সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-আশার আলো বনাম থলের বিড়াল by তারেক শামসুর রেহমান
দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার বিরুদ্ধে আনীত ড্রাইভার আজম খানের অভিযোগকে আইসিআইর ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। আজম খান মন্ত্রীর সাবেক এপিএসের ড্রাইভার। ড্রাইভার আজম পলাতক অবস্থায় থেকে আরটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবারও জানালেন,
পিলখানায় যে ৭৪ লাখ টাকাসহ সাবেক এপিএস ফারুক আটক হয়েছিলেন, তার গন্তব্য ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জিগাতলার বাড়ি। গত ৬ অক্টোবর প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে এই খবরটিই প্রাধান্য পেয়েছে। নতুন করে রেলের 'ঘুষ-বাণিজ্যের' খবরটি এলো এমন এক সময় যখন পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকায় আসছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গ্যাব্রিয়েল মারিনো ওকাম্পো।
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের কারও কারও বিরুদ্ধে যখন 'বড় দুর্নীতির' অভিযোগ ওঠে এবং সেই অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে তদন্ত দল আসে, তখন বিদেশে আমাদের মান-মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! ক্ষমতাসীনরা এটা কতটুকু বোঝেন, আমি জানি না। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এই পর্যবেক্ষণ টিমের ঢাকায় আসার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আমাদের দেশে যেসব তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে এ ধরনের তদন্ত পরিচালিত হয়, তাতে বিদেশিদের আস্থা থাকে না। আমি মনে করি, দুদকের জন্য একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হলো এখন তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল যদি দুদকের তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভবিষ্যতে যে কোনো বৈদেশিক সাহায্যও হুমকির মুখে থাকবে।
দুদকের তদন্তে এর আগে প্রমাণিত হয়েছিল ধৃত ৭৪ লাখ টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিতের কোনো সম্পর্ক নেই! এ দেশের সাধারণ মানুষ, এমনকি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ের মানুষ কি তা বিশ্বাস করেছে? মানুষ বিশ্বাস করেনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করেন। এটা সত্য এবং এক সময় বাম রাজনীতির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করেও অতীতে একতা পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এতে প্রমাণ করে, তিনি তার এলাকায় জনপ্রিয়। তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েও তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। কিন্তু 'রাজনীতি' অর্থ আয়ের একটা মাধ্যম হতে পারে না। সুরঞ্জিতের পারিবারিক ঐতিহ্য এমন ছিল না যে, তিনি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে শতকোটি টাকার মালিক হতে পারেন! তার আয়ের উৎস কী? একজন এমপি হিসেবে তিনি কত টাকা 'সম্মানী' পান? রাষ্ট্র তাকে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে যে সুযোগ দেয়, তা দিয়ে কি তিনি (১০ কোটি টাকা) দিরাইয়ে 'সেন মার্কেট' করতে পারেন? তার যে ২০ কোটি টাকার একাধিক মাছের খামার রয়েছে, সেই টাকার উৎস কী? যে ধানি জমি তার রয়েছে, তা কি পারিবারিকভাবে তিনি পেয়েছেন! তার ছেলে সৌমেন যে টেলিকম কোম্পানিতে ৫ কোটি টাকা লগি্ন করেছে, তা কি তার বৈধ? জিগাতলায় সুরঞ্জিতের যে ৫ তলা বাড়িটি রয়েছে তা কি তার বৈধ আয়ে কেনা? নাকি দখল করা? সংবাদপত্রে এর আগে ওই বাড়িটি নিয়ে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল।
আজ এসব প্রসঙ্গ থাক। রাজনীতিবিদরা জনগণের সেবা করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের যখন কোনো বৈধ আয় থাকে না, তখন তিনি যখন কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেন, তখন তার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। প্রসঙ্গক্রমেই এসে গেল মওলানা ভাসানীর কথা। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে (আমরা তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি) আমরা টাঙ্গাইলে 'হুজুরের' সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটা ভাঙা বাড়ির বারান্দায় বসিয়ে তিনি আমাদের গাছের একটি করে ক'দিনের পুরনো কলা খেতে দিয়েছিলেন। ভাসানী অগাধ সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু হননি। দুঃখী মানুষের কথা তিনি আজীবন বলে গেছেন। ইচ্ছা করলে খোদ ঢাকা শহরেই একাধিক বাড়ি তিনি করে যেতে পারতেন। তিনি কি আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি আদর্শ হতে পারতেন না? ভাসানীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে গেছেন, এটা বলা যাবে না। বরং তাদের অনেকের আর্থিক কষ্টে দিন কেটেছিল বা এখনও কাটছে। কিংবা হাজী দানেশ? কী সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ? উদাহরণ প্রসঙ্গ থাক। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিবিদ। তরুণ বয়সে এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি এক সময় আশার আলো ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু 'থলের বিড়াল' তো এখন বেরিয়ে পড়েছে। তিনি রেলের 'কালো বিড়াল' তাড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই যে 'কালো বিড়াল', তা তিনি নিজেই প্রমাণ করলেন। বিরোধী দলকে এটা আর প্রমাণ করতে হবে না।
প্রথমবার তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সেটা একটা ভালো দিক ছিল। কিন্তু সরকারপ্রধান কেন যে আবার তাকে পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনলেন, আমি তা বুঝতে আজও অক্ষম। আরও অবাক হওয়ার বিষয়_ মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হলো। কিন্তু সেন বাবু থেকে গেলেন কোনো দফতর ছাড়াই। এ ক্ষেত্রে একটা জিনিস স্পষ্ট, আর তা হচ্ছে সরকারপ্রধানের আস্থা তিনি এখনও ফিরে পাননি। এমতাবস্থায় আমি তাকে অনুরোধ করব স্বপ্রণোদিত হয়ে ছুটিতে যেতে। ইতিমধ্যে ক্যাবিনেটে তার থাকা না থাকা নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। হাইকোর্ট যখন একটি রিট শুনানির জন্য গ্রহণ করেন, তখন বুঝতে হবে আবেদনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও 'মেরিট' আছে। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, মন্ত্রীর পেছনে সরকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে। একজন মন্ত্রী শুধু 'গোলটেবিলে' বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবেন, তার জন্য তো রাষ্ট্র প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে পারে না? মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার 'ক্ষমতা' যদি না থাকে, তাহলে তার চলে যাওয়াই মঙ্গল। আমি চাইব তিনি 'ছুটিতে' যাবেন এবং সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন। তিনি ভালো বলেন। রসিকতা করেন। 'টক শো' মন্ত্রী হিসেবে তার চাহিদা অনেক বেশি। এমনিতেই সরকারের 'ঝামেলা' অনেক বেশি। একের পর এক সংকট তৈরি হচ্ছে। সরকার কোনোটারই কূল-কিনারা করতে পারছে না। হলমার্কের ঘটনার যখন কোনো 'সমাধান' সরকার দিতে পারছে না, তখন হলমার্কের বিতর্কিত এমডি তানভীর মাহমুদ 'হাটে' হাঁড়ি ভেঙে দিলেন। অভিযোগ করলেন ৫টি প্রতিষ্ঠানের (টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট, নকশি নিট, ডিএন স্পোর্টস ও খানজাহান আলী) হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রকাশ করা হচ্ছে না। এই অভিযোগের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে জানি না, তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য এই তথ্য একটি 'সূত্র'। এ বিষয়টি আমরা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলাম। কিন্তু বাস্তব যা তা হচ্ছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আমাদের অনেক ক্ষতি করে গেলেন। এর আগে আবুল হোসেনও অনেক ক্ষতি করেছেন। অনেকটা আবুল হোসেনের কারণেই বিশ্বব্যাংকের একটি পর্যবেক্ষণ দল বাংলাদেশে এলো। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা স্বীকার করেন আর না-ই করেন, মন্ত্রিসভার সদস্যদের দুর্নীতির খবর আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। এই ভাবমূর্তি আমরা কাটিয়ে উঠব কীভাবে?
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বার্ষিক আয় মাত্র ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। এটাকেই আমরা 'সত্য' বলে ধরে নিচ্ছি। আর সত্য বলে ধরে নিলে তিনি ১০ কোটি টাকা দিয়ে 'সেন মার্কেট' নির্মাণ করলেন কীভাবে? তার দেওয়া তথ্যকে ভিত্তি করে নির্বাচন কমিশন তো এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন 'নেবে' না, এটাই বাস্তব। আর দুদক আমাদের জানিয়েছে, ড্রাইভার আজমকে 'পাওয়ার' পরই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জিজ্ঞাসা করা হবে।
দুদক চেয়ারম্যানের কথায় কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।
আসলেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা 'কালো বিড়াল'। পেশা হিসেবে একজন আইনজীবী হলেও জীবনে কোনোদিন কোর্টে দাঁড়িয়েছেন, মক্কেলের জন্য লড়েছেন, তা কেউ জানে না। কিন্তু দিনে দিনে তার সম্পদ স্ফীত হয়েছে। তার জন্য সরকার একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু 'একজনের' জন্য আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে না। তিনি 'ছুটিতে' যান। দুদক বিষয়টি নিয়ে পুনর্তদন্ত করুক। সেন বাবু ক্যাবিনেটে থাকলে সুষ্ঠু তদন্ত হবে না। প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্যই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ক্যাবিনেট থেকে বিদায় নেওয়া উচিত।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
tsrahmanbd@yahoo.com
www.tsrahmanbd.blogspot.com
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের কারও কারও বিরুদ্ধে যখন 'বড় দুর্নীতির' অভিযোগ ওঠে এবং সেই অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে তদন্ত দল আসে, তখন বিদেশে আমাদের মান-মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! ক্ষমতাসীনরা এটা কতটুকু বোঝেন, আমি জানি না। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এই পর্যবেক্ষণ টিমের ঢাকায় আসার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আমাদের দেশে যেসব তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে এ ধরনের তদন্ত পরিচালিত হয়, তাতে বিদেশিদের আস্থা থাকে না। আমি মনে করি, দুদকের জন্য একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হলো এখন তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল যদি দুদকের তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভবিষ্যতে যে কোনো বৈদেশিক সাহায্যও হুমকির মুখে থাকবে।
দুদকের তদন্তে এর আগে প্রমাণিত হয়েছিল ধৃত ৭৪ লাখ টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিতের কোনো সম্পর্ক নেই! এ দেশের সাধারণ মানুষ, এমনকি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ের মানুষ কি তা বিশ্বাস করেছে? মানুষ বিশ্বাস করেনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করেন। এটা সত্য এবং এক সময় বাম রাজনীতির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করেও অতীতে একতা পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এতে প্রমাণ করে, তিনি তার এলাকায় জনপ্রিয়। তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েও তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। কিন্তু 'রাজনীতি' অর্থ আয়ের একটা মাধ্যম হতে পারে না। সুরঞ্জিতের পারিবারিক ঐতিহ্য এমন ছিল না যে, তিনি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে শতকোটি টাকার মালিক হতে পারেন! তার আয়ের উৎস কী? একজন এমপি হিসেবে তিনি কত টাকা 'সম্মানী' পান? রাষ্ট্র তাকে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে যে সুযোগ দেয়, তা দিয়ে কি তিনি (১০ কোটি টাকা) দিরাইয়ে 'সেন মার্কেট' করতে পারেন? তার যে ২০ কোটি টাকার একাধিক মাছের খামার রয়েছে, সেই টাকার উৎস কী? যে ধানি জমি তার রয়েছে, তা কি পারিবারিকভাবে তিনি পেয়েছেন! তার ছেলে সৌমেন যে টেলিকম কোম্পানিতে ৫ কোটি টাকা লগি্ন করেছে, তা কি তার বৈধ? জিগাতলায় সুরঞ্জিতের যে ৫ তলা বাড়িটি রয়েছে তা কি তার বৈধ আয়ে কেনা? নাকি দখল করা? সংবাদপত্রে এর আগে ওই বাড়িটি নিয়ে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল।
আজ এসব প্রসঙ্গ থাক। রাজনীতিবিদরা জনগণের সেবা করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের যখন কোনো বৈধ আয় থাকে না, তখন তিনি যখন কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেন, তখন তার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। প্রসঙ্গক্রমেই এসে গেল মওলানা ভাসানীর কথা। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে (আমরা তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি) আমরা টাঙ্গাইলে 'হুজুরের' সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটা ভাঙা বাড়ির বারান্দায় বসিয়ে তিনি আমাদের গাছের একটি করে ক'দিনের পুরনো কলা খেতে দিয়েছিলেন। ভাসানী অগাধ সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু হননি। দুঃখী মানুষের কথা তিনি আজীবন বলে গেছেন। ইচ্ছা করলে খোদ ঢাকা শহরেই একাধিক বাড়ি তিনি করে যেতে পারতেন। তিনি কি আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি আদর্শ হতে পারতেন না? ভাসানীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে গেছেন, এটা বলা যাবে না। বরং তাদের অনেকের আর্থিক কষ্টে দিন কেটেছিল বা এখনও কাটছে। কিংবা হাজী দানেশ? কী সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ? উদাহরণ প্রসঙ্গ থাক। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিবিদ। তরুণ বয়সে এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি এক সময় আশার আলো ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু 'থলের বিড়াল' তো এখন বেরিয়ে পড়েছে। তিনি রেলের 'কালো বিড়াল' তাড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই যে 'কালো বিড়াল', তা তিনি নিজেই প্রমাণ করলেন। বিরোধী দলকে এটা আর প্রমাণ করতে হবে না।
প্রথমবার তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সেটা একটা ভালো দিক ছিল। কিন্তু সরকারপ্রধান কেন যে আবার তাকে পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনলেন, আমি তা বুঝতে আজও অক্ষম। আরও অবাক হওয়ার বিষয়_ মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হলো। কিন্তু সেন বাবু থেকে গেলেন কোনো দফতর ছাড়াই। এ ক্ষেত্রে একটা জিনিস স্পষ্ট, আর তা হচ্ছে সরকারপ্রধানের আস্থা তিনি এখনও ফিরে পাননি। এমতাবস্থায় আমি তাকে অনুরোধ করব স্বপ্রণোদিত হয়ে ছুটিতে যেতে। ইতিমধ্যে ক্যাবিনেটে তার থাকা না থাকা নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। হাইকোর্ট যখন একটি রিট শুনানির জন্য গ্রহণ করেন, তখন বুঝতে হবে আবেদনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও 'মেরিট' আছে। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, মন্ত্রীর পেছনে সরকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে। একজন মন্ত্রী শুধু 'গোলটেবিলে' বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবেন, তার জন্য তো রাষ্ট্র প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে পারে না? মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার 'ক্ষমতা' যদি না থাকে, তাহলে তার চলে যাওয়াই মঙ্গল। আমি চাইব তিনি 'ছুটিতে' যাবেন এবং সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন। তিনি ভালো বলেন। রসিকতা করেন। 'টক শো' মন্ত্রী হিসেবে তার চাহিদা অনেক বেশি। এমনিতেই সরকারের 'ঝামেলা' অনেক বেশি। একের পর এক সংকট তৈরি হচ্ছে। সরকার কোনোটারই কূল-কিনারা করতে পারছে না। হলমার্কের ঘটনার যখন কোনো 'সমাধান' সরকার দিতে পারছে না, তখন হলমার্কের বিতর্কিত এমডি তানভীর মাহমুদ 'হাটে' হাঁড়ি ভেঙে দিলেন। অভিযোগ করলেন ৫টি প্রতিষ্ঠানের (টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট, নকশি নিট, ডিএন স্পোর্টস ও খানজাহান আলী) হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রকাশ করা হচ্ছে না। এই অভিযোগের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে জানি না, তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য এই তথ্য একটি 'সূত্র'। এ বিষয়টি আমরা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলাম। কিন্তু বাস্তব যা তা হচ্ছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আমাদের অনেক ক্ষতি করে গেলেন। এর আগে আবুল হোসেনও অনেক ক্ষতি করেছেন। অনেকটা আবুল হোসেনের কারণেই বিশ্বব্যাংকের একটি পর্যবেক্ষণ দল বাংলাদেশে এলো। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা স্বীকার করেন আর না-ই করেন, মন্ত্রিসভার সদস্যদের দুর্নীতির খবর আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। এই ভাবমূর্তি আমরা কাটিয়ে উঠব কীভাবে?
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বার্ষিক আয় মাত্র ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। এটাকেই আমরা 'সত্য' বলে ধরে নিচ্ছি। আর সত্য বলে ধরে নিলে তিনি ১০ কোটি টাকা দিয়ে 'সেন মার্কেট' নির্মাণ করলেন কীভাবে? তার দেওয়া তথ্যকে ভিত্তি করে নির্বাচন কমিশন তো এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন 'নেবে' না, এটাই বাস্তব। আর দুদক আমাদের জানিয়েছে, ড্রাইভার আজমকে 'পাওয়ার' পরই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জিজ্ঞাসা করা হবে।
দুদক চেয়ারম্যানের কথায় কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।
আসলেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা 'কালো বিড়াল'। পেশা হিসেবে একজন আইনজীবী হলেও জীবনে কোনোদিন কোর্টে দাঁড়িয়েছেন, মক্কেলের জন্য লড়েছেন, তা কেউ জানে না। কিন্তু দিনে দিনে তার সম্পদ স্ফীত হয়েছে। তার জন্য সরকার একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু 'একজনের' জন্য আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে না। তিনি 'ছুটিতে' যান। দুদক বিষয়টি নিয়ে পুনর্তদন্ত করুক। সেন বাবু ক্যাবিনেটে থাকলে সুষ্ঠু তদন্ত হবে না। প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্যই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ক্যাবিনেট থেকে বিদায় নেওয়া উচিত।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
tsrahmanbd@yahoo.com
www.tsrahmanbd.blogspot.com
No comments