প্রতিবাদের প্রতীক মালালা by শাহীন হাসনাত

২০০৯ সালের কথা। পাকিস্তানের সোয়াতে তালেবানরা মেয়েদের স্কুলগুলো বন্ধ করে দিলে ছদ্মনামে ১১ বছরের এক কিশোরী বিবিসি উর্দু বিভাগের ওয়েবসাইটে নিয়মিত ডায়েরি লিখতে শুরু করে। ডায়েরির ভাষা তার একার থাকলেও এটা ছিল মূলত পাকিস্তানে নিগৃহীত প্রতিটি কিশোরীর মনের কথা।


যুদ্ধ, হত্যা এবং মৃত্যুর বিভীষিকাকে পেছনে ফেলে খুব দ্রুত উৎসাহব্যঞ্জক সেই ডায়েরি লেখিকা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে তার কিছু সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়। ওই কিশোরী এক সাক্ষাৎকারে দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিল, 'শিক্ষার দ্বার কারও জন্য বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। আমি পড়ালেখা করব, করবই। ঘরে, স্কুলে, অন্য কোনো জায়গায়; কেউ তা বন্ধ করতে পারবে না।' নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জ্ঞানের আলো জ্বালাতে তার অকুতোভয় কণ্ঠস্বর সেদিন সবাইকে চমকে দিয়ে জুগিয়েছে সাহস ও শক্তি। সমকালীন সমবয়সীদের ভরসাস্থল হয়ে ওঠা সেই জাদুকরী ভাষ্যকার আর কেউ নয়_ সারাবিশ্বের প্রতিবাদের প্রতীক মালালা ইউসুফজাই।
শুভশক্তির যাত্রা মিছিলে প্রথম প্রথম অনেকেই আমলে নিতে চায়নি তার কথাগুলো। কিন্তু তালেবানরা তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করলে এবং ২০১১ সালে শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনীত করা হলে দৃশ্যপটে আসে মালালা। পাকিস্তান সরকার তাকে প্রথম জাতীয় শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে গত বছরের শেষের দিকে। সেই মালালা এখন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। মালালার প্রতি রইল অনেক ভালোবাসা ও দোয়া। মালালা আবারও প্রমাণ করল, 'অসির চেয়ে মসির শক্তি অনেক বেশি।' কারণ মালালা সমাজ বদলের জন্য লড়াই করছে। বিদ্রোহ করেছে বর্বরতার বিরুদ্ধে। মূর্খ ও গুহাবাসীদের ভয়ঙ্কর রুদ্ররূপকে সে বিশ্ববাসীর কাছে খোলাসা করে দিয়েছে। মালালা এখন সবার কাছে 'লড়াইয়ের প্রতীক'।
বিশ্বের অন্য সব শিশু-কিশোরের মতো পাকিস্তানি ছেলেমেয়েরাও শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। কারণ শিক্ষা মানুষকে আলোর পথ দেখায়। শুধু মেয়ে হওয়ার অপরাধে কাউকে শিক্ষা থেকে বলপূর্বক বঞ্চিত করা কাম্য নয়। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া, শিক্ষকের কাছ থেকে শেখা, সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা এবং খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয়ে যে আনন্দের ভুবন তৈরি হয়, তার মূল্য শিশুদের জীবনে অনেক বেশি। এর প্রভাব পরবর্তী জীবনের পরতে পরতে প্রতিফলিত হয়। এই পথ ধরেই আজকের শিশু আগামী দিনের সুনাগরিক হয়_ এটাই নিয়ম ও বাস্তবতা।
আমরা জানি, ইসলাম অর্থ শান্তি। মানবজীবনে সুখ, শান্তি, শুভ, সত্য এবং সততা প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। ইসলাম শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তারপরও শিক্ষা রোধ করতে কেন এই নৃশংসতা ও পাশবিকতা? কোন ধর্ম এর অনুমতি দিয়েছে? ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষিত হতে চাওয়া কি অপরাধ? মালালার অপরাধ, সে শিক্ষার আলো চেয়েছে। সে সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারও বটে। এমতাবস্থায় বিশ্বের নির্যাতিত ও প্রান্তিক এলাকাগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে মালালার কণ্ঠকে চেপে ধরা সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না। মালালা মানবিক মূল্যবোধ-বিবর্জিত যে বর্বর গোষ্ঠীর বলয় ভেদ করতে গিয়ে জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে, তা শুধু পাকিস্তানে নয়; সারাবিশ্বের জন্য শিক্ষণীয় ও উদাহরণবিশেষ।
কিশোরী মালালার নিষ্পাপ মুখাবয়ব, সরল হাসি আর ইস্পাতদৃঢ় সংকল্প_ কাপুরুষ ঘাতকের আঘাত দমাতে পারবে না। সমাজের যাবতীয় অন্ধত্ব ও বিকারগ্রস্ততার বিরুদ্ধে মালালার সংগ্রাম ও সাহসিকতা কোনো ধর্মের ভিত্তি বা দোহাই দিয়ে নয়। এটা সব ধরনের কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে। যে সমাজে সংকীর্ণতা ও সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় রাজনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে; সেখানে মালালা শুধু শিক্ষার অধিকারটুকুই চেয়েছে; স্কুলে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে সে পেয়েছে তপ্ত বুলেটের আঘাত। সেই সমাজ এত দ্রুত বদলাবে_ এমনটা আশা করা যায় না। এটা সবাই জানে যে, শিক্ষা মানুষকে সহিষ্ণু করে। কিন্তু মালালার ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার বদলে সহিংসতা আর রক্তপাতকে উস্কে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রসারে মালালা তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে কি-না জানি না। তবে এটা বলা যায় যে, আওয়াজ উঠছে, প্রতিবাদ হচ্ছে। একদিন না একদিন মালালার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। সামাজিক পৈশাচিকতা, অন্ধত্ব ও বর্বরতার বিরুদ্ধে সমাজ আলোকিত করার এ লড়াইয়ে মালালা এখন
সবার পথপ্রদর্শক।
 

No comments

Powered by Blogger.