খোলা হয়। কিন্তু তালেবান হুমকি সেখানে অব্যাহত থাকে। এর বিরুদ্ধে মালালার মতো এত অল্প বয়সী মেয়েরাও তালেবানদের নারী শিক্ষাবিরোধী নীতির বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসে। দেখা যাচ্ছে যে, প্রশাসন ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তালেবানরা উচ্ছেদ হলেও সন্ত্রাসী ও বর্বর গ্রুপ হিসেবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। উপরন্তু জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ক্ষমতা তাদের আছে। এই ক্ষমতার সব থেকে বড় ছাউনি হলো সোয়াতে মালালার মতো মাত্র ১৪ বছরের একটি মেয়ের ওপর তাদের সন্ত্রাসী হামলা।
এই হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানে রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব যথেষ্ট থাকলেও মালালার ওপর এই তালেবান আক্রমণের বিরোধিতা সেখানে শুধু সরকার ও সামরিক বাহিনী নয়, সর্বস্তরের জনগণের মধ্যেও ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে আরব আমিরাতের মতো প্রতিক্রিয়াশীল অঞ্চলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো পাকিস্তানের জনগণের তালেবান বিরোধিতা। এই বিরোধিতা যে ব্যাপক সেটা আমরা দেখছি মসজিদে মসজিদে, খ্রিস্টান গির্জায় গির্জায় মালালার জন্য প্রার্থনার মধ্যে। এই প্রতিরোধই সব থেকে বড় শক্তি যা পাকিস্তানে বর্বর তালেবানদের রাজনৈতিক প্রভাব নির্মূল করে সেখানে শুধু ধর্মনিরপেক্ষ নয়, ধর্ম বিযুক্ত (ঝবপঁষধৎ) রাজনীতির সম্প্রসারণ ঘটাতে পারে।
১৫.১০.২০১২
বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments