গাজীপুর সিটি নির্বাচন: আদালতে দু’পক্ষই
গাজীপুর
সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত করে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ
চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার।
গতকাল চেম্বার আদালতে আবেদনটি করা হয়। হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল
বিভাগে আবেদন করার জন্য বিএনপির মেয়র প্রার্থী গতকাল আপিল বিভাগের চেম্বার
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর অনুমতি পান। পরে সুপ্রিম কোর্টের
সংশ্লিষ্ট শাখায় ওই আবেদন জমা দিলেও নথিপত্র আদালতে না আসায় গতকাল বিকাল
পর্যন্ত চেম্বার আদালতে এর শুনানি হয়নি বলে জানান হাসান সরকারের আইনজীবী
সানজিদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, আমরা আপিল ফাইল করেছি। আগামীকাল (আজ) এ বিষয়ে
শুনানি হবে। এদিকে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমও আপিল করবেন বলে জানান।
সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হিসেবে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল করতে গতকাল
সপ্রিম কোর্টে আসেন তিনি। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যেকোনো প্রক্রিয়ায়
নির্বাচনটা যেন হয়। গাজীপুর সিটির উন্নয়নের স্বার্থে আমরা নির্বাচন চাই।
আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করতে চাই। গাজীপুর সিটির নির্বাচনের স্বার্থে আমি
সবার কাছে সহযোগিতা চাই। এজন্য আমি এসেছি, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে
আবেদন করব। জাহাঙ্গীর আলমের আইনজীবী এসএম শফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, আমরা
আপিলের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি শেষ করেছি। নথিপত্রও প্রস্তুত করেছি।
আগামীকাল (আজ) সকালেই আবেদন করা হবে। আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে আশা করি আমরা
শুনানি করবো। তিনি বলেন, জনগণ চায় এই নির্বাচন হোক। আওয়ামী লীগের প্রার্থীও
অবশ্যই এই নির্বাচন চান। এজন্যই এ আপিল আবেদন করা হবে।
সীমানা জটিলতা সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি নিয়ে রোববার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ভোটের মাত্র নয়দিন আগে প্রার্থীদের প্রচারণার মধ্যে গাজীপুর এই নির্বাচন স্থগিত হয়। সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের ৬টি মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এ রিট আবেদন করেন সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও ১ নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবিএম আজহারুল ইসলাম সুরুজ। এর আগে তিন বছর আগে ওই ছয় মৌজার সীমানা জটিলতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন আজহারুল ইসলাম। পরে হাইকোর্টের দেয়া রুলের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ বিষয়টি নিষ্পত্তি করে ৬টি মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করে। চলতি বছরের ৪ঠা মার্চ এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন এবং গাজীপুর সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বৈধতা চ্যালেঞ্জ রোববার রিট আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম।
নির্বাচন স্থগিতে হতাশা-ক্ষোভ
সীমানা জটিলতা নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর উৎসবের আমেজে ভাটা পড়েছে। নগরবাসীর মনে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্থবির হয়ে গেছে নির্বাচনী কার্যক্রম। প্রায় তিনশ ত্রিশ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উৎসবের নগরে যেন শোকের আবহ নেমে এসেছে। প্রধান দুজন মেয়র প্রার্থী ছাড়াও অন্য মেয়র প্রার্থী এবং কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা ভেঙে পড়েছেন। নানা লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাচ্ছেন তারা। নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সিপিবির মেয়র প্রার্থী এই নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগও দাবি করেছেন। অন্যদিকে টঙ্গী থানায় বিএনপির ১২০ জন নেতাকর্মীর নামে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
স্থগিত হওয়ার পর দুদিন ধরেই ঢাকায় দৌড়-ঝাঁপ করছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। নির্বাচনী লড়াইয়ে তারা বিজয়ের পথে ছিলেন উল্লেখ করে করণীয় নিয়ে তাদের নেতাদের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। নির্বাচন স্থগিত হওয়ার বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি চাই নির্বাচনটা হোক। কারণ আমি গণতন্ত্রের চর্চা করি। গাজীপুর সিটির উন্নয়নের স্বার্থে আমি সবার সহযোগিতা চাই। চলমান প্রক্রিয়ায়, যেকোনো প্রক্রিয়ায় নির্বাচনটা ১৫ই মে হয়ে যাক, সেটাই আমি চাইছি। এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ বলেছেন, নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের বিজয়ের পথে জোয়ার উঠেছিল। সেই জায়গাতে নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় নগরবাসীর মনে কষ্ট রয়েছে। তবে সীমানা জটিলতায় নির্বাচন স্থগিত হওয়ার প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করে তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। নির্বাচন স্থগিত হওয়ার বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমান বলেন, আমরা একটা ভোটের উৎসবে ছিলাম। নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় মনে হচ্ছে ভূমিকম্পের পরবর্তী অবস্থার মতো আমরা থমকে আছি। নির্বাচন বন্ধ হবার বিষয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গাজীপুর জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় নগরবাসীর ক্ষতি হয়েছে। তবে নির্বাচন স্থগিত হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা নিজ দলের নেতাদের অবস্থান বুঝতে পেরেছেন। কোন কোন নেতা তাদের পক্ষে নির্বাচনে নেমেছেন আর কোন কোন নেতা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মাঠে না নেমে কি ভূমিকায় আছেন তা টের পেয়ে গেছেন প্রার্থীরা।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দীন সরকার সোমবার সকালে তার বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ১৫ই মে নির্বাচনের ব্যাপারে এবং জয়ের ব্যাপারে এখনো পুরোপুরি আশাবাদী। তিনি বলেন, সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক হলে আদালতে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত প্রতিকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। স্থগিত হওয়ায় হয়তো, প্রচারে দু-একদিন ক্ষতি হয়েছে। তাতে সমস্যা নেই, ভোটাররা তো আমাদের সবাইকে চেনেন, জানেন। আর দু’একদিন তো ঝড়-তুফান বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও প্রচারে সমস্যা হতে পারে। এ সময় হাসান সরকারের সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল, যুবনেতা প্রভাষক বশির আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিএনপির ১২০ নেতাকর্মীর নামে যানবাহন ভাঙচুর ও যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে টঙ্গী থানায় মামলা করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে টঙ্গী থানার এসআই আল আমিনের দায়ের করা মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশের হাতে তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে বলে জানিয়েছেন টঙ্গী থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. হাসান। এদিকে, রোববার দুপুরে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর বিকালে তাক্ষণিক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দীন সরকারের বাসা থেকে বের হবার সময় আটক কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানকে ছেড়ে দিলেও তার সঙ্গে আটক হওয়া ১৩ জন ছাড়া পাননি। তারা সবাই ওই মামলার আসামি হয়েছেন। টঙ্গীতে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আটক হওয়ার পর এখন জেলা বিএনপি কার্যালয় নেতাশূন্য হয়ে আছে দু’দিন ধরে। নেতা-কর্মীদের মনে এক ধরনের ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক রয়েছে। তারা বলছেন, গত কয়েকদিনে তাদের বেশ ক’জন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আরো অনেকের বাসায় হানা দেয়া হয়, সে কারণেই তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও নানা ধরনের ভয়-ভীতি রয়েছে। যা তারা এবং তাদের মেয়র প্রার্থী কয়েকদিন ধরেই প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। তবে হাসান উদ্দীন সরকার বলেছেন, এই সাজানো মামলার বয়ে আমরা ভীত নই। এর আগেও আমাদের সকলস্তরের নেতাকর্মীদের নামে অনেক মামলা তারা দিয়েছে।
গত মার্চ মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ছয়টি মৌজা অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছিল ইসি। সেই গেজেট চ্যালেঞ্জ করে এক নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবিএম আজহারুল ইসলাম সুরুজ একটি রিট আবেদন করেন। তার আবেদনের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ ভোট স্থগিত করে।
স্থগিতাদেশ বাতিল করে আগামী ১৫ই মে ভোট গ্রহণের জন্য আইনি লড়াইয়ে নেমেছে বিএনপির মেয়র প্রার্থী।
জাহাঙ্গীর আলমের আইনজীবী আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বাবুল সাংবাদিকদের জানান, সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার যে বিষয়টিকে সামনে রেখে নির্বাচন স্থগিত করানো হয়েছে, ওই বিষয়টি ২০১৩ সালে মীমাংসিত। মীমাংসিত বিষয়টি আদালতে সত্য গোপন করে রিট করে স্থগিতাদেশ নেয়া হয়েছে।
এদিকে সিপিবির মেয়র প্রার্থী কাজী রুহুল আমিন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় জানান, সীমানা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ না করে নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনী তফসিল দিয়ে ঠিক করেনি। নির্বাচনে নেমে তাদের টাকা-পয়সা খরচ হয়ে গেছে। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে না পারলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি ও নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতায় তাদের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।
রিটের খবর জানতো না ইসি
স্টাফ রিপোর্টার জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে জটিলতার বিষয়ে ইসির কাছে কোনো তথ্য ছিল না। শুনানির আগে পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত বিষয়ে রিট হওয়ার খবর ইসি জানত না। গতকাল পর্যন্ত ইসির কাছে অফিসিয়ালি কোনো আদেশ আসেনি। গণমাধ্যমের খবর আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করে ইসি। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে কমিশন কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকও করেনি। সোমবার বিকালে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, এ বিষয়ে আমরা আগে কিছু জানতাম না। গণমাধ্যমের খবরে জানতে পেরেছি হাইকোর্ট গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত করেছেন। আদালতের নির্দেশনার প্রতি সম্মান রেখে আমরা এ নির্বাচনের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি।
সীমানা জটিলতা সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি নিয়ে রোববার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ভোটের মাত্র নয়দিন আগে প্রার্থীদের প্রচারণার মধ্যে গাজীপুর এই নির্বাচন স্থগিত হয়। সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের ৬টি মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এ রিট আবেদন করেন সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও ১ নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবিএম আজহারুল ইসলাম সুরুজ। এর আগে তিন বছর আগে ওই ছয় মৌজার সীমানা জটিলতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন আজহারুল ইসলাম। পরে হাইকোর্টের দেয়া রুলের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ বিষয়টি নিষ্পত্তি করে ৬টি মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করে। চলতি বছরের ৪ঠা মার্চ এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন এবং গাজীপুর সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বৈধতা চ্যালেঞ্জ রোববার রিট আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম।
নির্বাচন স্থগিতে হতাশা-ক্ষোভ
সীমানা জটিলতা নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর উৎসবের আমেজে ভাটা পড়েছে। নগরবাসীর মনে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্থবির হয়ে গেছে নির্বাচনী কার্যক্রম। প্রায় তিনশ ত্রিশ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উৎসবের নগরে যেন শোকের আবহ নেমে এসেছে। প্রধান দুজন মেয়র প্রার্থী ছাড়াও অন্য মেয়র প্রার্থী এবং কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা ভেঙে পড়েছেন। নানা লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাচ্ছেন তারা। নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সিপিবির মেয়র প্রার্থী এই নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগও দাবি করেছেন। অন্যদিকে টঙ্গী থানায় বিএনপির ১২০ জন নেতাকর্মীর নামে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
স্থগিত হওয়ার পর দুদিন ধরেই ঢাকায় দৌড়-ঝাঁপ করছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। নির্বাচনী লড়াইয়ে তারা বিজয়ের পথে ছিলেন উল্লেখ করে করণীয় নিয়ে তাদের নেতাদের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। নির্বাচন স্থগিত হওয়ার বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি চাই নির্বাচনটা হোক। কারণ আমি গণতন্ত্রের চর্চা করি। গাজীপুর সিটির উন্নয়নের স্বার্থে আমি সবার সহযোগিতা চাই। চলমান প্রক্রিয়ায়, যেকোনো প্রক্রিয়ায় নির্বাচনটা ১৫ই মে হয়ে যাক, সেটাই আমি চাইছি। এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ বলেছেন, নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের বিজয়ের পথে জোয়ার উঠেছিল। সেই জায়গাতে নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় নগরবাসীর মনে কষ্ট রয়েছে। তবে সীমানা জটিলতায় নির্বাচন স্থগিত হওয়ার প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করে তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। নির্বাচন স্থগিত হওয়ার বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমান বলেন, আমরা একটা ভোটের উৎসবে ছিলাম। নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় মনে হচ্ছে ভূমিকম্পের পরবর্তী অবস্থার মতো আমরা থমকে আছি। নির্বাচন বন্ধ হবার বিষয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গাজীপুর জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় নগরবাসীর ক্ষতি হয়েছে। তবে নির্বাচন স্থগিত হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা নিজ দলের নেতাদের অবস্থান বুঝতে পেরেছেন। কোন কোন নেতা তাদের পক্ষে নির্বাচনে নেমেছেন আর কোন কোন নেতা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মাঠে না নেমে কি ভূমিকায় আছেন তা টের পেয়ে গেছেন প্রার্থীরা।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দীন সরকার সোমবার সকালে তার বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ১৫ই মে নির্বাচনের ব্যাপারে এবং জয়ের ব্যাপারে এখনো পুরোপুরি আশাবাদী। তিনি বলেন, সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক হলে আদালতে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত প্রতিকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। স্থগিত হওয়ায় হয়তো, প্রচারে দু-একদিন ক্ষতি হয়েছে। তাতে সমস্যা নেই, ভোটাররা তো আমাদের সবাইকে চেনেন, জানেন। আর দু’একদিন তো ঝড়-তুফান বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও প্রচারে সমস্যা হতে পারে। এ সময় হাসান সরকারের সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল, যুবনেতা প্রভাষক বশির আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিএনপির ১২০ নেতাকর্মীর নামে যানবাহন ভাঙচুর ও যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে টঙ্গী থানায় মামলা করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে টঙ্গী থানার এসআই আল আমিনের দায়ের করা মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশের হাতে তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে বলে জানিয়েছেন টঙ্গী থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. হাসান। এদিকে, রোববার দুপুরে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর বিকালে তাক্ষণিক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দীন সরকারের বাসা থেকে বের হবার সময় আটক কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানকে ছেড়ে দিলেও তার সঙ্গে আটক হওয়া ১৩ জন ছাড়া পাননি। তারা সবাই ওই মামলার আসামি হয়েছেন। টঙ্গীতে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আটক হওয়ার পর এখন জেলা বিএনপি কার্যালয় নেতাশূন্য হয়ে আছে দু’দিন ধরে। নেতা-কর্মীদের মনে এক ধরনের ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক রয়েছে। তারা বলছেন, গত কয়েকদিনে তাদের বেশ ক’জন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আরো অনেকের বাসায় হানা দেয়া হয়, সে কারণেই তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও নানা ধরনের ভয়-ভীতি রয়েছে। যা তারা এবং তাদের মেয়র প্রার্থী কয়েকদিন ধরেই প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। তবে হাসান উদ্দীন সরকার বলেছেন, এই সাজানো মামলার বয়ে আমরা ভীত নই। এর আগেও আমাদের সকলস্তরের নেতাকর্মীদের নামে অনেক মামলা তারা দিয়েছে।
গত মার্চ মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ছয়টি মৌজা অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছিল ইসি। সেই গেজেট চ্যালেঞ্জ করে এক নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবিএম আজহারুল ইসলাম সুরুজ একটি রিট আবেদন করেন। তার আবেদনের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ ভোট স্থগিত করে।
স্থগিতাদেশ বাতিল করে আগামী ১৫ই মে ভোট গ্রহণের জন্য আইনি লড়াইয়ে নেমেছে বিএনপির মেয়র প্রার্থী।
জাহাঙ্গীর আলমের আইনজীবী আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বাবুল সাংবাদিকদের জানান, সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার যে বিষয়টিকে সামনে রেখে নির্বাচন স্থগিত করানো হয়েছে, ওই বিষয়টি ২০১৩ সালে মীমাংসিত। মীমাংসিত বিষয়টি আদালতে সত্য গোপন করে রিট করে স্থগিতাদেশ নেয়া হয়েছে।
এদিকে সিপিবির মেয়র প্রার্থী কাজী রুহুল আমিন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় জানান, সীমানা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ না করে নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনী তফসিল দিয়ে ঠিক করেনি। নির্বাচনে নেমে তাদের টাকা-পয়সা খরচ হয়ে গেছে। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে না পারলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি ও নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতায় তাদের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।
রিটের খবর জানতো না ইসি
স্টাফ রিপোর্টার জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে জটিলতার বিষয়ে ইসির কাছে কোনো তথ্য ছিল না। শুনানির আগে পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত বিষয়ে রিট হওয়ার খবর ইসি জানত না। গতকাল পর্যন্ত ইসির কাছে অফিসিয়ালি কোনো আদেশ আসেনি। গণমাধ্যমের খবর আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করে ইসি। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে কমিশন কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকও করেনি। সোমবার বিকালে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, এ বিষয়ে আমরা আগে কিছু জানতাম না। গণমাধ্যমের খবরে জানতে পেরেছি হাইকোর্ট গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত করেছেন। আদালতের নির্দেশনার প্রতি সম্মান রেখে আমরা এ নির্বাচনের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি।
No comments