আঙ্গু কাবিলা বনাম মাঙ্গু কাবিলার অন্তহীন যুদ্ধ by ফারুক ওয়াসিফ
অমুককে প্রতিরোধ করতে তমুকের দলবলের রাস্তা আটকে সশস্ত্র পাহারা বসানোর ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ পরিচিত। গত শুক্রবারের প্রথম আলোর একটি খবর ও ছবিতে দেখা যায়, ফরিদপুরের এক এলাকায় মাঠের মধ্যে একদল গ্রামবাসী লাঠি-বল্লম-সড়কি আর বেতের তৈরি ঢাল হাতে বসে আছে। প্রতিপক্ষকে দেখামাত্রই হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা প্রস্তুত। সেদিন সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে আয়মন আকবরের ফরিদপুরে আসার কথা থাকায় শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের লোকদের এই রণসাজ। আগের দিনও তারা একচোট লড়াই করে নিয়েছে। সেই লড়াইয়ে তিনজন গুলিবিদ্ধসহ পাঁচজন আহত হয়। চর দখলের কায়দায় মারামারির জন্য তাদের তৈরি থাকা দেখে মনে পড়ে মোকাবেলা নামের একটি ঢাকাই ছবির কথা।
সেই ছবিতে এফডিসির দুই বিখ্যাত অ্যাকশন হিরো ওয়াসিম আর জসিমকে দেখা যায় দুই গোত্রসর্দারের ভূমিকায়। গোত্র দুটির নাম আঙ্গু কাবিলা আর মাঙ্গু কাবিলা। আঙ্গু আর মাঙ্গু কাবিলার মধ্যে বিরোধের কোনো শেষ নেই। নতুন হলো নায়িকা নিয়ে বিবাদ। ছবিজুড়ে নায়ক-নায়িকার নাচগানে ভরপুর দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় দুই গোত্রপতির হুংকার এবং লাঠি-বল্লম-তলোয়ার নিয়ে মারামারি। মাঝেমধ্যে তারা বাঘ সেদ্ধ করে ভোজ খায়! তো একটি দৃশ্যে দেখা গেল আজব কাবিলার লোকজনের সেই বাঘ-ভোজ অনুষ্ঠানের পেছন দিয়ে একটি গাড়ি চলে যাচ্ছে। তেমনি একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাংলাদেশের সেটে আমরা দেখতে পাচ্ছি মান্ধাতা আমলের লেঠেল-লড়াই।
সভ্যতা যেন এ দেশকে বাইপাস করে চলে গেছে। বাইরে যতই আধুনিক রোশনাই ভেতরে এখনো সেই আঙ্গু কাবিলা আর মাঙ্গু কাবিলার যুগ। কাবিলায় কাবিলায় ভাগ হয়ে আছে সবাই, আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি কাবিলা, একই দলের বিভিন্ন উপদলীয় কাবিলা, এলাকাভিত্তিক কাবিলাসহ গ্রুপিংয়ের হাজারো ফেরকা। আর এদের ভেতরে পদ, ক্ষমতা বা অর্থ নিয়ে বিরোধ মীমাংসার অব্যর্থ উপায় হলো ‘যুদ্ধ’। এবং পরিশেষে ‘জো জিতা ওহি সিকান্দর’; যিনি জিতবেন, তিনিই হবেন অধিপতি। তিনিই পাবেন ঊর্ধ্বতন নেতাদের বাহবা আর নিচের কর্মীদের জিন্দাবাদ।
মধ্যযুগের বাংলায় শান্তিপূর্ণ যুগের পাশাপাশি কিছু সময়ের জন্য এ রকম অবস্থা বিরাজ করছিল। সে সময় যিনিই গায়ের জোরে সিংহাসন দখল করতেন, তিনিই দিল্লির সম্রাটের কাছে নজরানার বিনিময়ে ‘সুবেদার’, ‘নবাব’ প্রভৃতি উপাধি কিনে এনে রাজত্ব করতে পারতেন। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধ-মীমাংসার এই রীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বলয়ে এখনো স্বমহিমায় বিরাজমান। সহিংসতার ক্ষমতাই এখনো রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি। যে হরতালে বিরোধী দল বেশি ক্যাডার নামাতে পারে, সেই হরতাল সফল; আর বিরোধী দলগুলোকে দাবড়ানির ওপর রাখতে পারাই সরকারের রাজনৈতিক সাফল্য। ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে গ্রাম-শহরে দলীয় ও উপদলীয় হানাহানির মধ্যেও এই সহিংসতার সংস্কৃতিরই প্রসার।
ঢাকাই ছবির মতো উত্তেজিত সংলাপ আর ঢাক গুড়গুড় আবহ সংগীতই যেন আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও স্থায়ী সুর। টেলিভিশনের টক শো, জনসভার বক্তৃতা, রাজনৈতিক পোস্টারের ভাষাসহ হেন জায়গা নেই যেখানে উত্তেজনা ও বিবাদের ভাষা ও ভঙ্গি অকাতরে ব্যবহূত হয় না। এসবের প্রভাব সবার ওপরে পড়ে এবং উত্তেজনা আর অস্থিরতা হয়ে ওঠে রাজনীতি ও সংস্কৃতির মূল ভাব। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই সহিংসতা পুরুষের সৃষ্টি। এই যুদ্ধংদেহী মেজাজ তাদেরই এবং এর ব্যবহারকারীও তারা। এই ব্যাটাগিরি রাজনৈতিক আচরণকেও অনেকটা প্রভাবিত করে।
কিন্তু দোষ কি কেবল রাজনীতির? সমাজের মানুষ যেমন, রাজনীতিতে তারই প্রতিফলন ঘটে। আমাদের রাষ্ট্র-রাজনীতি থেকে সমাজ ও পরিবার—সবখানেই কি সহিংসতার সংস্কৃতিরই জয়জয়কার দেখা যায় না? ১৮ জুলাই ফেনীর এক কলেজছাত্র দুর্ঘটনায় নিহত হয়। পরপরই তার সহপাঠীরা শহরজুড়ে তাণ্ডব চালায়। একটি হাসপাতাল ও ৩০টি বাস ভাঙচুর করা হয়, ছয়টি বাস পোড়ে এবং মারধরও চলে। গোটা শহর দুপুর ১২টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত অচল থাকে, মহাসড়ক থাকে অবরুদ্ধ। দায়ী যারা, তাদের বিচারের দাবির থেকে প্রতিহিংসার আবেগটাই বড় হয়ে ওঠে কেন? হয়তো তারা বুঝে ফেলেছে, বিচার-প্রক্রিয়ার অপরাধী ছাড়া পেতে পারে কিংবা পুলিশে তাদের আস্থা নেই। কিংবা তারা হয়তো বিচারই চায় না, চায় প্রতিহিংসার চরিতার্থতা। প্রতিহিংসা হলো সহিংসতার জরুরি রসায়ন, এটা ছাড়া ঠিক সংঘাত জমে না। যে দেশে অপরাধ হলে বিচার হয়, সে দেশে এভাবে বিচারের দাবির পথ প্রতিহিংসার আবেগ দখল করতে পারে না। অন্য দিকে আন্দোলনের ধৈর্য্য কম বলেই কি ভাংচুরের উৎসাহ বেশি?
দ্বন্দ্ব মীমাংসায় বলপ্রয়োগের দাওয়াই কত ‘জনপ্রিয়’, বিপুলসংখ্যক ফৌজদারি মামলার দিকে তাকালেও তা ধরা পড়ে। আইন ভূমিকা রাখে খুন-জখম তথা বলপ্রয়োগ ঘটে যাওয়ার পর। পারিবারিক কলহ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক বিরোধ, ধর্মীয় বিতর্ক, দাম্পত্য কলহসহ এমন কোনো ক্ষেত্র কি পাওয়া যায়, যেখানে বলপ্রয়োগের ব্যবহার নেই, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া নেই? পথচলতি নানা ঘটনা এমনকি রিকশায় রিকশায় বাধাবাধি, বাসে-সিএনজিতে যাত্রী-চালকে বচসা, এমনকি পাড়াপড়শির কাজিয়ারও শেষ হতে দেখা যায় বলপ্রয়োগে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের কথাও আমরা শুনি। আর যেখানে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে না, বুঝতে হবে সেখানে বলপ্রয়োগের ভয়ে দুর্বল প্রতিপক্ষ চুপ হয়ে মেনে নিয়েছে।
বলপ্রয়োগের পথে দ্বন্দ্ব মীমাংসার এই ধারা কিংবা প্রতিহিংসার বাসনা সমাজকেও সহিংসতায় অভ্যস্ত করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী স্বয়ং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীমানুষের ওপর চড়াও হয়। এভাবে পাল্টাপাল্টি সহিংসতায় সমাজের মধ্যে নৈরাজ্যবাদী প্রবণতা আরও গেড়ে বসে। সব সময় যে তা প্রকট থাকে তা নয়, অনেক সময় তা চাপা উত্তেজনার আকারে সমাজ-রাষ্ট্রের শিরায় শিরায় বইতে থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন বিডিআর বিদ্রোহের মতো ট্র্যাজেডির জন্ম হয় কিংবা ঘটে যায় কানসাট-ফুলবাড়ী বা শনির আখড়ার মতো জনরোষের বিস্ফোরণ।
শৃঙ্খলা ও স্বার্থের খাতিরে বলপ্রয়োগের ব্যবস্থা রাখতেই হয় রাষ্ট্রকে। পুলিশ-মিলিটারি-র্যাব-সোয়াতেরও সেটাই কাজ। কিন্তু আইন ও বিচার, সংলাপ ও আপস এবং প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ মীমাংসাকে ছাপিয়ে সংঘাত যখন আগে চলে আসে তখন বুঝতে হয় যে, রাষ্ট্রটি পরিণত নয়, সমাজ সাবলীল নয়। সংঘাত প্রশমনে আমাদের যেমন আছে আদালত, আছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংসদ থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদ, আছে বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো। এ ধরনের সংস্থাগুলো অনেকটা সেফটি ভালেভর মতো কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হয় ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার বাষ্প বের করে দিয়ে আইন ও বিচারের পথ সুগম করার সেফটি ভাল্ভগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। আপস-মীমাংসার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরতার দশা কাজির গরুর মতো, যাদের অস্তিত্ব কেবল কেতাবে, গোয়ালে নয়।
ফরিদপুরের ওই ঘটনার কথাই ধরা যাক, একজন সংসদীয় উপনেতা আর একজন শ্রমমন্ত্রী—দুজনই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজনের পুত্রের রাজনৈতিক অভিলাষ যদি অপরের বাসনার পথে বাধা হয়, তার মীমাংসা তো জেলা কমিটি বা কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমেই হতে পারত। কিন্তু সেসবের দ্বারস্থ না হয়ে তাঁরা নামলেন শক্তির পাল্লা দিতে। তাঁরা কি ধরে নিয়েছিলেন যে তাঁদের ওপরে কোনো আইন বা কর্তৃপক্ষ নেই? বিরোধ মীমাংসার প্রাতিষ্ঠানিক উপায়গুলোর প্রতি এই অনীহা সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়নের পথে বিরাট বাধা। আঙ্গু কাবিলা বনাম মাঙ্গু কাবিলার গোত্রীয় সংঘাতের পরিবেশ নৈরাজ্যের পরিবেশ। বিরোধীদের হরতাল-অবরোধ, ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন অথবা তৃতীয় কোনো শক্তির গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলের ঘটনা এ পরিবেশেই ঘটার সুযোগ পায়। আর জনগণ হয় রাজনীতি বিমুখ।
বলপ্রয়োগের বিকল্প হিসেবে সুশাসন বা গুড গভর্নেন্স দিয়ে সংঘাতের ক্ষেত্রকে প্রশমিত করার ব্যর্থতা রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই ব্যর্থতা। এই নৈরাজ্য ও বলপ্রয়োগের বাস্তবতা শাসকশ্রেণীর তৈরি হলেও জনগণের আয়নায় তার প্রতিফলন ঘটে, তলার শ্রেণীগুলোর আচরণেও তার প্রতিধ্বনি ওঠে। পোশাকশ্রমিকদের কোনো ফরিয়াদেই যখন সরকার ও মালিকপক্ষের টনক নড়ে না, তখনই তারা রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। গায়ের জোরে শোষণের বিপরীতে দেখা যায় গা দিয়ে প্রতিরোধের প্রতিবাদ। কানসাট, ফুলবাড়ী, শনির আখড়ায় জনগণের নিরুপায় ক্ষমতা প্রদর্শনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না, যদি যার যা কাজ সে তা করত। যদি সব আদালতে অন্তত আইন অনুযায়ী বিচারের নিশ্চয়তা থাকত, যদি দুদকে অন্তত বড় দুর্নীতিগুলো ধরা পড়ত। সংসদে যদি জনগণের স্বার্থের কথা আলোচিত হতো, রাজনৈতিক দলে যদি গণতন্ত্র থাকত এবং বড় দলগুলো জনগণকে ‘আশার ছলনে’ না ভুলিয়ে জনস্বার্থ রক্ষার কিছুটা চেষ্টা করত। তাহলে আঙ্গু কাবিলা আর মাঙ্গু কাবিলার এই অন্তহীন যুদ্ধ আমাদের দেখতে হতো না।
যাঁরা নিজেদের কাবিলা সর্দার ভাবছেন, পুুষছেন নিজস্ব বাহিনী, এলাকাকে ভাবছেন জমিদারি, তাঁদের বুঝতে হবে দেশের অধিকাংশ মানুষ রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কাবিলা-যুগ পার হয়ে এসেছে।তারা জননেতা চায় ও জাতীয়নেতা চায়, কাবিলা সর্দার নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
সেই ছবিতে এফডিসির দুই বিখ্যাত অ্যাকশন হিরো ওয়াসিম আর জসিমকে দেখা যায় দুই গোত্রসর্দারের ভূমিকায়। গোত্র দুটির নাম আঙ্গু কাবিলা আর মাঙ্গু কাবিলা। আঙ্গু আর মাঙ্গু কাবিলার মধ্যে বিরোধের কোনো শেষ নেই। নতুন হলো নায়িকা নিয়ে বিবাদ। ছবিজুড়ে নায়ক-নায়িকার নাচগানে ভরপুর দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় দুই গোত্রপতির হুংকার এবং লাঠি-বল্লম-তলোয়ার নিয়ে মারামারি। মাঝেমধ্যে তারা বাঘ সেদ্ধ করে ভোজ খায়! তো একটি দৃশ্যে দেখা গেল আজব কাবিলার লোকজনের সেই বাঘ-ভোজ অনুষ্ঠানের পেছন দিয়ে একটি গাড়ি চলে যাচ্ছে। তেমনি একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাংলাদেশের সেটে আমরা দেখতে পাচ্ছি মান্ধাতা আমলের লেঠেল-লড়াই।
সভ্যতা যেন এ দেশকে বাইপাস করে চলে গেছে। বাইরে যতই আধুনিক রোশনাই ভেতরে এখনো সেই আঙ্গু কাবিলা আর মাঙ্গু কাবিলার যুগ। কাবিলায় কাবিলায় ভাগ হয়ে আছে সবাই, আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি কাবিলা, একই দলের বিভিন্ন উপদলীয় কাবিলা, এলাকাভিত্তিক কাবিলাসহ গ্রুপিংয়ের হাজারো ফেরকা। আর এদের ভেতরে পদ, ক্ষমতা বা অর্থ নিয়ে বিরোধ মীমাংসার অব্যর্থ উপায় হলো ‘যুদ্ধ’। এবং পরিশেষে ‘জো জিতা ওহি সিকান্দর’; যিনি জিতবেন, তিনিই হবেন অধিপতি। তিনিই পাবেন ঊর্ধ্বতন নেতাদের বাহবা আর নিচের কর্মীদের জিন্দাবাদ।
মধ্যযুগের বাংলায় শান্তিপূর্ণ যুগের পাশাপাশি কিছু সময়ের জন্য এ রকম অবস্থা বিরাজ করছিল। সে সময় যিনিই গায়ের জোরে সিংহাসন দখল করতেন, তিনিই দিল্লির সম্রাটের কাছে নজরানার বিনিময়ে ‘সুবেদার’, ‘নবাব’ প্রভৃতি উপাধি কিনে এনে রাজত্ব করতে পারতেন। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধ-মীমাংসার এই রীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বলয়ে এখনো স্বমহিমায় বিরাজমান। সহিংসতার ক্ষমতাই এখনো রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি। যে হরতালে বিরোধী দল বেশি ক্যাডার নামাতে পারে, সেই হরতাল সফল; আর বিরোধী দলগুলোকে দাবড়ানির ওপর রাখতে পারাই সরকারের রাজনৈতিক সাফল্য। ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে গ্রাম-শহরে দলীয় ও উপদলীয় হানাহানির মধ্যেও এই সহিংসতার সংস্কৃতিরই প্রসার।
ঢাকাই ছবির মতো উত্তেজিত সংলাপ আর ঢাক গুড়গুড় আবহ সংগীতই যেন আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও স্থায়ী সুর। টেলিভিশনের টক শো, জনসভার বক্তৃতা, রাজনৈতিক পোস্টারের ভাষাসহ হেন জায়গা নেই যেখানে উত্তেজনা ও বিবাদের ভাষা ও ভঙ্গি অকাতরে ব্যবহূত হয় না। এসবের প্রভাব সবার ওপরে পড়ে এবং উত্তেজনা আর অস্থিরতা হয়ে ওঠে রাজনীতি ও সংস্কৃতির মূল ভাব। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই সহিংসতা পুরুষের সৃষ্টি। এই যুদ্ধংদেহী মেজাজ তাদেরই এবং এর ব্যবহারকারীও তারা। এই ব্যাটাগিরি রাজনৈতিক আচরণকেও অনেকটা প্রভাবিত করে।
কিন্তু দোষ কি কেবল রাজনীতির? সমাজের মানুষ যেমন, রাজনীতিতে তারই প্রতিফলন ঘটে। আমাদের রাষ্ট্র-রাজনীতি থেকে সমাজ ও পরিবার—সবখানেই কি সহিংসতার সংস্কৃতিরই জয়জয়কার দেখা যায় না? ১৮ জুলাই ফেনীর এক কলেজছাত্র দুর্ঘটনায় নিহত হয়। পরপরই তার সহপাঠীরা শহরজুড়ে তাণ্ডব চালায়। একটি হাসপাতাল ও ৩০টি বাস ভাঙচুর করা হয়, ছয়টি বাস পোড়ে এবং মারধরও চলে। গোটা শহর দুপুর ১২টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত অচল থাকে, মহাসড়ক থাকে অবরুদ্ধ। দায়ী যারা, তাদের বিচারের দাবির থেকে প্রতিহিংসার আবেগটাই বড় হয়ে ওঠে কেন? হয়তো তারা বুঝে ফেলেছে, বিচার-প্রক্রিয়ার অপরাধী ছাড়া পেতে পারে কিংবা পুলিশে তাদের আস্থা নেই। কিংবা তারা হয়তো বিচারই চায় না, চায় প্রতিহিংসার চরিতার্থতা। প্রতিহিংসা হলো সহিংসতার জরুরি রসায়ন, এটা ছাড়া ঠিক সংঘাত জমে না। যে দেশে অপরাধ হলে বিচার হয়, সে দেশে এভাবে বিচারের দাবির পথ প্রতিহিংসার আবেগ দখল করতে পারে না। অন্য দিকে আন্দোলনের ধৈর্য্য কম বলেই কি ভাংচুরের উৎসাহ বেশি?
দ্বন্দ্ব মীমাংসায় বলপ্রয়োগের দাওয়াই কত ‘জনপ্রিয়’, বিপুলসংখ্যক ফৌজদারি মামলার দিকে তাকালেও তা ধরা পড়ে। আইন ভূমিকা রাখে খুন-জখম তথা বলপ্রয়োগ ঘটে যাওয়ার পর। পারিবারিক কলহ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক বিরোধ, ধর্মীয় বিতর্ক, দাম্পত্য কলহসহ এমন কোনো ক্ষেত্র কি পাওয়া যায়, যেখানে বলপ্রয়োগের ব্যবহার নেই, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া নেই? পথচলতি নানা ঘটনা এমনকি রিকশায় রিকশায় বাধাবাধি, বাসে-সিএনজিতে যাত্রী-চালকে বচসা, এমনকি পাড়াপড়শির কাজিয়ারও শেষ হতে দেখা যায় বলপ্রয়োগে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের কথাও আমরা শুনি। আর যেখানে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে না, বুঝতে হবে সেখানে বলপ্রয়োগের ভয়ে দুর্বল প্রতিপক্ষ চুপ হয়ে মেনে নিয়েছে।
বলপ্রয়োগের পথে দ্বন্দ্ব মীমাংসার এই ধারা কিংবা প্রতিহিংসার বাসনা সমাজকেও সহিংসতায় অভ্যস্ত করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী স্বয়ং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীমানুষের ওপর চড়াও হয়। এভাবে পাল্টাপাল্টি সহিংসতায় সমাজের মধ্যে নৈরাজ্যবাদী প্রবণতা আরও গেড়ে বসে। সব সময় যে তা প্রকট থাকে তা নয়, অনেক সময় তা চাপা উত্তেজনার আকারে সমাজ-রাষ্ট্রের শিরায় শিরায় বইতে থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন বিডিআর বিদ্রোহের মতো ট্র্যাজেডির জন্ম হয় কিংবা ঘটে যায় কানসাট-ফুলবাড়ী বা শনির আখড়ার মতো জনরোষের বিস্ফোরণ।
শৃঙ্খলা ও স্বার্থের খাতিরে বলপ্রয়োগের ব্যবস্থা রাখতেই হয় রাষ্ট্রকে। পুলিশ-মিলিটারি-র্যাব-সোয়াতেরও সেটাই কাজ। কিন্তু আইন ও বিচার, সংলাপ ও আপস এবং প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ মীমাংসাকে ছাপিয়ে সংঘাত যখন আগে চলে আসে তখন বুঝতে হয় যে, রাষ্ট্রটি পরিণত নয়, সমাজ সাবলীল নয়। সংঘাত প্রশমনে আমাদের যেমন আছে আদালত, আছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংসদ থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদ, আছে বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো। এ ধরনের সংস্থাগুলো অনেকটা সেফটি ভালেভর মতো কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হয় ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার বাষ্প বের করে দিয়ে আইন ও বিচারের পথ সুগম করার সেফটি ভাল্ভগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। আপস-মীমাংসার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরতার দশা কাজির গরুর মতো, যাদের অস্তিত্ব কেবল কেতাবে, গোয়ালে নয়।
ফরিদপুরের ওই ঘটনার কথাই ধরা যাক, একজন সংসদীয় উপনেতা আর একজন শ্রমমন্ত্রী—দুজনই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজনের পুত্রের রাজনৈতিক অভিলাষ যদি অপরের বাসনার পথে বাধা হয়, তার মীমাংসা তো জেলা কমিটি বা কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমেই হতে পারত। কিন্তু সেসবের দ্বারস্থ না হয়ে তাঁরা নামলেন শক্তির পাল্লা দিতে। তাঁরা কি ধরে নিয়েছিলেন যে তাঁদের ওপরে কোনো আইন বা কর্তৃপক্ষ নেই? বিরোধ মীমাংসার প্রাতিষ্ঠানিক উপায়গুলোর প্রতি এই অনীহা সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়নের পথে বিরাট বাধা। আঙ্গু কাবিলা বনাম মাঙ্গু কাবিলার গোত্রীয় সংঘাতের পরিবেশ নৈরাজ্যের পরিবেশ। বিরোধীদের হরতাল-অবরোধ, ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন অথবা তৃতীয় কোনো শক্তির গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলের ঘটনা এ পরিবেশেই ঘটার সুযোগ পায়। আর জনগণ হয় রাজনীতি বিমুখ।
বলপ্রয়োগের বিকল্প হিসেবে সুশাসন বা গুড গভর্নেন্স দিয়ে সংঘাতের ক্ষেত্রকে প্রশমিত করার ব্যর্থতা রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই ব্যর্থতা। এই নৈরাজ্য ও বলপ্রয়োগের বাস্তবতা শাসকশ্রেণীর তৈরি হলেও জনগণের আয়নায় তার প্রতিফলন ঘটে, তলার শ্রেণীগুলোর আচরণেও তার প্রতিধ্বনি ওঠে। পোশাকশ্রমিকদের কোনো ফরিয়াদেই যখন সরকার ও মালিকপক্ষের টনক নড়ে না, তখনই তারা রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। গায়ের জোরে শোষণের বিপরীতে দেখা যায় গা দিয়ে প্রতিরোধের প্রতিবাদ। কানসাট, ফুলবাড়ী, শনির আখড়ায় জনগণের নিরুপায় ক্ষমতা প্রদর্শনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না, যদি যার যা কাজ সে তা করত। যদি সব আদালতে অন্তত আইন অনুযায়ী বিচারের নিশ্চয়তা থাকত, যদি দুদকে অন্তত বড় দুর্নীতিগুলো ধরা পড়ত। সংসদে যদি জনগণের স্বার্থের কথা আলোচিত হতো, রাজনৈতিক দলে যদি গণতন্ত্র থাকত এবং বড় দলগুলো জনগণকে ‘আশার ছলনে’ না ভুলিয়ে জনস্বার্থ রক্ষার কিছুটা চেষ্টা করত। তাহলে আঙ্গু কাবিলা আর মাঙ্গু কাবিলার এই অন্তহীন যুদ্ধ আমাদের দেখতে হতো না।
যাঁরা নিজেদের কাবিলা সর্দার ভাবছেন, পুুষছেন নিজস্ব বাহিনী, এলাকাকে ভাবছেন জমিদারি, তাঁদের বুঝতে হবে দেশের অধিকাংশ মানুষ রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কাবিলা-যুগ পার হয়ে এসেছে।তারা জননেতা চায় ও জাতীয়নেতা চায়, কাবিলা সর্দার নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments