নিয়ন্ত্রণহীন খেলাপি ঋণ ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত
তখন ঋণের সুদ বেড়ে যাবে। সার্বিকভাবে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে। এতে ভালো ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে না। এছাড়া ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে। এটি হলে অনেক বিপদ। তখন ব্যাংকের বাইরে টাকা চলে যাবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ২০১০ সালে ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ গঠন করার পর থেকে সরকারি ব্যাংকে ঋণের নামে ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে। সে ঋণগুলো বারবার খেলাপি হচ্ছে। তবে নতুন ঋণ খুব বেশি খেলাপি হচ্ছে না। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বর্তমান এমডিরা যথেষ্ট ভালো। আশা করছি, ঘুরে দাঁড়াবে। তবে সময় লাগবে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে দুর্যোগ বেড়েই চলেছে। খেলাপি ঋণ প্রতি বছর বাড়ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। তারল্য সংকটও প্রকট। সার্বিক চিত্র হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর পথে সরকার যাচ্ছে না। এর জন্য দরকার আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন। এরপর সব ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপির বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে। এটি না করলে খেলাপি ঋণ কখনও কমবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ২০১৬ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের শতকরা ৯ দশমিক ৩১ ভাগ। তবে এর বাইরে অবলোপনকৃত ৫৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ মামলায় আটকে আছে। এ ঋণ হিসাবে নিলে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়াবে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। অবলোপনকৃত ঋণ মন্দ ঋণ হওয়ায় নীতিমালা অনুযায়ী এসব ঋণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে আলাদা করে রাখা হয়। এছাড়া তথ্য গোপন করে বিপুল অঙ্কের খেলাপিযোগ্য ঋণকে খেলাপি না দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনেও এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য আইনগত জটিলতার কথা বলা হয়েছে। শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ে আইনি জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। খেলাপি গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ না করার জন্য বিভিন্ন আইনি ফাঁকফোকর বের করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খেলাপি গ্রাহকরা শ্রেণীকরণ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে শ্রেণীকরণের ওপর স্থগিতাদেশ নিচ্ছেন। এ সুবাদে তারা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন।
কারণ একজন ঋণখেলাপি অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন না। এমনকি জাতীয় কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে আইনগত বাধা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো প্রকৃতপক্ষে একজন ঋণখেলাপিকেই গ্রাহক হিসেবে গ্রহণ করছে। ওই গ্রাহক আবার খেলাপি হয়ে আবার আদালতে মামলা করছেন। এভাবে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে তারা আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন। এটি মোকাবেলা করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর তহবিল সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিচ্ছে তা আদায় হচ্ছে না। আবার আমানত প্রবাহও কমে গেছে। এতে বেসরকারি ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ সংকট মেটাতে একদিকে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, অপরদিকে ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। এক বছর আগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৬৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। তিন মাস আগে এই ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা বা ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি মালিকানার দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৯৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তিন মাস আগে এই ব্যাংক দুটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা বা ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬০৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অন্যদিকে ডিসেম্বর শেষে বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩০ হাজার ৬২২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বরে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এদিকে গত ডিসেম্বর শেষে আলোচিত ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা; যা এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
No comments