বাংলাদেশের তরুণীদের হিজাব ভাবনা

‘দীর্ঘসময় কোরআন নিয়ে গবেষণার পর গেল ১ জানুয়ারি আমি শাহাদা পাঠ করি। ইসলামের প্রতিটি দিক এতই চমৎকার যে, আমি দ্বিধায় পড়ে যাই- কোন মুক্তাটি আগে ধারণ করব? অনেক ভেবেচিন্তে হিজাবের মুক্তাটিই অঙ্গে জড়িয়ে নিই। হিজাবের অলঙ্কার পরে শান্তির ধর্মে পথচলা শুরু হয় আমার।’ কথাগুলো বলেছেন মালয়েশিয়ান তরুণী শিলা। মেক্সিকো থেকে আন্দ্রেয়া ইসাবেলা লিখেছেন, ‘আমি মুসলিম নই। নিয়মিত হিজাব পরি। সব নারীকেই হিজাব পরা উচিত।’ আমেরিকান তরুণী ওয়াইজেকসিন লিখেছেন, ‘চার বছর আগেও আমি ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণায় ডুবে ছিলাম। তিন বছর হল আমি কোরআন পড়ছি। আর এটি দ্বিতীয় বছর, আমি ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে-কে সাপোর্ট করছি।’ বিশ্ব হিজাব দিবস উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ‘ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে’র ফ্যান পেজে এভাবেই নিজেদের হিজাব-অনুভূতি ও মন্তব্য পোস্ট করেন হিজাবপ্রেমীরা। হিজাব পরে ছবি আপলোডও করছেন তারা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব দেশের সব বয়সের নারীই তাদের অনুভূতি শেয়ার করেছেন কোটি মানুষের সঙ্গে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নাজমা খানমের আহ্বানে ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে পালিত হয়। শুরুর বছরই ৬৭টি দেশ হিজাব দিবস উদযাপনে অংশ নেয়। দুই বছরের মাথায় ১৫০টি দেশ এবং মাত্র চার বছরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই অনন্য হিজাব উৎসব। এ বছরও ১ ফেব্রুয়ারি ১৯০টি দেশে একযোগে পালিত হয়েছে বিশ্ব হিজাব দিবস। হিজাব ডে উপলক্ষে বাংলাদেশের তরুণীদের হিজাব ভাবনা-অনুভূতি এবং হিজাবের নিত্য বিষয় নিয়ে কথা হয় ৪ তরুণীর সঙ্গে। যুগান্তর পাঠকদের জন্য চুম্বাকাংশ তুলে ধরা হল।
রীমা সুলতানা
শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
প্রশ্ন : হিজাব বলতে কী বোঝেন?
উত্তর : হিজাব হল একটি আবরণ, যা আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখে। এ আবরণের ওপর আরেকটি চাদর মাথা ও বুকের ওপর ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কোরআন। এটাকে বলা হয় ‘জিলবাব’। দুঃখজনক হলেও সত্য, জিলবাব বলতে আমরা শুধু বোরকাকেই বুঝি। এই যে আমি ড্রেস পরেছি, মাথা ও বুকে আলাদা স্কার্ফ জড়িয়েছি, কোরআনের আয়নায় আমার হিজাব হয়ে গেছে। কিন্তু সমাজের অনেকেই একে হিজাব বলে মানতে রাজি নয়।
প্রশ্ন : আপনি বলতে চাইছেন ‘বোরকা’ জিলবাব বা হিজাবের অংশ নয়?
উত্তর : আমি মোটেও সেরকমটি বলনি। বোরকা অবশ্যই জিলবাবের উদ্দেশ্য পূরণ করে। একই সঙ্গে আমার স্বাভাবিক ড্রেস এবং স্কার্ফও জিলবাবের অন্তর্ভুক্ত। অনেকেই বিষয়টি সহজভাবে নেন না। কেউ যদি বোরকার মাধ্যমে হিজাব করেন, তাকে যেমন নিষেধ করার অধিকার আমার নেই; একইভাবে আমি যদি শালীন ড্রেসে হিজাব করি আমাকেও বাঁকা চোখে দেখার অধিকার কোরআন কাউকে দেয়নি।
রোজা মায়িশা বানী
শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রেশন, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, ঢাকা।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে এখনও হিজাব ডে তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি কেন?
উত্তর : এটা দুঃখজনক। হিজাবের মতো ফরজ ইবাদত নিয়ে বিশ্ব যখন জেগে উঠেছে, তখনও আমরা অধিকাংশ মুসলমানের দেশে বিশ্ব-কণ্ঠের সঙ্গে সুর মেলাতে পারছি না। গত একশ’ বছর ধরে আলেম-ওলামারা পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াজ-লেখালেখি করছেন। এরকম একটি আয়োজনে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করা ছিল সময়ের দাবি। আফসোস! অনেকে জানেও না, হিজাব নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক দিবস আছে। সেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সের নারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে। শুধু হিজাবের সৌন্দর্য-নিরাপত্তা এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করছেন লাখ লাখ নারী। সে খবর এ মুসলিম দেশে আমরা ক’জন রাখি?
প্রশ্ন : ইসলাম দিবসনির্ভর ধর্ম নয়। তাই কোনো ধরনের দিবস উদযাপনে ধর্মদরদিরা এগিয়ে আসেন না। ঠিক এ কারণেই কী হিজাব দিবসেও কাক্সিক্ষত সাড়া মিলছে না?
উত্তর : ইসলাম দিবসনির্ভর ধর্ম নয়- এ কথাটিই সঠিক নয়। বরং ইসলামই সবচেয়ে বেশি দিবসনির্ভর ধর্ম। ঈদের দিন, জুমার দিন, মিলাদুন্নবী, শবেবরাতসহ অনেক দিবসই আমরা পালন করি। এর বাইরেও অনেক দল-খানকার উদ্যোগে বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়। তাহলে হিজাব দিবস পালনের ক্ষেত্রে ধর্মের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে থাকা কেন? পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইন্স ডেসহ অন্যসব দিবস যদি পালন করা যেতে পারে, তবে হিজাব ডে, সালাত ডে, সালাম ডে পালন করতে দোষ কোথায়? নবীজী (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘কেউ যদি কোনো ভালো কাজের উদ্যোগ নেয়, তবে যত লোক ভালো কাজটি করবে, সবার সমান সওয়াব উদ্যোক্তা পাবে।’ অপসংস্কৃতির সয়লাব রোখার জন্য হলেও এ ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এগিয়ে আসা জরুরি।
তানিয়া আক্তার
শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
প্রশ্ন : আপনি কেন হিজাব করেন?
উত্তর : আমার ভালো লাগে তাই হিজাব করি। হিজাব আমাকে নিরপত্তা দেয়। দেয় সুসাস্থ্যও। হিজাব করার ফলে আমার চুল ধুলাবালি এবং সরাসরি সূর্যরশ্মি থেকে মুক্ত থাকে। এতে করে চুলের সাস্থ্য যেমন ঠিক থাকে তেমনি চুলের যতœ নেওয়াও সহজ হয়।
প্রশ্ন : কবে থেকে আপনি হিজাব করছেন?
উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি হিজাব শুরু করি। হিজাব করার আগের এবং পরের অনুভূতি আমার কাছে ভিন্ন রকম। হিজাব আমাকে সম্মান এবং নিরাপত্তা দিয়েছে। যা হিজাবহীন জীবনে পাইনি। হিজাব ডে’র মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে নারী তার প্রকৃত অধিকার ও সম্মান ফিরে পাবে- এই আমাদের প্রত্যাশা।
জান্নাতুল কাবিনূর কুয়াশা
শিক্ষার্থী, আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ
প্রশ্ন : আপনি কি হিজাব করেন?
উত্তর : আসলে আমার সাইনোসাইটিসের প্রবলেম আছে। তাই হিজাব করতে পারি না। তবে আমি হিজাব ভালোবাসি এবং সব নারীর জন্য হিজাব জরুরি মনে করি।
প্রশ্ন : কেন হিজাব সবার জন্য জরুরি?
উত্তর : হিজাবের সাস্থ্যগত উপকারিতা তো আছেই, একই সঙ্গে হিজাব আমাদের নিরাপত্তা দেয়। কোরআনেও আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তোমরা হিজাব করো। হিজাব তোমাদের বখাটেদের বখাটেপনা থেক রক্ষা করবে।’
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail : alfatahmamun@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.