নতুন মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ভূমিকার অবসান? by আলী রীয়াজ
যেকোনো
সমাজে শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্তকে বিবেচনা করা হয় একাদিক্রমে বিত্তের
হিসাবে এবং সমাজে ওই শ্রেণির ভূমিকা দিয়ে। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে কেবল
বিত্তই শ্রেণিবিচারের মাপকাঠি হতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, মধ্যবিত্ত হচ্ছে
তারাই, যারা কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা তাদের অন্য শ্রেণিগুলো
থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন,
বিশেষত সেবা খাতের বিকাশ, বিশ্বায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং রাষ্ট্রের
প্রত্যক্ষ পরিপোষণের মধ্য দিয়ে যে নতুন মধ্যবিত্ত তৈরি হয়েছে, তাদের
বৈশিষ্ট্যগুলো কী? তাদের সঙ্গে পুরোনো মধ্যবিত্তের পার্থক্য কী? নতুন ও
পুরোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যকার একটি বড় পার্থক্য মানস গঠনের। একে আমরা
‘সাংস্কৃতিক পুঁজির’ ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি। আমি এই ধারণা ধার
করেছি ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বর্দোর কাছ থেকে। তাঁর বক্তব্যের সারাংশ
করলে দাঁড়ায় এই রকম-সাংস্কৃতিক পুঁজি অর্জিত হয় জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে।
ব্যক্তির জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাই ব্যক্তির রুচি, অভ্যাস, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি
নির্মাণ করে দেয়। আমি তাঁর বক্তব্য আরও সম্প্রসারিত করে বলতে চাই, এটা
কেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়, একটি শ্রেণির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
একটি শ্রেণি কীভাবে গড়ে উঠেছে, কীভাবে বিকশিত হয়েছে, সেটা ওই শ্রেণির
সদস্যদের বিশ্ববীক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয় বলে আমি
মনে করি। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশের
মধ্যবিত্তবিষয়ক আলোচনায় এই সাংস্কৃতিক পুঁজির দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ
করেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনের বাইরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য
চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে যে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় তা হচ্ছে, ‘মানব,
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পুঁজি’। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলাতে শুরু করেছে ১৯৮০-র দশকে, যখন ব্যাপকভাবে
মধ্যবিত্তের একাংশের উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসন এবং একটি ছোট অংশের রাজনৈতিক ও
অর্থনৈতিক সুযোগ ব্যবহার করে উঁচু শ্রেণিতে উঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর ফলে
একটা শূন্যতার সূচনা হয়। সেই জায়গাতে আসে গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ, যাদের
মানসম্পন্ন শিক্ষার এবং রুচিগত পরিশীলনের (সফিস্টিকেশন) অভাব আছে। তারা
অবশিষ্ট পুরোনো মধ্যবিত্তদের ‘নিমজ্জিত’ করে ফেলে। তিনি বলেন, ‘এখনো শিক্ষা
(ডিগ্রির বিবেচনায়) ও পেশার (মূলত ব্যবসা) গুরুত্ব আছে, কিন্তু সেগুলো আর
নির্ণায়ক বিষয় নয়। আয় ও সম্পদ, যা সম্প্রতি অর্জিত হয়েছে, তা-ই এই বিকাশমান
মধ্যবিত্তের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব লাভ করে এবং সেগুলো পুরোনো মূল্যবোধ
ও সেক্যুলার সংস্কৃতির জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছে।’ ইসলামের এই পর্যবেক্ষণের
সঙ্গে আমি এখানে একমত যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা এখন আরও সুস্পষ্টভাবে দেখতে
পাচ্ছি, কিন্তু আমার ভিন্নমত হচ্ছে সময়ের বিবেচনা। আমি অনুমান করি, এই
পরিবর্তন হয়েছে ১৯৯০-এর দশকের পরে। এই বিষয়ে সেলিম জাহানের প্রস্তাবিত
মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিভাজন আমাদের মনোযোগ দাবি করে। সেলিম জাহান ২০১১ সালে
ইউএনডিপির একটি প্রকাশনায় বেশ কয়েকটি দেশে অর্থনীতিক উন্নয়নে মধ্যবিত্তের
ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বাংলাদেশ সেই গবেষণার বিষয় ছিল না। তবে তাঁর
বক্তব্য বাংলাদেশকে বোঝার জন্য সাহায্য করে। সেলিম জাহান বলেছেন, গত কয়েক
দশকে বিশ্বায়ন ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মধ্যবিত্ত
শ্রেণির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ফলে
ঐতিহ্যগতভাবে যে শ্রেণিকে আমরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলে জানতাম, তাদের মধ্যে
একটা বিভাজন তৈরি হয়েছে। এর এক অংশকে সেলিম জাহান বলছেন ‘সামাজিক মধ্যবিত্ত
শ্রেণি’, অন্যটিকে বলছেন ‘অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি’। উন্নয়নশীল
দেশগুলোতে ঐতিহ্যগতভাবে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল, তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে
‘সাধারণ জীবনযাপন, উঁচু মানের চিন্তাভাবনা’ (‘সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই
থিংকিং’)। এই শ্রেণি কিছু আচারপদ্ধতি ও মূল্যবোধ ধারণ করে। সমাজের
ক্রান্তিকালে এই সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়ে
এসেছে এবং সমাজের অন্য শ্রেণি, বিশেষত দরিদ্র শ্রেণি তাদের ওপর আস্থা
রেখেছে। বিপরীতক্রমে যে নতুন ‘অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি’র বিকাশ ঘটেছে,
তারা প্রধানত বয়সে তরুণ, উচ্চশিক্ষিত ও পেশাজীবী। কিন্তু সামাজিক মধ্যবিত্ত
শ্রেণি যেসব মূল্যবোধ ও আচারকে গুরুত্ব দিত, এরা তাকে একইভাবে গুরুত্ব দেয়
না। ‘তারা অর্থের দ্বারা চালিত এবং ব্যবসা ও ভোগবাদ তাদের মননের অংশ’।
তিনি বলছেন যে এদের ‘নতুন ধনিক’ বলে অভিহিত করা হয়। সেলিম জাহানের এই
পর্যবেক্ষণের জন্য যেসব দেশকে ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে এই নতুন শ্রেণির
মধ্যবিত্তরা তরুণ ও প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, বাংলাদেশের
ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এই নতুন শ্রেণির
‘সাংস্কৃতিক পুঁজি’, যা প্রথাসিদ্ধ মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক পুঁজির চেয়ে
ভিন্ন, তার ভেতরে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক (এবং অর্থনৈতিক) ব্যবস্থার
অনুপস্থিতির কারণেই কি আমরা গণতন্ত্রের বিষয়ে তাদের অনাগ্রহ লক্ষ করছি?
তাহলে কি বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার সংকট স্থায়ী রূপ
নিতে যাচ্ছে? একই সঙ্গে তারা যে সমাজে ধর্মের ভূমিকার প্রশ্নে মধ্যবিত্তের
আগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন অবস্থা নিচ্ছে, সেটা কি একই কারণে? এই শ্রেণির
সদস্যরা ধর্মকে ব্যক্তির আদর্শের চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শিক নির্দেশক
হিসেবে দেখতে চান, নাকি কেবল ধর্মের ব্যাপারে দৃশ্যমানতার মাধ্যমে তাঁদের
অন্যান্য আচরণকে বৈধতা দিতে চান? বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক বড় অংশের
মধ্যে জনসমক্ষে ধর্মাচরণের প্রচারের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও ধর্মের
মধ্যকার বিভাজন বিষয়ে কী ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে? বাংলাদেশের সমাজে
সেক্যুলারাইজেশনের প্রক্রিয়া কখনোই শক্তিশালী ছিল না, কিন্তু সমন্বয়বাদী
ইসলামের যে ধারাটি প্রধান ধারা বলে বিবেচিত হতো, মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক বড়
অংশই যদি আর সেই ধারা বহন না করে, তবে ভবিষ্যৎ পথরেখা কী? বাংলাদেশে কি
মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক ভূমিকার অবসানের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে? বাংলাদেশের
রাজনীতিতে গত কয়েক দশকে ধর্মের প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়েই উপস্থিত
হয়েছে, কিন্তু এই বিষয়ে বিতর্কমূলক আলোচনার বাইরে ধর্ম ও রাজনীতি, ধর্ম ও
সমাজ এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ে ভূয়োদর্শনলব্ধ আলোচনা খুব
সীমিত। পূর্বধারণার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির
দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। বাংলাদেশের বিরাজমান
পরিস্থিতি এসব বিষয়ে আলোচনা দাবি করে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments