সংবিধান সংশোধনে সবাইকে দরকার by আলী রীয়াজ
বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন এখন জোর আলোচনার বিষয়। সংসদে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে একটি কমিটি নির্বাচনের পর এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন জোট সংবিধানের বিভিন্ন ধারা সংশোধনের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। উচ্চ আদালতের দেওয়া একটি রায়, যার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা এখনো জানা যায়নি, সেটাকে উপলক্ষ করেই এই উদ্যোগ। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের ঘটনা নতুন নয়। গত ৩৮ বছরে বৃহত্তর সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এই সময়ের ঘটনাপ্রবাহের আলোকে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই উপলব্ধি করেন। সংবিধান সংশোধনের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে অতীতে তাগিদ দিয়েছি। আমার ধারণা, বাংলাদেশের মূল সংবিধান এবং তার পরে উপর্যুপরি অবিবেচনাপ্রসূত পরিবর্তন—সবই সংবিধানের বিভিন্ন দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছে। সে কারণেই সংবিধানের একটা বড় ধরনের পরিবর্তন খুবই জরুরি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কী হবে? নিঃসন্দেহে সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল সংসদেরই আছে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্য আছেন সরকারি জোটে, তাঁরা চাইলেই সংশোধনী আনতে পারেন। মৌলিক পরিবর্তন আনা হলে তার জন্য গণভোটের প্রয়োজন হবে। কিন্তু সংবিধানের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন, সংযোজন কি কেবল সংসদ সদস্যদেরই বিষয়? তদুপরি সংবিধান সংশোধনে তাড়াহুড়ো করাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তার কারণও আমরা জানি। এ ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো প্রয়োজন আছে বলে কারোরই মনে করার কারণ নেই। এযাবৎ সরকারি জোটের কার্যক্রম থেকে মনে হচ্ছে, তারা এই রেওয়াজ অনুসরণ করতে উৎসাহী। সংবিধান সংশোধনের প্রধান লক্ষ্য কী, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। গত ৩৮ বছরের অভিজ্ঞতায় যেসব দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে, সেগুলো এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মোকাবিলা করা হবে কি না, তা সরকারি দলের সদস্যরা বলেননি। বরং তাঁদের কথাবার্তায় মনে হয় বিশেষ কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের জন্যই তাঁরা বেশি উৎসাহী।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংবিধান প্রণয়নের বিভিন্ন রকম প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। যেসব দেশে যুদ্ধ বা সংঘাতের পর নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে লক্ষ করেছেন, বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এটা বোঝার জন্য যে, সবার জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কি না। কেননা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা ছাড়া সংবিধান কোনো অবস্থাতেই ভবিষ্যৎ-সংকট মোকাবিলার ব্যবস্থা করতে পারে না। সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব সব ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিরাই পালন করেছেন, কিন্তু কেবল জনপ্রতিনিধিদের বিবেচনাই সংবিধানের ভিত্তি হয়নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেসব দেশ পরবর্তী সময়ে স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, জাতীয় আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে সংবিধানের বিভিন্ন দিক সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে শেষ পর্বের সূচনা হয় ১৭৮৬ সালে এনাপলিস কনভেনশনের মধ্য দিয়ে। সেখানেই একটি সংবিধান কনভেশনের ডাক দেওয়া হয়। ফিলাডেলফিয়ায় ওই অধিবেশন বসে ১৪ মে ১৭৮৭ সালে, কিন্তু কোরামের অভাবে আরও ১০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। ২৫ মে শুরু হয় কনভেনশন, শেষ হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। এই পাঁচ মাসের কনভেনশনের পটভূমিকায় ছিল ১৭৮১ সালে স্বাক্ষরিত আর্টিকেলস অব কনফেডারেশন থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোয় বিভিন্ন রকম দলিল-দস্তাবেজ, চুক্তি, আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্রের এই সংবিধান রচনার পরও তা নিয়ে এর রচয়িতারা যে আলোচনা-বিতর্ক অব্যাহত রেখেছিলেন, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ১৭৮৭-৮৮ সালে নিউইয়র্কের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ৮৭টি রচনা। এগুলোর লেখক হলেন আলেকজান্ডার হেমিলটন, জেমস মেডিসন ও জন জে। এই রচনাগুলো ‘ফেডারিলিস্ট পেপার’ বলে পরিচিত এবং সংবিধান-বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর শিক্ষার্থীদের অবশ্য পাঠ্য। ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের পুরোনো যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আলাপ-আলোচনা, ব্যাখ্যা-পাল্টা ব্যাখ্যা, সমঝোতা ও বিশ্লেষণ। কিন্তু এটা কেবল নতুন সংবিধান তৈরির জন্যই প্রয়োজন, তা নয়। বরং যখনই একটি সংবিধানকে সবার অধিকারের রক্ষাকবচে পরিণত করার চেষ্টা হয়, তখনই দরকার উন্মুক্ত জাতীয় আলোচনা। বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির সময় এই বিবেচনা সংবিধানপ্রণেতাদের ছিল না। বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১০) এদিকে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। এ নিয়ে পুনরুক্তির প্রয়োজন নেই।
সংবিধান প্রণয়ন ও সংবিধানের মৌল বিষয়গুলো সংশোধন, সংযোজন ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হওয়া খুবই জরুরি। শেষাবধি আইনপ্রণেতারাই সংবিধানের পরিবর্তন, পরিবর্ধন করবেন। কিন্তু সেটা যথেষ্ট কি না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। যে কারণে বিভিন্ন দেশে সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনের জন্য সংবিধান কমিশন নিয়োগের উদাহরণ রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সংবিধানকে বদল করে নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব কেবল নির্বাচনে বিজয়ী দলই নেয়নি। প্রথমে সেখানে কনভেনশন ফর ডেমোক্রেটিক সাউথ আফ্রিকা গঠন করা হয়। তাতে অগ্রগতি না হওয়ায় ‘মাল্টিপার্টি নেগোশিয়েটিং প্রসেস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কেবল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল, তা নয়। সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল এই প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক। তিন পর্যায়ে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। প্রথম পর্যায়ে কমিটির কাছে ১৭ লাখ মন্তব্য জমা পড়েছিল। এক হাজারের বেশি কর্মশালা আয়োজন করে ৯৫ হাজার সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও কমিটি কর্মকর্তারা কথা বলেছিলেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল নির্ধারণ করে দেয়, এসব মন্তব্যের কোনগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে। সর্বসাকল্যে ১৩ হাজার ৪৩৩টি লিখিত মন্তব্য সংবিধানপ্রণেতাদের বিবেচনার জন্য গৃহীত হয়। এর ১০ শতাংশ এসেছিল বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের কাছ থেকে। এর ভিত্তিতে যে খসড়া সংবিধান তৈরি হয়, তা বিলি করে আবারও মন্তব্য চাওয়া হয়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দুই লাখ ৫০ হাজার পরামর্শ ও মন্তব্য জমা পড়ে। সর্বশেষ যখন খসড়াটি সংসদে আলোচনা হয়, সেসব অধিবেশন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এসব প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল একটাই, সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সংবিধান তৈরি করা।
