কারাগারে খালেদার তিন মাস: সবার দৃষ্টি আজ আদালতে by কাফি কামাল
কারাগারে
তিন মাস কেটে গেছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। স্যাঁতসেঁতে বদ্ধ
পরিবেশ, নিঃসঙ্গতা ও প্রয়োজনীয় অর্থোপেডিক বেডের অভাবে কারাগারে অসুস্থ হয়ে
পড়েছেন তিনি। প্রথম দিকে অসুস্থতার মাত্রা সহনীয় হলেও বর্তমান পরিস্থিতি
গুরুতর। কারাবন্দি খালেদা জিয়ার চাহিদা ও বিএনপির অব্যাহত দাবির মুখেও
কারাকর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়নি সুচিকিৎসার। ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের
পর্যবেক্ষণে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ মেলেনি তার। সরকারি
চিকিৎসকদের পরামর্শও বাস্তবায়ন হয়নি। কারাবন্দি চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসার
দাবিতে বিএনপি নেতারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ আসেনি। ফলে দিনদিন খারাপের দিকেই
যাচ্ছে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য। বাম হাত ও বাম পা ফুলে গেছে। অর্থোপেডিকের
তীব্র ব্যথায় হাঁটাচলা করতে পারছেন না তিনি। এমন পরিস্থিতিতে আজ তার জামিন
শুনানি দিন ধার্য্য রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। বিএনপি
চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সমন্বিত
সিদ্ধান্ত পরিচালিত হচ্ছে দল। তবে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তার অভাব
অনুভব করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর থেকে
অব্যাহত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত তৈরি ও সরকারের ওপর চাপ
সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে গেছে বিএনপি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের
ধরন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে দলটি।
কারাগারে প্রথম তিনদিন ডিভিশন পাননি খালেদা জিয়া। পরে ডিভিশন পেলেও মেলেনি প্রয়োজনীয় অর্থোপেডিক বেড। অপরিসর খাট, শক্ত বিছানার কারণে পুরনো অর্থোপেডিকের সমস্যা বেড়েছে তার। একপর্যায়ে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। তার অসুস্থতার মাত্রা নির্ণয় ও সুচিকিৎসা নিয়ে দুই মাস ধরে নানাভাবে দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। তাদের অভিযোগ, পুরনো পরিত্যক্ত কারাগারের বদ্ধ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, একাকিত্ব ও প্রয়োজনীয় অর্থোপেডিক বেডের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। তার পরিবারের সদস্যরা প্রথম অসুস্থতার বিষয়টি সামনে আনে। তারা জানায়, বাম হাত ও হাঁটুতে সমস্যাসহ বয়সজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরপর বিএনপি জোর দাবি জানায়, বাইরের চিকিৎসকের পরামর্শসহ চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন তার। কিন্তু বারবার বিএনপির দাবিকে অগ্রাহ্য করে সরকার। একপর্যায়ে সরকারি চিকিৎসকদের নিয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার পরামর্শ নেয় কারাকর্তৃপক্ষ। সরকারি মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এনে কয়েকটি এক্স-রে করা হয় তার। এক্স-রে রিপোর্ট দেখে মেডিকেল বোর্ড সমস্যা চিহ্নিত ও পরামর্শ দেয়। কারাকর্তৃপক্ষ তাও ফলো করেনি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া সরকারি চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধও খাচ্ছেন না। তিনি বারবার তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া নেতা ও স্বজনদের। বিএনপির অব্যাহত দাবির মুখে কারাকর্তৃপক্ষ অনানুষ্ঠানিকভাবে একজন মহিলা চিকিৎসক ডাকলেও তার পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ করা হলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি। এদিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে ফুলে গেছে খালেদা জিয়ার বাম হাত ও বাম পা। তীব্র স্নায়ুবিক ব্যথার কারণে তিনি হাঁটাচলা করতে পারছেন না। সম্প্রতি দোতলা থেকে হেঁটে নামতে না পারায় স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। সর্বশেষ কয়েকজন আইনজীবী সাক্ষাৎ করতে গেলে খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। তার অসুস্থতার তীব্রতার কথা যেন আইনজীবীরা আদালতের কাছে তুলে ধরেন। তারপরও কারাগারে সাধারণ খাবার খাচ্ছেন খালেদা জিয়া। বিশেষ কোনো চাহিদাও নেই তার। এতকিছুর পরও মনোবল হারাননি খালেদা জিয়া। নেতাদের পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত তিনি। বিএনপির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন নিয়মতান্ত্রিক পথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের। কোনো ধরনের উস্কানিতে পা না দিতে করেছেন সতর্ক।
কারাগারে পাঠানোর পর থেকে কোনো মামলাতেই কারাকর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে হাজির করেনি নিম্ন আদালতে। প্রতিবারই তার অনুপস্থিতির কারণ দেখানো হয়েছে শারীরিক অসুস্থতা। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর এক মাসের মাথায় ৭ই মার্চ তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান স্থায়ী কমিটির ৭ সদস্যসহ ৮ জন। তারপর একাধিকবার মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আইনজীবীরা সাক্ষাৎ করেছেন কয়েকবার। প্রতি সপ্তাহে একবার নিয়মিত সাক্ষাৎ পাচ্ছেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পর লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসে কয়েকদফা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও তার দুই কন্যা। তবে শারীরিক অসুস্থতাকে কারণ দেখিয়ে একাধিকবার দলের নেতা ও পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বাতিলও করেছে কারাকর্তৃপক্ষ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে দাবি করে এসেছে বিএনপি। কিন্তু আইনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মামলাটি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার চেয়ে প্রাধান্য দেয় আইনি মোকাবিলায়। রায়ের পর রায়ের অনুলিপি পেতে, উচ্চআদালতে নথি সরবরাহ ও জামিনে বিলম্বের পরও কড়া কর্মসূচির দিকে যায়নি বিএনপি। বিএনপির অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে খালেদা জিয়ার মামলায় যুক্ত হয়েছেন দুজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল। বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা আইনজীবী কথা দিয়েছেন আইনি সহায়তা দানের। এছাড়া খালেদা জিয়ার মামলার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ দান এবং বিচারে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা হচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে একজন বৃটিশ আইনজীবী। খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইল কিউসি ইতিমধ্যে তার মামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কথাও বলেছেন। উল্লেখ্য, ৮ই ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠানোর পর ১২ই মার্চ হাইকোর্ট থেকে জামিন পান খালেদা জিয়া। জামিনের বিরুদ্ধে দুদকের আপিলের প্রেক্ষিতে চেম্বার জজ তা আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ একটি বেঞ্চ ১৯শে মার্চ দেয়া এক আদেশে ৮ই মে পর্যন্ত জামিন স্থগিত করেন। ফলে আটকে যায় খালেদা জিয়ার মুক্তি। কারাগারে যাওয়ার দীর্ঘ তিন মাস পর আজ তার জামিন শুনানির দিন ধার্য্য রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। বিএনপি নেতারা প্রত্যাশা করছেন এবার জামিন মিলবে খালেদা জিয়ার। কিন্তু ইতিমধ্যে কুমিল্লায় দায়েরকৃত অন্য মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফলে সবার কৌতূহল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আজ খালেদা জিয়া কি জামিন পাবেন। সবার চোখ এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
খালেদার জামিন প্রশ্নে আপিল বিভাগে শুনানি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে আজ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বেঞ্চে এ শুনানি হবে। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকায় ‘দুর্নীতি দমন কমিশন বনাম বেগম খালেদা জিয়া’ মামলাটি তালিকার ৯ নম্বরে রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গত ১২ই মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরে হাইকোর্টের দেয়া জামিনের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। গত ১৪ই মার্চ আপিল বিভাগ এক আদেশে খালেদা জিয়ার জামিন ১৮ই মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে লিভ টু আপিল দায়েরের নির্দেশ দেন। পরদিন দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা পৃথক লিভ টু আপিল করেন। ১৯শে মার্চ এক আদেশে খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করে ৮ই মে শুনানির দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আদেশের দুই সপ্তাহের মধ্যে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে এবং এর পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে আসামিপক্ষকে আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দিতে বলা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দিয়েছেন।
গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং অন্য আসামিদের ১০ বছর কারাদণ্ড দেন আদালতের বিচারক। পাশাপাশি আসামিদের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা অর্থদণ্ড দেন আদালত। রায়ের পর খালেদাকে রাখা হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলেও খালেদা জিয়ার সামাজিক ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পরে বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের মাধ্যমে হাইকোর্টে আপিল ও জামিনের আবেদন করেন খালেদা জিয়া।
কারাগারে প্রথম তিনদিন ডিভিশন পাননি খালেদা জিয়া। পরে ডিভিশন পেলেও মেলেনি প্রয়োজনীয় অর্থোপেডিক বেড। অপরিসর খাট, শক্ত বিছানার কারণে পুরনো অর্থোপেডিকের সমস্যা বেড়েছে তার। একপর্যায়ে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। তার অসুস্থতার মাত্রা নির্ণয় ও সুচিকিৎসা নিয়ে দুই মাস ধরে নানাভাবে দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। তাদের অভিযোগ, পুরনো পরিত্যক্ত কারাগারের বদ্ধ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, একাকিত্ব ও প্রয়োজনীয় অর্থোপেডিক বেডের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। তার পরিবারের সদস্যরা প্রথম অসুস্থতার বিষয়টি সামনে আনে। তারা জানায়, বাম হাত ও হাঁটুতে সমস্যাসহ বয়সজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরপর বিএনপি জোর দাবি জানায়, বাইরের চিকিৎসকের পরামর্শসহ চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন তার। কিন্তু বারবার বিএনপির দাবিকে অগ্রাহ্য করে সরকার। একপর্যায়ে সরকারি চিকিৎসকদের নিয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার পরামর্শ নেয় কারাকর্তৃপক্ষ। সরকারি মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এনে কয়েকটি এক্স-রে করা হয় তার। এক্স-রে রিপোর্ট দেখে মেডিকেল বোর্ড সমস্যা চিহ্নিত ও পরামর্শ দেয়। কারাকর্তৃপক্ষ তাও ফলো করেনি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া সরকারি চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধও খাচ্ছেন না। তিনি বারবার তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া নেতা ও স্বজনদের। বিএনপির অব্যাহত দাবির মুখে কারাকর্তৃপক্ষ অনানুষ্ঠানিকভাবে একজন মহিলা চিকিৎসক ডাকলেও তার পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ করা হলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি। এদিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে ফুলে গেছে খালেদা জিয়ার বাম হাত ও বাম পা। তীব্র স্নায়ুবিক ব্যথার কারণে তিনি হাঁটাচলা করতে পারছেন না। সম্প্রতি দোতলা থেকে হেঁটে নামতে না পারায় স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। সর্বশেষ কয়েকজন আইনজীবী সাক্ষাৎ করতে গেলে খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। তার অসুস্থতার তীব্রতার কথা যেন আইনজীবীরা আদালতের কাছে তুলে ধরেন। তারপরও কারাগারে সাধারণ খাবার খাচ্ছেন খালেদা জিয়া। বিশেষ কোনো চাহিদাও নেই তার। এতকিছুর পরও মনোবল হারাননি খালেদা জিয়া। নেতাদের পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত তিনি। বিএনপির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন নিয়মতান্ত্রিক পথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের। কোনো ধরনের উস্কানিতে পা না দিতে করেছেন সতর্ক।
কারাগারে পাঠানোর পর থেকে কোনো মামলাতেই কারাকর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে হাজির করেনি নিম্ন আদালতে। প্রতিবারই তার অনুপস্থিতির কারণ দেখানো হয়েছে শারীরিক অসুস্থতা। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর এক মাসের মাথায় ৭ই মার্চ তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান স্থায়ী কমিটির ৭ সদস্যসহ ৮ জন। তারপর একাধিকবার মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আইনজীবীরা সাক্ষাৎ করেছেন কয়েকবার। প্রতি সপ্তাহে একবার নিয়মিত সাক্ষাৎ পাচ্ছেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পর লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসে কয়েকদফা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও তার দুই কন্যা। তবে শারীরিক অসুস্থতাকে কারণ দেখিয়ে একাধিকবার দলের নেতা ও পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বাতিলও করেছে কারাকর্তৃপক্ষ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে দাবি করে এসেছে বিএনপি। কিন্তু আইনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মামলাটি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার চেয়ে প্রাধান্য দেয় আইনি মোকাবিলায়। রায়ের পর রায়ের অনুলিপি পেতে, উচ্চআদালতে নথি সরবরাহ ও জামিনে বিলম্বের পরও কড়া কর্মসূচির দিকে যায়নি বিএনপি। বিএনপির অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে খালেদা জিয়ার মামলায় যুক্ত হয়েছেন দুজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল। বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা আইনজীবী কথা দিয়েছেন আইনি সহায়তা দানের। এছাড়া খালেদা জিয়ার মামলার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ দান এবং বিচারে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা হচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে একজন বৃটিশ আইনজীবী। খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইল কিউসি ইতিমধ্যে তার মামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কথাও বলেছেন। উল্লেখ্য, ৮ই ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠানোর পর ১২ই মার্চ হাইকোর্ট থেকে জামিন পান খালেদা জিয়া। জামিনের বিরুদ্ধে দুদকের আপিলের প্রেক্ষিতে চেম্বার জজ তা আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ একটি বেঞ্চ ১৯শে মার্চ দেয়া এক আদেশে ৮ই মে পর্যন্ত জামিন স্থগিত করেন। ফলে আটকে যায় খালেদা জিয়ার মুক্তি। কারাগারে যাওয়ার দীর্ঘ তিন মাস পর আজ তার জামিন শুনানির দিন ধার্য্য রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। বিএনপি নেতারা প্রত্যাশা করছেন এবার জামিন মিলবে খালেদা জিয়ার। কিন্তু ইতিমধ্যে কুমিল্লায় দায়েরকৃত অন্য মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফলে সবার কৌতূহল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আজ খালেদা জিয়া কি জামিন পাবেন। সবার চোখ এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
খালেদার জামিন প্রশ্নে আপিল বিভাগে শুনানি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে আজ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বেঞ্চে এ শুনানি হবে। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকায় ‘দুর্নীতি দমন কমিশন বনাম বেগম খালেদা জিয়া’ মামলাটি তালিকার ৯ নম্বরে রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গত ১২ই মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরে হাইকোর্টের দেয়া জামিনের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। গত ১৪ই মার্চ আপিল বিভাগ এক আদেশে খালেদা জিয়ার জামিন ১৮ই মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে লিভ টু আপিল দায়েরের নির্দেশ দেন। পরদিন দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা পৃথক লিভ টু আপিল করেন। ১৯শে মার্চ এক আদেশে খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করে ৮ই মে শুনানির দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আদেশের দুই সপ্তাহের মধ্যে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে এবং এর পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে আসামিপক্ষকে আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দিতে বলা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দিয়েছেন।
গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং অন্য আসামিদের ১০ বছর কারাদণ্ড দেন আদালতের বিচারক। পাশাপাশি আসামিদের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা অর্থদণ্ড দেন আদালত। রায়ের পর খালেদাকে রাখা হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলেও খালেদা জিয়ার সামাজিক ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পরে বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের মাধ্যমে হাইকোর্টে আপিল ও জামিনের আবেদন করেন খালেদা জিয়া।
No comments