ভারত-স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই by অমিত বসু
কোথায় যাচ্ছ জিজ্ঞেস করলে অনেকে স্পষ্ট করে কিছু বলতে চায় না। বলে, এই একটু যাচ্ছি, কাজ আছে। গোপনীয়তার দুটি কারণ থাকতে পারে। হয়তো কাজটি খুবই তুচ্ছ, বলার মতো নয়। কিংবা গোপনীয়তা বজায় না রাখলে কাজটি বিঘি্নত হতে পারে।
আন্না হাজারে তেমনি আন্দোলনের যাত্রাপথ রহস্যাবৃত রেখেছেন প্রথম থেকেই। কেউ কিছু জানতে চাইলেই বলেছেন, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করাটাই আমার লক্ষ্য। বাক্যটি পাপরের মতো হালকা এবং মুচমুচে। খেতে ভালো, পেট ভরে না। প্রথমদিকে লোকে এর স্বাদ নিয়ে খুশি হয়েছে। পরে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য ফের আন্নার দিকে তাকিয়েছে। যদি আরও কিছু রসদের জোগান দেন সেই আশায়। খোঁচাখুঁচিতে তিতিবিরক্ত হয়ে আন্না শেষে বলেই ফেলেছেন, আমি রাজনৈতিক দল গড়তে চাই। যে দল নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় বসবে। দুর্নীতিগ্রস্তদের সাজা দেবে। তবে আমি দলের বাইরে থাকব। কথাটা আগে বললেই পারতেন। আদর্শবাদী আন্দোলনটা ভূমিকা মাত্র। উদ্দেশ্য, রাজনীতির রাস্তায় হাঁটা। ভালো ভালো কথা বলে লোকের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন। তারপর চেয়ার দখল। প্রথমে কুর্সির কথা তুললে সব আবেগ মাটিতে মিশত। মানুষ ধরে নিত, আর পাঁচটা রাজনৈতিক দল যা চায় আন্না তা-ই চাইছেন। তার উদ্দেশ্য কখনোই মহৎ নয়।
যারা মনে করে রাজনীতির দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয় না, তাদের চিন্তায় গলদ আছে। রাজনীতিতে স্বার্থপরতা-মহত্ত্ব দুই-ই লুকিয়ে থাকে। প্রকাশের তারতম্য লক্ষ্য করা যেতে পারে। অনেক সময় খারাপের চাপে ভালো মাথা তুলতে ব্যর্থ হয়। শেষমেশ সততারই জিত হয়। দেশের কল্যাণে রাজনীতির চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী আছে। সেটা সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলে দোষটা রাজনীতির নয়, যারা করছে তাদের। রাজনীতি করতে গিয়ে সংকোচের কোনো স্থান থাকতে পারে না।
শুধু ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তির লোভে যারা রাজনীতি করে তারা ক্রমে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তঞ্চকতা কখনোই সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে না। আন্না হাজারে কুমতলব নিয়ে রাজনীতির দড়ি টানাটানিতে নামছেন, এমন ভাবার কোনো কারণ ছিল না। তার সহজ-সরল জীবনযাত্রা, বারবার অনশন করে সরকারকে শাসনের দক্ষতা আশা জাগিয়েছিল। মনে হয়েছিল তিনি সত্যিই ভালো কিছু করতে চাইছেন। রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক শুদ্ধিকরণই তার ব্রত। কলঙ্কিত নেতাদের ধুয়েমুছে সাফ করাটা কি খারাপ কাজ।
