আবাসিকে বাড়ছে না গ্যাসের দাম
জাতীয়
নির্বাচনকে সামনে রেখে বাসাবাড়িতে (আবাসিক) গ্যাসের দাম না বাড়ানোর
সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাবে আগামী মাস থেকেই বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুৎ
কেন্দ্র, সার কারখানা, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজি, শিল্প-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন
খাতে গ্যাসের দাম। এ মুহূর্তে মোট উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ১৫ শতাংশ
বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ
উৎপাদন কেন্দ্র ও সার সারখানায় ২০০ শতাংশ করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। এ
ছাড়া অন্য শিল্পকারখানা, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজিসহ অন্য খাতগুলোয় ৪০-১০০
শতাংশ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ
কেন্দ্রগুলোয় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ হচ্ছে ৩.১৬ টাকা। নতুন
প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়লে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে প্রতি ইউনিট গ্যাসের
দাম দিতে হবে ৯.৪৮ টাকা। এ খাতে উৎপাদিত গ্যাসের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত
হচ্ছে। এ ছাড়া সার কারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য দাম দিতে হয়
২.৭১ টাকা। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম
পড়বে ৮.১৩ টাকা। উৎপাদিত মোট গ্যাসের প্রায় ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় সার
কারখানায়। আর শিল্প-কলকারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ
হচ্ছে গড়ে ৭.৭৬ টাকা। এ খাতে প্রস্তাব অনুযায়ী ১০০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব
কার্যকর হলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য গ্রাহককে মূল্য পরিশোধ করতে হবে
১৫.৫২ টাকা। এ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন
কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমান যুগান্তরকে
বলেন, তারা ইতিমধ্যে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছেন। তবে
বাসাবাড়ির (আবাসিক) জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) জন্য দাম বৃদ্ধির
প্রস্তাব কম হবে।
সে ক্ষেত্রে এ খাতে ৩০-৩৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা
হতে পারে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তিতাস ২০০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব
চূড়ান্ত করেছে। বর্তমানে মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৪১ শতাংশই বিদ্যুৎ খাতে খরচ
হয়। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, আগামী মাসের
২৬ তারিখ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।
এর আগেই সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে। চলতি বছর ১০০০
মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে ১৪ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা
অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে। এ টাকা সমন্বয় করতে গ্যাসের দাম বাড়ানো ছাড়া
কোনো বিকল্প নেই বলে যুগান্তরের কাছে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তিতাস
গ্যাস কোম্পানিসহ সব বিতরণ কোম্পানিকে এলএনজির দাম সমন্বয় করে প্রস্তাব
তৈরি করে বিইআরসির কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, বিতরণ কোম্পানিগুলো
আগামী ২-১ দিনের মধ্যে বিইআরসির কাছে এ প্রস্তাব জমা দেবে। জ্বালানি বিভাগ
সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের জন্য ভর্তুকি বন্ধে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর
উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বাসাবাড়ির (আবাসিক) গ্যাসের
দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। গত বছরের ২৩ ফেব্র“য়ারি সরকার গ্যাসের গড়
মূল্য ২২.৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে। বিইআরসি দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর
সিদ্ধান্ত দিলেও উচ্চ আদালতের রায়ে দ্বিতীয় দফা গ্যাসের দাম বাড়ানোর
সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সরকার গত কয়েক বছরে সাড়ে ৩শ’র বেশি
শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দিলেও তা অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি।
পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় সরকার এসব
শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ দিতে পারছে না। এ কারণে উচ্চমূল্যের জ্বালানি
এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগামী এপ্রিলে প্রথম
দফায় ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। এই গ্যাস এলএনজি আকারে
এলেও তা গ্যাসে রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে মিশ্রণ আকারে যোগ করা হবে।
দ্বিতীয় দফায় অক্টোবরে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি বর্তমান গ্যাসের সঙ্গে
মিশ্রিত হয়ে যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। এ জন্য সরকারকে অতিরিক্ত ১৪-১৫ হাজার
কোটি টাকা বেশি অর্থ গুনতে হবে। এর মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকা জোগান হবে
এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড থেকে। বাকি টাকার জোগান দিতে সরকার আন্তর্জাতিক
ইসলামি ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে উচ্চসুদে ঋণ নেয়ার
পাশাপাশি গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। বিইআরসির একজন শীর্ষ
কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, তিতাস, জালালাবাদ,
কর্ণফুলী, বাখরাবাদ, পিজিসিএলসহ সব বিতরণ কোম্পানিকে দাম সমন্বয় করে
প্রস্তাব পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এ প্রস্তাব তারা যাচাই-বাছাই করে গ্যাসের
দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার
এলএনজি বিক্রি হচ্ছে ১৩.৫২ টাকা। অপরদিকে স্থানীয়ভাবে দেশে প্রতি ঘনমিটার
গ্যাসের দাম রাখা হচ্ছে গড়ে ৭.৩৫ টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়ায় ৬.১৭ টাকা।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২৬৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন
হচ্ছে।
এর মধ্যে অর্ধেক গ্যাস চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে। অথচ এসব
ক্ষেত্রে সরকার প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম পাচ্ছে মাত্র ২.৭০ টাকা থেকে সাড়ে ৩
টাকা। এখানেও সরকার সাড়ে তিন টাকার বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে। এলএনজি এলে এই
ভর্তুকি দাঁড়াবে ১০ টাকার বেশি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার বিদ্যুৎ
ও সার খাতে যদি ভর্তুকি না দিত তাহলে এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো
না। এ খাতে দেয়া ভর্তুকি দিতে গিয়ে এখন জনগণের পকেট কাটার চিন্তা-ভাবনা
করছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়লে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। একইভাবে
শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এতে শত শত
শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বেকার হয়ে যাবেন হাজার হাজার কর্মচারী।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এসএম
শামসুল আলম বলেন, বছর ঘুরতে না ঘুরতে ফের গ্যাসের দাম বাড়ানো জনস্বার্থের
জন্য অনুকূল নয়। তিনি বলেন, গ্যাস খাতের প্রতিটি কোম্পানির হাতে বিপুল
পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে, যা দিয়ে এলএনজির বাড়তি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব
হবে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। শিল্প মালিকরা
বলেছেন, এখন গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হলে তা কোনোমতেই শিল্প খাত সহ্য করতে
পারবে না। শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে। তখন দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম
বেড়ে যাবে, মানুষ বিদেশি পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকবে। সার্বিকভাবে এর প্রভাব
পড়বে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর। তারা বলেছেন, সরকার এখন
গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে শিল্প-কারখানাগুলো ধসে পড়বে। রফতানি
খাত প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। আমদানি বিকল্প স্থানীয় শিল্পপণ্য বিদেশি
পণ্যের কাছে মার খাবে।
No comments