টক শো by কাজল ঘোষ
টকশো তাহলে আসলেই টক? যারা জোরের সঙ্গে বলেন, ‘কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়’ তাদের কাছেও? কিংবা যারা অন্যের সমালোচনায় অক্লান্ত মুখর তারাও নিজের সমালোচনা শুনতে একেবারেই নারাজ? সরকারি মহলের বিশিষ্ট জনদের নানা মত-মন্তব্য আগে থেকেই ছিল, ইদানীং তা তীব্র হয়ে উঠছে ক্রমে।
সে আক্রমণের বিষে জর্জরিত টকশো এখন ক্ষমতাসীনদের জন্য যেন সত্যিই বিস্বাদ টক। তবে টকশো নিয়ে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তির মধ্যরাতে সিঁদ কাটার গল্প এই প্রথম নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিক অনুষ্ঠানে এ নিয়ে কথা বলেছেন। দুষেছেনও। কথা হচ্ছে, কারও জবান বন্ধ করে কি প্রলয় থামানো যাবে? রাজবাড়ী জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী যেদিন টকশোতে অংশ নেয়া আলোচকদের মধ্যরাতে গলাকাটার কথা বলেছেন; ঠিক ওইদিনই দেশের প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা টকশোতেই এর জবাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের গলা কাটা হচ্ছে। সাংবাদিক সাগর-রুনিরও গলা কাটা হয়েছে। এখন প্রত্যেকেরই গলা কাটার খবর পাচ্ছি। তাকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছেন, কথার ছুরি দিয়ে তাদেরও রোজ গলা কাটা হচ্ছে। এবিএম মূসার কথার সত্যতা মিলবে ওয়ান ইলেভেনে গোয়েন্দাদের রেকর্ড করা টকশোগুলো প্রিভিউ করলেই। দুই নেত্রী যখন কারাগারে, প্রতিদিনই যখন নতুন ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সামরিক তল্পিবাহী উপদেষ্টারা ছবক দিচ্ছেন। তখন আজ প্রধানমন্ত্রী যাদের কথার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, শত্রুপক্ষ ভাবছেন, তাদের ভূমিকা কি ছিল? সেদিনের অগণতান্ত্রিক ফৌজি শাসনের প্রতিটি পদক্ষেপের কি কঠিন সমালোচনা করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরাই। মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌল্লাহ্, এবিএম মূসা, সৈয়দ আবুল মকসুদ, নূরুল কবীর, আসিফ নজরুল। তাদের গোয়েন্দাদের জীবননাশের হুমকি নিয়েই প্রতিদিন টকশোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলতে হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, তাদের সেদিনের ক্যাসেট পরীক্ষা করে দেখুন না। যখন আপনার দলের বেশির ভাগ নেতারা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে দৌঁড়ঝাপ করেছেন। উত্তরপাড়ায় ছুটেছেন। আপনারই বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন দলের অনেকে। প্রতিদিনই নানা গল্প ফাঁদা হচ্ছে। এমন দুঃসময়ে দেশের সাধারণ মানুষের পাশে তখন পার্লামেন্ট বলেন, জবাবদিহি বলেন, প্রতিবাদের আওয়াজ বলেন- তা ছিল এই টকশোগুলোই। আজ যখনই সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা করা হচ্ছে তখনই কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে মিডিয়াকে। অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ততার সূত্রে ওয়ান-ইলেভেনের জমানা, বর্তমান সরকার ও আগে জোট আমলের শাসন দেখার সুযোগ হয়েছে। তিন জমানাতেই টকশো করতে গিয়ে একইরকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। নিয়ন্ত্রণের নানা গাইডলাইন শুনতে হয়েছে। বাস্তবতার কাছে বেশির