শ্রীলঙ্কা কেন মিয়ানমারের পথে? by মীযানুল করীম
‘সিন্ধুর
টিপ সিংহল দ্বীপ’ বলে গেছেন যিনি, সেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বর্তমান
শ্রীলঙ্কার সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ‘টিপ’-এর উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু
ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের পর এখন উগ্র ও সহিংস সাম্প্রদায়িকতা সেই ‘টিপ’কে কলঙ্কের
চিহ্নে পর্যবসিত করেছে। এ উপমহাদেশের পূর্ববর্তী মিয়ানমার আর দক্ষিণ
প্রান্তের লঙ্কাভূমিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলমান সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের
মধ্যে বিরাট মিল রয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকার এযাবৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ তথা
শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বারবার হামলা ও
হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে সে দেশের মুসলমানেরা নিজেদের আর নিরাপদ বোধ করতে
পারবেন বলে মনে হয় না। দৃশ্যত এটা বৌদ্ধ-মুসলিম বিরোধ হলেও এর পেছনে
জাতীয়তাবাদের নামে চরম বিদ্বেষ এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অগণতান্ত্রিক ও
অসহিষ্ণু মানসিকতা সক্রিয়। শ্রীলঙ্কার মোট ভূখণ্ডের পরিমাণ বাংলাদেশের
অর্ধেকেরও কম- ৬৫ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখের
মতো। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কা আমাদের মতো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন
থেকে মুক্ত হয়। দেশটির উত্তর ও পূর্ব প্রদেশে সংখ্যালঘু তামিলদের বসবাস।
জাফনা ও ত্রিঙ্কোমালি যথাক্রমে এ দু’টি প্রদেশের রাজধানী। ২০০৯ সালে
সমাপ্ত, সিকি শতাব্দীর গৃহযুদ্ধকালে তামিল গেরিলাদের দুর্ধর্ষ সংগঠন
এলটিটিইর সাথে সরকারি বাহিনীর অবিরাম সঙ্ঘাতের কারণে শ্রীলঙ্কার নাম
প্রতিদিন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উচ্চারিত হতো। গৃহযুদ্ধজনিত অপরিমেয় ক্ষতি
কাটিয়ে ওঠার প্রথম প্রয়াসের মাঝেই মুসলিমবিরোধী সহিংসতার ঘটনা শ্রীলঙ্কার
শুভাকাক্সক্ষীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এবার মার্চের প্রথম সপ্তাহে
বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনার জের ধরে গুজব ছড়িয়ে শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ
সম্প্রদায়ের লোকজন সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর চড়াও হয়। প্রশাসনের দৃশ্যত
নিরপেক্ষতা ও কঠোরতা সত্ত্বেও দাঙ্গাবাজ দুর্বৃত্তদের দমানো যাচ্ছে না। এর
একটা কারণ, জাতীয়তাবাদের নামে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা এবং আরেক কারণ, সমাজে
প্রভাবশালী শ্রেণী হিসেবে ভিক্ষুদের একাংশের ধর্মের নামে সন্ত্রাসে উসকানি।
‘অহিংসার পূজারী’দের এহেন সহিংস মনোভাব ও তৎপরতা দেখে বিশ্ববিবেক হতভম্ব।
লক্ষ করার বিষয়, ভারত ও মিয়ানমারের মতো শ্রীলঙ্কাতেও একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী
কথিত জাতীয়তাবাদকে তাদের বীভৎস সাম্প্রদায়িক চেহারা লুকানোর মুখোশ হিসেবে
ব্যবহারের ব্যর্থ চেষ্টা করছে। একই সাথে, এটা গণতন্ত্র, মানবতা, ন্যায়নীতি ও
সভ্যতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। Majority বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, ধর্ম, ভাষা,
বর্ণের মানুষ যখন Minority বা সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রতি Brute বা বর্বর হয়ে
ওঠে, তখন সেটা গণতন্ত্রের চেতনাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয়। অথচ এসব দেশের
সরকার ও নেতারা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য ও প্রগতির বুলি আওড়াতে পারঙ্গম।
এবারে শ্রীলঙ্কায় মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কেন্দ্র ছিল
সুপরিচিত কান্ডি শহর। দেশটির মধ্যাঞ্চল প্রদেশের রাজধানী এই কান্ডি। গত ৫
মার্চ থেকে চার দিন ধরে কান্ডিতে মুসলিমদের বাড়িঘর ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে
উগ্রপন্থীরা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ৯ মার্চ সারা দেশে জুমার জামাতের
সময় মসজিদের বাইরে সেনা ও পুলিশ পাহারা ছিল। তবে এ দিনেও বহু স্থানে
সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর হামলা চালায়। এবার সহিংসতায়
তিনজনের মৃত্যু ঘটেছে। হামলার প্রতিবাদে মুসলিম নাগরিকেরা তাদের দোকানপাট
খোলেননি। কান্ডির বেশির ভাগ মসজিদ ভস্মীভূত বা লণ্ডভণ্ড করায় মুসল্লিরা
খোলা জায়গায় জুমার নামাজ আদায় করেন। হামলার মূল উসকানিদাতাসহ ১৪০ জন আটক
হওয়ার খবর জানানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সাথে আমাদের বাংলাদেশের নানা দিক দিয়ে
সম্পর্ক বিদ্যমান অনেক আগে থেকেই। শুধু আজকের ক্রিকেট টুর্নামেন্টই নয়,
উপমহাদেশের ভৌগোলিক সংলগ্নতা তো আছেই। কথিত আছে, অতীতে বাঙালি রাজকুমার
বিজয় সিংহ সে দেশ জয় করে সেখানকার রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তার নামেই
দেশটির নাম হলো ‘সিংহল।’
ডাচ্, ওলন্দাজ ও ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল পেয়ারা
আকৃতির সিংহল। ইংরেজিতে বলা হতো Ceylon. সিলোন টি স্বাদে-গন্ধে বিশ্বখ্যাত।
সম্ভবত আশির দশকে সে দেশের নতুন নাম হয় ‘শ্রীলঙ্কা’। রামায়ণের রাক্ষসরাজ
রাবণের লঙ্কাপুরীই বর্তমান শ্রীলঙ্কা। ইসলামধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন,
বেহেশত থেকে আদিপিতা হজরত আদম আ: ও বিবি হাওয়া আ:কে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন। আদম আ: সরন্দ্বীপ (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) আর হাওয়া আবিসিনিয়ায়
(বর্তমান ইথিওপিয়া) প্রেরিত হন। তারা পরস্পরের সাক্ষাৎ পান আরবের জেদ্দায়।
আজো শ্রীলঙ্কায় রয়েছে Adam's Peak বা আদমশৃঙ্গ। এটা মুসলিম, বৌদ্ধ ও
হিন্দু- তিন সম্প্রদায়ের কাছেই পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে নাকি আদম আ:-এর
দীর্ঘ কদম মোবারক, অর্থাৎ পায়ের ছাপ সংরক্ষিত রয়েছে। প্রতিদিন বহু মানুষ
অনেক সিঁড়ি ভেঙে পাহাড় শীর্ষের এই তীর্থদর্শনে আসেন।শ্রীলঙ্কার ৭০ শতাংশের
মতো বৌদ্ধ, যারা সিনহালা বা সিংহলী ভাষায় কথা বলেন। ১৫ শতাংশের মতো হিন্দু,
যাদের ভাষা তামিল। ১০ শতাংশ মুসলিম যারা তামিলভাষী হলেও ভাষাগত পরিচয়
‘তামিল’-এর বদলে তারা ধর্মীয় পরিচয় ‘মুসলমান’ হিসেবে পরিচিত। জনসংখ্যার
বাকিরা খ্রিষ্টান। অতীতে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও
ব্রিটেনের উপনিবেশবাদীদের অধীনে থাকায় শ্রীলঙ্কায় আজো মানুষের নামকরণসহ
সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্রিষ্টানদের প্রভাব রয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার
নিকটতম ভারতীয় রাজ্য বা প্রদেশ হলো তামিলনাড়ু। ২৬ বছরব্যাপী (১৯৮৩-২০০৯)
রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পাদপীঠ যে উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ, এটা ভারতের
তামিলনাড়ুর কাছেই। এ দুই দেশের মাঝে পক প্রণালী এবং এর মধ্যে কয়েকটি
ক্ষুদ্র দ্বীপ প্রায় সারি বেঁধে অবস্থিত। দেখে মনে হবে, এক দেশ থেকে আরেক
দেশে যাওয়ার জন্য অতীতে অতিকায় কোনো মানব এগুলোর ওপর পা ফেলে জলভাগ অতিক্রম
করেছেন। এটাকে Adam's Bridge (আদমের সেতু) বলা হয়ে থাকে। ভারত ও
শ্রীলঙ্কার তামিলরা একই জনগোষ্ঠীর লোক। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে ভারতের
পাঠানো সৈন্যরা শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের দমনে কলম্বো সরকারকে সহায়তা
করেছিল। এতে যে ভারতীয় তামিলরাও সাঙ্ঘাতিক ক্ষুব্ধ হয়েছিল, তামিলনাড়ু
প্রদেশে এক জনসভায় আত্মঘাতীা হামলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর
মৃত্যু তারই প্রমাণ। শ্রীলঙ্কার মুসলমানেরা শত শত বছর আগে থেকেই সে দেশের
বাসিন্দা। তাদের মধ্যে শিক্ষিত ও বিত্তবান মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু
তারা বিভিন্ন সময় বৈষম্য, সন্ত্রাস ও অপপ্রচারের শিকার এবং বারবার
নিরাপত্তাহীনতা তাদের গ্রাস করার উপক্রম হয়। ‘শ্রীলঙ্কান মুসলিম কংগ্রেস’
একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠন। নিকট অতীতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী
হিসেবে এ সি এস হামিদ (শাহুল হামিদ) ছিলেন বিশ্বে সুপরিচিত। ১৯৬৯-৭০ সালের
দিকে তদানীন্তন পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার ছিলেন বুদ্ধিজীবীতুল্য
ব্যক্তিত্ব স্যার রাজেক ফরিদ। এই কবি মানুষটির নাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান
বা বর্তমান বাংলাদেশেও পরিচিত ছিল। বাংলাদেশ আমলে ঢাকার আবাহনী ক্লাবে
ফুটবল খেলেছেন শ্রীলঙ্কার পাকির আলী। ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় কোনো
কোনো বছর শ্রীলঙ্কার মুসলিম ব্যবসায়ীদের স্টল চোখে পড়ে। এখন নিদাহাস
ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হচ্ছে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে। এতে বাংলাদেশও
অংশ নিচ্ছে। কে এই প্রেমাদাসা? তিনি হলেন শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট
রানাসিংহে প্রেমাদাসা। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন মৃত্যুর কিছু দিন
আগে। সরল মানুষটির সাদাসিধে জীবন যাপন ছিল লক্ষণীয়। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায়
সফরে এসে উঠেছিলেন হোটেল শেরাটনে। হঠাৎ এক ফাঁকে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল এড়িয়ে
তিনি বেরিয়ে পড়েন রাজপথে। দেখা গেল, রাস্তায় মুচিকে দিয়ে জুতা সেলাই
করাচ্ছেন সাধারণ মানুষের মতো। ঘটনাটি মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল। কলম্বোতে মে
দিবসের র্যালিতে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দেয়ার সময় প্রকাশ্যে ঘাতকের
গুলিতে তিনি নিহত হয়েছিলেন। প্রেমাদাসার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান
বিটিভিতে (তখন এ দেশে এটাই একমাত্র টিভি চ্যানেল) সরাসরি প্রচার করা
হয়েছিল। সেখানে বৌদ্ধভিক্ষু ত্রিপিটক থেকে, হিন্দু পুরোহিত গীতা থেকে এবং
মুসলিম আলেম কুরআন শরীফ থেকে পাঠ করেছেন। শ্রীলঙ্কার হিন্দু ও মুসলিমের
ভাষাগত অভিন্নতা সে অনুষ্ঠানেও ছিল লক্ষ করার বিষয়। আজ যারা মুসলিম নিধন,
বিতাড়ন কিংবা নির্যাতনে উন্মত্ত, তারা কি সে অনুষ্ঠানের কথা জানে না?
প্রেমাদাসার মতো, মানুষের জন্য প্রেমপ্রীতি যদি ভিক্ষুদেরও না থাকে, তারা
কিভাবে নিজেদের দাবি করবেন মহামতি বুদ্ধের অহিংস বাণীর অনুসারী হিসেবে?
লঙ্কান মুসলমানেরা সে দেশের শুধু বৈধ বাসিন্দা ও পূর্ণ নাগরিকই নন, তারা
বারবার চরম ত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রমাণ রেখেছেন দেশপ্রেমের। স্বদেশের অখণ্ডতা
ও সার্বভৌমত্বের জন্য; শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি ও শান্তির জন্য
তাদের প্রয়াস ও দায়িত্ববোধ অন্যদের চেয়ে বিন্দুমাত্রও কম নয়। গৃহযুদ্ধের
সময় তারা দেশের অখণ্ডতা ও জাতির সংহতির প্রশ্নে যথাযথ ভূমিকা রাখায় একই
ভাষী তামিল বিদ্রোহীদের টার্গেট হয়েছেন। অপর দিকে, সরকার তাদের ব্যবহার
করতে চেয়েছে নিজের স্বার্থে। এ অবস্থায় উভয় পক্ষের হাতে মুসলমানেরা চরম
দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের অনেককে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এখন
সবিশেষ উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের হেতু হলো, মিয়ানমারের উগ্রভিক্ষুদের
মুসলিমবিদ্বেষের সাথে শ্রীলঙ্কার উগ্রভিক্ষুদের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির
মিল তো আছেই; তদুপরি, এ দুয়ের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে
পরস্পরকে মদদদানের খবরও এসেছে। মিয়ানমারে যেমন ধর্মান্ধ বৌদ্ধদের সংগঠন
‘মা বা থা’, তেমনি শ্রীলঙ্কায় ‘বুদুবালা’ নামে কট্টর বৌদ্ধরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে
নেমেছে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে। মুসলিমবিরোধী প্রপাগান্ডা ও দাঙ্গা
শ্রীলঙ্কার জাতিগত সঙ্কট বাড়িয়ে দেবে এবং জাতীয় সংহতিকে করবে আরো দুর্বল।
এমনিতেই গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৯ বছর পার হলেও জাতির মাঝে অনাস্থা ও বিভাজন
দূর হয়নি। তামিল জনগোষ্ঠী আজো নিজেদের বঞ্চিত মনে করছে। অপর দিকে,
শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ অধ্যুষিত সরকার মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের দায়ে
আন্তর্জাতিকভাবে অভিযুক্ত। স্মর্তব্য, গৌতম বুদ্ধের কথিত অনুসারী, গেরুয়া
বসনধারী কিছু ভিক্ষু আজ যেমন তাদের ধর্মের গায়ে কালিমা লেপন করছে, তেমনি
১৯৫৯ সালে তাদেরই ্একজন শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত নেতা ও প্রধানমন্ত্রী সলোমন
বন্দর নায়েককে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে দেশটিকে কলঙ্কিত করেছিল। সলোমনের
স্ত্রী শ্রীমাভো এবং তার পর, কন্যা চন্দ্রিকা দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
ছিলেন অনেক বছর। এখন চন্দ্রিকার ছেলে অনূঢ়া রাজনীতিতে সক্রিয়। শ্রীলঙ্কায়
সর্বশেষ মুসলিমবিরোধী সহিংসতার কেন্দ্রস্থল হলো প্রাচীন নগরী কান্ডি।
ক্রিকেট টেস্টের সুবাদেও শহরটির নাম বিশ্বে সুপরিচিত। কান্ডিতে অতীতেও
মুসলমান সংখ্যালঘুরা হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আশির দশকের প্রথম দিকে
একবার মসজিদে হামলাসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের ন্যক্কারজনক ঘটনা
ঘটেছিল। তখন সেখানকার এক মুসলিম যুবকের সাথে আমার কথা হয়েছিল চট্টগ্রামে।
তিনি ব্যবসায়ী এবং ভালো ইংরেজি জানেন। মুসলিমবিরোধী সেই সহিংসতা প্রসঙ্গে
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার কথা শুনে মনে হলো, তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন
সম্ভাব্য ‘ঝামেলা’ থেকে বাঁচার জন্য। হয়তো জেনেশুনেও তিনি এমন স্পর্শকাতর
বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি ‘আবার না জানি, কোন বিপদ পড়ি’- এ কথা ভেবে। আসলে
সংখ্যালঘুরা বারবার হয়রানি, হামলা বা হুমকির শিকার হলে এবং তা সত্ত্বেও
প্রশাসন তাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা না দিলে এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়
তাদের মাঝে। তখন তারা সাহস বা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং বাস্তবতাকে
এড়িয়ে যেতে চান। নব্বইয়ের দশকে সার্ক দেশগুলোতে পরিবেশ রক্ষায় বেসরকারি
সংস্থার ভূমিকার ওপর কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলাম। তখন শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক
মানেল তাম্পি (মহিলা) এবং মোহন সমরসেকারার সাথে আলাপ হয়েছে। সিলেনি ডেইলি
নিউজ নামের ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক মোহনকে সে দেশের মুসলমানদের অবস্থা
সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের
অনেকেই ব্যবসায়ী ও বিত্তবান।’ তার এই খণ্ডিত জবাব থেকে প্রকৃত পরিস্থিতি
বোঝা যায় না। একই সাথে তিনি উগ্রসিংহলি জাতীয়তাবাদীদের সশস্ত্র তৎপরতার
কথাও বলেছিলেন।
No comments