সমস্যা বাধল দল গঠন নিয়ে। তার সতীর্থরা অধৈর্য হয়ে উঠলেন। চটজলদি ক্ষমতা লাভের আশায় তারা আন্নার কাঁধে চড়েছিলেন। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার নৌকা ভেবেছিলেন আন্নাকে। যখন দেখলেন সে কাজে সিদ্ধি লাভ অসম্ভব, তখন তারা আন্নার তরণি ছেড়ে অন্য সোনার তরী খুঁজতে লাগলেন, যাতে চড়ে অনায়াসে ক্ষমতার সৈকতে পেঁৗছতে বাধা নেই। আন্না বুঝলেন, রাজনীতির কথা মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে করা তার চেয়ে ঢের কঠিন। কাজটা মগজের শুধু নয়, অত্যন্ত পরিশ্রমের। একটি দেশের নদী, পাহাড়, সমুদ্র, মাটি, আকাশ, বাতাসকে যেমন চিনতে হয়, সেই সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে হয় জনজীবনের সঙ্গে। মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়াটা অত্যাবশ্যকীয়। সেটার জন্য দরকার মাটির সঙ্গে গভীর যোগাযোগ। এক জায়গায় বসে বাণী দান করে কাজ শেষ করলে চলে না। আন্না হাজারের ফাঁকি সেখানেই। দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তার কারণটা শারীরিক হতে পারে। তিনি যোগ ব্যায়াম করেন। প্রচুর ওষুধ খান। খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রিত। বয়স খুব একটা বেশি নয়। সবে সত্তর ছাড়িয়েছে। অসুস্থতার কথা উঠলেই তিনি বলেন, আমি সুস্থ। আমাকে ওষুধ খেতে হলেও ইনজেকশন নিতে হয় না। অর্থাৎ তার মতে, যতক্ষণ না শরীরে সুই ফোটানো হচ্ছে ততক্ষণ কাউকে অসুস্থ বলা যায় না। তার কথা ধরেই জিজ্ঞেস করা যায়, আপনি যদি পুরোপুরি সুস্থই হন তাহলে মহারাষ্ট্রে নিজের গ্রাম রালেগা সিদ্ধি ছেড়ে নড়েন না কেন? ভারতের মতো বিশাল দেশের কল্যাণ সাধন কি বসে বসে করা সম্ভব? দিলি্লর রামলীলা ময়দানে দু'একবার অনশনে বসা ছাড়া এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু করেননি। শেষবার অনশন মাঝপথে থামিয়েছেন বাধ্য হয়ে। কোনো সাড়া পাননি বলে।
আন্নার কথাবার্তায় মহাত্মা গান্ধীর বিকল্প হয়ে ওঠার ইচ্ছাটা স্পষ্ট। অন্য বিষয় বাদ দিলেও তার শরীরের যা অবস্থা তাতে কখনোই সেটা সম্ভব নয়। গান্ধী শেষের দিনগুলোতেও সারাদেশ চষে ফেলেছেন। ক্লান্তি জয় করে গ্রামের পর গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। রোগ-শোক-মৃত্যু তাকে ভয় পেত। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত না হলে তিনি আরও দীর্ঘদিন বাঁচতেন। তিনি অনশন, সত্যাগ্রহ বা পদযাত্রা করে অসুস্থ হতেন না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। আন্নাকে কিন্তু কথায় কথায় হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হয়। চিকিৎসার পালা শেষ হয় না। একবার ফুরোয় তো ফের শুরু হয়।
'সাউন্ড মাইন্ড ইন অ্যা সাউন্ড হেলথ' বলতে যা বোঝায় গান্ধীজি তার চূড়ান্ত উদাহরণ। গান্ধীর সঙ্গে পাল্লা দিতে আন্না যেটা করেছেন সেটা হাস্যকর। আপন মূর্তি স্থাপন করেছেন নিজ গ্রামে। তার জীবন্ত সত্তাকে পুতুল বানিয়েছেন তিনি নিজেই। কোনো কাজ না করে এভাবে কি মানুষের মন জয় কর যায়? গান্ধী কোনো ক্ষমতার চেয়ার দখল করেননি বলেই স্থান পেয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। তাকে তাচ্ছিল্য করে কমিউনিস্টরা নিজেদের পালে হাওয়া লাগাতে চেয়েছিলেন। পারেননি। গান্ধীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে তাদেরও। গান্ধীকে না মানলে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় ছিল। আন্নাকে না মানলে কারোর কি কোনো ক্ষতি আছে?
রাজনীতিকদের অভিভাবক ছিলেন গান্ধী। বিতর্কিত বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করতেন তিনি। তার সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা নয়। সেটাই স্বাভাবিক। কোনো মানুষের পক্ষেই একশ' ভাগ নির্ভুল হওয়া সম্ভব নয়। তার আদর্শ, দর্শন, একনিষ্ঠ কর্মধারা তাকে যুগোত্তীর্ণ করেছে। আন্না হাজারে গান্ধীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাইলে ক্ষতি নেই, নিজেকে গান্ধী হিসেবে জাহির করাটা শ্লেষাত্মক।
আন্না যাদের সঙ্গে নিয়ে এগোতে চাইছেন তাদের উদ্দেশ্যটাই পরিষ্কারভাবে জানা উচিত ছিল অনেক আগেই যে কী চায় তারা। কেন তারা তার চারপাশে ঘুরঘুর করেন। ঠেকে শিখছেন আন্না। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন তাদের চরিত্র। তাকে সিঁড়ি করে ক্ষমতার গাছে চড়াটাই যে সতীর্থদের অভিসন্ধি সেটা বুঝেই নিজেকে কিছুটা সরিয়ে আনতে চাইছেন। তা-ইবা পারছেন কই। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিং দেশহিতৈষী সেজে তার পাশে ছিলেন। আস্তে আস্তে ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। হরিয়ানার ভিওয়ালি লোকসভা কেন্দ্র থেকে দাঁড়াতে চান তিনি। আন্নার আরেক সহযোগী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা কিরণ বেদীর স্বপ্ন দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার। সাবেক সরকারি আমলা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জয়ের রাস্তা সাফ করতে কংগ্রেসকে টার্গেট করেছেন। সোনিয়া গান্ধীর জামাতা, প্রিয়াঙ্কার স্বামী রবার্ট ভদ্রকে কলঙ্কিত করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন।
আন্নার ছায়াসঙ্গী হয়েও কেজরিওয়াল ভরসা করছেন রামদেব বা রবিশঙ্করের মতো ধর্মীয় নেতাদের। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, শিল্পপতিরাও পিছিয়ে নেই। ভোটের বাজারে আন্নার দর কতটা মেপে দেখা হচ্ছে। আন্নার অবস্থা শোচনীয়। নদীতে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। ধান্দাবাজ নেতাদের পাশে দাঁড়ালেও বিপদ, না দাঁড়ালেও অপদস্থ হওয়ার শঙ্কা। বাধ্য হয়ে বলেছেন, কংগ্রেস মন্ত্রী কপিল সিবালের বিরুদ্ধে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দাঁড়ালে তিনি প্রচারে নামবেন। আন্না আপাতত অমর হওয়ার কথা ভাবছেন না, রক্তমাংসের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া।
অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক
যারা মনে করে রাজনীতির দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয় না, তাদের চিন্তায় গলদ আছে। রাজনীতিতে স্বার্থপরতা-মহত্ত্ব দুই-ই লুকিয়ে থাকে। প্রকাশের তারতম্য লক্ষ্য করা যেতে পারে। অনেক সময় খারাপের চাপে ভালো মাথা তুলতে ব্যর্থ হয়। শেষমেশ সততারই জিত হয়। দেশের কল্যাণে রাজনীতির চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী আছে। সেটা সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলে দোষটা রাজনীতির নয়, যারা করছে তাদের। রাজনীতি করতে গিয়ে সংকোচের কোনো স্থান থাকতে পারে না।
শুধু ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তির লোভে যারা রাজনীতি করে তারা ক্রমে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তঞ্চকতা কখনোই সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে না। আন্না হাজারে কুমতলব নিয়ে রাজনীতির দড়ি টানাটানিতে নামছেন, এমন ভাবার কোনো কারণ ছিল না। তার সহজ-সরল জীবনযাত্রা, বারবার অনশন করে সরকারকে শাসনের দক্ষতা আশা জাগিয়েছিল। মনে হয়েছিল তিনি সত্যিই ভালো কিছু করতে চাইছেন। রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক শুদ্ধিকরণই তার ব্রত। কলঙ্কিত নেতাদের ধুয়েমুছে সাফ করাটা কি খারাপ কাজ।
