মিতুল-বিন্তির 'অক্সিজেন ফ্যাক্টরি' by সাদ্দিফ অভি
ইট-কাঠের
নগরে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়াটাই যেন দায়। তার উপর বাড়ছে বিশ্ব
তাপমাত্রা। এই ধরনের নানারকম পরিবেশগত সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় বের
করেছেন এক দম্পতি।
মিতুল-বিন্তির অক্সিজেন ফ্যাক্টরি |
এক সময় থিয়েটারে কাজ করতেন মিতুল, ঢাকা
কলেজ থেকে ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বর্তমানে তার নিজের একটি
প্রোডাকশন হাউস আছে, নাম ‘ফিল্ম শপ ’। ২০০৮ সালে মিতুলের সঙ্গে ঘর বাধেন
বিন্তি। দু’জন মিলেই এখন প্রোডাকশন হাউসটি চালান। নতুন সংসারে গুছিয়ে উঠতে
সময় লেগেছে অনেকদিন। কিন্তু এর মধ্যেও করে ফেলেছিলেন নিজস্ব একটি ছাদের
ব্যবস্থা।
রাজধানীর কল্যাণপুর প্রধান সড়কের
ওভারব্রিজ পার হয়ে কিছুদূর গেলে দেখা যায় কৃষ্ণচূড়া এপার্টমেন্ট। এর ৮ তলায়
৪টি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের সঙ্গেই কিছু খোলা জায়গা
রয়েছে। তার মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে একটি ফ্ল্যাট পেয়ে যান এই দম্পতি। ফ্ল্যাটে
ওঠার আগে নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নেন সেই জায়গা। খোলা জায়গায় বাগান করার
সাধ জাগে এই দম্পতির। কিন্তু বাগান কেন?
মিতুল যখন টেলিভিশনে কাজ করতেন তখন
বাগান নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের কাজ শুরু হয়। বিন্তি তখন একজন সহকারী নিয়ে
ঢাকার কয়েকটি এলাকা ঘুরে ঘুরে বাসায় বাগান করে এমন সৌখিন মানুষ খুঁজে
বেড়িয়েছিলেন। সেই মানুষদের নিয়ে ১৩ পর্বের একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
প্রচারিত হয়েছিল তখন। এরপর থেকেই বাগানের নেশায় বুঁদ হলেন তারা।
বিন্তির আগে থেকেই ইন্টেরিওরের কাজ
কিছুটা জানা ছিল। সেই শেখাকে কাজে লাগালেন নিজের ঘর সাজাতে। এই সাজানোর
পেছনে অর্থ ব্যয় করেছেন খুব কম, কিন্তু সাজিয়েছেন পুরোটাই মনের মত করে।
ছাদকে পরিয়েছেন সবুজ অলংকার। মিতুল-বিন্তির নিজস্ব সেই জগতে প্রবেশ করলে
মনে প্রশ্ন আসে এ আবার কোন দুনিয়া?
বাসার ছাদে ঘাসের চাদর! এই শহরে নরম
ঘাসে পা ফেলে হাঁটা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তাই নিজের মতো করে ছোট্ট একটি
জায়গায় ঘাসের ব্যবস্থা করেছেন এই দম্পতি। শুধু ঘাস নয়, আছে বাহারি ফুল-ফলসহ
নানা জাতের ঔষধি গাছ। পুরো খোলা জায়গাটার মেঝে টাইলসের তৈরি। ছিমছাম
পরিষ্কার জায়গা। খুব যত্নে থাকে জায়গাটি, সেখানে আছে বসার ব্যবস্থাও।
এই দম্পতি তাদের জায়গার নাম রেখেছেন
‘অক্সিজেন ফ্যাক্টরি’। ভোর হলে পাখির কিচিরমিচিরে ভরে যায় তাদের আবাস। এ
শহরে পাখিদের কোলাহলে কজনেরই বা ঘুম ভাঙ্গে? পাখিদেরও তো বাঁচার জন্য
প্রয়োজন অক্সিজেন।
একশ’রও বেশি গাছ লাগিয়েছেন তারা। ঔষধি,
সবজি, মসলা, ফল কিংবা ফুল সবই আছে এখানে। ঔষধির মধ্যে আছে থানকুনি, তুলসী, ৩
রকমের পুদিনা, এলোভেরাসহ অনেক কিছু। ফলের মধ্যে রয়েছে দুই রকমের আম, তিন
রকমের পেয়ারা, মালবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, থাই জামরুল, মালটা, লেবুসহ আরও অনেক
ধরনের ফল গাছ। মসলার মধ্যে রয়েছে অরিগানো, দারুচিনি, কারিপাতা, তেজপাতা,
চুই এবং পোলাও পাতা। সবজির মধ্যে আছে ফুলকপি, চেরি টমেটো, স্কোয়াস, চায়না
ক্যাবেজ, চায়না সুপারলিফ, চায়না লেটুস, বিভিন্ন ধরনের শাক, গাজরসহ আরও অনেক
সবজি।
এ রকম উদ্যোগের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ
জানান বিন্তি। তিনি বলেন, ‘আমরা স্ট্রেস রিলিফের জন্য কিংবা রিফ্রেশমেন্টের
জন্য অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনই মনে করি না। বাসার ছাদের এই বাগান
স্ট্রেস অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। এছাড়া এখান থেকে অক্সিজেন তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে
আশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেখাদেখি আশেপাশের বাড়িতেও বাগান হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ছোট পরিবারের জন্য
পর্যাপ্ত তাজা সবজির যোগান আসে এখান থেকে। বাচ্চাদের মানসিক বিকাশেও বড়
ভূমিকা রাখে এ ধরনের বাগান। এর পাশপাশি বাগানে কাজ করাও এক ধরনের শারীরিক
ব্যায়াম বলা যায়। মোট কথা ক্রিয়েটিভিটির সবচেয়ে বড় জায়গা হলো বাগান।
বাগান সম্পর্কে জানতে ৬-৭ মাস আগে সবুজ
বাগান সোসাইটি নামক একটি অনলাইন গ্রুপে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেই গ্রুপের
প্রথম বর্ষপূর্তিতে সেরা পাঁচজন বাগানিকে দেয়া হয় পুরস্কার। তার মধ্যে
বিন্তি একজন। ট্র্যাডিশনাল বাগানের পাশাপাশি এখন তার চিন্তা ফেলে দেওয়া
জিনিসের পুনঃব্যবহার নিয়ে। সেজন্যই তিনি বিভিন্ন পরীক্ষামূলক কাজও করছেন।
এই কাজের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের মগে ফুল গাছ, বাথটাবের মধ্যে পানি জমিয়ে
তাতে শাপলা এবং পদ্ম জাতীয় ফুল ফোটানো। এতে সাফল্যও পেয়েছেন। মন চাইলেই এই
দম্পতি বন্ধুদের নিয়ে নির্মল আড্ডায় মেতে ওঠেন তাদের এই অক্সিজেন
ফ্যাক্টরিতে। বন্ধুরাও অন্য জায়গার চাইতে এখানেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
No comments