কথা সামান্যই-একজন শিক্ষকের কথা by ফজলুল আলম
শিক্ষা, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষানীতি নিয়ে আমরা সুগভীর কথাবার্তা শুনি এবং মনে করি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়েই দেশকে যথাযথভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। এই শিক্ষা থেকেই আগামী প্রজন্ম দেশে প্রয়োজনীয় অবদান রাখবে।
কথাগুলো সবই সঠিক, কিন্তু এত কথার মধ্যে আমরা ভুলে যাই শিক্ষকের অবদানের কথা। আমার ধারণায় ও অভিজ্ঞতায় (স্কুল থেকে শুরু করে দেশের ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ত) শিক্ষকের মধ্যে রকমভেদ আছে। একদল শিক্ষক আছেন যাঁরা শিক্ষাপ্রদানকে একটি কর্মসংস্থান হিসেবে দেখেন। অনেকটা অফিস-আদালতে বা পেশাজীবী কাজের মতো মনে করলেও তাঁরা শিক্ষাকে একটি উচ্চ পেশা মনে করেন, কিন্তু শিক্ষকদের বেতন-ভাতার করুণ দশায় এই পেশায় যথেষ্ট মনোযোগ দিতে সক্ষম হন না। অন্য একদল শিক্ষককে আমি দেখেছি তাঁরা শুরু থেকেই শিক্ষাপ্রদানকে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের উন্নতিতে পূর্ণভাবে নিজেদের নিবেদিত করেন। তাঁরাও শিক্ষকদের প্রতি সরকারি-বেসরকারি অবহেলা ও বেতন-ভাতার করুণ দশায় বিচলিত থাকেন; কিন্তু সেসবকে শিক্ষাপ্রদানে বাধা মনে করেন না। তাঁরা শিক্ষাপ্রদান ও ছাত্রছাত্রীদের প্রতিভার বিকাশে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেন। এই দ্বিতীয় ধরনের শিক্ষকরা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অমর হয়ে থাকেন।
এই রকম একজন শিক্ষক ছিলেন তাজমিলুর রহমান। তাঁকে আমি পেয়েছিলাম ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বগুড়া জিলা স্কুলে। তিনি কী কী পড়াতেন তা আমার মনে নেই, তবে তিনি যখন বাংলা ক্লাস নিতেন তখন মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তিনি এত সাবলীলভাবে বইপত্রের সাহায্য ছাড়াই পড়াতেন যে মনে হতো আমরা গল্প শুনছি। সে সময়ে গরমে টানা পাখা ছিল। তাজমিলুর স্যার মাঝেমধ্যে সেই টানা পাখার ঝালরপ্রান্ত ধরে থাকতেন। একদিন তাঁর টানে কিছু অংশ ওপরের কাঠ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর তিনি আর পাখা ধরে টানাটানি করেননি। তাঁর পোশাক ছিল পায়জামা ও সাধারণ পাঞ্জাবি, কিন্তু তাঁর অবয়বে কী একটা জ্যোতি ছিল যে জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে কথা শুনতে সবাই আগ্রহী হতো। এমনকি ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরাও তাঁর ক্লাসে কখনো গোল পাকিয়েছে বলে মনে নেই। আর একটা বিষয় ছিল তিনি কখনো বেত দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে দৈহিক শাস্তি দিতেন না।
স্যার যে বছর জিলা স্কুলে যোগ দিলেন সেই বছর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্কুলের একজন ছাত্র সাইফুল ইসলাম (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনেত্রী মৌয়ের বাবা) সারা দেশের মধ্যে দশম স্থান অর্জন করে। তাকে স্বাগত জানাতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেটার ভার পেয়েছিলেন তাজমিলুর রহমান স্যার।
তারপর তিনি নিয়মিতভাবে প্রতি শনিবার ক্লাস শেষে (সে সময় রবিবার ছিল ছুটির দিন) একটি 'সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান' করার ভার পান। আমি পড়াশোনায় যেটুকু ভালো ছিলাম, বক্তা হিসেবে শূন্য। তার ওপরে আমি ছিলাম 'তোতলা'। কিন্তু তাজমিলুর স্যার আমাকে দিয়ে আবৃত্তি করাবেনই। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হয়ে গেল যখন আবৃত্তি করতে গিয়ে তোতলাইনি। সেই থেকে আমি নিয়মিত আবৃত্তিকার হয়ে উঠলাম। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভারপ্রাপ্ত বলেই হয়তো আমি যখন 'স্ফুলিঙ্গ' নামের দেয়াল পত্রিকা বের করব বলে ঠিক করে তাঁকে জানালাম, তখন তিনি পূর্ণ সমর্থন দিলেন। নামের কথাও জিজ্ঞাসা করলেন। সে সময় আমাদের একটা দ্রুতপঠন বইয়ে লেনিনের জীবনী ছিল। আমি অকপটে বললাম যে লেনিনের পত্রিকা 'ইসক্রা' শব্দটির অনুবাদ করেছি। তিনি খুবই খুশি হয়ে সম্মতি দিলেন এবং মনে হয় কয়েক সংখ্যার জন্য সামান্য কিছু খরচও দিয়েছিলেন (তখন দুই আনায় ব্রড সাইজের কার্টিজ পেপার পাওয়া যেত)। বড় ভাইদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া পেইন্ট বক্সের ওয়াটার কালার ও সাধারণ কালিতেই পত্রিকা বের হতো। ইতিমধ্যে আজাদের মুকুলের মহফিলে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হলাম (দশ টাকা পেয়েছিলাম)। বিষয় ছিল পিকনিক। আমি এঁকেছিলাম হতদরিদ্র এক নারী ও দুই শিশুর জঙ্গলে মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না করার দৃশ্য। জয়নুল আবেদিন থেকে কপি করে একটা কাককেও একপাশে বসিয়ে দিয়েছিলাম। পরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্যার সেটা সবাইকে দেখালেন ও আমার আঁকা পিকনিকের বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েক মিনিট কথাও বললেন। আমার জীবনের যতগুলো পরম প্রাপ্তি আছে, তার মধ্যে স্যারের সেই বক্তব্য একটি। স্কুল ছাড়ার পরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদাই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, বিশেষত, লেখালেখিতে তাজমিলুর স্যারের উৎসাহ দেওয়ার কথা মনে পড়ত, মনে পড়ে আজও।
জানি না স্যারের সংস্পর্শে আসা অন্য সফল ব্যক্তির কী অভিমত হবে, তবে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ও অধ্যাপক জাফর ইকবালও তাঁর ছাত্র ছিলেন। দুজনই এ দেশের প্রতিষ্ঠিত জগৎজোড়া সুনাম পাওয়া ব্যক্তিত্ব। আরো অনেকে আছেন, তাঁদের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। বছর চারেক আগে আমি বগুড়া জিলা স্কুলে 'সভ্যতার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক' নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম। তাতে তাজমিলুর স্যার ছিলেন চেয়ার। হেডমাস্টার ছিলেন প্রধান অতিথি। সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম। স্যার তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, 'বাইরের এই বাতাসহীন অবস্থায় তোমরা যা বললে তাতে এই ছোট্ট ঘরে একটা ঝড় বইয়ে দিলে।'
স্যার জানতেন না যে তিনি কত ছাত্রের জীবনে ঝড় বইয়ে দিয়েছেন। শুরুতে বলেছি শিক্ষা, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষানীতির কথা, কিন্তু সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছাড়া সেসব যে অর্থহীন হয়ে পড়ে সেটাও আমরা জানি। তাজমিলুর রহমান ছিলেন একজন বিশাল ব্যতিক্রম। তাঁর স্মৃতি অম্লান হয়ে রবে।
লেখক : কথাশিল্পী ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
এই রকম একজন শিক্ষক ছিলেন তাজমিলুর রহমান। তাঁকে আমি পেয়েছিলাম ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বগুড়া জিলা স্কুলে। তিনি কী কী পড়াতেন তা আমার মনে নেই, তবে তিনি যখন বাংলা ক্লাস নিতেন তখন মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তিনি এত সাবলীলভাবে বইপত্রের সাহায্য ছাড়াই পড়াতেন যে মনে হতো আমরা গল্প শুনছি। সে সময়ে গরমে টানা পাখা ছিল। তাজমিলুর স্যার মাঝেমধ্যে সেই টানা পাখার ঝালরপ্রান্ত ধরে থাকতেন। একদিন তাঁর টানে কিছু অংশ ওপরের কাঠ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর তিনি আর পাখা ধরে টানাটানি করেননি। তাঁর পোশাক ছিল পায়জামা ও সাধারণ পাঞ্জাবি, কিন্তু তাঁর অবয়বে কী একটা জ্যোতি ছিল যে জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে কথা শুনতে সবাই আগ্রহী হতো। এমনকি ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরাও তাঁর ক্লাসে কখনো গোল পাকিয়েছে বলে মনে নেই। আর একটা বিষয় ছিল তিনি কখনো বেত দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে দৈহিক শাস্তি দিতেন না।
স্যার যে বছর জিলা স্কুলে যোগ দিলেন সেই বছর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্কুলের একজন ছাত্র সাইফুল ইসলাম (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনেত্রী মৌয়ের বাবা) সারা দেশের মধ্যে দশম স্থান অর্জন করে। তাকে স্বাগত জানাতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেটার ভার পেয়েছিলেন তাজমিলুর রহমান স্যার।
তারপর তিনি নিয়মিতভাবে প্রতি শনিবার ক্লাস শেষে (সে সময় রবিবার ছিল ছুটির দিন) একটি 'সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান' করার ভার পান। আমি পড়াশোনায় যেটুকু ভালো ছিলাম, বক্তা হিসেবে শূন্য। তার ওপরে আমি ছিলাম 'তোতলা'। কিন্তু তাজমিলুর স্যার আমাকে দিয়ে আবৃত্তি করাবেনই। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হয়ে গেল যখন আবৃত্তি করতে গিয়ে তোতলাইনি। সেই থেকে আমি নিয়মিত আবৃত্তিকার হয়ে উঠলাম। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভারপ্রাপ্ত বলেই হয়তো আমি যখন 'স্ফুলিঙ্গ' নামের দেয়াল পত্রিকা বের করব বলে ঠিক করে তাঁকে জানালাম, তখন তিনি পূর্ণ সমর্থন দিলেন। নামের কথাও জিজ্ঞাসা করলেন। সে সময় আমাদের একটা দ্রুতপঠন বইয়ে লেনিনের জীবনী ছিল। আমি অকপটে বললাম যে লেনিনের পত্রিকা 'ইসক্রা' শব্দটির অনুবাদ করেছি। তিনি খুবই খুশি হয়ে সম্মতি দিলেন এবং মনে হয় কয়েক সংখ্যার জন্য সামান্য কিছু খরচও দিয়েছিলেন (তখন দুই আনায় ব্রড সাইজের কার্টিজ পেপার পাওয়া যেত)। বড় ভাইদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া পেইন্ট বক্সের ওয়াটার কালার ও সাধারণ কালিতেই পত্রিকা বের হতো। ইতিমধ্যে আজাদের মুকুলের মহফিলে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হলাম (দশ টাকা পেয়েছিলাম)। বিষয় ছিল পিকনিক। আমি এঁকেছিলাম হতদরিদ্র এক নারী ও দুই শিশুর জঙ্গলে মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না করার দৃশ্য। জয়নুল আবেদিন থেকে কপি করে একটা কাককেও একপাশে বসিয়ে দিয়েছিলাম। পরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্যার সেটা সবাইকে দেখালেন ও আমার আঁকা পিকনিকের বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েক মিনিট কথাও বললেন। আমার জীবনের যতগুলো পরম প্রাপ্তি আছে, তার মধ্যে স্যারের সেই বক্তব্য একটি। স্কুল ছাড়ার পরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদাই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, বিশেষত, লেখালেখিতে তাজমিলুর স্যারের উৎসাহ দেওয়ার কথা মনে পড়ত, মনে পড়ে আজও।
জানি না স্যারের সংস্পর্শে আসা অন্য সফল ব্যক্তির কী অভিমত হবে, তবে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ও অধ্যাপক জাফর ইকবালও তাঁর ছাত্র ছিলেন। দুজনই এ দেশের প্রতিষ্ঠিত জগৎজোড়া সুনাম পাওয়া ব্যক্তিত্ব। আরো অনেকে আছেন, তাঁদের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। বছর চারেক আগে আমি বগুড়া জিলা স্কুলে 'সভ্যতার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক' নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম। তাতে তাজমিলুর স্যার ছিলেন চেয়ার। হেডমাস্টার ছিলেন প্রধান অতিথি। সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম। স্যার তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, 'বাইরের এই বাতাসহীন অবস্থায় তোমরা যা বললে তাতে এই ছোট্ট ঘরে একটা ঝড় বইয়ে দিলে।'
স্যার জানতেন না যে তিনি কত ছাত্রের জীবনে ঝড় বইয়ে দিয়েছেন। শুরুতে বলেছি শিক্ষা, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষানীতির কথা, কিন্তু সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছাড়া সেসব যে অর্থহীন হয়ে পড়ে সেটাও আমরা জানি। তাজমিলুর রহমান ছিলেন একজন বিশাল ব্যতিক্রম। তাঁর স্মৃতি অম্লান হয়ে রবে।
লেখক : কথাশিল্পী ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments