মানুষ কি আরো এক শ’ বছর পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে? by মুহাম্মদ ইউনূস
পৃথিবীতে
পারমাণবিক অস্ত্র বহু বছর ধরেই বিদ্যমান, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এ অস্ত্র
নিয়ে যে হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে তা মানুষের মনে প্রবল শঙ্কা তৈরি করছে। কোনো
কোনো রাষ্ট্রপ্রধানরা পরস্পরের উদ্দেশে তাদের নিজ নিজ পারমাণবিক ক্ষমতা
নিয়ে এমনভাবে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছেন যা ঝগড়ারত দুই বালকের মধ্যে কার খেলনা
কত বড় ও কত বাহারী তা নিয়ে বড়াই করার মতো শোনাচ্ছে। এই ‘খেলনা’গুলো সচল
করা হলে তা কোটি কোটি মানুষের জীবনে কী ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে তা নিয়ে
তাদের কোনো দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর আকাশে কালো মেঘের যে
ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে তাতে এই দু’টি দেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোই শুধু নয়,
সমগ্র পৃথিবীই ভীষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়েছে। গত কয়েক শত বছরে বিভিন্ন
জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হয়েছে তা পৃথিবীর জাতিগুলোকে
একতাবদ্ধ হবার এবং পারস্পরিক ভীতি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠান তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংগঠনগুলো শত শত
বছরের বৈরিতা, সঙ্ঘাত ও হত্যাযজ্ঞ ভুলে জাতিগুলোকে শান্তির পথে আসার পথ
প্রশস্ত করেছে। কিন্তু হঠাৎ করে ব্রেক্সিটের মতো ঘটনা আচমকা সবাইকে হকচকিত
করে তুলেছে। ইউরোপের অনেকগুলো জাতির ঐক্যের মহান পদযাত্রা থেকে একটি জাতির
আকস্মিক ছিটকে পড়ায় অন্যরা ভীষণভাবে মর্মাহত হয়েছে। এই প্রবণতা এখন আর
পৃথিবীর একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই- এটা ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। অন্য দেশগুলোর
জাতীয় নির্বাচনগুলোতেও বিচ্ছিন্নতার একই ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনো কোনো
দেশ থেকে আসা ঘোষণায় মনে হয় তারা যেন অন্য দেশগুলো থেকে নিজেকে আলাদা করতে
ইটের ও আইনের দেয়াল খাড়া করায় ব্যস্ত। একটি গ্লোবাল ভিলেজ তৈরির যে
সম্মিলিত স্বপ্ন বিশ্ববাসী দেখছে তা থেকে এই নেতিবাচক রাজনৈতিক ধারা একটি
বিশাল বিচ্যুতি। গণবিধ্বংসী অস্ত্র বিশেষ করে পরমাণু অস্ত্রের ওপর এর
তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ছে। আমি পরমাণু অস্ত্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই এবং শুধু একটি
মাত্র বোতাম টেপার মধ্য দিয়ে কতো হাজার নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড কার্যকর হবার
অপেক্ষায় আছে তা জানার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই। এগুলোর সংখ্যা কত তা কোনো
বিষয় নয়, কেননা এরা পৃথিবীকে বহুবার ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। আমার কাছে এটা
বড়ো ধরনের একটা মস্তিষ্ক বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। এটা কোনো রাজনৈতিক ইস্যু
নয়, এটা মানবীয় উন্মত্ততার এক প্রমত্ত বাড়াবাড়ি। কে কার চেয়ে বেশি উন্মত্ত
তা প্রদর্শনের একটা প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়েছে। আমাদের আচরণের অসঙ্গতি
সহজেই ধরা পড়ে যখন আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ়
প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করার পাশাপাশি একই সাথে আবার পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার
সমৃদ্ধ করার কাজেও জোরেশোরে লেগে পড়ি। আমরা এক দিকে একটা সুন্দর পৃথিবী
নির্মাণে আমাদের প্রতিশ্রুতির কথা বলছি, আবার একই সাথে পৃথিবীটা আদৌ টিকে
থাকবে কি না তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই; মনে হচ্ছে ‘শত্রু’কে
পরাজিত করাটাই শুধু আমাদের একমাত্র চিন্তা, তা সেটা করতে গিয়ে পুরো
পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিলাম কি না সেটা নিয়ে চিন্তা করা আমাদের বিষয় নয়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিষয়ে প্যারিস চুক্তিকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি এবং সময়
ফুরিয়ে যাবার আগেই এই চুক্তি বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। পৃথিবীকে
রক্ষা করতে বিশ্ববাসী যখন জেগে উঠেছে তখন কয়েকটি দেশ মুহূর্তেই সব কিছু
ধ্বংস করে দিতে সক্ষম এমন সব পরমাণু অস্ত্রের শক্তি ও মজুদ বাড়াতে
ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ শুরু করেছে। কোনো কোনো নেতা অবশ্য মানুষের এই আচরণের
মধ্যে কোনো স্ববিরোধিতা দেখছেন না। আমি এটাকেও একটা সীমাহীন মস্তিষ্কবিকৃতি
বলব। এই উন্মত্ততাকে আমরা কত দূর যেতে দেবো সেটাই এখন আমাদের কাছে
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গোটা পৃথিবীকে আমাদের বোঝাতে হবে যে, এই উন্মত্ততা
নিয়ে মানবসভ্যতা টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু এই উন্মত্ততা বেড়েই চলেছে- এর
থামার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এটা দু’দিক থেকে বাড়ছে। প্রথমত,
রাজনৈতিক দিক থেকে এটা পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তর্মুখী
চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। আমরা যখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাই তখন আমরা
আর সবাইকে শত্রু বলে ভাবতে শুরু করি। তখন আমরা ধ্বংসের ক্ষমতা দিয়ে এর
মোকাবেলা করতে চাই। এর দ্বিতীয় দিকটা অর্থনৈতিক। যেহেতু আমি দরিদ্র মানুষ
বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের নিয়ে কাজ করি, অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন
দারিদ্র্য সৃষ্টির কারণ কী বলে আমি মনে করি। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে,
দারিদ্র্য দরিদ্র মানুষদের দ্বারা সৃষ্ট হয়নি; আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
চার পাশে গড়ে তুলেছি দারিদ্র্য তারই সৃষ্টি। এই ব্যবস্থাটার সংস্কার করা না
গেলে দারিদ্র কখনোই দূর হবে না। সমস্যা দরিদ্র মানুষদের মধ্যে নয়- তারা আর
যেকারো মতোই উদ্যোগী ও সক্ষমতায় পরিপূর্ণ। সমস্যা অর্থনৈতিক কাঠামোর
মধ্যে। আমি এ প্রসঙ্গে বনসাই গাছের উদাহরণ দিই। আমরা যদি বনের সবচেয়ে
বড়গাছটির বীজটি নিই আর তা একটি ফুলের টবে রোপণ করি, আমরা একটি ছোট গাছ পাবো
যা বড়ো জোর দু’ থেকে তিন ফুট উঁচু হবে। এটা দেখতে বনের বড় গাছটার মতোই
সুন্দর হবে, তবে এটা হবে তার একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। কিন্তু এ গাছটা বেড়ে
উঠবে না কেনো? ব্যাখ্যাটা খুবই সোজা। দোষটা বীজের মধ্যে নয়, কেননা বীজ থেকে
অঙ্কুরিত গাছটা বেড়ে ওঠার পর্যাপ্ত মাটিটা কখনো পায়নি। দরিদ্র মানুষও
হচ্ছে বনসাই গাছের মতো। তাদের বীজের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই; সমাজ তাদেরকে
অন্যদের মতো বড় হবার কোনো পথই খোলা রাখেনি। আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে
তুলেছি সেটা এভাবেই দারিদ্র্যের জন্ম দিচ্ছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটার
উপযুক্ত সংস্কার করা গেলে দারিদ্র্য বলে আর কিছু থাকবে না। আমি বার বার
দেখানোর চেষ্টা করেছি আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে গলদটা কোথায় এবং এই
ব্যবস্থা আমাদের কী ক্ষতিটা করছে। এই ব্যবস্থা সমাজের অল্প থেকে অল্পতর
সংখ্যক মানুষের হাতে পৃথিবীর সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার একটা প্রক্রিয়ায় পরিণত
হয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থায় এর থেকে পরিত্রাণ পাবার কোনো উপায় নেই। এখন
আমাদের বলা হচ্ছে যে, পৃথিবীর মাত্র আটজন মানুষের হাতে পৃথিবীর নিচের দিকের
৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। মাত্র
আটজন মানুষের হাতে পৃথিবীর প্রায় ৪০০ কোটি মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ!
আমাদের আরো বলা হচ্ছে যে, সম্পদের এই কেন্দ্রীকরণ দিন দিন বেড়ে চলেছে।
আগামী বছর হয়তো আমরা শুনব যে, মাত্র দুইজন বা তিনজন মানুষের কাছে পৃথিবীর
নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে। সম্পদের
এই কেন্দ্রীকরণকে একটি বেড়ে ওঠা বিশাল মাশরুমের সাথে তুলনা করা যায় যার
মালিকানা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর সংখ্যক লোকের হাতে চলে যাচ্ছে। মাশরুমের
নিচে তার যে কাণ্ডটি রয়েছে তা প্রতিনিয়ত সরু থেকে সরুতর হচ্ছে। এই কাণ্ডটি
পৃথিবীর ৯৯.৯ শতাংশ মানুষের সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা কি এই অদ্ভুত
অবস্থাকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে মেনে নেবো, নাকি একে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার
একটা তামাশা বলে বাতিল করে দেবো? কিন্তু বাস্তবে আমরা এ প্রশ্নটি মোটেই
তুলছি না। এটাকেও আরেকটি মস্তিষ্ক বিকৃতি বলা ছাড়া উপায় থাকে না। যেহেতু
আমরা এই পাগলামির পরিবেশে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমরা কখনো এটা খেয়ালে
আনছি না। পৃথিবীর মাত্র আধা ডজন দেশের অল্প কয়েকজন ব্যক্তির হাতে
অর্থনৈতিক ক্ষমতার এই চরম একচেটিয়া অধিকারের মধ্যে আমরা যেমন কোনো দোষ
খুঁজে পাই না, তেমনি একই ভাবে পৃথিবীর আধা ডজন দেশের মাত্র আধা ডজন লোকের
হাতে পৃথিবীকে ধ্বংস করার এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মধ্যেও আমরা কোনো সমস্যা
দেখতে পাই না। অর্থনেতিক ব্যবস্থার এই উন্মত্ততার উৎপত্তি মানবচরিত্র
সম্বন্ধে আমাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত। পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় ধরেই নেয়া হয় যে, মানুষ সবসময় আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত, অন্য
কথায় মানুষ হচ্ছে একটা স্বার্থপর প্রাণী। মানুষ সম্পর্কে এই ব্যাখ্যা মেনে
নিতে আমার কষ্ট হয়। একজন মানুষ শুধু আত্মস্বার্থ দ্বারাই চালিত হয় না Ñএই
তত্ত্ব যেমনটা বলে; একজন মানুষ একই সাথে আত্মস্বার্থ ও পরার্থপরতা দুটোরই
সংমিশ্রণ। মানুষকে সবসময় শুধু স্বার্থপর বলে আখ্যায়িত করে তত্ত্ব আমাদেরকে
সেটাই বিশ্বাস করতে এবং সেভাবেই আচরণ করতে বাধ্য করছে। এর ফলে মানুষ এমন
আচরণ করছে যেন তারা জন্মলগ্ন থেকে চোখে ডলার চিহ্ন-আঁকা চশমা পরে আছে যা
দিয়ে তারা শুধু একটা জিনিসই দেখতে পায়, আর তা হচ্ছে টাকা। কিন্তু আমরা যদি
এই তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে মানুষকে স্বার্থপর ও পরার্থপর দু’ভাবেই
ব্যাখ্যা করি তাহলে পুরো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা
নেয়: এখন এখানে দু’ধরনের ব্যবসা পাওয়া যাবে -প্রচলিত মুনাফা সর্বোচ্চকারী
ব্যবসা যার পেছনে থাকবে আত্মস্বার্থ, আর একই সাথে মানুষের সমস্যা সমাধানে
পরার্থপরতাভিত্তিক আরেক ধরনের ব্যবসা। আমি একে বলছি ‘সামাজিক ব্যবসা’, যার
অস্তিত্ব আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক তত্ত্বে নেই। এই পরার্থপর ব্যবসায়ে
উদ্যোক্তার উদ্দেশ্য টাকা কামানো নয়; কোম্পানী লাভ করবে, কিন্তু লাভটা
কোম্পানীর ভেতরেই থেকে যাবে ব্যবসাটাকে বড় করার জন্য অথবা বিনিয়োগকারীর
টাকা ফেরত দেবার জন্য। স্বার্থপর ব্যবসায়ে আপনি অনেক লাভ করতে চান, কিন্তু
পরার্থপর ব্যবসায়ে আপনি নিজের লাভের কথা না ভেবে কিভাবে অন্যদের উপকার করা
যায় তাই নিয়ে ভাবেন। আমরা যদি সামাজিক ব্যবসার ধারণা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে
পারি তাহলে আমরা সবার জন্য একটি আরো উন্নত ও ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবী গড়ে
তুলতে পারব। মানবচরিত্র সম্বন্ধে প্রচলিত পুঁজিবাদী তত্ত্বের আরেকটি ভুল
ধারণা এই যে, মানুষকে অন্যের অধীনে চাকরি করেই জীবন কাটাতে হবে। তার জন্মই
হয়েছে অন্যের অধীনে কাজ করার জন্য। এই তত্ত্বে ধরে নেয়া হয় যে, মানুষের
জীবনে পরম পাওয়া হচ্ছে চাকরি পাওয়া। এটাই মানুষের মোক্ষ। এটাও মানবচরিত্র
সম্বন্ধে অত্যন্ত ভুল একটা ব্যাখ্যা। প্রতিটি মানুষই একটা স্বতন্ত্র সত্তা,
যে উদ্যোক্তা হতে চায়, এবং নিজে থেকে কিছু করতে চায়। ইতিহাসও তাই বলে।
উদ্যোক্তা হওয়াটা আমাদের ডিএনএ-র মধ্যে নিহিত। আমাদের উচিত আমাদের নতুন
প্রজন্মকে এই ধারণা দেয়া যে, তারা উদ্যোক্তা হবার জন্যই জন্মেছে। অন্তত
আমরা তাদেরকে একথা বলতে পারি যে, তাদের সামনে দুটো পথ খোলা আছে : তারা
চাকরি খুঁজতে পারে অথবা নিজেরাই চাকরি সৃষ্টি করতে পারে। এই দুটো বিকল্পের
মধ্যে তারা যেকোনো একটা বেছে নিতে পারে। কিন্তু আজ তাদের সামনে চাকরি ছাড়া
অন্য কোনো বিকল্প আছে একথা ভুলেও বলা হয় না। আমরা যদি এটা ধরে নিই যে,
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই উদ্যোক্তা হবার প্রতিভা রয়েছে, তাহলে আমাদের পুরো
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই সম্পূর্ণ বদলে যাবে। সম্পদ কেন্দ্রীকরণের গতিটা শ্লথ
হয়ে যাবে, এমনকি এটা উল্টেও যেতে পারে যদি বিপুলসংখ্যক তরুণরা উদ্যোক্তায়
পরিণত হয়। তারা আর ধনীকে আরো ধনী করার এবং সম্পদ কেন্দ্রীকরণে ভাড়া করা
সৈনিকে পরিণত হবে না। বরং তারা নিজেরাই সম্পদের মালিকে পরিণত হবে। তারা
অর্থনীতিতে সৃষ্টিশীল অংশীদার হয়ে যাবে। সম্পদ আরো ব্যাপক ও সুষমভাবে
বণ্টিত হবার কারণে রাজনীতিও পরিচ্ছন্ন হতে শুরু করবে। রাজনীতির গোড়াটাই
এমনভাবে বদলে যাবে যে, সবাই এতে কার্যকরভাবে অংশ নিতে পারবে। এখানে আরেকটা
গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে, আর তা হচ্ছে ‘আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স’। আমরা
জানতে পারছি যে, অদূরভবিষ্যতেই কারখানা, ব্যবসা ও অফিসগুলো চালাতে আর
মানুষের প্রয়োজন হবে না; বুদ্ধিমান যন্ত্রই এ কাজগুলো করবে। তাহলে মানুষের
