স্পীকারের রুলিং সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের শুনানি হবে আপীল বিভাগে- হাইকোর্টের আদেশের ওপর কোন স্থগিতাদেশ দেয়নি সুপ্রীমকোর্ট

সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে স্পীকারের দেয়া রুলিংকে অকার্যকর ও আইনের চোখে ভিত্তিহীন বলে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়।


সোমবার সকালে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সুপ্রীমকোর্টের অবকাশকালীন চেম্বার আদালতে এ আবেদন করে। পরে চেম্বার বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সুপ্রীমকোর্টের অবকাশকালীন ছুটির পর ৩০ সেপ্টেম্বর বিষয়টি শুনানির দিন ধার্য করে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। অপরদিকে, দুটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযত, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সোমবার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, এখন অনেকেই মনে করেন সংসদ ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি। কিন্তু পরিস্কারভাবে বলতে চাই, হাইকার্টের রায়কে কেন্দ্র করে কিছুটা মতবিরোধ হয়েছে। তবে বিচার বিভাগের প্রতি জাতীয় সংসদ সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। স্পীকারের রুলিং নিয়ে আলোচনা করতে সবাইকে সংযত হয়ে কথা বলার পরামার্শ দিয়ে সুরঞ্জিত বলেন, স্পীকারের রুলিং নিয়ে মঙ্গলবার সংসদে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবে এ বিষয়ে সবাইকে সংযত ও সংযমী হয়ে কথা বলতে হবে। এ রায় আমাদের ব্যথিত করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৯ মে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সড়ক ভবন সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্যরা। এ নিয়ে ৫ জুন সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী কিছু মন্তব্য করেন। একই দিন সংসদে কয়েকজন সদস্য সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতির বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ওই বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানান। এর ১৩ দিনের মাথায় ১৮ জুন স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ সংসদে একটি রুলিং দেন।
সোমবার আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা আপীল আবেদনে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলেও চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায়ের ওপর কোন স্থগিতাদেশ না দিয়ে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী কেএম সাইফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সরকার হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়েছিল। কিন্তু আদালত স্টে অর্ডার দেয়নি। তারা আবেদনে বলেছিল, বিবাদীদের না শুনে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে। এটি অসত্য তথ্য। সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করেছেন। এছাড়াও তাঁরা বলেছেন, সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণœ হয়েছে। এটাও সঠিক নয়। চেম্বার বিচারপতির শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত এ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন কেএম সাইফুদ্দিন আহমেদ, মনজিল মোরসেদ ও মোস্তাফিজুর রহমান খান।
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত এ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা লিভ টু আপীল দায়ের করেছি। আমরা বলেছি, হাইকোর্টে বিবাদীদের বক্তব্য শোনেননি। এ রায়ে স্পীকার ও সংসদের অধিকার ক্ষুণœ হয়েছে। সুতরাং রায়টি সঠিক হয়নি, বিষয়টি এখন বিচারাধীন। তাহলে সংসদ কি এ নিয়ে আলোচনা করতে পারবেÑএমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংসদ চলে তাদের রুলস রেগুলেশন অনুযায়ী। এ বিষয়ে আমি আর বেশি কিছু বলতে পারব না।
স্পীকার আব্দুল হামিদের রুলিংয়ের বৈধতা নিয়ে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চ গত ২৪ জুলাই রায় ঘোষণা করে। পূর্ণাঙ্গ অভিমত ও নির্দেশনাসহ ওই রায় প্রকাশ করা হয় ২৭ আগস্ট। রায়ে বলা হয়, একজন বিচারকের সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে স্পীকারের দেয়া রুলিংয়ের আইনগত কোন ভিত্তি নেই এবং তা আইনের দৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন। স্পীকারের ওই অভিমতের ‘আইনগত কোন কার্যকারিতা’ নেই বলেও আদালত জানায়। ওই রুলিং সংবিধানের ৯৬ (৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং সংবিধান ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলা হয় রায়ে।
আদালতের দেয়া অভিমতে বলা হয়েছে, স্পীকারের অভিমত, একই সঙ্গে বলব, আদালতের এ ধরনের আচরণের কি করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা তা গ্রহণ করবেন। এটি সংবিধানের ৯৬ (৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। স্পীকারের রুলিং সংবিধান ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। হাইকোর্ট রায়ে বলে, রাষ্ট্রের কোন অঙ্গ যাতে সংবিধানে দেয়া তার ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন না করে তা দেখার দায়িত্ব সুপ্রীমকোর্টের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। বিশেষ অধিকারের সীমা সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। এই ব্যাখ্যার ক্ষমতা একমাত্র সুপ্রীমকোর্টের এখতিয়ারাধীন। সংসদ তার এই বিশেষ অধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারক হিসাবে নিজেকে দাবি করতে পারে না। আদালত বলেছে, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়েছে। জনগণ সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সংবিধানের সীমার মধ্যে থেকে সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে আদালত অভিমতে বলেছে, মাননীয় বিচারপতি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করেছেন, এটি বলা যায় কি? সংবিধানের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোন মামলা দায়ের করা হলে সেক্ষেত্রে সেই মামলাটি সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদে বাধা।
আদালত আরও বলেছে, মাননীয় স্পীকারের রুলিংয়ে এমন কিছু দেখা যায় না যে, মাননীয় বিচারক সংসদের কোন কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে তার আদালতে বা কোন আদালতে কোন প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোন মামলা দায়ের বা বিচারাধীন থাকার বিষয়টিও স্পীকার তাঁর রুলিংয়ে বলেননি। সুতরাং সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদের কোন লঙ্ঘন হয়নি। আদালত রায়ে আরও বলে, সড়ক ভবনের মামলায় সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
আদালত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে অভিমতে আরও বলেছে, সংবিধানের ৯৬ (৫) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বা অন্য কোন সূত্র থেকে এই তথ্য পেয়ে যে একজন বিচারক শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে তার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে এবং এর তদন্ত ফল জানানোর জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। কাউন্সিল যদি তদন্তে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ওই বিচারক দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়েছেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন, তাহলে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে তার পদ থেকে অপসারণ করবেন।
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি পর্যালোচনা করে আদালত রায়ের অভিমতে বলেন, সুপ্রীমকোর্টের ও অন্য বিচারকরা সংসদের সমালোচনা থেকে মুক্ত। বিচারকদের বিষয়ে সংসদের অপ্রত্যাশিত বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। বিচারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন বিচারকের আচরণ সংসদের বিবেচনাধীন বিষয় হতে পারে না। সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধির বিধান অবজ্ঞা করে এ ধরনের আলোচনা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষুণœ করতে পারে। আদালত বলেছে, বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে, আইন প্রণেতাদের স্বাধীনতা। সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতার জন্যও এই স্বাধীনতা প্রয়োজন।
হাইকোর্ট রায়ে আরও বলে, রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ তাদের কর্তৃত্ব, এখতিয়ার ও ক্ষমতা সংবিধান থেকে প্রাপ্ত। সাংবিধানিক বিষয়ে রাষ্ট্রের বিচার অঙ্গ চূড়ান্ত বিচারক এবং এ বিষয়ে এর কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার সংবিধানের মূল স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধান পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু অমান্য করা যায় না। সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাগের উল্লেখ করে আদালত বলেছে, আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দুটি অঙ্গ সংবিধানের সৃষ্টি। আদালত রায়ে বলেছে, আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দু’টি অঙ্গসহ নির্বাহী বিভাগ বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত। এতে করে দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উন্নয়ন, বিকাশ ও স্থিতিশীল হবে। আদালত রায়ে বলে, আমরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেছি। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের, নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার এবং বিচারিক ক্ষমতা আদালতের। তিনটি অঙ্গের প্রতিটিকে অন্য অঙ্গের বিধানের প্রতি লক্ষ্য রেখে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে হবে। স্বাভাবিক কার্যপরিচালনার স্বার্থে একটি অঙ্গকে অপর অঙ্গ থেকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে না। সংবিধান হচ্ছে এই তিনটি অঙ্গের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রতিটি অঙ্গ তার কাজের ক্ষেত্রে নিজস্ব জায়গায় স্বাধীন। যদি কোন অঙ্গ তার ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে তাহলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ তার বিচারিক বিবেচনার ক্ষমতা আদালতের ওপর ন্যস্ত করেছে। আইন প্রণেতাদের বিচারিক ক্ষমতা গ্রহণ অসাংবিধানিক।

No comments

Powered by Blogger.