সমস্যা বাধল দল গঠন নিয়ে। তার সতীর্থরা অধৈর্য হয়ে উঠলেন। চটজলদি ক্ষমতা লাভের আশায় তারা আন্নার কাঁধে চড়েছিলেন। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার নৌকা ভেবেছিলেন আন্নাকে। যখন দেখলেন সে কাজে সিদ্ধি লাভ অসম্ভব, তখন তারা আন্নার তরণি ছেড়ে অন্য সোনার তরী খুঁজতে লাগলেন, যাতে চড়ে অনায়াসে ক্ষমতার সৈকতে পেঁৗছতে বাধা নেই। আন্না বুঝলেন, রাজনীতির কথা মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে করা তার চেয়ে ঢের কঠিন। কাজটা মগজের শুধু নয়, অত্যন্ত পরিশ্রমের। একটি দেশের নদী, পাহাড়, সমুদ্র, মাটি, আকাশ, বাতাসকে যেমন চিনতে হয়, সেই সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে হয় জনজীবনের সঙ্গে। মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়াটা অত্যাবশ্যকীয়। সেটার জন্য দরকার মাটির সঙ্গে গভীর যোগাযোগ। এক জায়গায় বসে বাণী দান করে কাজ শেষ করলে চলে না। আন্না হাজারের ফাঁকি সেখানেই। দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তার কারণটা শারীরিক হতে পারে। তিনি যোগ ব্যায়াম করেন। প্রচুর ওষুধ খান। খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রিত। বয়স খুব একটা বেশি নয়। সবে সত্তর ছাড়িয়েছে। অসুস্থতার কথা উঠলেই তিনি বলেন, আমি সুস্থ। আমাকে ওষুধ খেতে হলেও ইনজেকশন নিতে হয় না। অর্থাৎ তার মতে, যতক্ষণ না শরীরে সুই ফোটানো হচ্ছে ততক্ষণ কাউকে অসুস্থ বলা যায় না। তার কথা ধরেই জিজ্ঞেস করা যায়, আপনি যদি পুরোপুরি সুস্থই হন তাহলে মহারাষ্ট্রে নিজের গ্রাম রালেগা সিদ্ধি ছেড়ে নড়েন না কেন? ভারতের মতো বিশাল দেশের কল্যাণ সাধন কি বসে বসে করা সম্ভব? দিলি্লর রামলীলা ময়দানে দু'একবার অনশনে বসা ছাড়া এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু করেননি। শেষবার অনশন মাঝপথে থামিয়েছেন বাধ্য হয়ে। কোনো সাড়া পাননি বলে।
আন্নার কথাবার্তায় মহাত্মা গান্ধীর বিকল্প হয়ে ওঠার ইচ্ছাটা স্পষ্ট। অন্য বিষয় বাদ দিলেও তার শরীরের যা অবস্থা তাতে কখনোই সেটা সম্ভব নয়। গান্ধী শেষের দিনগুলোতেও সারাদেশ চষে ফেলেছেন। ক্লান্তি জয় করে গ্রামের পর গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। রোগ-শোক-মৃত্যু তাকে ভয় পেত। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত না হলে তিনি আরও দীর্ঘদিন বাঁচতেন। তিনি অনশন, সত্যাগ্রহ বা পদযাত্রা করে অসুস্থ হতেন না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। আন্নাকে কিন্তু কথায় কথায় হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হয়। চিকিৎসার পালা শেষ হয় না। একবার ফুরোয় তো ফের শুরু হয়।
'সাউন্ড মাইন্ড ইন অ্যা সাউন্ড হেলথ' বলতে যা বোঝায় গান্ধীজি তার চূড়ান্ত উদাহরণ। গান্ধীর সঙ্গে পাল্লা দিতে আন্না যেটা করেছেন সেটা হাস্যকর। আপন মূর্তি স্থাপন করেছেন নিজ গ্রামে। তার জীবন্ত সত্তাকে পুতুল বানিয়েছেন তিনি নিজেই। কোনো কাজ না করে এভাবে কি মানুষের মন জয় কর যায়? গান্ধী কোনো ক্ষমতার চেয়ার দখল করেননি বলেই স্থান পেয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। তাকে তাচ্ছিল্য করে কমিউনিস্টরা নিজেদের পালে হাওয়া লাগাতে চেয়েছিলেন। পারেননি। গান্ধীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে তাদেরও। গান্ধীকে না মানলে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় ছিল। আন্নাকে না মানলে কারোর কি কোনো ক্ষতি আছে?
রাজনীতিকদের অভিভাবক ছিলেন গান্ধী। বিতর্কিত বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করতেন তিনি। তার সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা নয়। সেটাই স্বাভাবিক। কোনো মানুষের পক্ষেই একশ' ভাগ নির্ভুল হওয়া সম্ভব নয়। তার আদর্শ, দর্শন, একনিষ্ঠ কর্মধারা তাকে যুগোত্তীর্ণ করেছে। আন্না হাজারে গান্ধীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাইলে ক্ষতি নেই, নিজেকে গান্ধী হিসেবে জাহির করাটা শ্লেষাত্মক।
আন্না যাদের সঙ্গে নিয়ে এগোতে চাইছেন তাদের উদ্দেশ্যটাই পরিষ্কারভাবে জানা উচিত ছিল অনেক আগেই যে কী চায় তারা। কেন তারা তার চারপাশে ঘুরঘুর করেন। ঠেকে শিখছেন আন্না। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন তাদের চরিত্র। তাকে সিঁড়ি করে ক্ষমতার গাছে চড়াটাই যে সতীর্থদের অভিসন্ধি সেটা বুঝেই নিজেকে কিছুটা সরিয়ে আনতে চাইছেন। তা-ইবা পারছেন কই। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিং দেশহিতৈষী সেজে তার পাশে ছিলেন। আস্তে আস্তে ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। হরিয়ানার ভিওয়ালি লোকসভা কেন্দ্র থেকে দাঁড়াতে চান তিনি। আন্নার আরেক সহযোগী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা কিরণ বেদীর স্বপ্ন দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার। সাবেক সরকারি আমলা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জয়ের রাস্তা সাফ করতে কংগ্রেসকে টার্গেট করেছেন। সোনিয়া গান্ধীর জামাতা, প্রিয়াঙ্কার স্বামী রবার্ট ভদ্রকে কলঙ্কিত করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন।
আন্নার ছায়াসঙ্গী হয়েও কেজরিওয়াল ভরসা করছেন রামদেব বা রবিশঙ্করের মতো ধর্মীয় নেতাদের। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, শিল্পপতিরাও পিছিয়ে নেই। ভোটের বাজারে আন্নার দর কতটা মেপে দেখা হচ্ছে। আন্নার অবস্থা শোচনীয়। নদীতে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। ধান্দাবাজ নেতাদের পাশে দাঁড়ালেও বিপদ, না দাঁড়ালেও অপদস্থ হওয়ার শঙ্কা। বাধ্য হয়ে বলেছেন, কংগ্রেস মন্ত্রী কপিল সিবালের বিরুদ্ধে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দাঁড়ালে তিনি প্রচারে নামবেন। আন্না আপাতত অমর হওয়ার কথা ভাবছেন না, রক্তমাংসের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া।
অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক
No comments