আলবেনিয়ায় নতুন সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৭ সালের শেষ পর্যায়ে। সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চলা এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে বিভিন্ন উন্মুক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) এবং আইন বিশ্লেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়। এরই আলোকে তৈরি হয় একটি খসড়া। সংবিধান কমিশনের তৈরি করা এই খসড়ার ওপর সবার মতামত গ্রহণ করার পর প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হয়। লক্ষণীয় যে, খসড়া সংবিধানের ২৫ শতাংশ ধারা-উপধারায় পরিবর্তন আনা হয় সমাজের বিভিন্ন অংশের মতামতের ভিত্তিতে। ইরিত্রিয়ায় সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কমিশনও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের জন্য চেষ্টা চালায়। তাতে শুধু যে ইরিত্রিয়ায় বসবাসরতরাই অংশ নিয়েছিল, তা নয়; প্রবাসে বসবাসরত সাড়ে সাত লাখ ইরিত্রীয় তাদের মন্তব্য ও পরামর্শ তুলে ধরে।
অনেকেই হয়তো আমার দেওয়া এসব উদাহরণের সমালোচনা করতে পারেন এই বলে যে, এগুলো সংবিধান তৈরিপ্রক্রিয়া, সংশোধনের নয়। এসব উদাহরণ থেকে যে বিষয়টি লক্ষ করার, তা হলো সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। সংবিধান তৈরি এবং বিশেষ করে একে আরও বেশি গণতান্ত্রিক করে তুলতে চাইলে সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ একে স্থায়ী ও শক্তিশালী করে। এতে করে জনসাধারণের মধ্যে সংবিধান ও সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়। ফলে সংবিধান রক্ষার জন্য তাদের ভেতরে তাগিদ দেখা দেয়।
বাংলাদেশে বারবার সংবিধান লঙ্ঘনের ইতিহাস সবার জানা। সাধারণ জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সংবিধানের বিভিন্ন বিধিবিধান নিয়ে সচেতনতা অত্যন্ত কম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী ভবিষ্যতে সংবিধান লঙ্ঘন ও বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখল বন্ধের জন্যই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংবিধানে লেখা থাকলেই অবৈধ ক্ষমতা দখল বন্ধ হবে বলে মনে হয় না, তবে সংবিধান বিষয়ে সচেতনতা গণতন্ত্র ও অধিকার রক্ষায় জনগণকে অধিকতর উৎসাহী করবে—এমনটা আশা করা যেতে পারে।
দেশের প্রধান বিরোধী দল সংসদীয় কমিটিতে তাদের কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি। তাঁরা এ কমিটিতে শেষাবধি অংশগ্রহণ করবেন কি না, সেটা দেখার বিষয়। দলগতভাবে তাঁরা অংশ না নিলে লাভবান হবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল যদি প্রক্রিয়াটি উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হয় সংশোধনীগুলো খুব সংকীর্ণ বিবেচনায় তৈরি করে এবং তাড়াহুড়ো করে প্রক্রিয়াটি শেষ করে, তবে তা বিরোধী দলের জন্য ইতিবাচক হয়ে উঠবে এবং দেশের জন্য হবে মারাত্মক ক্ষতিকর।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কী হবে? নিঃসন্দেহে সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল সংসদেরই আছে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্য আছেন সরকারি জোটে, তাঁরা চাইলেই সংশোধনী আনতে পারেন। মৌলিক পরিবর্তন আনা হলে তার জন্য গণভোটের প্রয়োজন হবে। কিন্তু সংবিধানের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন, সংযোজন কি কেবল সংসদ সদস্যদেরই বিষয়? তদুপরি সংবিধান সংশোধনে তাড়াহুড়ো করাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তার কারণও আমরা জানি। এ ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো প্রয়োজন আছে বলে কারোরই মনে করার কারণ নেই। এযাবৎ সরকারি জোটের কার্যক্রম থেকে মনে হচ্ছে, তারা এই রেওয়াজ অনুসরণ করতে উৎসাহী। সংবিধান সংশোধনের প্রধান লক্ষ্য কী, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। গত ৩৮ বছরের অভিজ্ঞতায় যেসব দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে, সেগুলো এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মোকাবিলা করা হবে কি না, তা সরকারি দলের সদস্যরা বলেননি। বরং তাঁদের কথাবার্তায় মনে হয় বিশেষ কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের জন্যই তাঁরা বেশি উৎসাহী।