ভাগ সময়ই এগুলোকে হজম করতে হয়েছে। কথা হচ্ছে, আজ যারা আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে পরিচিত, তারা যেভাবে বর্তমানে মিডিয়ার বিরোধী পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন; জোট আমলে বিএনপিও শেষ সময়ে একই রকম ভূমিকা নিয়েছিলেন। এ যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সকল সমালোচনার পরও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তিনি টকশোতে যারা কথা বলেন তাদের মতোই স্পষ্ট কথাটি চেপে রাখেননি। মিডিয়ায় টকশো ওয়ালারা যে সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঠিক সমালোচনা করছেন তা খোলাখুলি বলে দিয়েছেন।
নিয়মিত আলোচনায় অংশ নেয়া আওয়ামী সমর্থক এক আলোচককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার সরকার ক্ষমতায় অথচ আপনাকে টকশোতে বসে নানাভাবে বিরোধিতা করতে হচ্ছে? মৃদু হেসে ওই আলোচকের জবাব ছিল, কি করবো? সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এর পক্ষে বলার কিছু নেই। সাগর-রুনি হত্যাকারীদের বিচারে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হলেও আট মাসেও ফুরোবে না। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রী গেল, উপদেষ্টা গেল তারপরও বলা হচ্ছে কোন দুর্নীতি হয়নি? এর পক্ষে বললে তো নিজের বিবেকের কাছেই দায়ী থাকবো। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য, যারা গভীর রাতে টকশোতে অংশ নেন, তাদের বিরোধী দলের লোক মনে করেন বলে প্রকাশ্য সভায় বলেছেন। ওয়ান-ইলেভেনের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তিনি নিজেই চুপসে আছেন। আর দলের সাধারণ সম্পাদক তো টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের অর্বাচীন, জ্ঞানপাপী বলতে ছাড়েননি। যাক এ-ও বিস্ময়কর এত রাত জেগে সকলেই টকশোর আলোচনা শোনেন। টকশোতে সরকারের কাউকে কাউকে যখন কোন আলোচক দুর্নীতির দায়ে ‘তুই চোর’ বলে বসেন তখন তা স্লোগানে পরিণত হয়ে যায়। এগুলো কি সবই অযৌক্তিক সরকার বিরোধী প্রলাপ?
এখনও যদি টকশোতে অংশগ্রহণকারীদেরকে কোন দলের পক্ষে বা কতজন দল নিরপেক্ষ বা কতজন সরকার সমর্থক হিসাব করা হয় বা গোপন পদ্ধতিতে যাচাই করা হয়, তাতে দেখা যাবে এদের বেশির ভাগই কোন না কোনভাবে সরকারের লোক। আর যেখানে সংসদের বেশির ভাগ লোকই সরকার পক্ষের, রাষ্ট্রযন্ত্রের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের লোকই তাদের, সেখানে বিরোধিতার স্থানটুকু কোথায়? যেখানে সংসদ চলছে একদলীয় কায়দায়। বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদে যান না। জবাবদিহি চর্চা যে সংসদে হয় না। তখন পার্লামেন্টের বিকল্প টকশো এটা বলতে দ্বিধা নেই।
সমপ্রতি টিভির লাইসেন্স না দেয়ায় প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা সরকারের সমালোচনা করছেন খোদ প্রধানন্ত্রীর এমন কথায় প্রশ্ন থাকে, সরকারের আস্থাভাজন যাদের লাইসেন্স দেয়া হলো তারা সরকারের জন্য কি করছেন? মিডিয়া সবসময়ই আওয়ামী ফ্রেন্ডলি এটা প্রচলিত। সংস্কৃতিমনা বা ভাল বলতে পারেন ভোকাল এমনদের বেশির ভাগ আওয়ামী বলয়ের সঙ্গেই কোন না কোনভাবে যুক্ত। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কাদের উদ্দেশে রাত জেগে গলা কাটার কথা বলছেন?
নানা আওয়াজ টকশো নিয়ন্ত্রণের। টকশো নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন নতুন কোন বিষয় নয়। স্বৈরাচার এরশাদের জমানায় সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ হতো প্রেস এডভাইসের মাধ্যমে। কোন খবর ছাপা যাবে আর কোন খবর ছাপা যাবে না। কোনটির গুরুত্ব কম আর কোনটিকে ব্ল্যাক আউট করতে হবে তার নির্দেশনা সন্ধ্যার পরই নিউজ টেবিলে চলে আসতো। আর টেলিভিশন বলতে ছিল সাহেব বিবি গোলামের বাক্স বিটিভি। তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিটিভি স্বায়ত্তশাসন না পেলেও গণতান্ত্রিক সরকারের আমলগুলোতে নতুন নতুন চ্যানেল বাংলাদেশে শুরু হওয়া বেসরকারি টেলিভিশনের তালিকাকে দীর্ঘ করেছে। একানব্বইতে খালেদা জিয়ার প্রথম জমানায় মিডিয়াগুলো ভাল দিয়ে শুরু করলেও শেষ দিকে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া ভাল পাওয়া যায়নি সরকারের তরফে। আসে আওয়ামী লীগ জমানা। বেসরকারি টেলিভিশনের সূচনা হয়। হানিমুন পিরিয়ড শেষে শেষ পর্যন্ত ফলাফল একই বৃত্তের দিকেই যায়। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি নিজেদের পছন্দসই ব্যক্তিদের টেলিভিশন লাইসেন্স দিলেও শেষ রক্ষা পায়নি দ্বিতীয় মেয়াদে। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার এ এক সমস্যা। ওয়ান-ইলেভেনে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। টকশোগুলো বন্ধের আলোচনা হয়েছে। সাড়াজাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের বরাতে জানা যায়, ‘বাংলাদেশী মিডিয়া ফিলিং হিট ফ্রম কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট’ শিরোনামে ২০০৭ সালের ২৬শে নভেম্বর পাঠানো তৎকালীন মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি তারবার্তায় লিখেছিলেন, বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই মিডিয়ার স্বাধীনতা একটি লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের কবিতা প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপার জন্য পিআইডি থেকে নির্দেশ ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশের ব্যাপক রাজনৈতিক দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করলেও অপরাধীদের শাস্তি হয়নি। পার্লামেন্টে সাংবাদিকদের তাচ্ছিল্য করা যেন নিয়মিত ঘটনা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের মতো করে সাংবাদিকদের রিপোর্টকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। কর্মকর্তারা বিশেষ করে টেলিভিশনের দিকেই মনোনিবেশ করেছিলেন, সংবাদপত্রের চেয়ে যা বেশি বাংলাদেশীদের কাছে পৌঁছে যায়। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই তখন টকশো বন্ধের নির্দেশও দিয়েছিল। সেসময় ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল সিএসবি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন টেলিভিশন টকশো নিয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। স্বাক্ষর ছাড়া এক গুচ্ছ নির্দেশনা টকশো প্রযোজনায় যুক্তদের পাঠানো হয়েছিল। সাংবাদিকদের অনেককেই তখন প্রতিবেদন প্রকাশ ও টকশোতে কথা বলার জন্য গোয়েন্দাদের কাছে নাজেহাল হতে হয়েছে। প্রয়াত ফয়েজ আহমদ, আতাউস সামাদ ও প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা তাদের রক্ষায় একটি সেল গঠন করেছিলেন। পরের পরিস্থিতি সকলেরই জানা। পট বদলালেও বোল বদলায়নি। গণতান্ত্রিক জমানাতেও সরকার ক্ষমতায় এসেই টকশো নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন প্রণয়নের কথা এসেছে। টকশো সংক্রান্ত খসড়ায় বলা হয়েছিল, কোন ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য, অন্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট এবং বাংলাদেশের আইনসিদ্ধ ও নির্বাচিত সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন বক্তব্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। কি সামরিক জামানা, কি গণতান্ত্রিক জমানা, কি অদ্ভূত কিসিমের সরকার তাতে টকশোর রোষানল থেমে নেই। এটাই যেন বাস্তবতা। এ সময়েও একের পর এক সম্পাদককে তাদের লেখার জন্য, খোলামেলা কথা বলার জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে- সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ টুডে সম্পাদক আসাফউদ্দৌল্লাহ, গবেষক ও কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, শীর্ষ নিউজ সম্পাদক একরামুল হক, একুশে টেলিভিশনের অঞ্জন রায়কে। কে কোন পরিস্থিতিতে কেন আদালতে গিয়েছেন তা কারও অজানা নয়। সবশেষ আরটিভিতে রেলওয়েগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য প্রতিবেদক বায়েজীদ আহমেদকে নানা হুমকি ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে।
শেষ কথা: শেষ করতে চাই, সাড়ে তিন হাজার মাইল দূরের আম্মান শহরের একটি টকশোর কথা বলে। জর্দানের রাজধানী। আরব বসন্তের ঢেউ যার কূল ছুঁয়েছে। সেখানের এক বেসরকারি টেলিভিশনের একটি টকশো এ সংক্রান্ত সকল আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। হাল আমলের পরিচিত পদ্ধতিতেই টকশো চলাকালে কথা বলার একপর্যায়ে দর্শকরা হঠাৎ দেখলো জুতা ছোড়াছুড়ি। এতেও আতঙ্কের কিছু ছিল না। চলচ্চিত্রে হরহামেশাই এ দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু... তারপর। বিতর্ক জমে ওঠে। যুক্তির বাঁধ ভেঙে একজন আরেকজনের দিকে তেড়ে যায়। সঞ্চালক নিবৃত করার চেষ্টায় একসময় হাল ছেড়ে দেয়। কে শোনে কার কথা। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। তাতেও উত্তেজনার প্রশমন হয়নি। নিজের লাইসেন্সকৃত পিস্তলটি প্রতিপক্ষের দিকে উঁচিয়ে ধরে সরকার দলীয় আলোচক। জর্দানের জু সেট টিভির একটি টকশো ছিল এটি। তাৎক্ষণিক সরাসরি সমপ্রচার এই অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া হয়। গ্রেপ্তার করা হয় পিস্তল নিয়ে তেড়ে আসা সরকার দলীয় এমপি মোহাম্মদ সায়াবকাকে। তার প্রতিপক্ষ আলোচক ছিলেন বিরোধীদলীয় সাবেক এমপি মনসুর আলদীন মুরাদ। ফিরে আসি নিজভূমে। ধন্যবাদ দিতে হয় নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর এই দেশে টকশোতে অংশ নেয়া আলোচকদের। তাদের উত্তেজনা, গালাগালি, তেড়ে আসার দৃশ্যই আমরা দেখি। পর্দার দৃশ্যমান অভিমান শেষে হ্যান্ডশেক আর কোলাকুলির মুগ্ধতা আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এটাই মতপ্রকাশের সৌন্দর্য। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, যেসব দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে না সেসব দেশে সরকার ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে উদাসীন থাকে, ফলে মৃত্যুর হার বাড়ে, দুর্ভিক্ষ প্রলম্বিত হয়। কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাবেন, খাদ্য সঙ্কটের কথা ফলাও করে প্রচার করলে খাদ্য মজুতকারী ও মুনাফাখোরদের লাভ হয়। এই বক্তব্যে আংশিক সত্যতা থাকলেও দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা সম্পর্কে সংবাদপত্রের সাহসী প্রতিবেদন সরকারকে তৎপর হতে তাড়িত করে এবং গণদুর্ভোগের ফলে প্রশমিত হয়। বাক্স্বাধীনতা নিয়ে এর চেয়ে স্পষ্ট কথা আর কি হতে পারে। যখন একটি দেশের সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের নামে দলগুলোতে চলে এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা তন্ত্র। ব্রুট মেজরিটি যেখানে সবকিছুকে কব্জা করে। সেখানে দেশের ভাল-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা প্রকাশের স্থান গণমাধ্যম ছাড়া অবশিষ্ট থাকে না। দিন শেষে যারা কথা বলেন, আর যা-ই হোক তারা নিশ্চয়ই দেশের অমঙ্গল চান না।
নিয়মিত আলোচনায় অংশ নেয়া আওয়ামী সমর্থক এক আলোচককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার সরকার ক্ষমতায় অথচ আপনাকে টকশোতে বসে নানাভাবে বিরোধিতা করতে হচ্ছে? মৃদু হেসে ওই আলোচকের জবাব ছিল, কি করবো? সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এর পক্ষে বলার কিছু নেই। সাগর-রুনি হত্যাকারীদের বিচারে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হলেও আট মাসেও ফুরোবে না। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রী গেল, উপদেষ্টা গেল তারপরও বলা হচ্ছে কোন দুর্নীতি হয়নি? এর পক্ষে বললে তো নিজের বিবেকের কাছেই দায়ী থাকবো। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য, যারা গভীর রাতে টকশোতে অংশ নেন, তাদের বিরোধী দলের লোক মনে করেন বলে প্রকাশ্য সভায় বলেছেন। ওয়ান-ইলেভেনের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তিনি নিজেই চুপসে আছেন। আর দলের সাধারণ সম্পাদক তো টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের অর্বাচীন, জ্ঞানপাপী বলতে ছাড়েননি। যাক এ-ও বিস্ময়কর এত রাত জেগে সকলেই টকশোর আলোচনা শোনেন। টকশোতে সরকারের কাউকে কাউকে যখন কোন আলোচক দুর্নীতির দায়ে ‘তুই চোর’ বলে বসেন তখন তা স্লোগানে পরিণত হয়ে যায়। এগুলো কি সবই অযৌক্তিক সরকার বিরোধী প্রলাপ?
এখনও যদি টকশোতে অংশগ্রহণকারীদেরকে কোন দলের পক্ষে বা কতজন দল নিরপেক্ষ বা কতজন সরকার সমর্থক হিসাব করা হয় বা গোপন পদ্ধতিতে যাচাই করা হয়, তাতে দেখা যাবে এদের বেশির ভাগই কোন না কোনভাবে সরকারের লোক। আর যেখানে সংসদের বেশির ভাগ লোকই সরকার পক্ষের, রাষ্ট্রযন্ত্রের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের লোকই তাদের, সেখানে বিরোধিতার স্থানটুকু কোথায়? যেখানে সংসদ চলছে একদলীয় কায়দায়। বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদে যান না। জবাবদিহি চর্চা যে সংসদে হয় না। তখন পার্লামেন্টের বিকল্প টকশো এটা বলতে দ্বিধা নেই।
সমপ্রতি টিভির লাইসেন্স না দেয়ায় প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা সরকারের সমালোচনা করছেন খোদ প্রধানন্ত্রীর এমন কথায় প্রশ্ন থাকে, সরকারের আস্থাভাজন যাদের লাইসেন্স দেয়া হলো তারা সরকারের জন্য কি করছেন? মিডিয়া সবসময়ই আওয়ামী ফ্রেন্ডলি এটা প্রচলিত। সংস্কৃতিমনা বা ভাল বলতে পারেন ভোকাল এমনদের বেশির ভাগ আওয়ামী বলয়ের সঙ্গেই কোন না কোনভাবে যুক্ত। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কাদের উদ্দেশে রাত জেগে গলা কাটার কথা বলছেন?
নানা আওয়াজ টকশো নিয়ন্ত্রণের। টকশো নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন নতুন কোন বিষয় নয়। স্বৈরাচার এরশাদের জমানায় সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ হতো প্রেস এডভাইসের মাধ্যমে। কোন খবর ছাপা যাবে আর কোন খবর ছাপা যাবে না। কোনটির গুরুত্ব কম আর কোনটিকে ব্ল্যাক আউট করতে হবে তার নির্দেশনা সন্ধ্যার পরই নিউজ টেবিলে চলে আসতো। আর টেলিভিশন বলতে ছিল সাহেব বিবি গোলামের বাক্স বিটিভি। তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিটিভি স্বায়ত্তশাসন না পেলেও গণতান্ত্রিক সরকারের আমলগুলোতে নতুন নতুন চ্যানেল বাংলাদেশে শুরু হওয়া বেসরকারি টেলিভিশনের তালিকাকে দীর্ঘ করেছে। একানব্বইতে খালেদা জিয়ার প্রথম জমানায় মিডিয়াগুলো ভাল দিয়ে শুরু করলেও শেষ দিকে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া ভাল পাওয়া যায়নি সরকারের তরফে। আসে আওয়ামী লীগ জমানা। বেসরকারি টেলিভিশনের সূচনা হয়। হানিমুন পিরিয়ড শেষে শেষ পর্যন্ত ফলাফল একই বৃত্তের দিকেই যায়। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি নিজেদের পছন্দসই ব্যক্তিদের টেলিভিশন লাইসেন্স দিলেও শেষ রক্ষা পায়নি দ্বিতীয় মেয়াদে। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার এ এক সমস্যা। ওয়ান-ইলেভেনে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। টকশোগুলো বন্ধের আলোচনা হয়েছে। সাড়াজাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের বরাতে জানা যায়, ‘বাংলাদেশী মিডিয়া ফিলিং হিট ফ্রম কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট’ শিরোনামে ২০০৭ সালের ২৬শে নভেম্বর পাঠানো তৎকালীন মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি তারবার্তায় লিখেছিলেন, বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই মিডিয়ার স্বাধীনতা একটি লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের কবিতা প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপার জন্য পিআইডি থেকে নির্দেশ ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশের ব্যাপক রাজনৈতিক দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করলেও অপরাধীদের শাস্তি হয়নি। পার্লামেন্টে সাংবাদিকদের তাচ্ছিল্য করা যেন নিয়মিত ঘটনা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের মতো করে সাংবাদিকদের রিপোর্টকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। কর্মকর্তারা বিশেষ করে টেলিভিশনের দিকেই মনোনিবেশ করেছিলেন, সংবাদপত্রের চেয়ে যা বেশি বাংলাদেশীদের কাছে পৌঁছে যায়। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই তখন টকশো বন্ধের নির্দেশও দিয়েছিল। সেসময় ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল সিএসবি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন টেলিভিশন টকশো নিয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। স্বাক্ষর ছাড়া এক গুচ্ছ নির্দেশনা টকশো প্রযোজনায় যুক্তদের পাঠানো হয়েছিল। সাংবাদিকদের অনেককেই তখন প্রতিবেদন প্রকাশ ও টকশোতে কথা বলার জন্য গোয়েন্দাদের কাছে নাজেহাল হতে হয়েছে। প্রয়াত ফয়েজ আহমদ, আতাউস সামাদ ও প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা তাদের রক্ষায় একটি সেল গঠন করেছিলেন। পরের পরিস্থিতি সকলেরই জানা। পট বদলালেও বোল বদলায়নি। গণতান্ত্রিক জমানাতেও সরকার ক্ষমতায় এসেই টকশো নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন প্রণয়নের কথা এসেছে। টকশো সংক্রান্ত খসড়ায় বলা হয়েছিল, কোন ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য, অন্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট এবং বাংলাদেশের আইনসিদ্ধ ও নির্বাচিত সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন বক্তব্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। কি সামরিক জামানা, কি গণতান্ত্রিক জমানা, কি অদ্ভূত কিসিমের সরকার তাতে টকশোর রোষানল থেমে নেই। এটাই যেন বাস্তবতা। এ সময়েও একের পর এক সম্পাদককে তাদের লেখার জন্য, খোলামেলা কথা বলার জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে- সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ টুডে সম্পাদক আসাফউদ্দৌল্লাহ, গবেষক ও কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, শীর্ষ নিউজ সম্পাদক একরামুল হক, একুশে টেলিভিশনের অঞ্জন রায়কে। কে কোন পরিস্থিতিতে কেন আদালতে গিয়েছেন তা কারও অজানা নয়। সবশেষ আরটিভিতে রেলওয়েগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য প্রতিবেদক বায়েজীদ আহমেদকে নানা হুমকি ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে।
শেষ কথা: শেষ করতে চাই, সাড়ে তিন হাজার মাইল দূরের আম্মান শহরের একটি টকশোর কথা বলে। জর্দানের রাজধানী। আরব বসন্তের ঢেউ যার কূল ছুঁয়েছে। সেখানের এক বেসরকারি টেলিভিশনের একটি টকশো এ সংক্রান্ত সকল আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। হাল আমলের পরিচিত পদ্ধতিতেই টকশো চলাকালে কথা বলার একপর্যায়ে দর্শকরা হঠাৎ দেখলো জুতা ছোড়াছুড়ি। এতেও আতঙ্কের কিছু ছিল না। চলচ্চিত্রে হরহামেশাই এ দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু... তারপর। বিতর্ক জমে ওঠে। যুক্তির বাঁধ ভেঙে একজন আরেকজনের দিকে তেড়ে যায়। সঞ্চালক নিবৃত করার চেষ্টায় একসময় হাল ছেড়ে দেয়। কে শোনে কার কথা। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। তাতেও উত্তেজনার প্রশমন হয়নি। নিজের লাইসেন্সকৃত পিস্তলটি প্রতিপক্ষের দিকে উঁচিয়ে ধরে সরকার দলীয় আলোচক। জর্দানের জু সেট টিভির একটি টকশো ছিল এটি। তাৎক্ষণিক সরাসরি সমপ্রচার এই অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া হয়। গ্রেপ্তার করা হয় পিস্তল নিয়ে তেড়ে আসা সরকার দলীয় এমপি মোহাম্মদ সায়াবকাকে। তার প্রতিপক্ষ আলোচক ছিলেন বিরোধীদলীয় সাবেক এমপি মনসুর আলদীন মুরাদ। ফিরে আসি নিজভূমে। ধন্যবাদ দিতে হয় নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর এই দেশে টকশোতে অংশ নেয়া আলোচকদের। তাদের উত্তেজনা, গালাগালি, তেড়ে আসার দৃশ্যই আমরা দেখি। পর্দার দৃশ্যমান অভিমান শেষে হ্যান্ডশেক আর কোলাকুলির মুগ্ধতা আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এটাই মতপ্রকাশের সৌন্দর্য। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, যেসব দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে না সেসব দেশে সরকার ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে উদাসীন থাকে, ফলে মৃত্যুর হার বাড়ে, দুর্ভিক্ষ প্রলম্বিত হয়। কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাবেন, খাদ্য সঙ্কটের কথা ফলাও করে প্রচার করলে খাদ্য মজুতকারী ও মুনাফাখোরদের লাভ হয়। এই বক্তব্যে আংশিক সত্যতা থাকলেও দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা সম্পর্কে সংবাদপত্রের সাহসী প্রতিবেদন সরকারকে তৎপর হতে তাড়িত করে এবং গণদুর্ভোগের ফলে প্রশমিত হয়। বাক্স্বাধীনতা নিয়ে এর চেয়ে স্পষ্ট কথা আর কি হতে পারে। যখন একটি দেশের সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের নামে দলগুলোতে চলে এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা তন্ত্র। ব্রুট মেজরিটি যেখানে সবকিছুকে কব্জা করে। সেখানে দেশের ভাল-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা প্রকাশের স্থান গণমাধ্যম ছাড়া অবশিষ্ট থাকে না। দিন শেষে যারা কথা বলেন, আর যা-ই হোক তারা নিশ্চয়ই দেশের অমঙ্গল চান না।
No comments