ডাউটই তো নেই, বেনিফিট পাবেন কিভাবে? by প্রভাষ আমিন

বিজিবি গেট কেলেঙ্কারির ঝড়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৫০ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। অনেক সাধনায় শেষ বেলায় পাওয়া মন্ত্রিত্বও যাই-যাই করেও কোনো রকমে ঝুলে আছে। মন্ত্রণালয় হারালেও মন্ত্রিত্ব টিকে আছে কোনো রকমে। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভাষায়, 'উজিরে খামোকা'র বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে আদালতে।


অনেক কষ্টে দুর্নীতি দমন কমিশনের সহায়তায় এপিএস আর রেল কর্মকর্তাদের বলির পাঁঠা বানিয়ে যখন কিছুটা গুছিয়ে আনতে পেরেছিলেন, স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আবারও মাঠ গরম করার দায়িত্ব পালন করছিলেন, নির্বাচনী মাঠ পুনরুদ্ধারের আশায় যাতায়াত শুরু করেছিলেন এলাকায়ও। তখনই আবার ঝড়, এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি নিয়ে। আরটিভিতে সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের ড্রাইভার আজম খানের সাক্ষাৎকার অনেক বেশি লক্ষ্যভেদী। আজম বুঝি সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে শেষ পেরেক ঠুকতেই হাজির হয়েছেন।
ঘটনার ছয় মাস পর ড্রাইভার আজমের হঠাৎ আবির্ভাব নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তার অনেক কয়টি যৌক্তিকও। এত দিন তিনি কোথায় ছিলেন, কে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে? এত দিন যিনি ভয়ে মুখ খোলেননি, এখন তিনি মুখ খোলার সাহস কোথায় পেলেন? দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারের গোয়েন্দারা যাঁকে খুঁজে পায়নি, একজন টিভি রিপোর্টার তাঁকে কোথায় পেলেন? সাক্ষাৎকারের পেছনে কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখা গেছে। কিন্তু এখন কৃষ্ণচূড়ার মৌসুম নয়। তার মানে আগেই এ সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয়েছিল। তবে কেন এত দিন পর সম্প্রচার? কাদের গ্রিন সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা। সাক্ষাৎকার কবে নিয়েছেন, কবে প্রচার করেছেন, এত দিন কোথায় ছিলেন- এসব প্রশ্ন তোলাই যায়। কিন্তু আজম কী বলেছেন, সেটা বিশ্বাসযোগ্য কি না আলোচনা করা উচিত সেটা নিয়ে। আজম বলেছেন, রেলে নিয়োগ-বাণিজ্যের ৭৪ লাখ টাকা নিয়ে তাঁরা তখনকার রেলপথমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায়ই যাচ্ছিলেন। তিনি আরো নিশ্চিত করেন, এর আগেও তাঁরা কয়েকবার এভাবে নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা নিয়ে মন্ত্রীর বাসায় গিয়েছেন। আজম আরো বলেছেন, ধরা পড়ার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস প্রথমে তাঁকে পাঁচ লাখ, পরে অর্ধেক, পরে পুরো টাকাটাই দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি; বরং সবাইকে ধরিয়ে দিয়েছেন। আজম ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যই তিনি সবাইকে ধরিয়ে দিয়েছেন- এটা আমি বিশ্বাস করি না। ৭৪ লাখ টাকা দিয়েও একজন ড্রাইভারকে কেনা যায়নি, এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে বিজিবি সদর দপ্তরে ঢুকে যাওয়ার পর আর আজমের ফিরে আসার সুযোগ ছিল না। আর আজম এটাও বুঝতে পেরেছিলেন, এখান থেকে একবার বেরোতে পারলে সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার তাঁকে ছাড়বে না। আর এপিএসের টাকা নিয়ে তিনি হজম করতে পারবেন না। টাকা না নিয়েও তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বারবার বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। আমিও বিশ্বাস করি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ষড়যন্ত্রের শিকার। কেউ না কেউ ড্রাইভারকে দিয়ে ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র করার, ফাঁদ পাতার সুযোগ তো করে দিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তই। তিনি বলছেন, এটা শুধু তাঁর বিরুদ্ধে নয়, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য অনেকেই ওত পেতে আছে, এটা আমরা জানি। সে জন্যই তো রাজনীতিবিদদের বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্য সুরঞ্জিত তো যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। লেনদেনটা দিনে নয়, মধ্যরাতে হতে যাচ্ছিল। এভাবে যে ঘরের দরজায় আটকে যাবেন, সেটা হয়তো ভাবতেও পারেননি তিনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পুরনো আমলের রাজনীতিবিদ। তাই তাঁর স্টাইলটাও পুরনো। এই ডিজিটাল যুগে কেউ নগদ টাকা লেনদেন করে!
ষড়যন্ত্রটা যদি সত্যি হয়, তবে টাকা যে সুরঞ্জিতের বাসায় যাচ্ছিল- এটাও তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ঘটনার পর থেকে সুরঞ্জিতের এপিএস বারবার বলছেন, টাকাটা তাঁর। আসলে তিনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। ড্রাইভার আজমও সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এপিএস তাঁকে পরে অনুরোধ করেছেন যেন মন্ত্রীকে বাঁচিয়ে তাঁকে ফাঁসানো হয়। এপিএস ওমর ফারুক কেন নীলকণ্ঠ হতে চাইছেন? ওমর ফারুক বুঝতে পেরেছিলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ফাঁসালেও তিনি নিজে বাঁচতে পারবেন না। বরং সুরঞ্জিত যদি বাঁচতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে আবার তিনি তাঁর পাশে থেকে আখের গোছাতে পারবেন। কিন্তু ড্রাইভার আজমের তো আর সে সুযোগ নেই, তাই নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেননি তিনি।
ঘটনার পর থেকেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পুরো ঘটনার জন্য মিডিয়াকে দায়ী করে আসছেন। তাঁর প্রশ্ন- এত তাড়াতাড়ি খবর পেল কিভাবে? এটা তো খুব সহজ। যাঁরা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ফাঁসাতে চেয়েছেন, তাঁরাই মিডিয়াকে খবর দিয়েছেন। আর সোর্স যে-ই হোক, এমন একটি খবর পেলে মিডিয়া তো ছুটে যাবেই। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিডিয়া ছুটে গেছে, এটা তো মিডিয়ার দক্ষতা। এর জন্য তো সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার ধন্যবাদ পাবেন। মিডিয়া যদি ছুটে গিয়ে ভুল রিপোর্ট করত, তাহলে তারা গালি শুনতে পারত। ৭৪ লাখ টাকাসহ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস এবং রেলের দুই কর্মকর্তা আটক হয়েছেন, এটা তো মিথ্যা নয়। এর সঙ্গে সুরঞ্জিত জড়িত না থাকলেও তো ঘটনা মিথ্যা হয়ে যায় না। ড্রাইভার আজমের সাক্ষাৎকার প্রচারের পরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, এটা বোগাস, মিডিয়ার সৃষ্টি। ড্রাইভার আজম কেন দাড়ি কেটে ফেলেছেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। হাস্যকর প্রশ্ন। যাঁকে পালিয়ে থাকতে হয়, তিনি তো নিজের চেহারা পাল্টানোর চেষ্টা করবেনই। ড্রাইভার আজম আরটিভির রিপোর্টার বায়েজিদকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন- এটা বোগাস হয় কিভাবে। বায়েজিদ তো আজমকে সৃষ্টি করেননি। দুদক যাঁকে খুঁজে পায়নি, বায়েজিদ তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, এটা তো তাঁর কৃতিত্ব। এর জন্য তাঁর পুরস্কার প্রাপ্য। তাঁকে কেন জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করতে হবে? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরটিভির বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। আরটিভির অপরাধটা কী? সুরঞ্জিত ড্রাইভার আজমের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন, আরটিভির বিরুদ্ধে কেন?
দুর্নীতি দমন কমিশন আগেও সুরঞ্জিতকে নির্দোষ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। ড্রাইভার আজমের সাক্ষাৎকার প্রচারের পরও দুদক চেয়ারম্যান সুরঞ্জিতের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ড্রাইভার, পিয়ন, চাপরাশির বক্তব্যের কোনো দাম নেই। কী আপত্তিকর মন্তব্য। আইনের চোখে তো সবাই সমান। দুদকের কাছেও তো মন্ত্রী আর ড্রাইভার সমান হওয়ার কথা। কে বলছেন সেটা নয়, কী বলছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ড্রাইভার আজম সত্যি বলছেন, না মিথ্যা বলছেন, দুদকের দায়িত্ব সেটা তদন্ত করা। তাঁকে খাটো করা নয়। দুদকের কাজ দুর্নীতিবাজদের ধরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দুদকের কাজ হচ্ছে রাঘব বোয়ালদের নির্দোষ বলে সার্টিফিকেট দেওয়া। তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই দুদক সৈয়দ আবুল হোসেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীকে নির্দোষ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে। দুদক যাকে নির্দোষ বলে সার্টিফিকেট দেয়, সাধারণ মানুষ তাকেই বেশি করে সন্দেহ করছে।
ড্রাইভারের সাক্ষাৎকার প্রচারের পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের কাছে বেনিফিট অব ডাউট আশা করেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষের তো কোনো ডাউটই নেই, উনি বেনিফিট পাবেন কিভাবে। এপিএস ওমর ফারুক সুরঞ্জিতকে বাঁচানোর জন্য যত চেষ্টাই করুন, নিজের ৭৪ লাখ টাকা নিয়ে তিনি মধ্যরাতে রেলওয়ের দুই কর্মকর্তাসহ ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন- এটা কাউকে বিশ্বাস করানো একটু কঠিনই। যদি সকালে হতো, তাহলে বলা যেত টাকা জমা দিতে ব্যাংকে যাচ্ছিলেন। যদি বিকেলে হতো, তাহলে বলা যেত ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাসায় যাচ্ছেন। কিন্তু মধ্যরাতে ৭৪ লাখ বৈধ টাকা নিয়ে কোনো পাগলও ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে না। তাহলে ওমর ফারুক অত টাকা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন? অত রাতে এপিএসের গাড়িতে রেলওয়ের দুই কর্মকর্তা কেন? ডাউটটা নিশ্চিত হয় তখনই, যখন সবাই জানেন, বিজিবি গেট থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসা কয়েক মিনিটের দূরত্ব। দুইয়ে দুইয়ে চারই হয়।

লেখক : সাংবাদিক, probhash2000@gmail.com
১৩.১০.২০১২

No comments

Powered by Blogger.