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংবিধান প্রণয়নের বিভিন্ন রকম প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। যেসব দেশে যুদ্ধ বা সংঘাতের পর নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে লক্ষ করেছেন, বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এটা বোঝার জন্য যে, সবার জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কি না। কেননা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা ছাড়া সংবিধান কোনো অবস্থাতেই ভবিষ্যৎ-সংকট মোকাবিলার ব্যবস্থা করতে পারে না। সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব সব ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিরাই পালন করেছেন, কিন্তু কেবল জনপ্রতিনিধিদের বিবেচনাই সংবিধানের ভিত্তি হয়নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেসব দেশ পরবর্তী সময়ে স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, জাতীয় আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে সংবিধানের বিভিন্ন দিক সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে শেষ পর্বের সূচনা হয় ১৭৮৬ সালে এনাপলিস কনভেনশনের মধ্য দিয়ে। সেখানেই একটি সংবিধান কনভেশনের ডাক দেওয়া হয়। ফিলাডেলফিয়ায় ওই অধিবেশন বসে ১৪ মে ১৭৮৭ সালে, কিন্তু কোরামের অভাবে আরও ১০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। ২৫ মে শুরু হয় কনভেনশন, শেষ হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। এই পাঁচ মাসের কনভেনশনের পটভূমিকায় ছিল ১৭৮১ সালে স্বাক্ষরিত আর্টিকেলস অব কনফেডারেশন থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোয় বিভিন্ন রকম দলিল-দস্তাবেজ, চুক্তি, আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্রের এই সংবিধান রচনার পরও তা নিয়ে এর রচয়িতারা যে আলোচনা-বিতর্ক অব্যাহত রেখেছিলেন, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ১৭৮৭-৮৮ সালে নিউইয়র্কের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ৮৭টি রচনা। এগুলোর লেখক হলেন আলেকজান্ডার হেমিলটন, জেমস মেডিসন ও জন জে। এই রচনাগুলো ‘ফেডারিলিস্ট পেপার’ বলে পরিচিত এবং সংবিধান-বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর শিক্ষার্থীদের অবশ্য পাঠ্য। ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের পুরোনো যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আলাপ-আলোচনা, ব্যাখ্যা-পাল্টা ব্যাখ্যা, সমঝোতা ও বিশ্লেষণ। কিন্তু এটা কেবল নতুন সংবিধান তৈরির জন্যই প্রয়োজন, তা নয়। বরং যখনই একটি সংবিধানকে সবার অধিকারের রক্ষাকবচে পরিণত করার চেষ্টা হয়, তখনই দরকার উন্মুক্ত জাতীয় আলোচনা। বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির সময় এই বিবেচনা সংবিধানপ্রণেতাদের ছিল না। বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১০) এদিকে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। এ নিয়ে পুনরুক্তির প্রয়োজন নেই।
সংবিধান প্রণয়ন ও সংবিধানের মৌল বিষয়গুলো সংশোধন, সংযোজন ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হওয়া খুবই জরুরি। শেষাবধি আইনপ্রণেতারাই সংবিধানের পরিবর্তন, পরিবর্ধন করবেন। কিন্তু সেটা যথেষ্ট কি না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। যে কারণে বিভিন্ন দেশে সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনের জন্য সংবিধান কমিশন নিয়োগের উদাহরণ রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সংবিধানকে বদল করে নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব কেবল নির্বাচনে বিজয়ী দলই নেয়নি। প্রথমে সেখানে কনভেনশন ফর ডেমোক্রেটিক সাউথ আফ্রিকা গঠন করা হয়। তাতে অগ্রগতি না হওয়ায় ‘মাল্টিপার্টি নেগোশিয়েটিং প্রসেস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কেবল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল, তা নয়। সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল এই প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক। তিন পর্যায়ে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। প্রথম পর্যায়ে কমিটির কাছে ১৭ লাখ মন্তব্য জমা পড়েছিল। এক হাজারের বেশি কর্মশালা আয়োজন করে ৯৫ হাজার সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও কমিটি কর্মকর্তারা কথা বলেছিলেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল নির্ধারণ করে দেয়, এসব মন্তব্যের কোনগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে। সর্বসাকল্যে ১৩ হাজার ৪৩৩টি লিখিত মন্তব্য সংবিধানপ্রণেতাদের বিবেচনার জন্য গৃহীত হয়। এর ১০ শতাংশ এসেছিল বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের কাছ থেকে। এর ভিত্তিতে যে খসড়া সংবিধান তৈরি হয়, তা বিলি করে আবারও মন্তব্য চাওয়া হয়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দুই লাখ ৫০ হাজার পরামর্শ ও মন্তব্য জমা পড়ে। সর্বশেষ যখন খসড়াটি সংসদে আলোচনা হয়, সেসব অধিবেশন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এসব প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল একটাই, সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সংবিধান তৈরি করা।
আলবেনিয়ায় নতুন সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৭ সালের শেষ পর্যায়ে। সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চলা এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে বিভিন্ন উন্মুক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) এবং আইন বিশ্লেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়। এরই আলোকে তৈরি হয় একটি খসড়া। সংবিধান কমিশনের তৈরি করা এই খসড়ার ওপর সবার মতামত গ্রহণ করার পর প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হয়। লক্ষণীয় যে, খসড়া সংবিধানের ২৫ শতাংশ ধারা-উপধারায় পরিবর্তন আনা হয় সমাজের বিভিন্ন অংশের মতামতের ভিত্তিতে। ইরিত্রিয়ায় সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কমিশনও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের জন্য চেষ্টা চালায়। তাতে শুধু যে ইরিত্রিয়ায় বসবাসরতরাই অংশ নিয়েছিল, তা নয়; প্রবাসে বসবাসরত সাড়ে সাত লাখ ইরিত্রীয় তাদের মন্তব্য ও পরামর্শ তুলে ধরে।
অনেকেই হয়তো আমার দেওয়া এসব উদাহরণের সমালোচনা করতে পারেন এই বলে যে, এগুলো সংবিধান তৈরিপ্রক্রিয়া, সংশোধনের নয়। এসব উদাহরণ থেকে যে বিষয়টি লক্ষ করার, তা হলো সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। সংবিধান তৈরি এবং বিশেষ করে একে আরও বেশি গণতান্ত্রিক করে তুলতে চাইলে সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ একে স্থায়ী ও শক্তিশালী করে। এতে করে জনসাধারণের মধ্যে সংবিধান ও সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়। ফলে সংবিধান রক্ষার জন্য তাদের ভেতরে তাগিদ দেখা দেয়।
বাংলাদেশে বারবার সংবিধান লঙ্ঘনের ইতিহাস সবার জানা। সাধারণ জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সংবিধানের বিভিন্ন বিধিবিধান নিয়ে সচেতনতা অত্যন্ত কম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী ভবিষ্যতে সংবিধান লঙ্ঘন ও বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখল বন্ধের জন্যই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংবিধানে লেখা থাকলেই অবৈধ ক্ষমতা দখল বন্ধ হবে বলে মনে হয় না, তবে সংবিধান বিষয়ে সচেতনতা গণতন্ত্র ও অধিকার রক্ষায় জনগণকে অধিকতর উৎসাহী করবে—এমনটা আশা করা যেতে পারে।
দেশের প্রধান বিরোধী দল সংসদীয় কমিটিতে তাদের কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি। তাঁরা এ কমিটিতে শেষাবধি অংশগ্রহণ করবেন কি না, সেটা দেখার বিষয়। দলগতভাবে তাঁরা অংশ না নিলে লাভবান হবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল যদি প্রক্রিয়াটি উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হয় সংশোধনীগুলো খুব সংকীর্ণ বিবেচনায় তৈরি করে এবং তাড়াহুড়ো করে প্রক্রিয়াটি শেষ করে, তবে তা বিরোধী দলের জন্য ইতিবাচক হয়ে উঠবে এবং দেশের জন্য হবে মারাত্মক ক্ষতিকর।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments