ঢাকার সিএমএম আদালত-গুরুতর অপরাধীরা জামিন পায় টাকা আর প্রভাবে! by আশরাফ-উল-আলম ও আ. জলিল উজ্জ্বল
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের নবদ্বীপ বসাক লেনে এক তরুণীকে হত্যা করে লাশ গোপন করতে তা ম্যানহোলে ফেলে দেয় সন্ত্রাসীরা। গত ১৮ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ মেয়েটির গলিত লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সূত্রাপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়।
পরে পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। তদন্তে জানা যায়, নিহত তরুণীর নাম লাবণী। তদন্তাধীন এই মামলায় গত ২১ মে তাপস চৌধুরী নামের এক আসামিকে গ্রেপ্তার করলে সে ২৪ মে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাপস নিজেকে হত্যাকাণ্ড ও লাশ গায়েব করার কাজে জড়িত বলে স্বীকার করে। এই আসামিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত জামিন দেন।
এ মামলার নথি থেকে দেখা যায়, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইসমাইল হোসেন গত ১৩ সেপ্টেম্বর আসামি তাপসকে জামিন দেন। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, আগে এই আসামির জামিন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত দুই বার নামঞ্জুর করেন। দ্বিতীয়বার নামঞ্জুর হয় গত ৪ সেপ্টেম্বর। মহানগর দায়রা জজ মো. জহুরুল হক আদেশে উল্লেখ করেন, আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করায় তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হলো।
উচ্চতর আদালতের এমন আদেশের মাত্র ৯ দিনের মাথায় হত্যার অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে থাকার পরও নিম্ন আদালত ওই আসামিকে জামিন দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, আসামির যেদিন জামিন দেওয়া হয়, সেদিনও মহানগর দায়রা জজ আদালতে একই আসামির আরেকটি জামিন আবেদন শুনানির অপেক্ষায় ছিল। এ বিষয়টি আসামিপক্ষের আইনজীবীরা গোপন করে যান।
মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র থেকে দেখা যায়, আসামির বয়স ২২ বছর। কিন্তু আসামিপক্ষের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন আদেশে আসামিকে কিশোর বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ আসামি যে কিশোর, তার সমর্থনে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. বোরহান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, উচ্চতর আদালতে জামিনের আবেদন শুনানির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় নিম্ন আদালত থেকে জামিন নেওয়া আদালতের সঙ্গে প্রতারণা। আর উচ্চ আদালত জামিন নামঞ্জুর করার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জামিন দেওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা।
আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, উচ্চ আদালত নামঞ্জুর করার পর ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন দেওয়ার এখতিয়ার নেই, যদি আসামির দীর্ঘ সময় হাজতবাস না হয় বা জরুরি কোনো কারণ উদ্ভব না হয়। আইনজীবীরা মনে করেন, এ জামিনটির ক্ষেত্রে আসামিপক্ষের প্রভাব কাজ করেছে। ম্যাজিস্ট্রেট হয়তো কোনো না কোনোভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
শুধু এই ঘটনাই নয়, এ ধরনের হত্যা মামলায় আসামির জামিন দেওয়ার হার ইদানীং ঢাকার সিএমএম আদালতে বেড়ে গেছে। হত্যার পাশাপাশি ডাকাতি, চুরি, চাঁদাবাজি, অর্থপাচার, গাড়ি চুরি, নারীপাচার, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলাসহ গুরুতর অপরাধের মামলায় আসামিদের ঢাকার এই আদালতে জামিন মিলছে অহরহ।
আইনজীবীরা আসামিদের জামিন করাতে পারলে খুশি হন। এমনকি তাঁরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন এ ধরনের জামিনে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও হতে পারে বলে শঙ্কিত অনেকে। আইনজীবীরা মনে করেন, প্রভাব ও প্রতিপত্তি যাদের আছে, তারা এখন সহজেই সিএমএম আদালত থেকে জামিন পায়। অথচ নিরীহ, গরিবরা বছরের পর বছর বিনা বিচারে হাজত খেটে চলেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার বিভিন্ন থানা ও নিম্ন আদালতে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায়। এখানে ভয়ংকর আসামিদের সরাসরি জামিনের পাশাপাশি উচ্চ আদালত থেকে নামঞ্জুর হওয়া আসামিদেরও জামিন দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকার একাধিক আইনজীবী কালের কণ্ঠকে বলেন, আসামি যদি সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদবির করতে পারে তবে জামিন হয়। আবার অর্থের প্রভাব থাকলেও জামিন পায়। কিছু দালালের মাধ্যমে এসব প্রভাব বিস্তার করা হয়।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট বোরহান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক আইনজীবীর কাছে তিনি শুনেছেন, সিএমএম আদালত থেকে গুরুতর অপরাধীরা জামিন পাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিকাশ কুমার সাহার নজরে আনা হয়েছে আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে। তিনি বলেছেন, বিষয়টি কঠোর দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে।
ঢাকার একজন বিশিষ্ট আইনজীবী নিজামুল হক মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, অস্বাভাবিক জামিনের ঘটনা বাড়ছে। অর্থের প্রভাব ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা জামিন দিচ্ছেন। ঢালাওভাবে এমন জামিনের ঘটনা ঘটলে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে বাধ্য। তিনি আরো বলেন, বড় অপরাধ করে ধরা পড়লেও এখন জামিন হয়- এই নিশ্চয়তা দিয়ে কিছু কিছু আইনজীবী মামলা নিচ্ছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখন হুমকির মুখে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের একটি মহলও এসব জামিন তৎপরতার সঙ্গে জড়িত বলে তিনি শুনেছেন।
ঢাকার আদালতের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক থাকলে এখন জামিন কোনো ঘটনাই নয়। হত্যা, মানবপাচার মামলায়ও জামিন হয়। তিনি বলেন, কিছু দালাল শ্রেণীর লোক আদালতের পরিবেশ নষ্ট করছে। এটা প্রতিহত করা প্রয়োজন।
এ ধরনের জামিনের আরো নজির
দুলু হত্যা : গত ৪ জুলাই ঢাকার চকবাজারের দেলোয়ার হোসেন দুলু হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর জামিন দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার দে। আসামি আলমগীর, আসলাম, সালাউদ্দিন ও রাসেল আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে তাদের জামিন দেওয়া হয়। অথচ গত ১৭ জুলাই এই চারজনসহ আসামি রুহুল আমিন ওরফে গাজী, শাহীন ওরফে নুরা, শরীফ, রাহী বেগম ও মোশারফ মোল্লা হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে একমাত্র রাহী বেগমকে আট সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়ে অন্য আসামিদের আবেদন নাকচ করে দেন হাইকোর্ট। বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. সাইফুজ্জামান টিপু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের শুনানিতে আসামিদের জামিনের বিরোধিতা করেন। এ সময় হাইকোর্টে জামিন নামঞ্জুরের বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। অথচ সেটি উপেক্ষা করেই হত্যা মামলার চার আসামিকে জামিন দেওয়া হয়।
ছিনতাই মামলা : মতিঝিল থানার ডিআইটি এক্সটেনশন রোড দিয়ে গত ৫ জুন মাসুদা বেগম যাচ্ছিলেন রিকশায় করে। এ সময় প্রাইভেট কারে চড়ে এসে একদল ছিনতাইকারী তাঁর গতি রোধ করে। তারা মহিলাকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটি দামি নতুন মোবাইল ফোনসেট, একটি পেনড্রাইভ, নগদ ১৩ হাজার টাকা, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ মোট ৭৫ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মাসুদা বেগম মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেটি তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ গাজীপুরের হায়দরাবাদ গ্রাম থেকে মোবাইল ফোনসেটটি উদ্ধার করে। এর সূত্র ধরে আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারের খালেক সাহেবের বাড়ি থেকে ছিনতাইকারী নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে ছিনতাইকাজে ব্যবহৃত প্রাইভেট কারটিও উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে মাসুদা বেগম মতিঝিল থানায় গিয়ে ওই ছিনতাইকারী, তাঁর মোবাইল ফোনসেট ও প্রাইভেট কারটি শনাক্ত করেন। পরে তিনি থানায় দস্যুতার অভিযোগে মামলা করেন। আশুলিয়ার জনৈক মো. সুমন এ ঘটনায় আসামি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে আদালতে ১৫৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন। এত কিছুর পরও ওই ছিনতাইকারীকে গত ১৪ আগস্ট জামিন দিয়েছেন একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। মোবাইল ফোনসেটের মালিকানা যাচাই হয়নি বা মোবাইল ফোনসেট উদ্ধারে জব্দ তালিকায় আসামির নাম নেই- এই মন্তব্য করে আসামিকে জামিন দেওয়া হয়।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা : বে-আইনিভাবে বিদেশে কচ্ছপ পাচার মামলার আসামি কিবরিয়া ও খায়রুল গ্রেপ্তার হওয়ার এক মাস দুই দিনের মাথায় জামিন পেয়ে যায় সিএমএম আদালত থেকে। ভারতীয় নাগরিক কিবরিয়া ও বাংলাদেশি খায়রুল ১০৮টি কচ্ছপ বিদেশে পাচার করতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় ১৯৭৫ সালের ২৫ (বি)-এর ১ (ক) ধারায় মামলা করে। নথিপত্রে দেখা যায়, এ দুই আসামিকে জামিন দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
অর্থপাচার : একই বিমানবন্দর দিয়ে ২৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনালের কাছে ঘোরাফেরা করার সময় গত ২৯ আগস্ট গ্রেপ্তার হয় নওয়াব খান। পরে পুলিশ বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (বি)-এর ১ (এ) ধারায় মামলা করে। গ্রেপ্তারের মাত্র ১০ দিনের মাথায় গত ৯ সেপ্টেম্বর ওই আসামিকে জামিন দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
উল্টো চিত্র : সূত্রাপুর থানার হত্যা মামলায় (নম্বর- ৭ (৮) ১২) নকিব হোসেন রানা নামে এক ব্যক্তিকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় গত ২৪ জুলাই। তাঁর কোনো স্বীকারোক্তি নেই। অন্য কোনো আসামিও তাঁর নাম বলেনি। অথচ এই আসামিকে সিএমএম আদালত জামিন দেননি। তাঁকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করতে হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রায় দুই মাস তাঁকে হাজতবাস করতে হয়। ২০ সেপ্টেম্বর তাঁকে জামিন দেন মহানগর দায়রা আদালত।
আবার হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে একটি হত্যা মামলায় (নম্বর- ১(৩) ১২) কিশোর নাজমুল হোসেন আগাম জামিন পায়। আগাম জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সে সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর। বয়সে কিশোর হওয়া সত্ত্বেও তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ম্যাজিস্ট্রেট। পরে মহানগর দায়রা আদালতে জামিন আবেদন করলে তাকে ২৬ সেপ্টেম্বর জামিন দেওয়া হয়।
এ মামলার নথি থেকে দেখা যায়, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইসমাইল হোসেন গত ১৩ সেপ্টেম্বর আসামি তাপসকে জামিন দেন। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, আগে এই আসামির জামিন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত দুই বার নামঞ্জুর করেন। দ্বিতীয়বার নামঞ্জুর হয় গত ৪ সেপ্টেম্বর। মহানগর দায়রা জজ মো. জহুরুল হক আদেশে উল্লেখ করেন, আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করায় তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হলো।
উচ্চতর আদালতের এমন আদেশের মাত্র ৯ দিনের মাথায় হত্যার অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে থাকার পরও নিম্ন আদালত ওই আসামিকে জামিন দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, আসামির যেদিন জামিন দেওয়া হয়, সেদিনও মহানগর দায়রা জজ আদালতে একই আসামির আরেকটি জামিন আবেদন শুনানির অপেক্ষায় ছিল। এ বিষয়টি আসামিপক্ষের আইনজীবীরা গোপন করে যান।
মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র থেকে দেখা যায়, আসামির বয়স ২২ বছর। কিন্তু আসামিপক্ষের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন আদেশে আসামিকে কিশোর বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ আসামি যে কিশোর, তার সমর্থনে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. বোরহান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, উচ্চতর আদালতে জামিনের আবেদন শুনানির অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় নিম্ন আদালত থেকে জামিন নেওয়া আদালতের সঙ্গে প্রতারণা। আর উচ্চ আদালত জামিন নামঞ্জুর করার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জামিন দেওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা।
আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, উচ্চ আদালত নামঞ্জুর করার পর ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন দেওয়ার এখতিয়ার নেই, যদি আসামির দীর্ঘ সময় হাজতবাস না হয় বা জরুরি কোনো কারণ উদ্ভব না হয়। আইনজীবীরা মনে করেন, এ জামিনটির ক্ষেত্রে আসামিপক্ষের প্রভাব কাজ করেছে। ম্যাজিস্ট্রেট হয়তো কোনো না কোনোভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
শুধু এই ঘটনাই নয়, এ ধরনের হত্যা মামলায় আসামির জামিন দেওয়ার হার ইদানীং ঢাকার সিএমএম আদালতে বেড়ে গেছে। হত্যার পাশাপাশি ডাকাতি, চুরি, চাঁদাবাজি, অর্থপাচার, গাড়ি চুরি, নারীপাচার, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলাসহ গুরুতর অপরাধের মামলায় আসামিদের ঢাকার এই আদালতে জামিন মিলছে অহরহ।
আইনজীবীরা আসামিদের জামিন করাতে পারলে খুশি হন। এমনকি তাঁরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন এ ধরনের জামিনে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও হতে পারে বলে শঙ্কিত অনেকে। আইনজীবীরা মনে করেন, প্রভাব ও প্রতিপত্তি যাদের আছে, তারা এখন সহজেই সিএমএম আদালত থেকে জামিন পায়। অথচ নিরীহ, গরিবরা বছরের পর বছর বিনা বিচারে হাজত খেটে চলেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার বিভিন্ন থানা ও নিম্ন আদালতে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায়। এখানে ভয়ংকর আসামিদের সরাসরি জামিনের পাশাপাশি উচ্চ আদালত থেকে নামঞ্জুর হওয়া আসামিদেরও জামিন দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকার একাধিক আইনজীবী কালের কণ্ঠকে বলেন, আসামি যদি সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদবির করতে পারে তবে জামিন হয়। আবার অর্থের প্রভাব থাকলেও জামিন পায়। কিছু দালালের মাধ্যমে এসব প্রভাব বিস্তার করা হয়।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট বোরহান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক আইনজীবীর কাছে তিনি শুনেছেন, সিএমএম আদালত থেকে গুরুতর অপরাধীরা জামিন পাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিকাশ কুমার সাহার নজরে আনা হয়েছে আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে। তিনি বলেছেন, বিষয়টি কঠোর দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে।
ঢাকার একজন বিশিষ্ট আইনজীবী নিজামুল হক মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, অস্বাভাবিক জামিনের ঘটনা বাড়ছে। অর্থের প্রভাব ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা জামিন দিচ্ছেন। ঢালাওভাবে এমন জামিনের ঘটনা ঘটলে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে বাধ্য। তিনি আরো বলেন, বড় অপরাধ করে ধরা পড়লেও এখন জামিন হয়- এই নিশ্চয়তা দিয়ে কিছু কিছু আইনজীবী মামলা নিচ্ছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখন হুমকির মুখে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের একটি মহলও এসব জামিন তৎপরতার সঙ্গে জড়িত বলে তিনি শুনেছেন।
ঢাকার আদালতের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক থাকলে এখন জামিন কোনো ঘটনাই নয়। হত্যা, মানবপাচার মামলায়ও জামিন হয়। তিনি বলেন, কিছু দালাল শ্রেণীর লোক আদালতের পরিবেশ নষ্ট করছে। এটা প্রতিহত করা প্রয়োজন।
এ ধরনের জামিনের আরো নজির
দুলু হত্যা : গত ৪ জুলাই ঢাকার চকবাজারের দেলোয়ার হোসেন দুলু হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর জামিন দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার দে। আসামি আলমগীর, আসলাম, সালাউদ্দিন ও রাসেল আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে তাদের জামিন দেওয়া হয়। অথচ গত ১৭ জুলাই এই চারজনসহ আসামি রুহুল আমিন ওরফে গাজী, শাহীন ওরফে নুরা, শরীফ, রাহী বেগম ও মোশারফ মোল্লা হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে একমাত্র রাহী বেগমকে আট সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়ে অন্য আসামিদের আবেদন নাকচ করে দেন হাইকোর্ট। বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. সাইফুজ্জামান টিপু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের শুনানিতে আসামিদের জামিনের বিরোধিতা করেন। এ সময় হাইকোর্টে জামিন নামঞ্জুরের বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। অথচ সেটি উপেক্ষা করেই হত্যা মামলার চার আসামিকে জামিন দেওয়া হয়।
ছিনতাই মামলা : মতিঝিল থানার ডিআইটি এক্সটেনশন রোড দিয়ে গত ৫ জুন মাসুদা বেগম যাচ্ছিলেন রিকশায় করে। এ সময় প্রাইভেট কারে চড়ে এসে একদল ছিনতাইকারী তাঁর গতি রোধ করে। তারা মহিলাকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটি দামি নতুন মোবাইল ফোনসেট, একটি পেনড্রাইভ, নগদ ১৩ হাজার টাকা, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ মোট ৭৫ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মাসুদা বেগম মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেটি তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ গাজীপুরের হায়দরাবাদ গ্রাম থেকে মোবাইল ফোনসেটটি উদ্ধার করে। এর সূত্র ধরে আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারের খালেক সাহেবের বাড়ি থেকে ছিনতাইকারী নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে ছিনতাইকাজে ব্যবহৃত প্রাইভেট কারটিও উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে মাসুদা বেগম মতিঝিল থানায় গিয়ে ওই ছিনতাইকারী, তাঁর মোবাইল ফোনসেট ও প্রাইভেট কারটি শনাক্ত করেন। পরে তিনি থানায় দস্যুতার অভিযোগে মামলা করেন। আশুলিয়ার জনৈক মো. সুমন এ ঘটনায় আসামি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে আদালতে ১৫৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন। এত কিছুর পরও ওই ছিনতাইকারীকে গত ১৪ আগস্ট জামিন দিয়েছেন একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। মোবাইল ফোনসেটের মালিকানা যাচাই হয়নি বা মোবাইল ফোনসেট উদ্ধারে জব্দ তালিকায় আসামির নাম নেই- এই মন্তব্য করে আসামিকে জামিন দেওয়া হয়।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা : বে-আইনিভাবে বিদেশে কচ্ছপ পাচার মামলার আসামি কিবরিয়া ও খায়রুল গ্রেপ্তার হওয়ার এক মাস দুই দিনের মাথায় জামিন পেয়ে যায় সিএমএম আদালত থেকে। ভারতীয় নাগরিক কিবরিয়া ও বাংলাদেশি খায়রুল ১০৮টি কচ্ছপ বিদেশে পাচার করতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় ১৯৭৫ সালের ২৫ (বি)-এর ১ (ক) ধারায় মামলা করে। নথিপত্রে দেখা যায়, এ দুই আসামিকে জামিন দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
অর্থপাচার : একই বিমানবন্দর দিয়ে ২৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনালের কাছে ঘোরাফেরা করার সময় গত ২৯ আগস্ট গ্রেপ্তার হয় নওয়াব খান। পরে পুলিশ বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (বি)-এর ১ (এ) ধারায় মামলা করে। গ্রেপ্তারের মাত্র ১০ দিনের মাথায় গত ৯ সেপ্টেম্বর ওই আসামিকে জামিন দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
উল্টো চিত্র : সূত্রাপুর থানার হত্যা মামলায় (নম্বর- ৭ (৮) ১২) নকিব হোসেন রানা নামে এক ব্যক্তিকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় গত ২৪ জুলাই। তাঁর কোনো স্বীকারোক্তি নেই। অন্য কোনো আসামিও তাঁর নাম বলেনি। অথচ এই আসামিকে সিএমএম আদালত জামিন দেননি। তাঁকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করতে হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রায় দুই মাস তাঁকে হাজতবাস করতে হয়। ২০ সেপ্টেম্বর তাঁকে জামিন দেন মহানগর দায়রা আদালত।
আবার হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে একটি হত্যা মামলায় (নম্বর- ১(৩) ১২) কিশোর নাজমুল হোসেন আগাম জামিন পায়। আগাম জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সে সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর। বয়সে কিশোর হওয়া সত্ত্বেও তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ম্যাজিস্ট্রেট। পরে মহানগর দায়রা আদালতে জামিন আবেদন করলে তাকে ২৬ সেপ্টেম্বর জামিন দেওয়া হয়।
No comments