সামনে আর কী-কাজ রইল? আমাদের বলা হচ্ছে যে, এই বুদ্ধিমান যন্ত্রের কারণে
পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষ বেকার হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য
বিশ্বব্যাপী সরকারি খরচে মৌলিক ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। এর ফলে মানুষ
স্বচ্ছন্দে বাঁচতে পারবে। আমাদের আরো বলা হচ্ছে যে, আগামী ২৫ বছরের মধ্যেই
আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বুদ্ধিমত্তায় মানুষের সমকক্ষতা অর্জন করবে। এমনও
হতে পারে যে এর পরবর্তী ২৫ বছরে তারা মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশি
বুদ্ধিমত্তা অর্জন করবে। সে সময়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তা হবে ইঁদুরের সমান-
এখন ইঁদুরের সাথে মানুষের বুদ্ধির তুলনায়। যখন বুদ্ধিমান যন্ত্ররা মানুষের
চেয়ে বহু গুণে বুদ্ধিমান হয়ে যাবে, তারা তখন ঠিক করবে এই গ্রহে মানুষের
কোনো প্রয়োজন আছে কি না; যদি থাকেও তাহলে সেটা কোন কাজে। যদি তারা মানুষের
জন্য কোনো কাজ খুঁজেও পায় সেটা নিশ্চিতভাবেই মানুষের জন্য সম্মানজনক কিছু
হবে না। সেই পৃথিবীতে আমরা যে ভূমিকা নিতে চাই সেটাই ঐ বুদ্ধিমান যন্ত্ররা
আমাদের জন্য রাখবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা খুব শিগগিরই বুঝতে পারবে
যে, এ পৃথিবীতে মানুষ এটা অপ্রয়োজনীয় বালাই ছাড়া আর কিছু নয়। এই ইস্যুতে
আমাদের নির্বুদ্ধিতাটা দেখুন! অতি-বুদ্ধিমান যন্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায়
আমরা এত বেশি মত্ত যে, আমরা ভুলেই গিয়েছি যে এ ধরনের প্রযুক্তি তৈরির
ক্ষেত্রে সার্বজনীন ও কঠোর গাইডলাইন থাকা উচিত, সদা জাগ্রত কোনো সরকারি
খবরদারি প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত। তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে যাতে কোনো
প্রযুক্তি পৃথিবী ও তার মানুষের জন্য শারীরিক, মানসিক, সামজিক ও
অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। এই সবগুলো উন্মত্ততার পেছনে আমি
একটি সাধারণ যোগসূত্র খুঁজে পাই, আর তা হচ্ছে লোভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা
আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি। এই সমস্যাটি চিরতরে দূর করতে হলে
আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে আমাদের সব
কর্মকাণ্ডের- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক- কেন্দ্রবিন্দু হবে পারস্পরিক
সহানুভূতির, অংশীদারিত্বের ও অন্যের প্রতি যত্নশীল হবার মানসিকতার ওপর গড়ে
ওঠা মানবিক মূল্যবোধ। আমরা যদি এটা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে এটা অসম্ভব নয় যে
আগামী এক শতকের মধ্যেই মানবজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
No comments