রক্তস্রোতের রাজনীতি by আতাউস সামাদ
শাসক আওয়ামী লীগ দলের জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপসের ওপর বোমা হামলার নিন্দা জানাই ও প্রতিবাদ করি আমরা। হামলাকারীর বোমা সামান্যের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি কোনো রকম আঘাতও পাননি। হত্যা ও অন্যান্য ধরনের সহিংসতা আইনের চোখে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রাজনৈতিক, গোষ্ঠীগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নীতির দিক থেকেও পরিত্যাজ্য। কারণ ওই ধরনের সন্ত্রাস ও সহিংসতা দেশের এবং সমাজের শান্তিশৃগ্ধখলা ধ্বংস করে। ফজলে নূর তাপস যে একজন আইনজীবী ও সংসদ সদস্য, এ কথার মধ্যেই তার পরিচয় সীমাবদ্ধ নয়। তার অন্য পরিচয়গুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে। শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বঙ্গবন্ব্দু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগসল্ট সেনা বিদ্রোহীরা বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একই সময়ে তাকেও হত্যা করে। এদিক থেকে বাংলাদেশের একটি দুঃখজনক অধ্যায়ের তীব্র যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপস। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ব্দু তনয়া শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে বিধায় তার সঙ্গেও ১৫ আগসেল্টর বেদনার অংশীদার। এরই মধ্যে ফজলে নূর তাপস আওয়ামী লীগের নেতাদের কাতারে পৌঁছে গেছেন। তিনি রাজধানী ঢাকার এমন একটি আসন থেকে গত নির্বাচনে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন, যেখানে উচ্চশিক্ষিত, বোদ্ধা এবং ধনবান ভোটারের সংখ্যা অনেক। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এ এলাকায়। আর আছে বিডিআর সদর দফতর। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিডিআর সৈনিকদের একটি দল তাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সমর্থন পাওয়ার জন্য তার সঙ্গে দেখা করে বলে কয়েকজন বিডিআর বিদ্রোহী তদন্তকারীদের বলেছেন। তারা বলেন, তাপস তাদের মাত্র কয়েকটি দাবি তুলে ধরতে পারবেন বলে জানান। ফজলে নূর তাপস তদন্তকারীদের কাছে একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন, যার বিস্তারিত আমাদের জানা নেই। এরই মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল আদালতে বঙ্গবন্ব্দু হত্যা মামলার চূড়ান্ত আপিল শুনানিতে তাকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী দলের সদস্য করা হয়েছে। এ ছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে সম্ভবত তিনি আপাতত বন্ব্দ দৈনিক পত্রিকা বাংলার বাণীর মালিক। তার বাবা শেখ মনি এ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। সব কিছু মিলিয়ে শাসক দলে ও সরকারি বলয়ে তার গুরুত্ব ও প্রভাব অনেক বলেই প্রতীয়মান হয়। ফলে স্বভাবতই ফজলে নূর তাপসের ওপর বোমা হামলা দেশ, সরকার ও রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এ বোমা হামলা নেতৃস্থানীয় ও বিভিন্ন পেশায় গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিতে ও অপরাধ জগতে বোমাবাজির প্রত্যাবর্তন ঘটল— এরকম আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। দেশে গণতন্ত্র চালু থাকলে নাগরিকরা অন্যান্য শত কষ্টের মধ্যেও যে একরকম স্বস্তিকর পরিবেশে বাস করেন তা ছেড়ে আমরা কি একটি ভীতিকর পরিস্থিতির দিকে চলেছি? ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের ওপর আক্রমণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা ও কয়েকজন মন্ত্রীর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল—বঙ্গবন্ব্দু হত্যা মামলার শুনানি বন্ব্দ করার জন্য তাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। হামলার পরদিন (বৃহস্পতিবার) ফজলে নূর তাপস মতিঝিল থানায় যে মামলা দায়ের করেছেন তাতে তিনি ঘটনাটিকে বঙ্গবন্ব্দু হত্যা মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা ও দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন (সূত্র : প্রথম আলো পত্রিকা)। গত শনিবার টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, তিনি বলছেন তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে ভয় পেয়ে সরকার বঙ্গবন্ব্দু হত্যা মামলার রায় কার্যকর না করে। স্মরণ করা যেতে পারে, এ মামলায় ১২ জন ফাঁসির আসামি আছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন জেলে বন্দি আর সাতজন পলাতক। জনাব তাপস হত্যা-প্রচেষ্টা মামলায় পুলিশ গত শনিবার পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। তাদের একজন হলেন শেখ মুজিব হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মেজর শরিফুল হক ডালিমের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা লে. (অব.) কামরুল হক স্বপন। আরেকজন হচ্ছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্নেল খোন্দকার আবদুর রশীদের মেয়ে মেহনাজ রশীদ খন্দকার। তৃতীয় ব্যক্তি হলেন আবদুর রহিম, যার পরিচয় বলা হচ্ছে ১৫ আগসল্ট ১৯৭৫ বিদ্রোহের নেতা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দল ফিদ্ধডম পার্টির একজন সদস্য। এ দলটি আশির দশকে সেনা শাসক লে. জে. স্লসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে কাজ শুরু করে। ওই দলের প্রার্থী হিসেবে কর্নেল ফারুক ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেল এরশাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জেনারেল এরশাদ এখন একজন সংসদ সদস্য। তার দল জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক দল। ১৯৯৬-এর মধ্য ফেব্রুয়ারির চরম বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফিদ্ধডম পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং সেই অতিশয় ক্ষণস্থায়ী ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে কর্নেল রশীদ বিরোধী নেতা হন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো তখন যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বয়কট করে ও পরে সফলভাবে অবরোধ আন্দোলন করে—ওই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ মাত্র একটি অধিবেশন করে বিএনপির নেতৃত্বে সংবিধান সংশোধনপূর্বক তাতে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা সংবলিত অনুচ্ছেদটি সংযোজন করেছিল। সংবিধানে ওই ব্যবস্থা এখনও বলবত্ আছে, তবে আওয়ামী লীগ সেটি এখন তুলে দিতে চাইছে। ১৯৯৬-এর জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করার পর ফিদ্ধডম পার্টি মোটামুটি নিষ্কিদ্ধয় হয়ে পড়ে বা দৃষ্টির প্রায় আড়ালে চলে যায়। ১৯৯৬-এর আগেই দলটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। এখন কামরুল হক স্বপন ও মেহনাজ রশীদের গ্রেফতার সবাইকে চমকে দিয়েছে। ফিদ্ধডম পার্টির নাম আবার দৈনিক পত্রিকার পাতায় ফিরে এসেছে। অবশ্য আটক মেহনাজ রশীদ ফিদ্ধডম পার্টির নামে দুবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন; কিন্তু তাতেও ওই দল তেমন প্রচার পায়নি। মেহনাজ রশীদ নির্বাচনে দু’বারই পরাজিত হন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপস তার অভিযোগে যা বলেছেন ও তার সমর্থনে যেসব তথ্য দিয়েছেন তার ভিত্তিতে ‘তদন্ত’ করে তারা মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হক স্বপন ও কর্নেল (অব.) রশীদের মেয়ে মেহনাজ রশীদকে গ্রেফতার করেছেন। তবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এও বলেছেন, তারা তদন্তের অন্যান্য দৃষ্টিকোণ খোলা রেখেছেন। প্রসঙ্গত, একটি চমকপ্রদ তথ্য সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেটি হলো নিহত শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপস ও ১৫ আগসল্ট ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ডের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মেজর (অব.) শরীফুল হক ডালিমের ছোট ভাই ’৭১-এর ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হক স্বপন একই ইমারতে আলাদা দুই ফ্ল্যাটে বাস করছিলেন (সূত্র : টেলিভিশন সংবাদ)। ফজলে নূর তাপস হত্যা-প্রচেষ্টা মামলার তদন্তে কী বের হবে তা বাংলাদেশ পুলিশই বলতে পারে। এখনও সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার ও জেরা চলছে। তবে কামরুল হক স্বপনকে আট দিনের এবং মেহনাজ রশীদকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়ায় অনুমান করা যায় যে, পুলিশ তাদের গভীরভাবে সন্দেহ করছে। ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপস নিজেও সাংবাদিকদের কাছে স্বপন সম্পর্কে তার সন্দেহের কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি বিস্তারিত আলাপ করেন গত শনিবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু তার বাড়িতে তাকে দেখতে গেলে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপসকে হত্যার চেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, রাজনীতিতে হঠাত্ করেই একটা গুমোট ভাব এসে গেছে এ ন্যক্কারজনক বোমা হামলার ফলে। তারপরের কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে আরও ধারণা জন্মাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ব্দু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্যরা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের হত্যার মধ্য দিয়ে যে রক্তস্রোত বইতে শুরু করে তা এখন যেন আদালত, বিচার ও রাজনীতি ছাড়িয়ে এমন একটা পরিবারভিত্তিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়ে গেছে বা হতে যাচ্ছে যা বংশপরম্পরায় চলতে থাকবে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে এমন দ্বন্দ্বের দেখা মেলে। এগুলো শেষ হওয়ার আগে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। গত বুধবার রাতে সংঘটিত বোমা হামলাটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যকার দূরত্ব আরও বাড়াবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সল্টকহোমে প্রবাসী আওয়ামী লীগারদের এক সভায় বলেছেন, ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপসের জীবননাশের চেষ্টার পেছনে তাদেরও হাত আছে যারা বঙ্গবন্ব্দুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের শুধু প্রশ্রয়ই দেয়নি, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোয় চাকরি দিয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উপলক্ষে একটি সরকারি-বেসরকারি মিশ্র সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে এক মঞ্চ থেকে ভাষণ দেয়ার একটি উদ্যোগ নেন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। বেগম জিয়া প্রথমে ওই সম্মেলন বা ভিআইপি সমাবেশে যোগ দিতে রাজি হলেও পরে ঘোষণা দিয়েই সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তার বক্তব্য ছিল যে তার মামলায় সরকারের বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ এবং তার দলের ওপর সরকারি নিপীড়ন লাগাতার চলছে বিধায় এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে উঠলে ওই ‘বেআইনি’ কাজকর্ম ও নির্যাতনকে বৈধতা দেয়া হবে। তারপর অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেন যে, বেগম জিয়া জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার এমন একটা মহতী উদ্যোগ নষ্ট করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাকে এ বিষয়ে বিদ্রূপ করেন। অন্যদিকে বেগম জিয়া বলেছেন, তারা সরকারের প্রতি বারবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, কিন্তু অপরপক্ষ থেকে যথাযথ সাড়া মেলেনি। তবে তারা মুখে যাই বলুন না কেন, আমাদের মনে হয় যে তাঁদের মধ্যে একে অপরের প্রতি গভীর সন্দেহ ও বিদ্বেষ বিরাজমান, যার শুরু সুদূর অতীত থেকে। শেখ হাসিনা এখন আর একথা গোপন করেন না যে, তিনি খালেদা জিয়ার স্বামী নিহত রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল জিয়াকে তার বাবা বঙ্গবন্ব্দু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চক্রান্তকারীদের একজন বলে মনে করেন। ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যার পর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘জিয়া বঙ্গবন্ব্দু হত্যার বেনিফিশিয়ারি’। প্রশ্নটি ছিল তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ব্দু হত্যার সঙ্গে জড়িত মনে করেন কিনা। এর কিছুদিন পর থেকে তিনি জেনারেল জিয়াকে ‘খুনি’ বলে অভিহিত করতেন এ কারণে যে, তার আমলে সশস্ত্র বাহিনীতে যেসব বিদ্রোহ হয় সেজন্য অনেক সৈনিককে তিনি ফাঁসি দিয়েছিলেন। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর যাবত্ শেখ হাসিনা জেনারেল জিয়াকে মুজিব হত্যার চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত বলে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ব্দু হত্যার আসামিদের জেনারেল জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে যে বিভিন্নভাবে চাকরি দেয়া হয় সে কথাও তিনি সবাইকে প্রায়ই মনে করিয়ে দেন। ২০০৪ সালের ২১ আগসল্ট বঙ্গবন্ব্দু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার যে চেষ্টা চালানো হয় তাতেও বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার জড়িত ছিল বলে তিনি শুরু থেকেই অভিযোগ করে এসেছেন। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জিয়া হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছে আর বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলকে তো সমর্থন করেছেই। এ ছাড়াও তিনি ১৯৯৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশজুড়ে অবরোধ করে বিরোধীরা যখন তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে তখন সচিবালয়ের কিছু কর্মকর্তা যে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এক ‘জনতার মঞ্চ’ গড়ে প্রশাসনকে অচল করে দেয় সেই ঘটনাকে বেগম খালেদা জিয়া একটি ‘সিভিলিয়ান ক্যু’ (বেসামরিক অভ্যুত্থান) বলে অভিহিত করেছেন এবং তিনি এটিকে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র বলেই মনে করেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন দুরূহ হয়ে পড়েছে। তদুপরি দু’পক্ষ যদি একে অপরকে ‘খুনি’ বা হত্যার ষড়যন্ত্রকারী বলে প্রচার চালিয়ে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয় তাহলে তো তারা শত্রুতার পথকেই উত্তম পথ বলে বেছে নেবে। তারা হয়তো এটাকেই ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ’ বলে বিশ্বাস করবে। তদুপরি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেখানে নীতিকেন্দ্রিক নয় সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য আগ্রহীদের কাছে এরকম ‘মেরুকরণ’ই মূল্যবান মনে হওয়া স্বাভাবিক।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপসকে হত্যার চেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, রাজনীতিতে হঠাত্ করেই একটা গুমোট ভাব এসে গেছে এ ন্যক্কারজনক বোমা হামলার ফলে। তারপরের কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে আরও ধারণা জন্মাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ব্দু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্যরা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের হত্যার মধ্য দিয়ে যে রক্তস্রোত বইতে শুরু করে তা এখন যেন আদালত, বিচার ও রাজনীতি ছাড়িয়ে এমন একটা পরিবারভিত্তিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়ে গেছে বা হতে যাচ্ছে যা বংশপরম্পরায় চলতে থাকবে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে এমন দ্বন্দ্বের দেখা মেলে। এগুলো শেষ হওয়ার আগে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। গত বুধবার রাতে সংঘটিত বোমা হামলাটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যকার দূরত্ব আরও বাড়াবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সল্টকহোমে প্রবাসী আওয়ামী লীগারদের এক সভায় বলেছেন, ব্যারিসল্টার ফজলে নূর তাপসের জীবননাশের চেষ্টার পেছনে তাদেরও হাত আছে যারা বঙ্গবন্ব্দুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের শুধু প্রশ্রয়ই দেয়নি, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোয় চাকরি দিয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উপলক্ষে একটি সরকারি-বেসরকারি মিশ্র সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে এক মঞ্চ থেকে ভাষণ দেয়ার একটি উদ্যোগ নেন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। বেগম জিয়া প্রথমে ওই সম্মেলন বা ভিআইপি সমাবেশে যোগ দিতে রাজি হলেও পরে ঘোষণা দিয়েই সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তার বক্তব্য ছিল যে তার মামলায় সরকারের বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ এবং তার দলের ওপর সরকারি নিপীড়ন লাগাতার চলছে বিধায় এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে উঠলে ওই ‘বেআইনি’ কাজকর্ম ও নির্যাতনকে বৈধতা দেয়া হবে। তারপর অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেন যে, বেগম জিয়া জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার এমন একটা মহতী উদ্যোগ নষ্ট করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাকে এ বিষয়ে বিদ্রূপ করেন। অন্যদিকে বেগম জিয়া বলেছেন, তারা সরকারের প্রতি বারবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, কিন্তু অপরপক্ষ থেকে যথাযথ সাড়া মেলেনি। তবে তারা মুখে যাই বলুন না কেন, আমাদের মনে হয় যে তাঁদের মধ্যে একে অপরের প্রতি গভীর সন্দেহ ও বিদ্বেষ বিরাজমান, যার শুরু সুদূর অতীত থেকে। শেখ হাসিনা এখন আর একথা গোপন করেন না যে, তিনি খালেদা জিয়ার স্বামী নিহত রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল জিয়াকে তার বাবা বঙ্গবন্ব্দু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চক্রান্তকারীদের একজন বলে মনে করেন। ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যার পর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘জিয়া বঙ্গবন্ব্দু হত্যার বেনিফিশিয়ারি’। প্রশ্নটি ছিল তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ব্দু হত্যার সঙ্গে জড়িত মনে করেন কিনা। এর কিছুদিন পর থেকে তিনি জেনারেল জিয়াকে ‘খুনি’ বলে অভিহিত করতেন এ কারণে যে, তার আমলে সশস্ত্র বাহিনীতে যেসব বিদ্রোহ হয় সেজন্য অনেক সৈনিককে তিনি ফাঁসি দিয়েছিলেন। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর যাবত্ শেখ হাসিনা জেনারেল জিয়াকে মুজিব হত্যার চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত বলে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ব্দু হত্যার আসামিদের জেনারেল জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে যে বিভিন্নভাবে চাকরি দেয়া হয় সে কথাও তিনি সবাইকে প্রায়ই মনে করিয়ে দেন। ২০০৪ সালের ২১ আগসল্ট বঙ্গবন্ব্দু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার যে চেষ্টা চালানো হয় তাতেও বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার জড়িত ছিল বলে তিনি শুরু থেকেই অভিযোগ করে এসেছেন। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জিয়া হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছে আর বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলকে তো সমর্থন করেছেই। এ ছাড়াও তিনি ১৯৯৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশজুড়ে অবরোধ করে বিরোধীরা যখন তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে তখন সচিবালয়ের কিছু কর্মকর্তা যে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এক ‘জনতার মঞ্চ’ গড়ে প্রশাসনকে অচল করে দেয় সেই ঘটনাকে বেগম খালেদা জিয়া একটি ‘সিভিলিয়ান ক্যু’ (বেসামরিক অভ্যুত্থান) বলে অভিহিত করেছেন এবং তিনি এটিকে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র বলেই মনে করেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন দুরূহ হয়ে পড়েছে। তদুপরি দু’পক্ষ যদি একে অপরকে ‘খুনি’ বা হত্যার ষড়যন্ত্রকারী বলে প্রচার চালিয়ে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয় তাহলে তো তারা শত্রুতার পথকেই উত্তম পথ বলে বেছে নেবে। তারা হয়তো এটাকেই ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ’ বলে বিশ্বাস করবে। তদুপরি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেখানে নীতিকেন্দ্রিক নয় সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য আগ্রহীদের কাছে এরকম ‘মেরুকরণ’ই মূল্যবান মনে হওয়া স্বাভাবিক।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
No comments